#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৮
২২.
বিশাল দুইতালা বাড়ি। পুরানো দিনের হলেও নতুন করে রং করা হয়েছে। দুইপাশে সবুজ ধানক্ষেত। বাড়ির সামনে হরেকরকম গাছপালা। পিছনে কলাগাছের স্তুপ। এই বাড়িটা সারা ফরিদপুরে ব্যারিষ্টার বাড়ি নামে পরিচিত। নাজমুল সাহেবের বাবা আলতাফ ছিলেন নামকরা ব্যারিষ্টার। বড় গেটটা খুলে দেওয়া হয়েছে। নিভৃত নিজের সাদা রঙা মার্সিডিজটা নিয়ে গেটের ভিতরে ঢুকছে। সে ফরিদপুর এসেছে খুব কম। বড়হয়ে বুঝ হওয়ার পর পড়াশোনার চাপে একদমই আসা হতোনা । শেষ একবার এসেছিলো বছর দুয়েক আগে। বিয়ের পর রুহানিকে নিয়ে। তারপর মায়ের কথায় দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে আর আজ এলো।
এই বাড়িতে থাকেন নিভৃতের বড়চাচি সুমনা। আর উনার চার ছেলেমেয়ে। বড়ছেলে, ছোটছেলের বউ। তাদের সন্তানাদি। নাজমুলের বিধবা বড় বোনও এই বাড়িতে থাকেন। নিভৃতের বড়চাচা ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন। এছাড়াও পাশে টিনের লম্বা করে ঘর তুলা। সেখানে বাড়ির কাজের লোকেরা থাকে। বিস্তর জমিজমা হওয়ায় সারাবছরই জমিতে ধান, পাট, সবজি চাষ করা হয়। সুমনার ছেলেরা এসব খেয়াল রাখে। তাই এই বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই।
মৌন এই বাড়িতে অনেকবার এসেছে। এই বাড়ির প্রতিটা কোণাই তার চেনা। ছোটবেলা থেকেই আসছে এই বাড়িতে। তবে আজ সে এই বাড়িতে প্রবেশ করবে এই বাড়ির ছোট ছেলের বউ হয়ে। যা মৌনর কল্পনাতীত। তারমতো নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এতোবড় বাড়ির বউ হবে তা অনেকটা অমাবস্যার চাঁদের মতোই ঘটনা।
বাড়ির সামনের বিশাল উঠানটায় একপাশে ধান শুকাতে দেওয়া হয়েছে। পাশে ছোটএকটা ডোবা আছে সেখানে হাঁসের দল খেলা করছে। ডোবাটার পাশে কয়েকটা আনারস গাছ লাগানো। দেখতে বেশ লাগে মৌনর। গাড়ি কখন থেমে গেছে মৌন খেয়ালই করেনি। নিভৃত তাকে রেখেই বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌন একধ্যানে আনারস গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর! দেখতে অনেকটা সবুজ বড় ফুলের মতো লাগে। ধারালো ফুল। নিভৃত মেয়েটাকে বের হতে না দেখে বলে উঠে,
‘এই মেয়ে!’
অতঃপর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে বাড়ির প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যায়। ধ্যান ভাঙে মৌনর। লালরঙা শাড়িটার আঁচলটা টেনে মাথায় দেয় সে। গাড়ি থেকে নামতেই দিথি, মিথি দৌঁড়ে আসে। তারা নিভৃতের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। জমজ দুইটা। মৌনকে অনেক পছন্দ করে তারা। কাঁদা দিয়ে রান্নাবান্না খেলছিল । আর কাঁদা নিয়েই জড়িয়ে ধরে মৌনকে।
‘আয়হায় মেয়ে দুইটা করছে কি দেখছো! এই সর তোরা। মৌনরে তো কাঁদা দিয়ে মাখামাখি করে ফেলছোত!’
২৩.
