#মনের_পিঞ্জরে
#Ariyana_Nur
#Part_15
নিস্তব্ধ রজনীতে ছাদের এক কোনে কফির মগ হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে সান।তার মাথায় ঘুড়ঘুড় করছে প্রয়সীর জন্য নানান চিন্তা।একটা নজর প্রয়সীকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে সে।অন্যের মাধ্যমে যতই প্রয়সীর খবর তার কাছে পৌচ্ছাক না কেন, নিজের চোখের দেখা আর অন্যের থেকে খবর নিয়ে নিজের অবাধ্য মনকে সান্ত করা কি এক?
আজ তিন দিন হয়ে গেছে সান ইশফাকে দেখে না।দেখবে কি ভাবে ইশফা তো তিনদিন ধরে ভার্সিটিতেই আসে না।সেদিনের পায়ের ব্যাথা থেকেই জ্বর এসেছে।জ্বর আর পায়ের ব্যাথা দুটো একসাথে কাবু করে বসেছে ইশফাকে।
সান আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের অবাধ্য মনকে নানান ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করল।কিন্তু কিছুতেই তার অবাধ্য মনকে বুঝাতে পারলো না।শেষে অবাধ্য মনের কাছে হার মেনে নিজেই নিজেকে প্রতিজ্ঞা করল,কাল যা কিছু হয়ে যাক না কেন,যেভাবেই হোক তার প্রয়সীকে সে এক পলক দেখবেই।
💦💦💦💦💦💦
হাতের মধ্যে ঔষধ নিয়ে তার দিকে কাদো কাদো ফেস করে তাকিয়ে রয়েছে ইশফা।ইশরা পাশে দাড়িয়ে হিজাব ঠিক করছে আর আড় চোখে ইশফার কান্ড দেখছে।
—ঢং করে ঔষধ এর দিকে তাকিয়ে না থেকে এবার ঔষধগুলো গিলে ফেল।তোর এই ঢং দেখে আমার বিরক্ত লাগছে।
ইশরা নিজের হিজাব ঠিক করতে করতে ইশফাকে কথাগুলো বলল।
ইশফা সামনের থেকে একটা কুশন ইশরাকে ছুড়ে মেরে তেজি গলায় বলল……
—বান্দরনী আমারে দেইখা তোর মনে হইতাছে আমি ঢং করতাছি?
ইশরা ভেঙচি কেটে বলল…..
—তয় কি করতাছো তুমি?ঔষধ হাতে নিয়ে মন্তর পরতাছো?
—সামনে আয় তুই তোর কানের নিচে দুইটা দিয়ে দেখাই আমি কি করতাছি।কতগুলো ঔষধ তার উপরে কত বড় বড়।এগুলো আমার গলা দিয়ে যে কেমনে ঢুকাই আমিই জানি।ছাতার মাথা ঔষধ খেতে আর ভালো লাগে না।
—ছাতার মাথা হোক বা ব্যাঙের মাথা হোক। ঔষধ তোমাকে খেতেই হবে।গত তিনদিন যেভাবে গিলেছো সেভাবেই ভালো মেয়ের মত ফটাফট ঔষধগুলো গিলে ফেলো।
ইশফা ইনোসেন্ট ফেস করে বলল……
—তুই না আমার সুইট বোন, আমার কলিজা।প্লিজ ঔষধ গুলো মা দেখার আগে ফেলে দে না।
—যতোই তেল মারো না কেন বেহেনা কাজ হবে না।আমি তোমার কথা সুনছি না।চুপচাপ ঔষধগুলো খাও।
ইশফা কাদো কাদো মুখ করে বলল…..
—প্লিজ…..
ইশরা চোখ রাঙিয়ে বলল…..
—খাবে নাকি জোর করে খাওয়াবো।
ইশফা নাক ফুলিয়ে কোন কথা না বলে ঔষধগুলো খেয়ে নিল।
ইশরা মুচকি হেসে আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল……
—আসছি আমি।বিকেল পযর্ন্ত সান্তিতে থাকো।কলেজ শেষে ফুপির বাসা হয়ে আসবো।আল্লাহ্ হাফেজ।
ইশরা দরজার দিকে পা বাড়াতে নিলেই ইশফা ডাক দিয়ে বলল……
—ইরু শোন?
ইশরা,ইশফার সামনে এসে বলল…..
—কিছু বলবি?
—ভাইয়ার সাথে তোর কথা হয়?
ইশরা চোখ ছোট ছোট করে ইশফার দিকে তাকিয়ে বলল…….
—আর কিছু?
—মনে রাখিস ভাইয়া কিন্তু ঐ কলেজের একজন টিচার।তাই ভাইয়াকে বেশি জ্বালাবি না আর দুষ্টুমি তো একদমি করবি না।
ইশরা রাগি গলায় বলল……
—তোর ঐ সাধু ভাইকে আমি জ্বালাই না।তোর ঐ সাধু ভাই কি করেছে জানিস?ক্লাসের সবার সামনে আমাকে বলেছে,মিসেস ইশরা খান আপনার কিছু নোটস আমার কাছে আছে।এসে নিয়ে যান।(ব্যাঙ্গ করে)এই কথা সুনার পর সবাই আমাকে গাজি বাঘের মত ধরেছে।বিয়ে হয়ে গেছে বলিনি কেন,দাওয়াত দেইনি কেন ইত্যাদি ইত্যাদি।লিপি তো চোখের জল নাকের জল এক করে ফেলেছিলো।জানিস কত কষ্ট করে সবাইকে মানিয়েছি।আর যখন তোর ঐ সাধু ভাইকে গিয়ে জিগ্যেস করলাম,আমাকে মিসেস ইশরা খান কেন বলেছেন?তখন বলে কি আমি মিস ইশরা খান বলেছি।আপনি সুনতে ভুল করেছেন।বল তখন মেজাজটা কেমন লাগে?
ইশরার কথা সুনে ইশফা মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
—তোর সাথে কথা বলাই বেকার।
কথাটা বলে ইশরা রাগ দেখিয়ে গটগট করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
💦💦💦💦💦💦
জিদান,ইশরা পার্কের এক বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে।ক্লাশ শেষে জিদান এক প্রকার জোর করেই ইশরাকে এখানে নিয়ে এসেছে।কারো মুখে কোন কথা নেই।দুজন নিরব হয়ে বসে আছে।
—স্যার আমাকে এখানে কেন এনেছেন?আপনার সাথে এখানে আমাকে কেউ দেখলে উল্টাপাল্টা ভাবা শুরু করবে।তা যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
জিদান ইশরার কথা সুনে ইশরার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল……
—আমার সাথে থেকেও তুই লোকের কথাকে ভয় পাচ্ছিস?
