মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১২
প্রিন্সেসের বয়স আনুমানিক এক বছর হবে। এ বয়সে স্বাভাবিকভাবেই মা চোখের আড়াল হলে বাচ্চারা কান্না-কাটি করে অস্থির হয়ে যায়। অথচ প্রিন্সেসের বেলায় এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মা নেই,মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গ পায় কিন্তু মেয়েটা কত প্রাণবন্ত, চঞ্চল।ছোট বেলা থেকে এমনটা তে অভ্যস্ত তাই হয়ত। মোনার চুল গুলো যেন ওঁর প্রিয় হয়ে উঠেছে, কোলে উঠেই চুলের দিকে হাত বাড়াবে। মোনা আলতো করে গাল টেনে দেয় ওঁর। মোনা আসছে পর্যন্ত একটু কাঁদতে দেখে নি মেয়েটাকে। মোনা কে দেখা মাত্রই হেসে হাত বাড়িয়ে দেয়। মোনা কোলে নিলেই বুকের মাঝে মিশে থাকে যেন।
নতুন জায়গা মোনার ঘুম আসছে না। জ্যাক অনেকবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে। একজন কাজের লোক বাঙালি রেস্তোরাঁ থেকে খাবার এনে দিয়েছে প্রতি বেলা। মোনা লিলি বেগমের কথা ভাবছে, অন্তত একটা ম্যাসেজ করা দরকার। বাসার আর সবাই ঝামেলা মুক্ত হলেও লিলি বেগম তো খুব চিন্তা করবে। মোনা ওই বাসার কথা মনেই করতে চায় না। মোনার বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে। মোনার সেই রাতের কথা মনে পড়ে, বিশ্রী রকমের অনুভূতি হয়। ওই বাসার মানুষ গুলোর প্রতি ঘৃন্য জমে গেছে। নিশান কিছুতেই এখানে থাকতে চাচ্ছিলো না, মোনা অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে রেখেছে। এ বাসাটা একদম নির্জন, সুনসান। মোনা ছোট বেলায় অন্ধকারে ভয় পেত খুব। রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতো, এখন আর সেই ভয় পাওয়া নেই। পরিস্থিতি পরিপক্ক করে তুলেছে মোনা কে, অভিজ্ঞ বানিয়ে দিয়েছে। মোনা জ্যাক কে নিয়ে ভাবছে, জ্যাকের বিষয়টা মোনা কে ভাবাচ্ছে। জ্যাক কেন এত আন্তরিকতা দেখাচ্ছে? এতটা আন্তরিক কোন মানুষ হতে পারে, তাও এই ভিনদেশে! কোন উদ্দেশ্যে আছে? এতদিনে কোন উদ্দেশ্যে খুঁজে পেলো না মোনা। কোণ কারণ ছাড়া কেন একজন মানুষ এত আন্তরিক আচরণ করবে? পৃথিবীটা বড্ড স্বার্থপর। স্বার্থ ছাড়া কেউই কিছু করতে চায় না। তবে জ্যাক কেন এর ব্যতিক্রম হবে? মোনা ভয়ে চুপসে থাকে,কেউ যদি এসে এখন ওর দরজায় টোকা দেয়? বা গভীর রাতে ঘুম ভাঙার পর কাউকে দেখে? মোনা আঁতকে উঠে। অজানা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। মোনা ছোট বেলায় একবার প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়েছিল মোনা, রাতে ঘুম ভাঙার পর জানালা ফাঁক দিয়ে ওঁদের বাসার সামনে ছোট একটা বাগান ছিলো সেখানে চোখ পড়ে। মোনার চোখে ভয়ঙ্কর এক চেহেরা পড়ে। মোনা চিৎকার দিয়ে উঠে। মোনার মা দৌড়ে এসে কত সূরা পড়ে যে ফুঁ দিয়েছে। সেই থেকে দিনের বেলাও বাগানের দিকে তাকাতো না মোনা। রাতে সব সময় জানালা বন্ধ করে ঘুমাতো। কি দিন ছিলো সেগুলো! বাসী বিবর্ণ অতীত মন্থর করছিলো মোনা। এত বছরের ব্যবধানে ঘটনাটা একবারও ম্লান হয়নি মোনার স্মৃতিতে। মায়ের মৃত্যুর দিনটাও যেন একটু মলিন হয়নি, চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কেমন অসহায়ের মত ছটফট করতে করতে চোখের সামনে মারা গেছে মানুষটা। সেদিনের পাওয়া আঘাত বুকের বাঁ পাশটাকে এখনো অবশ করে রেখেছে মোনার। মোনা ঘুমিয়ে যায়। সকালের সরু রোদ রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথে ঘুম কেটে যায়। কোন অসুবিধা হয়নি এ বাসায়,কোন ঝামেলায় পড়ে নি মোনা। মোনার ভয় কমে আসছে। মোনা তড়াক করে বিছানা ছাড়ে। ম্যাসেজের টিউন বাজে, জ্যাকের ম্যাসেজ-
-“হ্যাভ এ্যা নাইচ ডে।”
-“থ্যাংক্স। গুড মর্নিং। এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলেন?”
