মোনালিসা পর্ব ১১

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১১
লিলি বেগম রাগে কাঁপতে লাগল।‌ সব রাগ প্রিয়মের উপর। প্রিয়ম নির্বুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। প্রাণপণে বুঝানোর চেষ্টা করছে ও কিছু জানে না। লিলি বেগম প্রিয়মের কথা মানতে নারাজ।
-“ওঁরা কোথায় যাবে? ওঁদের কি করছিস তুই?”
-“আম্মু একটু বুঝার চেষ্টা করো আমি কিছু জানিনা। আমার সাথে সারাদিন চেঁচালেও আমি কি বলতে পারব?”
চেঁচামেচিতে এরিকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়লো। আজকাল একটার পর একটা দাঙ্গা লেগেই থাকে বাসায়। এরিক এসব নিয়ে কিছু বলে, মনে মনে তীব্র বিরক্ত হয়।
-“আম্মু কি হয়েছে?এত চিৎকার, চেঁচামেচি কিসের?”
-“নিশান আর মোনা কে কোথায়ও দেখছি না। তুই দেখেছিস ওঁদের?”
-“তুমি এত হাইপার হচ্ছো কেন? মোনাপু কি ছোট যে হারিয়ে যাবে? হয়ত কোথায়ও গেছে।”
লিলি বেগম চিন্তিত মুখে বলল,
-“না,না ওঁরা বাসা থেকে বের হয় না।”
-“রিল্যাক্স আম্মু। এতদিন বের হয়নি তাই বলে আজও বের হবে না? থিংক পজেটিভ।”
এরিকের কথাটা কিছুটা যুক্তিসংগত মনে হলো লিলি বেগমের কাছে। এরিক আবার বলল,
-“আমরা ঘুমিয়েছি তাই হয়ত ডাকে না। অপেক্ষা করো এসে যাবে ওঁরা।”
এরিকের দিকে প্রিয়ম হতাশ ভঙ্গিতে তাকালো। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“এই কথাটা আম্মুকে এতক্ষণ ধরে বুঝানোর চেষ্টা করছি কিন্তু আম্মু বলছে আমি নাকি ওঁদের খুন করে ফেলেছি।”
এরিক হেসে বলল,
-“ব্রাদার তুমি তো গুছিয়ে কথা বলতে পারো না।পেঁচিয়ে,ঘুরিয়ে কথা বলো, যা বুঝা আম্মুর পক্ষে দুষ্কর।”
প্রিয়মের সরল স্বীকারোক্তি,
-“এটা অবশ্য ঠিক।”
এরিক হাই তুলে বলল,
-“আমার ঘুমটা ভাঙলো অযথা।”
এরিক নিজের রুমে চলে যায়।অনেক রাতে ঘুমিয়েছে এরিক, চোখ জ্বলছে প্রদাহ হচ্ছে। রুমে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। লিলি বেগম চিন্তাগ্রস্থ চিত্তে বসে রইলো। প্রিয়ম ল্যাপটপ অন করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।
_____
মোনা আর নিশান রুমে অনেকক্ষণ যাবৎ বসে রইলো। বাসাটা একদম নিরব, কোলাহল মুক্ত। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও শুনা যায়। জ্যাক কোথায় গেল? ওঁদের রুমে একবারও আসলো না। জ্যাক কি বিরক্ত হয়েছে? জ্যাকের আচরণ দেখে মনে হয়নি যে বিরক্ত হয়েছে। আবার হতেও পারে, হয়ত প্রকাশ করছে না। নিশান ছটফট করছে, এ বাসায় থাকতে চাচ্ছে না। মোনার কাছে জিজ্ঞেস করছে এ বাসায় কেন আসছে। মোনা জবাব না দিয়ে উদাস মনে বসে রইলো। পৃথিবীতে কি ওঁদের মত নিঃসঙ্গ মানুষ আর আছে? হয়তোবা আছে, হয়তোবা নেই।
একটু পর জ্যাক আসলো। কোলে প্রিন্সেস। মোনা জ্যাক’কে দেখে দ্রুত উঠে বসলো। প্রিন্সেস হাসছে,বাচ্চাটার হাসি এত সুন্দর! এই মেয়েটা এত অতিমাত্রায় সুন্দর কেন? জ্যাক চেয়ার টেনে বসে বলল,
-“মোনালিসা আপনি কিন্তু প্রিন্সেসের কথা একবারও জিজ্ঞেস করেন নি।”
মোনা অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। বলল,
-“এক্সুয়াল্লি আমি খুব নার্ভাস ছিলাম।”
-“তা আপনায় দেখেই বুঝেছি।”
মোনা হাত বাড়িয়ে প্রিন্সেস’কে কোলে নিলো। মোনার কোলে এসে যেন উৎফুল্ল হয়ে পড়লো প্রিন্সেস, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে শুধু।জ্যাক নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আপনার ভাই কথা বলতে পারে না রাইট?”