ইশরা কিছু না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
ইশরাকে কিছু বলতে না দেখে জিদান পূনরায় বলল……
—কবের থেকে লোকের কথাকে তুই ভয় পাস ইশু?তুই তো লোকের কথাকে পরয়া করিস না।কে কি বলল না বলল তাতে কিছুই তোর যায় আসে না।
ইশরা হালকা চেচিয়ে বলল…..
—সেই ইশু মরে গেছে।সেই ইশু আরো ৪বছর আগেই মরে গেছে।এখন লোকের কথাকে আমি অনেক ভয় পাই।পারবো না আর আমি আমার বাবা,মা কে লোকের সামনে মাথা নিচু করে দাড়াতে দেখতে।
কথাগুলো বলতে বলতে ইশরার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরল।
—কি হয়েছে না হয়েছে আমি সব তোর মুখে সুনতে চাই।
—কেন ৪বছর আগের পুরোন গায়ে কি নতুন করে লবন দিয়ে তাজা করতে চাইছেন?
জিদান সামনের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল…..
—পুরনো কথা জানতে চেয়ে তোর গা আমি তাজা করতে চাই না।আমি তোকে সত্যের মোকাবেলা করাতে চাই।
ইশরা শক্ত গলায় বলল……
—অন্য কোন কথা আছে আপনার?
জিদান তাসিল্য হেসে বলল……
—আমার অন্য কথা শোনার কি সময় হবে তোর?
ইশরা কিছু না বলে চুপ করে রইল।ইশরাকে চুপ থাকতে দেখে জিদান চোখ বন্ধ করে বলল….
— “কাছে থাকতে আগলে রেখো
হাড়িয়ে গেলে খুজো না
তখন আর পাবে না।”
💦💦💦💦💦💦
বিকেল বেলা ইশফা বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে ফোনে নিক্স কার্টুন দেখছে।নিক্স এর মধ্যে ইশফার সব থেকে পছন্দের হল নিম্বু।ইশফা নিক্স দেখা শুরু করার পর থেকে কুকুর ভয় পায় বিধায় শখ করে একটা বিড়াল ছানা বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো।নামও রেখেছিলো নিম্বু।কিন্তু মায়ের বকনিতে সেটা আর বাড়িতে রাখা সম্ভব হয়নি।
কলিং বেলের শব্দ পেয়ে মিসেস খান দরজা খুলে দিল।তুশি মিসেস খানকে দেখে ঢোক গিলে বলল….
— আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছেন আন্টি?
মিসেস খান সালামের জবাব নিয়ে হাসি মুখে বলল…..
—আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি কেমন আছো?
—আমিও ভালো আন্টি।
—আরে বাহিরে দাড়িয়ে রয়েছো কেন?ভিতরে আসো।
তুশি শুকনো ঢোক গিলে বলল……
—আসলে আন্টি আমার সাথে আমার এক ভাই এসেছে।ইফুকে দেখতে আসতে চাওয়ার পর মা একা বাসা থেকে বের হতে দেয়নি।তাই ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।ভাইয়া নিচে দাড়িয়ে আছে।আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে ভাইয়াকে আমি ভিতরে আসতে বলতাম।
—আমার থেকে অনুমতি নেয়ার কি আছে মা।তোমার ভাই আমাদের বাড়িতে এসেছে তুমি তাকে বাহিড়ে দাড়া করিয়ে রেখেছো এটা কিন্তু ঠিক করো নি।এতে আমি খুব রাগ করেছি।তুমি ডাকো তোমার ভাইয়াকে।
তুশি ফোন দিতেই মুহূর্তে মধ্যে একজন সুদর্শন ছেলে এসে দরজায় দাড়ালো।শ্যামবর্ন গায়ের রং,মুখ ভর্তি দাড়ি,চোখে কালো চশমা,চুলগুলো সুন্দর করে সেট করা।ছেলেটি এসে মিসেস খানকে নম্রভাবে সালাম দিয়ে বলল…..
#মনের_পিঞ্জরে
#Ariyana_Nur
#Part_16
ইশফা ফোনের মধ্যেই ডুবে মনের সুখে কার্টুন দেখছে।বাড়িতে কে এল না এল,কি হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে তার কোন খবর নেই।
মিসেস খান তুশি আর তুশির ভাই এর সাথে কুশল বিনিময় করে তাদের ড্রয়িং রুমে বসিয়ে ইশফাকে ডাকতে গেল।
—ইশফা তুশি এসেছে তোর সাথে দেখা করতে।
ইশফা মায়ের কথা সুনে একপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল…..
–তুলশি পাতাকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও।
—তুশি একা আসে নি।সাথে ওর ভাই এসেছে।
কথাটা শোনার সাথে সাথে ইশফা ভ্রু কুচকে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল……
—তুশির ভাই!কোন ভাই?মা তুমি কি আমার সাথে মজা করছো?
মেয়ের এমন কথা সুনে মিসেস খান বিরক্ত হয়ে বলল……
—তোর কি মনে হচ্ছে আমি তোর সাথে মজা করছি?
ইশফা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না করল।
মিসেস খান তাড়া দিয়ে বলল……
—পায়ের ব্যাথা আছে?তুই একা তুশির সাথে দেখা করতে যেতে পারবি নাকি আমি ধরে নিয়ে যাব?
ইশফার পায়ের ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে।এখন একা একা আস্তে আস্তে হাটতে পারে।তাই ইশফা বলল…..