মোনা টেক্সট’টা করে ওয়াশরুমে যায়। মোনা আর নিশান’নের জন্য দুই মগ কফি নিয়ে আসে। মোনা নিজের কফি মগ হাতে নেয়, নিশান ঘুমোচ্ছে বলে ওঁর টা ফিরিয়ে যায়। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মোনা প্রিন্সেসের রুমে যায়। প্রিন্সেসের অভ্যাস একদম জ্যাকের মত, ঘুম ভাঙতে ভাঙতে দশটা-এগারোটা বেজে যায়। মোনা ওর পাশে বসে, ঝুঁকে পড়ে ওর গালে চুমু খায়। মোনা সিম কার্ড চেঞ্জ করে ফেলেছে, লিলি বেগম হয়ত বার বার ফোন দিচ্ছে।
লিলি বেগমের কান্না দেখে বিরক্তিতে লিলি বেগমের দিকে সরু চোখে তাকায় হাবিব সাহেব। হাবিব সাহেব কে অসহ্য লাগে আজকাল, আগের থেকে খুব বেশী অসহ্য। প্রিয়ম, এরিক আশেপাশে খুঁজেছে ওঁদের। কোথায়ও পায় নি।প্রিয়মের কপালে চিন্তার ভাঁজ।কোথায় যাবে ওঁরা? প্রিয়ম ওর ফোনটা হাতে নেয়। একটু পর পর ডায়েল করে মোনার ফোনে। মোনা’কে খুব মিস করছে প্রিয়ম,প্রিয়ম কখনো চায়নি ওঁরা বাসা থেকে চলে যাবে বা কিছু। প্রথম প্রথম থার্ড ক্লাস মেয়ে মনে হত মোনা কে, আস্তে আস্তে মোনা কে অসাধারণ মনে হয়েছে। মোনার রাগ, বিরক্ত হওয়া, প্রিয়মের অত্যাচারে অসহায় হওয়া চেহেরা প্রিয়ম’কে ভীষণ ভাবে শূন্যতায় ভোগাচ্ছে। মোনা’কে যেদিন জোর করে ক্লাবে নিয়ে যায় সেদিন কি অসহায় হয়ে উঠেছিল মোনার চেহেরা! মোনার এমন ঘাবড়ে যাওয়া চেহেরা দেখে মজা পেতো প্রিয়ম। ও’কে ঘাবড়াতে ভালো লাগত। প্রিয়ম ভাবছে কিভাবে ওঁদের খুঁজে পাওয়া যায়? ভার্সিটিতে যদি না পায়? নাকি মোনা বাংলাদেশে চলে গেছে? মোনার আতংকিত চেহেরা তাহলে আর দেখা হবে না। মোনা কে ভয় দেখিয়ে যদি বলত জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে, কেমন বাজে অবস্থা হত মোনার চোখে-মুখের।
মোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওয়ানা হচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে নিশানের জন্য। নিশান কি করে একা থাকবে? ও তো এ বাসার কারো সাথে কথা বলতে পারবে না,কেউ ওর ইশারার কথা বুঝবে না। কিছু প্রয়োজন হলেও চাইতে পারবে না। মোনা বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। মোনার রেডী শেষ হওয়ার আগেই একজন এসে জিজ্ঞেস করল,
-“ম্যাম কখন বের হবেন?”
