এনাজকে প্রথম দেখেছিলাম রায়হান ভাইয়ার রিসিপশনের দিন। রায়হান ভাইয়া আমার খালাতো ভাই তায়াং এর বন্ধু। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গিয়েছিলাম খালামণির বাড়ি বেড়াতে।ভাইয়া বাসায় ছিলো না। বন্ধুর বিয়ে কতশত কাজ তার। তাই আমাদের নিতে এনাজকে পাঠিয়েছিলো।তখনই এনাজের সাথে দেখা৷
কোলিং বেলের শব্দ পেতেই আমি ভেবেছিলাম তায়াং ভাইয়া এসেছে। দ্রুত পায়ে দরজা খুলতেই মাস্ক পরিহিত এক অচেনা পুরুষ নজর এলো। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
‘কাকে চাই?’
সে এক হাত দেয়ালে রেখে আরেক হাতে মোবাইল চাপছিলো। আমার কন্ঠস্বর পেয়ে চট করে আমার মুখপানে তাকালো। তার ঘন কুচকুচে কালো চোখের শান্ত দৃষ্টিতে আমার বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো।চাহনিটা এতো সুন্দর কেন?বুকে হাত না দিয়েও আমি টের পাচ্ছিলাম হৃৎপিণ্ডটা সমানতালে হাতুড়ি পেটা করছে। বুঝতে পারলাম না হঠাৎ হলো কি আমার! গত ৮ বছরের প্রতিজ্ঞাটা কি এবার ভাংতে বসবে নাকি? আমি বেহায়া হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।সে চোখ নামিয়ে মিনমিনে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘আন্টি আছে?’
‘জ্বি!’
‘একটু ডেকে দিবে?’
ভ্রু কুঁচকে গেলো।সাথে হৃৎপিন্ডের ধকধকানি কমে এলো। প্রথম দেখায় কাউকে তুমি বলে সম্বোধন করাটা আমার পছন্দ নয়। মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললাম না। পাশ সরে তাকে জায়গা করে দিয়ে বললাম,
‘ভেতরে এসে বসুন। আমি ডেকে দিচ্ছি।’
সে কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ পাশ কেটে ভেতরে এসে বসলো। আমি এক নজর তার দিকে তাকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম।এই অব্দি তাকে আর আমার দিকে তাকাতে দেখিনি।সে মাস্ক খুলে ফেলেছে। মাস্ক পরা অবস্থায় যতটা ভালো লেগেছে এখন ততটা ভালো লাগছে না।একেবারে যে খারাপ দেখতে তাও নয়। তবে একটা বিষয় খেয়াল করলাম উনি চেয়ারে বসে কেমন জানি হাসফাস করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে তা মুছে নিলো৷ আমি সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এনি প্রবলেম?’
‘না মানে হ্যাঁ! এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারবে?’
‘বসুন নিয়ে আসছি।’
ফ্যানের সুইচ টিপে ডাইনিং টেবিলের ওপর থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলাম। ধীরপায়ে তার সামনে দাঁড়ালাম। টি-টেবিলের ওপর পানির গ্লাস রাখলাম। উনি পকেট থেকে ইনহেলার বের করে মুখে পুরে নিলো। দুইবার টেনে খাপ লাগিয়ে পকেটে রেখে আমাকে বললো,
‘আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে।’
আমি এক দৃষ্টিতে কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।এরপর কোন কথা না বলে চুপচাপ খালামণিকে ডাকতে চলে গেলাম।
খালামণিকে ডেকে রুমে এসে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হতে না হতেই খালাতো বোন তন্বী চেচিয়ে উঠলো,
‘নোভাপু, রেডি হও না?’
‘আমি কোথায় যাবো?’
‘কোথায় যাবে মানে?ভাইয়ার কথা ভুলে গেছো?’
‘প্লিজ তন্বী জোর করিস না। আমার কোথাও যেতে ভালো লাগে না। ‘
‘এসব বললে চলবে না। তোমাকে যেতে হবে। আমাদেরকে নেওয়ার জন্য সেই কখন থেকে এনাজ ভাইয়া এসে বসে আছে। এখন তুমি যদি না যাও তাহলে তায়াং ভাইয়া ভয়ংকর রাগ করবে।’
বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এনাজ কে?’