—তুমি যাও।ওদের নাস্তা পানি দাও।ব্যাথা একটু কম আছে। আমি আস্তে আস্তে আসছি।
—ঠিক আছে সাবধানে আয়।
কথাটা বলে মিসেস খান চলে গেলো।ইশফা বিরবির করে বলতে লাগলো……
—আমার জানা মতে তুলশি পাতার কোন ভাই নাই।নতুন করে ভাই টপকালো কোথার থেকে।ভাই সাজিয়ে কাকে ও বাড়িতে নিয়ে এসেছে?উল্টাপাল্টা বুদ্ধি বের কইরা যদি ও কাউরে বাড়িতে আনে তাইলে ওর খবর আছে।
কথাগুলো বিরবির করতে করতে চুলগুলো হাত খোপা করে মাথায় সুন্দর করে ওড়না জরিয়ে বেড থেকে নামলো।আস্তে আস্তে পা ফেলে ড্রয়িং রুমের দিকে যেতে লাগলো।
💦💦💦💦💦💦
সোফার মধ্যে গাল ফুলিয়ে বসে আছে ইশরা।ইশরা,ইশিতা বেগম এর বাড়িতে আসার পর জানতে পেরেছে,ইশান নাকি তার বাবার সাথে কথা বলে তার জন্য নতুন টিচার রেখেছে।
—ফুপি তোমার ছেলেকে কিন্তু আমি খুন করে ফেলবো দেখে নিও তুমি।তখন আবার আমাকে কিছু বলতে পারবে না।
ইশানের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে নালিশের সুরে ইশরা কথাগুলো ইশিতা বেগমকে বলল।
ইশিতা বেগম এক পলক ইশান এর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল…..
—কি করেছে ইশান আমার মামুনিটার সাথে?
ইশরাঃতোমার ছেলে আব্বুকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার জন্য নতুন টিচার রেখেছে।তাও আবার ইংলিশ টিচার। আবার নাকি তোমাদের বাড়িতে এসে পড়তে হবে।বল এটা কি ও ঠিক করেছে?(কাদো কাদো হয়ে)
ইশিতা বেগমঃইশান কাজটা একদম ঠিক করেছে মা।ইশান তোর বড় ভাই।তোর যাতে পড়ালেখা ভালো হয় তার জন্যই তো ইশান নতুন টিচার রেখেছে।আর তাছাড়া আমাদের বাড়িতে এসে পড়তে তো তোর কোন অসুবিধে নেই।কলেজ থেকে তোদের বাড়ি যাওয়ার পথেই তো আমাদের বাড়ি পরে।পড়ার বাহানায় হলেও তুই আমাদের বাড়িতে আসতে পারবি।সাথে মা,মেয়ে মিলে একটু আড্ডা দিতে পারবো।
ইশরাঃরাখো তোমার আড্ডা। তুমিও তোমার ছেলের পক্ষ নিচ্ছ।কোথায় একটু বকবে তা না করে উল্টো আমাকে বুঝ দিতে আসছে।যাও তোমার সাথেও কথা নেই।(গাল ফুলিয়ে)
ইশিতা বেগম ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল……
—রাগ করে না মা।তোর ভালোর জন্যই তো সবটা করা হয়েছে।
—ফুপি পাগলেও নিজের ভালো বুঝে।একে বুঝিয়ে লাভ নেই এতো পাগল না বাদর।
কথাগুলো বলতে বলতে জিদান সামনে এসে দাড়ালো।
ইশরা, জিদানের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে হালকা চেচিয়ে বলল…….
—উনি এ বাড়িতে কি করছে?
ইশানঃঐ তোর নতুন টিচার।
কথাটা শোনার সাথে সাথেই ইশরা মাথা ভনভন করে ঘুড়তে লাগলো।ইশরা, ইশানের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল…….
—শয়তান পোলা দুনিয়াতে কি তোর জন্য টিচারের অভাব পরছিলো?আমি এর কাছে পড়বো না।
জিদান সোফায় আয়েস করে বসে বলল…..
—তোর না করাতে তো কিছু হচ্ছে না।কাল সুন্দর মত পড়তে চলে আসিস।আজ তোর ছুটি।
ইশরা,ইশিতা বেগমের হাত ধরে করুন গলায় বলল…..
—ফুপি প্লিস আমি এই রাক্ষস এর কাছে পড়বো না।তুমি মানা করে দাও।
ইশিতা বেগমঃএমন কথা বলে না মা।বরকে কি কেউ রাক্ষস বলে বল।
ইশরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল……
—কার বর।কিসের বর।এর সাথে আমার না বিয়ে হয়েছে আর না হবে।
জিদানঃবিয়ে নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। আগে বড় হ। সময় হলে আমিই সব ব্যবস্থা করবো।বাচ্চা মানুষদের মুখে এতো বিয়ে,বিয়ে মানায় না।
জিদান কথাটা বলে সবার অগোচরে ইশরাকে চোখ মারলো।
জিদানের এমন কাজে ইশরা কথা বলতে ভুলে গিয়ে জিদানের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল।
💦💦💦💦💦💦
ইশফা,তুশির সাথে বসে বসে কথা বলছে,আর আড় চোখে সামনে বসে থাকা ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ছেলেটাকে ইশফার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।কিন্তু গোফ,দাড়ি,চশমাতে মুখ ঢেকে থাকার কারনে ভালো মত মিলাতে পারছে না। ইশফার সিক্সত্থ সেন্স জানান দিচ্ছে সামনের মানুষটা তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।কিন্তু চোখে চশমা থাকার কারনে সে পুরোপুরি সিউর হতে পারছে না।
মিসেস খান ওদের সামনে কিছু স্নেক্স আর কফি রেখে নিজের কাজে চলে গেল।
ইশফাঃতুশ ভাইয়ার সাথে তো তুই আমাকে ভালোমত পরিচয় করালি না।তা উনি কেমন ভাইয়া হয় তোর?
ইশফার কথা সুনে তুশি ঢোক গিলে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে তুতলিয়ে বলল…..
—ভা-ভাই মানে আ-আমার ভাই।
ইশফা ভ্রু কুচকে বলল…….
—তা তো জানিই তোর ভাই।কেমন ভাই হয় সেটাই জানতে চাচ্ছি।
তুশিঃআ-আমার আ-আমার আ-আমার……
ইশফা আড় চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছেলেটার হাব ভাব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তুশিকে আমতা আমতা করতে দেখে ছেলেটা কেমন উসুখুসু করছে।
ইশফা যা বুঝার বুঝে গেছে।ইশফা তুশিকে আর বিভ্রান্ত না করে তুশির বাহুতে চাপর মেরে বলল…..
