মোনালিসা পর্ব ১৬

মোনালিসা
লেখা- ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৬
মোনা ক্লাসে গিয়ে গম্ভীর মুখো হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর শ্রুতি এসে বেশ শব্দ করে বসে মোনার পাশে। উদগ্রীব হয়ে বলে,
-“মোনালিসা এমনটা করলে কেন? ওভাবে চলে আসলে কেন? ঝগড়া হয়েছে তোমাদের মাঝে?”
-“আহা শ্রুতি আমার কথা বিশ্বাস করো, ছেলেটা আমার কাজিন। অন্য কোন সম্পর্ক নেই।”
মোনার কথা যেন শ্রুতির কান অবধি পৌঁছে না। শ্রুতি উৎফুল্ল হয়ে বলে,
-“ছেলেটার ব্লু আই,কি হ্যান্ডসাম,কি লুক! কাজিন হলে কি?তোমায় লাইক করে, বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নেও।”
মোনা অহেতুক কথা বাড়ালো না। শ্রুতি কোন কথাই বুঝার চেষ্টা করবে না। নিজের মত বলেই যাবে, নিজের মত বুঝেই যাবে।
-“মোনালিসা, নীল রঙা চোখের ছেলে! কত মেয়েরা পাগল। আর তুমি কিনা পাত্তা দিচ্ছো। অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি!”
-” শ্রুতি প্লীজ স্টপ। আমার মাথা ধরেছে। সমীর ও’র থেকেও সুন্দর।”
শ্রুতি আহত গলায় বলল,
-“সমীর হ্যান্ডসাম ঠিক আছে। কিন্তু চোখ তো নীল না।”
মোনালিসা উত্তর দিলো না। কিন্তু শ্রুতি তাতে মোটেও দমলো না। বলল,
-“প্রেম’টা হয়ে গেলে আমাকে আর সমীর’কে ট্রিট দিতে হবে কিন্তু।”
মোনা আপাতত এসব প্যাঁচাল থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসি টেনে শ্রুতির দিকে এগিয়ে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলল,
-“প্রেম হলে তোমাদের ট্রিট দিবো, চারজন মিলে লং ড্রাইভে যাবো। সারারাত ঘুরবো, পুরো আমেরিকা ঘুরে বেড়াবো। রোমাঞ্চকর না ব্যাপার’টা?”
শ্রুতি দ্বিগুণ আনন্দিত হয়ে মোনা’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“উফ মোনালিসা! কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আমি ভাবতেই পারছি না। কিন্তু আমেরিকা তো অনেক বড়, পুরোটা ঘুরবো কিভাবে?”
এর ভিতর ক্লাসে স্যার আসে। মোনা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ক্লাস শেষে আজ থেকে জব। নতুন চাকরি, মোনার এ বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা নেই। জ্যাক অনেক ভালো ভালো জবের অফার করেছে। কিন্তু মোনা রাজি হয়নি। কোন এক্সপেরিয়েন্স নেই, এডুকেশনাল স্কিল বলতে শুধু এইচএসসি পাস। জ্যাকের সুপারিশ চাকরি হতো কিন্তু পরে তো ঝামেলায় পড়তে হতো।
মোনা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসার পর দেখলো প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। মোনা ভেবেছিল প্রিয়ম এগিয়ে আসবে কথা বলতে। কিন্তু না, আসে নি। দূর থেকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়মের সাথে ওর দুই’টা বন্ধুও আছে। প্রিয়মের উদ্দেশ্য কি? মোনা বুঝতে পারছে না। এখানকার ওপেন মাইন্ডেড মেয়েদের রেখে হঠাৎ মোনার প্রতি আকৃষ্ট হলো কেন? মোনা অবচেতন মনে এসব ভাবছে। প্রিয়ম কে যতই অবজ্ঞা করুক না কেন মাঝে মাঝে প্রিয়মের বিষয়টা খুব ভাবায়।
মোনা যেতেই একটা ছেলে এগিয়ে আসলো। ছেলেটার নাম লরি। আমেরিকা এসেছে লেখাপড়া করতে। লরিও পার্ট টাইম জব করে। সেই সুবাধেই লরি মোনার প্রতি একটু বেশি যত্নশীল হলো। সব কাজ বুঝিয়ে দিলো। ছেলেটা অনার্গল হিন্দি বলছে। মোনা বলল,
-“আমি হিন্দি বুঝি না।”
ছেলেটা হাসলো। ইংরেজি তে বলল,
-“এতক্ষণ যা বললাম সব বৃথা তাহলে?”