‘ঐযে বসার রুমে যে ছেলেটা বসে আছে।’
‘ওহ!’
‘এই উঠো রেডি হও।’
‘আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না তন্বী।’
‘কেনোরে কি হয়েছে?’
খালামণি রুমে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলো। আমি মুখ শুকনো করে উত্তর দিলাম,
‘এমনি ভালো লাগে না।’
‘ঘুরে আয় ভালো লাগবেনি।’
খালামণিকে দেখে তন্বীর জোর বেড়ে গেলো। অভিযোগের সুরে বললো,
‘আম্মু, তুমি একটু বুঝাও আপুকে। আপু না গেলে কিন্তু আমিও যাবো না।’
তন্বী গাল ফুলিয়ে ধপ করে খাটে বসে পরলো। খালামণি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘জেদ করিস না। তৈরি হয়ে যা।’
‘বিনা দাওয়াতে আমি কি করে যাই? যার বিয়েতে সে তো তোমাদের দাওয়াত করেছে আমাকে নয়।’
‘ওহ এই ব্যাপার? এর জন্য যেতে চাচ্ছিস না তুই?’
আমি ঠোঁট উল্টে উত্তর দিলাম,
‘হুম!’
‘সকাল থেকে মাথা ধরেছে। শরীরটাও ভালো লাগছে না। তাই আমি যাবো না। আমার বদলে তুই যাবি।দুই বোন একসাথে গিয়ে খেয়েদেয়ে চলে আসবি। এতে সমস্যা কিসের?’
‘ঢেঢ় সমস্যা! তুমি বুঝবে না।’
তন্বী খালামণিকে বললো,
‘আম্মু তুমি তায়াং ভাইয়াকে বলো তো।’
‘আচ্ছা দেখছি। আমি তায়াং কে কল করছি।’
‘এই খালামণি না। তুমি ভাইয়াকে কল করবে না। আমি যাবো না।’
খালামণি আমার কথা শুনলো না। রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তন্বী দাঁত কেলিয়ে বললো,
‘আমিও এবার দেখবো তুমি না গিয়ে থাকো কি করে!’
হাতের সামনে থাকা বালিশ দিয়ে তন্বীকে একটা ধরাম করে বারি বসিয়ে দিলাম। তবুও ও হাসছে। ওর হাসি দেখে আমার মেজাজ চড়া হয়ে গেলো। আরেকটা বারি দিতে উদ্যত হলেই ও খিলখিলিয়ে হেসে জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেলো।
★
একজোড়া দাঁড়কাক সামনের প্রাচীরে বসে একঘেয়ে সুরে ডেকে চলছে।আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছিলাম। আজাইরা থাকলে যা হয় আরকি! তৎক্ষণাৎ মোবাইল হাতে খালামণির আগমন।
‘নে ধর কথা বল।’
‘কে?’
‘কথা বলে দেখ।’
‘আমি কথা বলবো না খালামণি। যত কিছু করো তোমরা আমি যাবো না।’
খালামণি চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘মোবাইল ধরতে বলেছি আমি।’
অগত্যা খালামণির চোখ রাঙানো দেখে আমার মোবাইল কানের কাছে ধরতেই হলো৷ মনে মনে আল্লাহর নাম জপছি। এখন ভাইয়া আমাকে ঢেঢ় বকা দিবে। বকা শোনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখুনি একজন প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলে উঠলো,
‘কি খবর ছোট বোন? কোন সমস্যা হয়েছে কি?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘নাহ তেমন কিছু না।’
‘তাহলে চুপচাপ এনাজের সাথে চলে এসো। কোন কথা শুনবো না। আমার বিয়েতে যদি তুমি না আসো তাহলে তোমার বিয়েতেও আমি যাবো না। বড় ভাই হিসেবে বলছি তোমাকে বিয়েতে আসতে হবে। আমি তায়াং এর কাছে শুনেছিলাম তুমি এসেছে। চারিদিকে এত কাজ যে নিজে গিয়ে বলতে পারিনি কিছু। তবে আমি তায়াং কে বলে দিয়েছিলাম তোমাকে নিয়ে আসতে। ছোট বোন যদি ভাইয়ের বিয়েতে না আসে তাহলে কি হয়? আমার বিশ্বাস ছোট বোন তার ভাইয়ের কথা রাখবে।অবশ্যই বৌ-ভাতে আসবে।আচ্ছা তাহলে রাখি। তাড়াতাড়ি চলে এসো।’