-“হুম।”
প্রিন্সেস হাত-পা নাড়িয়ে দুষ্টুমি করছে। মোনার লম্বা চুল গুলো টানছে, কখনো গালে নখের আঁচড় বসিয়ে দিচ্ছে। মোনার মনে হচ্ছে ও একটা শিমুল তুলোর বালিশ জড়িয়ে রাখছে। বাচ্চাদের প্রতি অন্যরকম দুর্বলতা আছে মোনার। প্রিন্সেস যদি সুন্দর না হয়ে কালো কুচকুচে হলো তাহলে কি মোনা এত আদর করত?এত করে টানত মোনা কে? সুন্দর বাচ্চা দেখলে সবাই চুমু খায়, আদর করে। কালো বাচ্চাদের তো কেউ এত চুমু খায় না। আমরা যতই বলি সৌন্দর্য দিয়ে মানুষ বিচার করা যায় না, সৌন্দর্য মনের ব্যাপার কিন্তু দিন শেষে তো সুন্দর জিনিসটাই আমাদের টানে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! মোনা ছোট বেলা থেকে অসম্ভব সুন্দরী, মোনা কোথায়ও গেলে ওঁর সাথে সবাই ভাব জমানোর চেষ্টা করত। নানা ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করত। এমন কি কলেজ হাই স্কুল লাইফে একজন স্যার মোনা কে নাকি ভীষণ ভাবে পছন্দ করত। মোনার একটা কালো বান্ধবী ছিলো, কই ওর সাথে তো কেউ ভাব জমানোর চেষ্টা করত না। ওকে ইমপ্রেসড করার চেষ্টা করত না,কোন স্যারও তো ওকে পছন্দ করত না। কলেজ লাইফে আরেকজন স্যার ছিলো মোনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। মোনা পুরো শরীর টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ দিয়ে দেখত,অথচ উনার বউ ছিলো। বিচিত্র আমাদের পৃথিবী, বিচিত্র রকমের মানুষের বসবাস এখানে!
জ্যাকের ডাকে ধ্যান ভাঙল মোনার। মোনা অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো।
-“আপনায় চিন্তিত দেখাচ্ছে। আমি আপনায় হেল্প করবো। আপনি টেনশন ফ্রী থাকতে পারেন।”
মোনা হাসলো। জ্যাক বলল,
-“এবার বলুন আপনি কেন বার বার এত বিপদে পড়ছেন?”
মোনা এই বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু জ্যাক জোর করতে লাগলো। মোনা এক প্রকার বাধ্য হয়ে বলল‌।
-“আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।” নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“শুধু একটা ভাই আছে। মায়ের স্বপ্ন ছিলো আমি আমেরিকায় লেখাপড়া করবো। তাছাড়া আমার বাংলাদেশে কেউ নেই। আমেরিকায় এক আত্মীয়র বাসা, তাঁদের কাছে এসে উঠেছি। বিভিন্ন প্রবলেম হচ্ছিলো ওখানে আমার।”
-“আপনি চাইলে এখানে থাকতে পারেন।আর আপনার সম্পূর্ণ খরচ আমি বহন করবো। জবের কোন দরকার নেই।”
মোনা চুপ হয়ে রইল। কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে কেন থাকবে? মোনা চায় আত্মনির্ভরশীল হতে। ইতস্তত বোধ করে বলল,
-” প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড জ্যাক। ফার্স্টলি এখানে থাকতে পারবো না,সেকেন্ডলি আমার জব লাগবে। আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন জ্যাক। ভুলবো না আমি আপনায়।”
-” আত্মনির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী? দ্যাট’স লাইক এ্যা সুপারব লেডি।‌ আই রেসপেক্ট ইউর ডিসিশন।”
মোনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইলো জ্যাকের দিকে। কি চমৎকার একজন মানুষ!
-“আপনি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ।”
জ্যাক হেসে বলল,
-“আমি জানি। আপনার দুইদিন এখানে থাকতে হবে। আমি ব্যবসার কাজে ব্যারিংটনের বাইরে যাবো। দুইদিন পরে ফিরবো। তারপর আপনায় সবকিছু ম্যানেজ করে দিবো। দুইদিন থাকবেন এখানে?”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলল। জ্যাক বলল,
-“আমি একটু পরই বেরুবো। আপনাদের জন্য বাঙালি রেস্তোরাঁ থেকে খাবার এনে দিবে। কোন অসুবিধা হলে, যাস্ট কল মি।”
মোনা এবার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।অতি আনন্দে কেঁদে ফেলবে যেন। এত সব বুঝে এই মানুষটা? মোনা বলল,
-“প্রিন্সেস কে কি নিয়ে যাবেন?”