মোনা কাজের প্রতি মনোযোগী হলো। লরি আর মোনা এক ভার্সিটিই পড়ে। লরি দুই ব্যাচ সিনিয়র। এখানকার সবার চেহারা মোনার একই রকম মনে হয়, মোনা মনে রাখতে পারেনা। মোনার শুধু মনে হয় জ্যাকের চেহেরা একটু অন্যরকম। বাঙালিদের চেহেরায় আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, এখানকার মানুষের চেহেরায় কোন আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পায়না মোনা। এক ধাঁচের চেহেরা মনে হয়।
মোনার বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়।নিশানের জন্য মনের মধ্যে সব সময় দুশ্চিন্তা বিরাজ করে। এখন নিজের হাতে খাওয়া শিখছে নিশান, খাবার প্লেটের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। মোনার শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে খুব। নিশান মোনা’কে দেখে অভিমানে গাল ফুলিয়ে থাকে। নিশানের বড় বড় চোখ দুটো’তে হালকা লালচেভাব ফুটে উঠে। মোনা রাগি স্বরে বলে,
-“নিশান তুমি আবার কেঁদেছো? বলেছি না কাঁদলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবো।”
নিশানের কান্না বেড়িয়ে আসতে চায়। নিশান জোরপূর্বক কান্না থামাতে চাওয়ার ফলে ঠোঁট দুটো কাঁপছে, দিঘির অতল জলে মৃদু হিমেল হাওয়া লাগলে যেরকম ভাবে কাঁপে ঠিক সেরকমই। মোনা নিশানের গালে, কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-“তোকে সারাজীবন আমার কাছে রাখবো, আমার শ্বশুর বাড়ি তোকে নিয়ে যাবো। কান্নাকাটি বন্ধ কর এখন,খুশি?”
নিশানের চোখ বেয়ে অবাধ্য দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিশানের এই কষ্ট ভীষণভাবে যন্ত্রনা দেয় মোনা’কে। নিজের যন্ত্রনার বহিঃপ্রকাশ মোনা করে না। নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“আচ্ছা নিশান চল, আমরা দুই জনে মিলে কেক বানাই।”
নিশানের কান্না অবশেষে থামলো। ফ্যাকাশে মুখ’টা তে উজ্জ্বলতার ছাপ দেখা দিলো। এই ক্লান্ত শরীরে মোনার মোটেও ইচ্ছে করছে না কিচেনে যেতে, তবুও নিশানের মন ভালো করতে যেতে হবে।
মোনা কিচেন থেকে এসে বিশ্রাম নেয়। তারপর বই নিয়ে বসে। বইয়ের ভিতর থেকে একটা রঙিন চিঠির খাম বের হয়। মোনা ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকায়। খামের ভিতর থেকে চিঠি’টা বের করে।
কৃষ্ণকলি,
তোর কুচকুচে কালো গায়ের রঙে আমি শুভ্রতা খুঁজে পাই। কে বলেছে তোকে কালো? তোর পুরো শরীর’টা কাজল রাঙা, কাজলে কি কোন মেয়ে’কে অসুন্দর লাগে বল? তোর কালো চোখের পাতায় গাঢ় করে দেওয়া কাজল আমি সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করবো। তোর কাজল রাঙা কপালে দেওয়া কালো টিপ আমি আমার নিখুঁত ভালোবাসার নিপুণ চাহনি দিয়ে অন্বেষণ করবো।হৃদয়ের সূর্য মন্দিরের দেবী তুই, মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমার তোর পূজা দিবো। তোর গায়ের রং নিয়ে তো অভিযোগ নেই। তোর কালো রংটা কে ই আমি ভালোবেসেছি। তুই কেন অযথা‌ মন খারাপ করিস?তোর মন খারাপে আকাশের চাঁদটা ম্লান হয়ে যায়, তুই দেখিস?তোর কান্নায় গগণের নক্ষত্র গুলো খসে পড়ে যেন। আমার কলিগরা তোকে নিয়ে উপহাস করেছে,আমি ওঁদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। লোকের কথা কানে নিয়ে আমাদের সম্পর্কে আমরা কেন সমস্যা টেনে আনবো? তুই ফোন অফ করে রেখেছিস, কোন যোগাযোগ করছিস না। শ্রুতি আমি কিন্তু দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। আমি মারা গেলে সে দায়ভার কে নিবে?