—আমি জানি তোর ভাই।তাই এতো আমার আমার করতে হবে না।তোর আমার আমার করতে করতে কফি ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে গেল।আমার, আমার করা রেখে কফি খা।ভাইয়া আপনিও নিন না।কফি তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।(ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে)
ইশফার কথা সুনে মনে হয় দুজন হাফ ছেড়ে বাচলো।
ইশফা কফির মগে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে আর তুশির সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলছে।কথার মাঝেই ইশফা বলল…….
—ভাইয়া আপনি ক্রিকেট খেলেন?
ইশফা যে কথাটা ছেলেটিকে বলেছে তা বুঝতে ছেলেটির একটু সময় লাগলো।ছেলেটা একটু বেশ ভাব নিয়ে বলল…..
—হুম খেলি।
ইশফাঃতাহলে নিশ্চই আপনার কাছে ব্যাট,স্টেম্প আছে?
—স্টেম্প নেই ব্যাট আছে।কেন?
ইশফাঃআমি আপনার ব্যাটটা একদিনের জন্য ধার নেবো।দেবেন?
তুশি অবাক হয়ে বলল……
—ইফু তুই ব্যাট দিয়ে কি করবি? ক্রিকেট খেলা তো তুই পছন্দই করিস না।
ইশফাঃগাধী আমি কি একবারো বলেছি আমি ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলবো।আমি তো ব্যাট দিয়ে ঐ বাদর বাহিনীর নেতা সান এর পা ভাঙবো।তখন ব্যাটা বুঝবে ব্যাথার জায়গায় শরীরের শক্তি দিয়ে ম্যাসেজ করলে,মলম লাগালে কেমন লাগে।
ইশফার কথা সুনে ছেলেটি কাশতে লাগলো।
ইশফা তার সামনে থেকে পানির গ্লাস ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে বলল……
—হায়রে…. মানুষ।কাশি এক কাশির ধরন আলাদা।
ইশফার কথায় ছেলেটির কাশি থেমে গেল।ছেলেটি অবাক হয়ে বলল…..
—মানে!!!
ইশফা মুচকি হেসে বলল…..
— চুরি করতে গেলে চোরকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হয়।না হলে সে, যে কোন সময় ধরা পরে যেতে পারে।কথাটা মাথায় রাখবেন মিঃসানজান শিকদার উফ্ সরি সান ভাইয়া (সুরটেনে)
#মনের_পিঞ্জরে
#Ariyana_Nur
#Part_17
৪দিন পর…..
ইশফা ভার্সিটিতে এসে করিডোর দিয়ে ক্লাশরুমের দিকে যাওয়ার সময় সান, নিরব ইশফার সামনে পরলো।নিরব ইসফাকে দেখে মুখের মধ্যে বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে বলল…..
—হাই ।কেমন আছো তুমি?
ইশফাঃ আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আপনি?
নিরবঃএইতো বেশ যাচ্ছে দিনকাল।
সান ইশফার সামনে দাড়িয়ে এদিন ওদিক তাকাচ্ছে।ইশফাকে এতোদিন পর সামনা-সামনি দেখে কথা বলার লোভটা আটকাটে পারছে না।কিন্তু ভিতরে সেদিনের ব্যপারটা নিয়ে একটা জরতা কাজ করছে।
ইশফা ব্যাগ থেকে একটা সানগ্লাস বের করে সানের সামনে ধরে বলল…..
—এটা আপনার।সেদিন বাড়িতে ফেলে চলে এসেছিলেন।
সানগ্লাসটা সান কাপাকাপা হাতে ধরে মুখে জোর পূর্বক একটু হাসি টেনে বলল…..
—ধন্যবাদ।
ইশফা সান এর এমন ভিতু ফেস দেখে মনে মনে হাসতে লাগলো।
নিরবঃবলতে হবে তোমার খুব সাহস আছে।যার সাথে প্রথম দিন কথা বলার সময় কাদো কাদো অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো তাকে মারার জন্যই তার কাছে ব্যাট,স্টেম্প ধার চাচ্ছিলে।ও মাই গড ভাবা যায় এসব।তা কি বলো,ব্যাট,স্টেম্প জোগাড় করে দিব।তুমি চাইলে আমি কিন্তু দু’টোই জোগাড় করতে পারি।
ইশফাঃলাগবে না।দরকার পরলে আমিই জোগাড় করে নিতে পারবো।আসি।
কথাটা বলে ইশফা সামনে দু’কদম বাড়ানোর পর সান পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলল…..
—ইশফা শোন……
ইশফা ঘুড়ে সান এর দিকে তাকিয়ে বলল…..
—কিছু বলবেন ভাইয়া?
ইশফার মুখে ভাইয়া সুনে সান তার রুপে ফিরে আসলো।রাগি গলায় বলল…..
—এই এতো ভাইয়া,ভাইয়া করো কেন?আমি তোমার কোন কালের ভাইয়া হই।একটু সাইয়া,সাইয়া করলেও তো পারো।(শেষের কথাটা সান আস্তে করে বিরবির করে বলল)
ইশফা সানের শেষের কথাটা বুঝতে না পেরে সানের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।
সানঃতোমার সাথে কিছু কথা আছে।
ইশফাঃজ্বি বলুন।
সানঃসেদিনের ব্যপারটা নিয়ে তুশিকে কিছু বলো না।ও এমনিতে অনেক ভয়ে রয়েছে।যা হয়েছে তাতে তুশির কোন দোষ নেই।আমিই তুশিকে ব্ল্যাকমেইল করে তুশির সাথে গিয়েছিলাম।
ইশফাঃএতো কষ্ট করে ছদ্মবেশে না গেলেও পারতেন।
সানঃযাওয়ার কারন তোমার কাছে অজানা নয়।তারপেরও যদি তুমি বুঝেও না বোঝার অভিনয় করো তাহলে কিছু করার নেই।তুমি খুব বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে।কারো মনের কথা না বুঝলেও, চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তোমার আছে।না কোন অন্যায় আবদার করবো আর না অন্যায় সইবো।আমি ভালো কিন্তু আমার রাগ অনেক খারাপ।যা আমার তা কিভাবে আমার করে রাখতে হয় তা আমি খুব ভালো করে জানি।
কথাটা বলেই সান চলে যেতে লাগলো।কয়েক কদম সামনে হেটে যাওয়ার পর পিছন দিকে ঘুড়ে বলল…..
