খাটের নিচে এক কোনো রক্তাক্ত অবস্থায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে মালা । কপাল বেয়ে তার ঝরঝর করে রক্ত পরছে , ঠোঁটের কোণে অনেক অংশ কেটে গিয়ে সেখান থেকেও রক্ত পরছে । তার ঠিক সামনেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে তার মায়ের দেয়া শাড়িটায় যা মালা আজ পরেছিল । অতএব শাড়ি পরতে যেসব বস্ত্রের প্রয়োজন মালা সেগুলো পরেই নিচে বসে আছে চুপটি করে । কান্নাকাটি করার এখানে কিছু নেই কেনো না এগুলো মালার জন্য নিত্য দিনের ব্যপার । এগুলোকেই সে এখন তার ভাগ্য মনে করে ।
মালার কিছুটা দূরত্বে সোফার উপর বসে দু’পা সামনের টেবিলের উপর রেখে মাথায় হাত ঠেকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে মালার স্বামী মেঘ আহমেদ । কিছু সময় পার হওয়ার পর মেঘ উঠে যেয়ে মালার সামনে দাড়ালো । মেঘকে দেখে মালা ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে আরো গুটিসুটি মেরে বসলো । মেঘ তার সামনে থেকে সরে আলমারি খুলে এক এক করে মালার সব শাড়ি নামিয়ে জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে দিল । মুহূর্তের মধ্যেই শাড়ি গুলোতে আগুন লেগে দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো । সমস্ত রুম একদম রক্তিম হয়ে উঠলো , সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় পশ্চিম আকাশ যেমন রক্তিম বর্ণ ধারণ করে ঠিক তেমন।
এসব দেখে মালা এক চিৎকার দিয়ে উঠলো ।
— মেঘ আপনি এসব কি করছেন , সবগুলো শাড়ি কেনো পুড়ছেন ?
— যেনো তুমি আর কখনো শাড়ি না পরতে পারো এইজন্য । একদম নির্বিকার হয়ে শান্ত ও শীতল কন্ঠে উওর দিল মেঘ । মেঘের কথা শুনে মালা ভয়ে চুপসে গেল, এখন আর মেঘকে কিছু বলা বা জিজ্ঞাসা করা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো ।
মালাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে মেঘ রুমের বাহিরে চলে গেল । ওয়াশরুমে যেয়ে মালা আয়নার সামনে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে । কপালের রক্ত এখানো বেয়ে পরছে , ঠোঁটের কোণের রক্ত শুকিয়ে আছে , গালে স্পষ্ট চড়ের দাগ । তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো মালার ঠোঁটের কোণে । এগুলো নতুন কিছু নয় মেঘ এরচেয়েও
বেশি বাজে ভাবে আঘাত করেছে মালাকে । বিয়ের দুইদিন পর থেকে আজ বিয়ের দেড় বছর পর্যন্ত মেঘের দেয়া আঘাতে অভ্যস্ত । এখন এটাকেই তার ভাগ্য মনে করে নিয়েছে । মেঘের ডাকে ঘোর ভাঙলো মালার ।
— মালা এখনো তোমার ফ্রেশ হওয়া হয়নি, জলদি বাহিরে আসো ।
— হুম আসছি ।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মালা মেঘের সামনে যেয়ে দাডালো । মালাকে এক পলক দেখে মেঘ ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে মালাকে খাটে বসিয়ে কাটা জায়গায় ঔষুধ লাগিয়ে দিল । মালা একনাগাড়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে । এই কেমন ভালোবাসা মেঘের , নিজে আঘাত করে নিজেই মলম লাগায় ।
— খেতে চলো মালা ।
মালা চুপচাপ মেঘের পিছু পিছু খেতে চলে আসলো । মেঘ আজ নিজে মালাকে চেয়ারে বসিয়ে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে আসলো , নিজ হাতে খাবার বেরে মালাকে খেতে বললো ।
মালা অবাক হয়ে মেঘকে দেখেই যাচ্ছে । আজ এই কোন মেঘকে দেখছে মালা আগে কখনো তো নিজ হাতে খাবার বেরে দেয় নি ।
— কি হলো খাও ।
মালা প্রথম লোকমা টা মুখে দিয়ে বের করতে নিলেই মেঘ কর্কশ কন্ঠে বললো ,
— একদম খাবার গুলো ফেলবে না , চুপচাপ প্লেইটের সবগুলো খাবার শেষ করো ।
অগ্যতা মালা চুপচাপ খেতে লাগলো । তরকারিতে অতিরিক্ত মরিচ আর লবণ দিয়ে রেখেছে মেঘ আর এখন মালাকে এগুলোই খেতে বলছে । ঝালে মালার চোখ দিয়ে পানি পরছে কিন্তু অনেক কষ্টে খাবার গুলো গিলে যাচ্ছে সে । একটু পানি পান করার জন্য গ্লাসটা হাতে নিতেই মেঘ তা সরিয়ে দিল ।