(সমীর)
মোনার চিঠিটা পড়া শেষ হতেই শ্রুতি ফোন দিয়ে উতলা গলায় বলল,
-“এই মোনালিসা, আমার একটা বই বোধ হয় ভুলে তোমার কাছে নিয়ে চলে গেছে। বই’টা যেভাবে আছে, ওভাবেই রেখে দেও।”
মোনা অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
-“হ্যাঁ এসেছে তো।”
উৎকণ্ঠিত হয়ে শ্রুতি বলল,
-“প্লীজ বইটা খুলো না।”
-“আচ্ছা।”
মোনা ফোন রেখে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেই লজ্জিত হয়। কারো চিঠি পড়া উচিত না, একদম অনুচিত কাজ। মোনা বুঝতে পারেনি এটা শ্রুতির বই। ও’র বইয়ের ভিতর চিঠি,এই ভেবে পড়তে শুরু করেছে। পড়া শেষে বুঝলো এটা শ্রুতি’কে দেওয়া সমীরের চিঠি। চিঠি’টা এতই মোহনীয় মনে হয়েছে মোনা পুরো’টা পড়ে ফেললো। মোনা চিঠি’টা যত্ন করে ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে যেভাবে ছিলো সেভাবেই রেখে দিলো। মোনার শরীর জুড়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতি উপলব্ধি হচ্ছে। কত আবেগ, অনুভূতি মিশ্রিত চিঠি।

মোনা সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনকার অভ্যাস মতো আড়মোড়া ভেঙ্গে বসলো। তারপর এলোমেলো হয়ে থাকা চুল গুলো গোছানোর চেষ্টা করল। চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, চোখ বুঁজেই বালিশের কাছে রাখা ফোনটা খুঁজলো। মোনা তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ল। কিচেনে রাখা থালা দুটো ধুয়ে, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা বানালো। কলিং বেল বাজছে, মোনা নিশান’কে দরজা খুলতে বলল। মোনা রান্নাঘর থেকে প্রিন্সের মৃদু চিৎকারের শব্দ পেলো। মোনা দ্রুত পায়ে রুমে এসে উৎফুল্ল হয়ে বলল,
-“প্রিন্সেস।”
প্রিন্সেস জ্যাকের কোল থেকে মোনার কোলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। মোনা বলে,
-“ওয়েট, ওয়েট হাত ধুয়ে আসছি।”
হাত ধুয়ে এসে মোনা প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে জ্যাক’কে বসতে বলে। মোনা প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়েই কফি তৈরি করে। মোনার প্রিন্সেস’কে অসম্ভব রকমের ভালোলাগে। কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর জ্যাক বলে,
-“মোনালিসা আপনার তো ভার্সিটি তে যেতে হবে,আমরা উঠি।”
জ্যাক কৌতুক করে আবার বলল,
-“নাকি প্রিন্সেস’কে নিয়ে যাবেন ভার্সিটি তে?”