-“একটু পর।”
মোনার মনে হচ্ছে ও এ বাসার রানী, সবাই ওর ভৃত্য। মোনা যা হুকুম করে মুহূর্তেই তা হাজির করে। বার বার জিজ্ঞেস করে কোন অসুবিধা হচ্ছে? মোনা জানে এগুলো সব জ্যাকের হুকুমে করছে। জ্যাকের কাছ থেকে মোনা এত কিছু আশা করেনি। মোনা চমকে যায় জ্যাকের কথা ভেবে,এত ভালো মানুষ কি আদৌ কেউ হয়। মোনা নিশানের কপালে চুমু খায়। রুমে চুপচাপ বসে থাকতে বলে।নিশান প্রচন্ড মন খারাপ করে মাথা ঝাঁকায়। চোখ ছলছল করে যেন কেঁদে ফেলবে। লিলি বেগমের কাছে থাকলে হয়ত এমন করত না, এখানে তো সব অপরিচিত।
-“দেখো না প্রিন্সেস কত ছোট,ও তো একা থাকে। তুমি তো ওর থেকে বড়। তুমি প্রিন্সেসের রুমে গিয়ে ও’কে কোলে নিবে। প্রিন্সেস কত কিউট দেখছ? তোমার মন ভালো লাগবে।”
মোনা বেড়িয়ে পড়ে। গাড়ি চলতে শুরু করল। মোনা ভাবছে জ্যাক না থাকলে কত অসুবিধায় পড়তে হত। হয়ত বাংলাদেশেই ফিরে যেতে হত।ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামলো, মোনার নার্ভাস লাগতে শুরু করল। গাড়ি থেকে বের হয়ে তাকিয়ে রইল ভার্সিটির দিকে উদাস মনে। এখানে কিভাবে খাপ খাওয়াবে নিজেকে? সব নতুন মুখ, এঁদের কাউকে আর কখনো দেখেনি। সবাই সবার মত আড্ডা দিচ্ছে, খাচ্ছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে। মোনা মন খারাপ করে এদিক- ওদিক তাকাতে লাগল। এত মানুষের ভিতরও নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। যে একা সে একাই, হাজার মানুষের ভীড়ের মাঝেও সে একা। ক্লাসেও কারো সাথে পরিচিত হতে পারলো না, চুপচাপ বসে রইলো। মোনার মত অনেকেই চুপচাপ বসে আছে, ওঁরা ও হয়ত অন্যদেশ থেকে এসেছে। কারো সাথেই পরিচিত হতে পারলো না। মানুষের সাথে মিশতে পারাও একটা গুন,যা মোনা রপ্ত করতে পারেনি। টিচার আসছে লেকচার দিচ্ছে আবার চলে যাচ্ছে। মোনার পড়া বুঝতে মোটামুটি সমস্যাই হচ্ছে। কয়েকটা বোরিং ঘন্টা কাটালো মোনা। মোনার মনে হচ্ছে এখানে ওঁর পড়া সম্ভব না। মোনার কান্না আসছে। ভার্সিটি ছুটি হওয়ার পর ফ্যাকাসে মুখে মোনা বেড়িয়ে পড়ে। মোনা সামনের দিকে তাকাতেই চমকে যায় প্রচন্ডভাবে। প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে! প্রিয়ম কি ও’কে খুঁজতে এসেছে? প্রিয়মের চোখাচোখি হতেই মোনা চোখ নামিয়ে নেয়। প্রিয়ম ঠোঁট প্রসস্থ করে মোনা’কে ডাকে। মোনা মাথা নিচু করে দাঁড়ায় প্রিয়মের সামনে। প্রিয়ম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ।
-“মোনা তুমি বাসা থেকে না বলে চলে এসেছো কেন?আরে কি আজব ব্যাপার? তুমি না বলে চলে এসেছো আর সব দোষ পড়ল আমার ঘাড়ে।”
প্রিয়ম মোনার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে উদগ্রীব হয়ে বলল,
-“এই মেয়ে তুমি এখানকার কি চিনো? কোথায় থাকো তুমি?কথা বলছ না কেন?”
মোনা সহজ গলায় বলল,
-“এখানে আমার এক ফ্রেন্ডের বড় বোন থাকে, উনারা আমায় একটা বাসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।”
-“কেন আমাদের বাসায় কি প্রবলেম ছিলো? তোমার কি কমন সেন্স নেই? তোমার জন্য বাসার সবাই টেনশন করবে তোমার এই চিন্তা মাথায় আসে নি?”
-“আপনাদের বাসায় অনেক প্রবলেম ছিলো। ওটা বাসা না, ওটা নরক। আর শুধু খালা টেনশন করবে আর কেউ না।”
প্রিয়ম রাগ মিশ্রিত গলায় বলে,
-“তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি এবনরমাল বিহেভ করছ?”
প্রিয়ম একটু থেমে বলে,
-“আচ্ছা মানছি আমি তোমার সাথে প্রথম দিকে অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি তো এখন তোমার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন আচরণ করছি না। তবুও কেন তুমি এমন করছ?”
-“আমার যেতে হবে।”
প্রিয়ম মোনার হাত চেপে ধরে। মোনা চোয়াল শক্ত করে বলে,
-“হাত ছাড়ুন। এখন আমি আপনাদের বাসায় থাকি না যে যা ইচ্ছে তাই করবেন। খালাকে গিয়ে বলবেন আমি ভালো আছি।”
-“মোনা তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ। তুমি বাসায় চলো।”
-“অপ্রসাঙ্গিক কথা বলেন না। আমি বাসা নিয়েছি।”
-“তোমার বাসার এড্রেস দেও,ফোন নম্বর দেও।”
মোনা এক জাটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। প্রিয়ম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মোনা কে সহজ-সরল ভেবেছিল খুব।
(চলবে)