বেশ কিছু সময় অনুনয় করে যেতে বলে কল কেটে দিলো।বুঝলাম এটা রায়হান ভাইয়া ছিলো। নির্ঘাত আমার বিটলার ভাইয়ের বুদ্ধি এটা। মোক্ষম জায়গায় ঢিল মেরেছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে আমাকে যেতেই হলো।
মোটামুটি মেকআপ করে ডিপ ব্লু রংএর একটা থ্রি পিস পরে নিলাম। মাথায় সেম রং এর হিজাব।তন্বী খয়েরী রঙের একটা গাউন পরেছে। সাথে গোল্ডেন কালার হিজাব। লিপস্টিকটা আরেকটু গাঢ় করতে করতে খেয়াল হলো এনাজকেও এই রং এর পাঞ্জাবিতে দেখেছি। আপনাআপনি মুখটা হা হয়ে গেলো। আগে খেয়াল হলে কখনো একি কালারের ড্রেস পরতাম না। আমার অবচেতন মন হঠাৎ এই রং টাকে বেছে নিলো কেন? উত্তর পেলাম না। তার আগেই তন্বী তাড়া দিয়ে উঠলো।
‘নোভাপু হইছে তোমার? এনাজ ভাইয়া কখন থেকে বসে আছে। বেচারা এবার আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে যাবে।’
‘সব শেষ শুধু কাজলটা বাকি রয়েছে।’
‘নিয়ে নাও। গাড়িতে বসে দিও।’
আমাকে কাজল দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে তন্বী হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো৷ আমি এক হাতে তখনো কাজল ধরে রেখেছি। বসার রুমে যেতেই দেখি এনাজ চেয়ারে বসে এখনো মোবাইল গুতাচ্ছে।
‘এনাজ ভাইয়া চলো।’
‘তোদের তাহলে হয়েছে! আমি ভেবেছিলাম আজকে তোদের সাজগোজ শেষ হবে না।’
এনাজ দাঁড়িয়ে মোবাইল পকেটে পুরে কথাটা বললো। এক পলক আমাদের দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে নজর দিলো। তারপর চট জলদী আবার আমাদের দিকে তাকালো। পা থেকে মাথা অব্দি আমাকে স্ক্যান করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
‘কিছু একটা মিসিং লাগছে।’
তার কথা শুনে ইতিমধ্যে আমার কপাল কুঁচকে গেছে।তন্বী জিজ্ঞেস করলো,
‘কি?’
এনাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
‘কিছু না, চল।’
কেনো জানি আমি মনে মনে চাইছিলাম এনাজ আরেকবার তাকাক আমার দিকে। কিন্তু এনাজ তাকালো না। এতে মনঃক্ষুণ্ন হলে নিজের মনকে নিজেই শাসালাম। কয়েক মিনিটের দেখা ছেলেকে নিয়ে এতো ভাবছি কেনো আমি? আমার লজ্জা করা উচিত। হাত দুটো মুঠ করে চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্থির করে বললাম,
‘কুল নোভা কুল! তুই কিন্তু একটু বেশি ভাবছিস।’
হাফ ছেড়ে তন্বীর পিছু নিলাম৷ রাস্তায় এসে এনাজ একটা সিএনজি ডেকে নিলো। তন্বী আগে উঠে পরলো। এনাজ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে মৃদুস্বরে বললো,
‘কাজল ছাড়া নারী আর চুনকাম ছাড়া বাড়ি দুটোই একরকম।’
আমি চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাতেই সে সিএনজির সামনে চালকের পাশে বসে পরলো।কিসের সাথে কিসের তুলনা করলো?পাগল নাকি ছেলেটা?তবে তার কাহিনি দেখে আমি চোখ নামিয়ে মুচকি হেসে ফেলেছি। নিজেকে স্বাভাবিক করে সিএনজিতে বসতেই সিএনজি চালক আল্লাহর নাম নিয়ে তার বাহন চালু দিলেন।
#চলবে
#মনমোহিণী
#Part_01
#Writer_NOVA