“মুখের কথা মিথ্যে হতে পারে”
“কিন্তু চোখের নয়।”
কথাটা বলে সান আর এক মুহূর্ত দেড়ি না করে সেখান থেকে গটগট করে হেটে চলে গেলো।আর ইশফা সান এর যাওয়ার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।এতোক্ষন সানের সব কথা ইশফার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।কিন্তু সান যে সান্ত ভাবে ইশফাকে ছোটখাট একটা ওয়ার্ণিং দিয়ে গেলো সেটা ইশফার মাথায় ঠিকই ঢুকেছে।
💦💦💦💦💦💦
ইশফাকে দেখে রিধি ঝাপিয়ে পরলো ইশফার উপর।ইশফাকে টাইট করে জরিয়ে ধরে বলল…..
—ইফু….কেমন আছিস তুই?পায়ের ব্যাথা কমেছে?জানিস কত মিস করেছি তোকে?আই মিস ইউ ইফু…….
ইশফাঃবোইন আমি চ্যাপটা হয়ে যাচ্ছি।আগে ছাড় আমায়।তার পরে তোর উওর দিচ্ছি।
রিধি ইশফাকে ছেড়ে দিয়ে বলল……
—বল এবার কেমন আছিস?
ইশফাঃআছি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।পা দুদিন আগেই ভালো হয়ে গেছে।তার পরেও বাবা ভার্সিটিতে এ দুদিন আসতে দেয়নি।
রিধিঃযাক ভালো হলেই আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।তোকে অনেকদিন পর পেয়েছি।তোর সাথে বলার জন্য অনেক কথা পেটে জমে আছে।তাই আজ কোন ক্লাশ হবে না।আজ শুধু ঘুরাঘুরি।
তুশি রিধির মাথায় গাট্টা মেরে বলল…….
—মাথা ঠিক আছে তোর?দুদিন আগে পা ভালো হয়েছে।এ পা নিয়ে বেশি হাটাচলা করলে পরে পা ব্যাথা করবে না।
রিধি তুশির কথা সুনে জিভে কামড় দিয়ে বলল…..
—তাইতো।আমি তো অতোটা ভেবে বলিনি।যা ঘুরাঘুরি বাদ।পেট পুরে খাওয়া-দাওয়া তো করতে পারবো।
তুশিঃপেটুপুরে খেতে খেতে একদিন দেখবি তোর টামি ফেটে গেছে।
রিধিঃএকদম আমার খাবার নিয়ে কথা বলবি না।আই লাভ খাবার।
ইশফাকে অন্য মন্যস্ক দেখে তুশি কাদো কাদো ফেস করে বলল…….
—ইফু তুই কি এখনো আমার উপর রেগে আছিস?
ইশফার মাথায় এতোক্ষন পযর্ন্ত সান এর কথাই ঘুরঘুর করছিলো।তুশির কথায় ইশফা চোখ রাঙিয়ে বলল…..
—তোর কি মনে হয় তোরে আমি এমনে এমনে ছাইরা দিমু।কিছুই ভুলি নাই আমি।সব সুদে আসলে উসুল করুম।
রিধি সন্দেহর চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল…..
— কি হয়েছে রে তোদের?তোদের কথায় আমি কেমন যেন রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি।
ইশফাঃতোকে সব পরে বলব।এখন কথা না বাড়িয়ে আমার কথা শোন।খাওয়া-দাওয়া,ঘুরাঘুরি সব হবে।কিন্তু আজ না পরে।আজ এমনিতেই অনেক দিন পর ভার্সিটিতে এসেছি।এভাবেই অনেক ক্লাশ মিস হয়েছে।
ইশফার কথার উপরে কেউ আর অন্য কোন কথা বললো না।কেননা ওর দুজন ভালো করেই জানে ইশফা পড়াশুনা নিয়ে কতটা সিরিয়াস।
💦💦💦💦💦💦
মাঠের এক কোনে ইশফা,তুশি,রিধি বসে আছে।তুশির মুখে সব শোনার পর রিধি মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে।
কিছুক্ষন চুপ থাকার পর রিধি আসফোসের সুরে বলল……
—এতোকিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানলাম না।
ইশফাঃআগে জানালে তোর এই চেহারাটা দেখতাম কেমনে।
তুশিঃরিধু তুই সুইন্নাই এমন করতাছোস।বোঝ এবার আমার কি হাল হয়েছিলো।আমি তো সামনে ছিলাম।
রিধিঃসব ঠিক আছে কিন্তু ইফু তুই বুঝলি কেমনে ঐইটা সান ভাইয়া ছিলো।
ইশফাঃতার হাতে একটা পোড়া দাগ আছে।যেটা আমি আমার পায়ে ম্যাসেজ করে দেওয়ার সময় লক্ষ করছিলাম। তুশরে আমতা আমতা করতে দেখে বাব বার হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছিল।কন্ঠ সুনে আমার প্রথমেই কেমন সন্দেহ হইছিলো হাতের পোড়া দাগ দেখে সিউর হয়ে গেছি।
রিধিঃবলতে হবে ইফু তোর বুদ্ধি আছে।
ইশফা ভাব নিয়ে বলল……
—আই নো।
তুশিঃভাব পরে নাও।এখন ক্লাশে চল।ক্লাশ শুরু হয়ে যাবে।
রিধিঃমাত্রই না আসলাম।এতো তাড়াতাড়ি টাইম শেষ হলো কিভাবে?
ইশফাঃবকবক করার সময় তোর আবার টাইমের খবর থাকে নি।চুপচাপ এবার উঠ।ক্লাশে যেতে হবে।
💦💦💦💦💦💦
ইশফা ভার্সিটি থেকে বাড়িতে এসে ফ্রেস হয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হতে না হতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো।ইশফা ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই অপর পাশ থেকে ভেসে এল……
—বাহ্ ভালোই তো আজ-কাল প্রপোজ পাওয়া হচ্ছে।আবার বাড়িতে এসেও নাকি খবর নেওয়া হচ্ছে।তা আমার কথা কি ভুলে গেছো?বলেছিলাম না,সান এর থেকে দূরে থাকবে।সান কোন সাহসে তোমার বাড়িতে এসে তোমার সাথে দেখা করে ?আর তুমি ওকে কেন কিছু বলোনি?তোমার বাড়িতে আসার পর ওকে বিনা অপমানে কিভাবে তুমি যেতে দিলে?