জ্যাক হেসে বলল,
-“ওকে নিয়ে ব্যবসার কাজে যাবো? ওর জন্য কেয়ারটেকার আছে।”
প্রিন্সেস মোনা বুকের মাঝে ঘুমিয়ে পড়লো।জ্যাক বলল,
-“আমার এক্ষুনি যেতে হবে।”
-“প্রিন্সেস কে আমার কাছে রাখবো?”
-“রাখুন।”
জ্যাক যাওয়ার আগে প্রিন্সেস কে কোলে নিয়ে পুরো মুখে চুমু খেলো। বুকের মাঝে পরম আদরে জড়িয়ে রাখলো। জ্যাক বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। মোনা প্রিন্সেস’কে ওর পাশে শুইয়ে রাখলো।
___
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। লিলি বেগম আর স্থির থাকতে পারলো না। লিলি বেগম আবার ছুটে মোনার রুমে গেলো। মোনার ব্যাগ, লাগেজ কিছু নেই‌। লিলি বেগমের বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠল। কিছুক্ষণ আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, প্রিয়মের রুমে গেলো। হন্তদন্ত হয়ে বলল,
-“আমি ওঁদের কে এ বাসা থেকে পাঠিয়ে দিবো। একবার বল মোনা কোথায়?”
এবার প্রিয়মও চমকে গেলো। চমকিত গলায় বলল,
-“বলো কি! ওঁরা তাহলে কোথায় যাবে?”
লিলি বেগম অসহায় গলায় বলল,
-“তুই সত্যি জানিস না?”
লিলি বেগম এবার আতঙ্ক,ত্রাসিত হয়ে কেঁদে ফেলে।লিলি বেগমের কান্নার শব্দ পেয়ে এরিক,হাবিব সাহেব দুইজনই আসলো। লিলি বেগম এরিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মোনার ব্যাগ ,লাগেজ কিছুই নেই রুমে।”
-“বলো কি? ওঁরা কোথায় যাবে?”
হাবিব সাহেব বিরক্ত হয়ে বলল,
-“দেখো কোন ছেলের সাথে ভেগেছে।”
লিলি বেগম রাগে চিৎকার করে উঠল। হাবিব সাহেব দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলল,
-“দেখো আমাদের টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়েছে কিনা? তোমার গহনা-গাটি সব আছে?”
লিলি বেগম শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো হাবিব সাহেব সাথে। হতবাক হয়ে গেলো হাবিব সাহেবের কথা শুনে। প্রিয়ম বলল,
-“বাবা তুমি কি সব বলছ? এবনরমাল হয়ে যাচ্ছো তুমি দিন দিন।”
-” আমি ঠিক বলছি। ওঁরা জাত ছোটলোক।”
এরিক বিরক্ত হয়ে তাকালো হাবিব সাহেবের দিকে। বলল,
-“ওঁদের তোমায় ভালোলাগে না তা বলতে পারো। এর জন্য এসব বলবে?”
হাবিব সাহেব চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,
-“মা-ছেলেরা তো দেখছি সব এক জোট হয়েছে।” হাবিব সাহেব প্রিয়ম আর এরিকের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
-“তোদের দুইজনের মাথা খেয়েছে ওই মেয়ে?এত দরদ উথলে উঠছে?”
কারো কথার দিকে খেয়াল নেই লিলি বেগমের। নানান আশঙ্কায় চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লো। মোনার এভাবে চলে যাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। এখানকার কিছুই চিনে না মোনা।মোনা নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে।নয়ত ব্যাগ,লাগেজ রুমেই থাকত।হাবিব সাহেব বিকালের দিকে বাসা থেকে বের হলো। প্রিয়ম কে চিন্তিত দেখাচ্ছে। মোনা আর নিশানের বিষয়টা ভাবাচ্ছে।প্রিয়ম লিলি বেগমের রুমে গেলো।
-“আম্মু মোনার ফোন নম্বর নেই তোমার কাছে?”
চোখ মুছে লিলি বেগম বলল,
-“আছে কিন্তু বন্ধ।”
লিলি বেগমের রাগ একটু পর ক্ষোভে পরিণত হলো যেন। ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
-“তোরা তো এটাই চেয়েছিলি না? এবার খুশি?”
-“আম্মু তুমি রিল্যাক্স হও। আমি কালকে মোনার ভার্সিটি তে যাবো। আমি ওঁদের খুঁজে বের করবোই। ওঁরা হঠাৎ এমন কেন করল বুঝতে পারছি না।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here