— একবারে সবগুলো খাবার শেষ করার পরেই পানি পাবে তুমি তার আগে না ।
ঝালে মালা চোখ দিয়ে অজস্র পানি পরছে , ঠোঁটের কোণেও অসম্ভব ঝালাপোড়া করছে । কান্না করতে করতেই সবগুলো খাবার শেষ করলো মালা । খাবার শেষ হওয়ার পর পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো ,
— আর কখনো বাহিরের কারোর জন্য ভালো রান্না করবে না , করলে এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা হবে । এই কথা বলেই মেঘ ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে আসলো ।
এক নিঃশ্বাসে পানি পান করে ছলছল চোখে মেঘের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে মালা । কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছে মেঘ তাকে । এখন এসবের কারণ উপলব্ধি করতে পারছে মালা । এই মানুষ টা তাকে অনেক ভালোবাসে নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই কেমন ভালোবাসা প্রকাশ করার ধারা । মেঘ তাকে নিয়ে অনেক পজেসিভ ও সন্দেহপ্রবন ।
আজ রাতের খাবারের জন্য মেঘ তার কয়েক বন্ধু ও তার স্ত্রীদের দাওয়াত করেছে । মালা সকলের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেনি পাছে মেঘ যেনো রেগে না যায় । কিন্তু যার ভয় ছিল সেটাই হলো । বন্ধুরা সকলে আসার পর মেঘের সামনে তার এক বন্ধু মালার প্রশংসা করে বলেছিল ” ভাবি আপনাকে আজ এই শাড়িতে অপূর্ব সুন্দর লাগছে ” এই কথা শুনার পর মালা ভয়ে ভয়ে একবার মেঘের দিকে তাকলো তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য । মেঘ তখন কিছু না বলে চুপচাপ বসে ছিল । খাবার টেবিলে খাওয়ার সময় মেঘের আরেক বন্ধু মালার প্রশংসা করে বলে উঠলো,
— ভাবি আপনার হাতের রান্না তো অসাধারণ এমন খাবার আর কখনো খাইনি । ইচ্ছে করছে আপনার হাতে একটি চুমু খেয়ে ফেলি ।
মেঘের চেহারা তখন আগুনির মতো লাল হয়ে গিয়েছিল । তখন নিজেকে সংযত করে বন্ধুদের ভালো ভাবে বিদায় দিয়ে তার সমস্ত রাগ মালার উপর তুললো । তার মতে মালা নিজ ইচ্ছে করে তাদের সামনে সেজেগুজে গিয়েছে পর পুরুষদের দেখানোর জন্য । বাহিরের পুরুষদের ভালো রান্না করে খাইয়েছে এমন তার ধারণা ।
মেঘ পেশায় একজন বিজনেস ম্যান ও চিত্রকার ও । ছোট বেলা থেকে তার আকাআকি করার শখ ছিল অনেক । এই শখ থেকেই আর্ট শিখেছে মেঘ । শহরের নামি দামি চিত্রকারদের মধ্যে একজন হলো মেঘ আহমেদ । উত্তরাধিকার সত্বে বাবার ফেলে যাওয়া বিজনেস সামলাচ্ছে সে । দুটো পেশায় অনেক নিপুণ মেঘ আহমেদ ।
নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে মালা । মা বাবা আর দুই বোন নিয়েই তার পরিবার । মালার বাবা পেশায় একজন সরকারী স্কুলের শিক্ষক । মালা পরিবারের বড় মেয়ে এই সূত্রে সবার অনেক আদরের ও । তার ছোট দুই বোন মধুরিমা ও মাদিহা ।
আজ থেকে দেড় বছর আগে পারিবারিক ভাবেই মেঘ ও মালার বিয়ে হয়েছে । মেঘের বাবা মা নেই তার এক ফুফি তাকে আগলিয়ে রেখেছে নিজ দায়িত্বে বিয়ে করিয়েছে । মেঘ যদি কারো কথা মান্য করে তা কেবল তার ফুফির । তার ফুফি আয়েশা বেগমের দুর সম্পর্কে আত্মীয় হয় মালা । প্রথম দেখায় তিনি মালার মতো শান্ত শিষ্ট, ভালো মেয়েকে মেঘের জন্য পছন্দ করেছে । মেঘ ও কোনো আপত্তি না করে তার ফুফির কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছে ।
বিয়ের আগে তাদের দৈনিক কথাবার্তা ফলে এক পর্যায়ে মেঘ ও মালা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে । সব ঠিকঠাক ভাবেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো । মেঘ মালাকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত আগলিয়ে রাখে । সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু মেঘের হিংস্রতা মালার সামনে প্রকাশ পেয়েছে বিয়ের দুইদিন পর যখন মেঘের ফুফির ছেলে দুষ্টুমি করে মালার গালে চিমটি দিয়ে ছিল।
চলবে …..
#মেঘমালা
#পর্বঃ১
#Sohana_Akther