অপর পাশের লোকটার গম্ভীর কথা সুনে ইশফার চিনতে একটুও ভুল হয়নি লোকটা কে।ইশফা লোকটার কথা সুনে রাগে রি-রি করছে।ইশফা রাগি গলায় বলল…….
—আমি কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার।বাড়িতে মেহমান আসলে তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা আমার বাবা,মা আমাকে শিখিয়েছে।আপনার কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে না।আর আমার যার সাথে ইচ্ছে দেখা করবো কথা বলবো।তাতে আপনার সমস্যা কোথায়?
— তুমি আবার ঐ সানের প্রেমে পরে যাওনি তো?সানের জন্য এতো দরদ দেখাচ্ছো কেন?
—আপনার মত ফালতু লোকের সাথে কথা বলার সময় আমার নেই।
কথাটা বলেই ইশফা কল কেটে দিয়ে বেডের উপর তার ফোন ছুড়ে মারলো।রাগে তার হাত-পা কাপছে।ইশফা ভেবে পায়না কে এই লোক?কিভাবে ওর সব খবরা-খবর পেয়ে যায়?
#মনের_পিঞ্জরে
#Ariyana_Nur
#Part_18
বাসার মধ্যে পিনপনতা নিরবতা।কিচেন থেকে শুধু টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।মিসেস খান কিচেনে কাজ করছে।ইশফা,ইশরা ঘুমিয়ে রয়েছে।মিঃখান নিজের রুমে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে।মিসেস খান রান্নাবান্না শেষ করে ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে সবাইকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে গেলো।
ইশফা,ইশরা দুজন একসাথে গল্প করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পান্তা ভাত হয়ে গিয়েছিলো।মায়ের ডাকে ঘুম ঘুম চোখে খাবার টেবিলে এসে বসল।খাবার খাওয়ার ইচ্ছে একজনেরও নেই।তারপরেও মায়ের বকুনি থেকে বাচতে দুজনই খাবার টেবিলে এসে হাজির হয়েছে।কেননা মিসেস খান রাতের খাবার না খেয়ে কাউকে ঘুমোতে দেয় না।যদি কেউ ঘুমিয়েও যায় তাকে টেনে তুলে রাতের খাবার খাওয়াবে।আর যতক্ষন ঘুম থেকে না উঠবে ততক্ষন কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান তো আছেই।
ইশরা,ইশফা দুজন মিঃখান এর দুপাশে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে।মিসেস খান কিচেন থেকে গোশতের বাটি হাতে করে নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো।দুই মেয়েকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে বলল…..
—হাত গুটিয়ে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।যতই বাহানা করো না কেন আমি কিন্তু না খেয়ে ঘুমোতে দিব না।
কথাটা বলে সে আবার কিচেনে চলে গেলো।
মিসেস খান কিচেন থেকে ফিরে এসে দেখে মিঃখান দু মেয়েকে বাচ্চাদের মত রুপকথার গল্প বলে খাইয়ে দিচ্ছে।মেয়েরাও আয়েস করে বসে খাচ্ছে।
মিসেস খানঃ এই তোদের কি কান্ড জ্ঞান নেই?মানুষটা সারাটা দিন খাটাখাটি করে কত দূর জার্নি করে এসেছে।এখন তার তোদের কে খাইয়ে দিতে হচ্ছে।তোদের কি হাত নেই?
মিঃখানঃআহ্ তুমি আমার পরিদেরকে বকছো কেন?ওদের খাইয়ে দিচ্ছি দেখে কি তোমার হিংসে হচ্ছে?একদম আমার পরিদের কে বকবে না।
মিসেস খানঃকি উল্টাপাল্টা বলছো।আমার হিংসে হতে যাবে কেন?(রেগে)
মিঃখানঃমেয়েদের কে খাইয়ে দিচ্ছি অথচ তোমাকে দিচ্ছি না।
মিসেস খানঃআরো মেয়েদের কে আদর দিয়ে বাদর করো।তোমার আশকারা পেয়েই মেয়েরা দিন দিন এমন হচ্ছে।
মিঃখানঃমোটেও না মেয়েরা এসব গুন তোমার কাছ থেকেই পেয়েছে।তুমি ওদেরকে পেটে নিয়ে যে সব অভ্যাস করিয়েছো ওরা তাই শিখেছে।
মিসেস খানঃওহ এখন সব দোষ আমার।
মিঃখানঃতোমারি তো। তুমিই তো প্রতিদিন রাতে বায়না ধরতে খাইয়ে দেবার জন্য।সেই অভ্যাসই ওরা পেয়েছে।তোমাকে খাইয়ে দিতে গিয়ে ভাবীর সামনে কত লজ্জায় না পরতে হয়েছিলো আমার।
মিঃখান মেয়েদেরকে খাইয়ে দিচ্ছে আর মিসেস খানকে ইচ্ছে এটা সেটা বলে রাগাচ্ছে।ইশফা,ইশরা তাদের বাবা,মায়ের খুনসুটি ঝগড়া দেখে মিটমিট করে হাসছে। ইশরা,ইশফা এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্থ।এমন প্রায় দিনই মিঃখান ইচ্ছে করে মিসেস খানকে এটা সেটা বলে রাগিয়ে দেয়।তার পরে তার মান ভাঙায়।এই হয়তো তাদের ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ।
মিসেস খান,মিঃখানকে কয়েক কথা সুনিয়ে রাগ করে সেখান থেকে চলে গেলো।মিসেস খান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিঃখান মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
ইশরাঃআব্বু তুমি হাসছো?মা কিন্তু অনেক রেগে গেছে।
ইশফাঃমাকে না রাগালে কি আব্বু তোমার হয় না।
মিঃখানঃতোরা তোদের খাবার শেষ কর।তোদের মাকে আমি দেখছি।আমি যেমন রাগিয়েছি রাগ ভাঙার দায়িত্বও আমার।তোদের এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