মোনা হাসলো। জ্যাকের চোখ গেলো দেয়ালের দিকে। মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আর্টও পারেন দেখছি।”
-“না আমি আর্ট পারিনা,ওসব আমায় দিয়ে হয়না। নিশান এঁকেছে।”
জ্যাক চমকে গিয়ে বলল,
-“ও মাই গড! রিয়েলি? আমরা একটা আর্ট স্কুল আছে ছোটখাট। আমার স্ত্রী আঁকতে পছন্দ করত। ওঁর সেই প্রবল আগ্রহ থেকেই স্কুল’টা খোলা হয়েছে। আপনার ভাই’কে সেখানে ভর্তি করিয়ে দিই? এইটুকু ছোট বয়সে এত ভালো আঁকে!”
মোনা মাথা নাড়ালো। মোনা ওইদিন ভেবেছিল স্কুলে ভর্তি করানোর কথা। মোনা যা ভাবে তা ই যেন জ্যাকের মাধ্যমে ম্যানেজ হয়ে যায়। মিরাকেল!
মোনা কে জ্যাক ভার্সিটি তে পৌঁছে দেয়। মোনা ভার্সিটিতেই যেতেই শ্রুতি বলে,
-“এই মোনালিসা আমার বই দেও তাড়াতাড়ি।”
মোনা বইটা দিলো। চিঠি’টা পড়ার কারণে মোনার এখন অপরাধ বোধ হচ্ছে। শ্রুতি বইটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলো চিঠি’টা আছে কিনা।
-“মোনা আজ আমি ক্লাস করব না। সমীরের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি, ও’কে একটু টাইম দিতে হবে।”
-“হোয়াট? মাথা ফাটিয়ে দিয়েছো?”
শ্রুতি অপরাধ বোধ করছে যেন। অনুতপ্তের সুরে বলে,
-“আর বলো না, আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনা কিছুতেই। একদম আউট অফ কন্ট্রোল। আমার সাথে একটু ঝগড়া হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে বলতে আমিই ঝগড়া করেছি। এক পর্যায়ে অনেক রেগে ওর কপালের উপর ফোন ছুঁড়ে ফেলি।”
মোনা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল শ্রুতির দিকে। শ্রুতি চলে গেলো। শ্রুতি হয়ত এই বইটার জন্যই এসেছে। ভার্সিটিতে কথা বলার মত একজন মানুষ হলো, তাও এবনরমাল। আজ আবার একা হয়ে গেলো মোনা।
ভার্সিটি শেষে কাজে গিয়েছে । পার্ট টাইম জব, ঘন্টা হিসেবে বলার। আজ লরা আসেনি। তাই নিয়ে মালিক খুব রেগে আছে। মোনা কাজ শেষে প্রতিদিনের মত ক্লান্ত বাসায় ফিরে।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ বাসায় ফিরেই দেখবে নিশান কেঁদে চোখ ফুলিয়ে আছে। ক্লান্ত ভর করা শরীর নিয়ে কিছু একটা করে নিশানের মন ভালো করতে হবে। মোনা বাসায় ফিরতেই নিশান ওর হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দেয়। মোনা নিশানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, নিশান ইশারায় কার্ড খুলে দেখতে বলে। প্রিয়মের বার্থ ডে কার্ড। মোনা নাক মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-“কে দিয়ে গেছে খালা?”
নিশান মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে।
-” প্রিয়ম ভাই এসেছিল?”
নিশান ঘাড় বাঁকিয়ে না বলে। মোনা কার্ড’টা রেখে দেয়। মোনা আজকাল একটা বিষয় খেয়াল করেছে, প্রিয়ম মোনার দিকে দূর থেকে তাকিয়ে থাকে। মোনার সামনে এসে কথা বলে না। আবার আগের মত বাসায়ও আসে না।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here