ইশফা,ইশরা কোন কথা না বাড়িয়ে নিজেদের পেটের চিন্তা করতে লাগলো।কেননা তারা জানে তাদের আব্বু তাদের মাকে ঠিকই মানাতে পারবে।
ইশফা,ইশরা তাদের বাবা,মায়ের এই খুনসুটি ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়।বিয়ের এতো বছর হয়ে যাবার পরেও তাদের মধ্যে কি সুন্দর ভালোবাসা বিদ্যমান রয়েছে।
💦💦💦💦💦💦
দেখতে দেখতে কেটে গেলো বেশ কিছু দিন।জিদান ইশরাকে মানানোর জন্য নানান ভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু কোন ভাবেই জিদান ইশরাকে মানাতে পারছে না। ইশরা সবার সাথে দুষ্টুমি,হাসি খুশিতে মেতে থাকলেও জিদানের সামনে সে একবারে গম্ভীর টাইপ হয়ে যায়।ভদ্র ভাবে জিদানের ক্লাশ করে।সপ্তাহে তিনদিন জিদানের কাছে টিউশন নিতে ইশিতা বেগম এর বাসায় যায়।মাথা নিচু করে জিদানের সামনে পড়তে বসে আবার মাথা নিচু করেই পড়া শেষে উঠে চলে আসে। ইশরা পড়ার বাইরে একটা কথাও জিদানের সাথে বলে না।এমনকি একবারের জন্যও জিদানের দিকে তাকায় না।ইশরার এমন ব্যবহারে জিদান মনে মনে খুব কষ্ট পায়।তারপরেও মুখ ফুটে কিছু বলে না।
ইশরা কলেজে ঢুকতেই তার চোখ যায় দূরে দাড়িয়ে থাকা জিদান এর দিকে।জিদান এক পাশে দাড়িয়ে দু’জন স্টুডেন্ট এর সাথে হাসি মুখে কথা বলছে।তা দেখেই ইশরার মাথা গরম হয়ে গেলো।জিদানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ক্লাশরুমের দিকে চলে গেলো।
ইশরার ক্লাশ এখনো শুরু হয়নি।ক্লাশ যে যার মত গল্প করছে, হৈ-হুল্লোড় করছে।ইশরা চুপচাপ মুখ গোমড়া করে বসে রয়েছে।ইশরাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে লিপি ভ্রু কুচকে বলল……
—আজ এমন হট হইয়া রইছোস ক্যান?কার সাথে কি নিয়া আবার ঝামেলা করছোস ।
লিপির কথায় ইশরা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল…..
—তোর কি মনে হয় আমি সব সময়ই ঝামেলা করি?
—চেতোস ক্যান?কি হইছে সেটা আগে বল।
ইশরা বিরবির করে কিছু একটা বলল।লিপি বুজতে না পেরে বলল……
—বিরবির না করে কি কইতাছোস জোরে বল।আমি কিছুই সুনি নাই ।
ইশরা কাঠ কাঠ গলায় বলল……
—আজকে ইংলিশ ক্লাশ করুম না।সাথে তুইও করবি না।
লিপি হালকা চেচিয়ে বলল…..
—কিহহহ…..ইংলিশ ক্লাশ মিস করুম!
ইশরা লিপির দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই লিপি ঢোক গিলে বলল……
—না মানে তুই তো জানিস আমার ইংলিশ ক্লাশ করতে কত ভালো লাগে।ইংলিশ আমার প্রিয় একটা সাবজেক্ট।আই লাভ……
লিপিকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে ইশরা বলল……..
—ক্লাশ না স্যার?
লিপি ঘাবড়ে গিয়ে বলল…..
—মানে?
ইশরা দাতে দাত চেপে বলল…..
—দাদারে আদা পরা খাওয়াইতে আইসো না।তোমার যে ইংলিশ ক্লাশ কত পছন্দ তা আমার জানা আছে।আগে তো দেখলাম না ভালোমত ক্লাশ করতে।যেই দিন ঐ বদের হাড্ডি জিদান স্যার আসলো সেদিন থেকেই তোমার ইংলিশ ক্লাশ পছন্দ হয়ে গেছে।
—ঐ তুই স্যাররে বদের হাড্ডি বলস ক্যান?
—কেন?স্যারকে বদের হাড্ডি বলাতে লাগলো বুঝি?(রেগে)
—লাগবেই তো।স্যার কত ভালো তারে বদের হাড্ডি বললে লাগবো না।আমি বুঝি না স্যার এর সাথে তোর কি শক্রতা।স্যার আসার পর থেকেই তুই স্যারকে দেখতে পারিস না।কি করেছে স্যার তোকে?আমার কেন যেন মনে হয় স্যারকে তুই আগে থেকেই চিনোস।
ইশরা রাগি গলায় বলল…….
—হ’ চিনি তো।তারে খুব ভালো করেই চিনি।
লিপি খুশি হয়ে বলল……
—সত্যি তুই স্যারকে আগে থেকে চিনিস।কিছু হয় তো?মানে আত্মীয়-তাত্মীয়?
—হ লাগে তো।
লিপি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল….
—সত্যি! কি হয় স্যার তোর?
ইশরা দাতে দাত চেপে বলল…..
—আমার জামাই লাগে হইছে।
ইশরার কথা সুনে লিপি চোখ বড় বড় করে বলল…..
— কিহহহ?
—কি কি করোস ক্যান।যা জানতে চাইছোস তাই বলছি।এবার চুপ থাক। আর একটা কথা বলবি তাইলে তোর খবর আছে।
ইশরার চোখ রাঙানো রাগি গলার কথা সুনে লিপি দমে গেলো।লিপি বুঝতে পারলো ইশরা এখন অসম্ভব রেগে আছে। তাই কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বসে রইল।
💦💦💦💦💦💦
উদাস মনে সান তার বন্ধুদের সাথে বসে রয়েছে।সেদিনের পর থেকে যে ইশফা,সানকে এরিয়ে চলে তা সান ভালোই বুঝতে পেরেছে।নিরব নিজ ইচ্ছায় কথা বলতে গেলেও ইশফা কোনমত হু হা করে চলে যায়।সানও ইশফাকে কোন বিরক্ত করে নি।নিজের মত ছেড়ে দিয়েছে।কেননা ইশফার সব খবরা-খবর তো সে পায়ই।আর চোখের দেখা সে তো প্রতিদিনই সে দেখে।
হুট করে এলি এসে সান এর হাত জড়িয়ে ধরলো।সান ঝাড়া দিয়ে এলির থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল……
—হুটহাট এমন গায়ে এসে পরিস কেন?বলেছিনা গায়ে হাত দেয়া আমার পছন্দ না।
এলি হাসি মুখে বলল…..
—ওহ্ জান আজ বাদে কাল তো আমার হাত ধরেই ঘুড়বে।তাই আগের থেকে অভ্যাস করে নাও।
সান ভ্রু কুচকে বলল…..
—প্রথমত আমাকে এই জান ডাকা অফ কর।আর পাগলের মত কি বলছিস তুই?তোর হাত ধরে ঘুড়তে যাবো কেন?
এলি লাজুক হেসে বলল……
—তুমি জানো আমি বাপিকে তোমার আর আমার কথা বলেছি।বাপি আমাদের বিয়ের জন্য রাজি।আজ সে তোমার পাপার সাথে কথাও বলতে যাবে।জানো আমি আজ খুব খুশি।ভাবতেও অবাক লাগছে দুদিন পরে আমি মিসেস সানজান হয়ে যাব।(খুশি হয়ে)
এলির কথা সুনে সবাই হা করে এলির দিকে তাকিয়ে রইল।সান এর চেহারার রং মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেছে।চোখগুলো অসম্ভব লাল হয়ে গেছে।সান রাগি গলায় বলল……
—হেনা এদিকে আয়।
হেনা সান এর থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিল।সান এর এমন রাগি গলার ডাক সুনে ভয়ে তার হাত-পা কাপছে।কাপা কাপা পায়ে সানের সামনে এসে দাড়াতেই সান রাগি গলায় বলল……
—তোর এই আধা পাগল বান্ধবীকে আমার সামনের থেকে নিয়ে যা।তোর কথামত ওকে আমাদের সাথে এলাও করেছি।কিন্তু আজকের পর আর করবো না।একে বলে দিস দ্বিতীয় বার যেন আমার সামনে না আসে।
এলিঃসান তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?হবু বউ এর সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে বল।তুমি জানো আমি হেনার মত একটা মিডেলক্লাস,ড্রাইভারের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য।তা না হলে এর সাথে বন্ধুত্ব কে করতো।দেখো আমাদের বিয়ের পর কিন্তু এসব বন্ধু চলবে না।
এলির কথা সুনে হেনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো।হেনা ভাবতেও পারেনি এলি ওকে এভাবে কথা শোনাবে।হেনাকে কান্না করতে দেখে সান চেচিয়ে বলল…..
—আর এক ফোটা জল তোর চোখ দিয়ে বের হলে ঠাটিয়ে এক চর বসাবো ।তোকে আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ের চাল-চলন আমার ভালো লাগে না।এর সাথে বন্ধুত্ব করিস না।সুনেছিস আমার কথা।এখন কেন কষ্ট পাচ্ছিস।
সান এলিকে উদ্দেশ্য করে বলল…..
—হাউ ডেয়ার ইউ।তোর সাহস কি করে হয় আমার সামনে আমার বন্ধুকে অপমান করার? তুই মেয়ে দেখে আমি এখন অব্দি নিজেকে কন্টল করে রেখেছি।তা না হলে আমার বন্ধুকে আপমান করার জন্য যে তোকে আমি কি করতাম তুই ভাবতেও পারতি না।
এলিঃতুমি আজ আবার এর জন্য আমার সাথে উচু গলায় কথা বললে?কাজটা কিন্তু একটুও ঠিক করলে না।এমনিতেই আমি তোমার উপর আপসেট সেদিনের ব্যবহারের জন্য।তুমি সেদিন আমাকে সবার সামনে বকেছো।আজ অব্দি সরিও বলোনি।
সানকে অতিরিক্ত রেগে যেতে দেখে নিরব আর শিপন সানকে টেনে সেখান থেকে দুরে নিয়ে গেলো।
নিরবঃভাই মাথা ঠান্ডা কর।এতো রাগলে চলবে না।রাগলে তুই এমনিতেও নিজের মধ্যে থাকিস না।মেয়ে মানুষ ছেড়ে দে না।
সান রাগে গজগজ করতে করতে বলল…..
—ছেড়ে দিব ওকে।দেখছিস কি ব্যবহার করছে ও।তার পরেও বলছিস ছেড়ে দিতে।
শিপনঃসান সান্ত হ তুই।তুই তো জানিসই ও বড় লোকের বিগড়ে যাওয়া সন্তান।মনে হয় কাল পেটে মাল পানি পরেছে তার নেশা এখনো কাটেনি।নয়তো বিয়ের খুশিতে সকাল সকাল মাল-পানি খেয়ে এসেছে।দেখছিস না কেমন ঢুলে ঢুলে কথা বলছে।
নিরবঃআমার তাই মনে হচ্ছে।তুই মাথা ঠান্ডা কর সান।আমরা ব্যপারটা দেখছি।
সান ওদের থেকে ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলল……
—তোদের যা খুশি কর।
কথাটা বলেই সে গটগট করে হেটে চলে গেলো।
💦💦💦💦💦💦
ভার্সিটির পিছন দিকের জায়গাটা খুব নিড়িবিলি।মানুষ জন বেশি সেদিকে যাতায়াত করে না।সেখানে এক বেঞ্চের মধ্যে বসে রয়েছে সান।ভার্সিটিতে জরুরী কিছু কাজ থাকায় রাগ করে আর বাড়িতে চলে যায়নি।কাজ শেষ করে এখানে বসে রয়েছে।ভিতরে ভিতরে এলির উপর রাগে সে ফেটে পরছে।হেনাকে অপমান করার জন্য এলিকে দুটো চড় লাগাতে পারলে তার সান্তি হত।মেয়ে মানুষ দেখে সানের চড় খাওয়া থেকে বেচে গেছে এলি।
হেলা সানদের ডাইভার এর মেয়ে।ছোটবেলা থেকে হেনার সানদের বাড়িতে যাতায়াত থেকেই তাদের বন্ধুত্ব।সান সব সময় হেনাকে সব ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে।এমনকি এই ভার্সিটিতে যে পরছে তাও সান এর সাহায্যে।এসব কথা সান আর হেনার পরিবারের লোক ছাড়া কেউ জানে না।
সান মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।কেউ একজন সানের সামনে এসে পানির বোতল ধরল।সান কিছুক্ষন থ’ মেরে বসে থেকে লোকটাকে দেখার জন্য মাথা উচু করতেই অবাক হয়ে যায়।
(