বলতে বলতে এগিয়ে আসেন রুমি। মৌন তাকে বড় ভাবি ডাকে। মাকে এগিয়ে আসতে দেখে দুজনেই দৌঁড় দিয়েছে।
‘তুই আয়তো মৌন। মেয়ে দুইটা তোর শাড়িটা নষ্ট করে দিলো।’
মৌন হাসিমুখে বলে, ‘সমস্যা নেই বড় ভাবি।’
রুমি তাকিয়ে দেখেন ছোটমেয়েটাকে। এই তো সেদিনও খেলতে আসতো আরু,নিরুর সাথে। আর আজ লাল শাড়ি পরে বউ সেজে এসেছে।
‘আয় ঘরে আয়। ছোটমা, ছোটবাবা তো কখন এসে পড়ছে।’
দুজনে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলো। বিশাল বড় বৈঠকখানার মতো ঘর। সেগুন কাঠের সোফা, টেবিল, পুরানো দিনের ২১ ইঞ্চি টিভি, দূরে বিশজন বসার মতো বিস্তৃত ডাইনিং টেবিল। নানারকম পুরানো শো পিস।
সোফায় বসে নাজমুল, মিরা, সুমনা, নাজমুলের বড়বোন নাজমা কথা বলছে। মৌনকে দেখে মিরা বললো,
‘কাঁদায় মাখামাখি হলি কিভাবে মৌন?’
মৌন জবাব দেওয়ার আগে রুমি বললো,
‘আরে তোমার দুষ্টু দুই নাতনির কারবার ছোটমা।’
মিরা হাসিমুখে বললেন,
‘আচ্ছা, মৌন ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’
‘আচ্ছা, মা।’
মৌন এবাড়িতে অনেকবার আসলেও দুতালায় গিয়েছে কেবল হাতেগুনা কয়েকবার। নিভৃতের ঘরে দুয়েকবার উঁকি দিয়েছিলো। তবে কখনো যাওয়া হয়ে উঠেনি। মৌনর খুব ইচ্ছেছিলো এই ঘরে ঢুকার। তবে এইবাড়ির ছোটছেলের ঘরে প্রবেশ নিষেধ ছিল। তাই ভিতরে যাওয়া হয়ে উঠেনি। ভাগ্যের কি খেলা! আজ সে সেই ছোটছেলের বউ হয়ে অধিকার নিয়ে ঘরে ঢুকছে।
রুমি দরজার বাইরে এসে থামলো। মুচকি হেসে বললো,
‘তাহলে তুই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।’
‘ঠিক আছে। বড়ভাবি।’
______________
নিভৃত সবেমাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে কেবল টাউজার। খাটে বসে সে তার চুলগুলো মুছে যাচ্ছে। এমন সময় ভিতরে ঢুকে মৌন। নিভৃতকে খালি গায়ে দেখে লজ্জা পায় সে। লজ্জায় তার হলদে গাল লাল রং ধারণ করেছে। নিভৃত বিরক্তি নিয়ে তাকায়। ধমকে বলে,
‘এই মেয়ে কারো ঘরে প্রবেশ করলে নক করে আসতে হয় সেই শিক্ষা পাওনি?’
‘দেখুন এটা আমারও ঘর।’
‘কি! তুমি এখানেও আমার সাথে থাকবে? এই মেয়ে তুমি এতো বেহায়া!’
‘আপনার কাছে অনুরোধ এখানে অন্তত এভাবে চেঁচামেচি করবেন না। বাড়ির সবাই খারাপ ভাববে।’
‘দেখো তুমি একদম কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেনা। বের হও ঘর থেকে।’
নিভৃতের গলা উঁচিয়ে বলা কথাটা অনেকেই শুনেছে। অপমানিতবোধ করে মৌন। তবুও কিছু বলেনা। এখান সে ক্লান্ত। ঝগড়া করার ইচ্ছে তার নেই।
‘আপনার যত ইচ্ছে আপনি চেঁচান। আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।’
মেয়েটার সাহস দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নিভৃত। এই মেয়ে এতো সাহস পায় কোথায়! নয়ন মিয়া মৌনর ব্যাগটা বাইরে রেখে গেছে। রুমি হয়তো নিচে গিয়েই নয়নকে পাঠিয়েছিলো।
মৌন একটা শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিভৃত যারপরনাই অবাক।
২৪.
‘মিরা তুমি মৌনর মাঝে কি পেলে আমি বুঝিনা। কত ভালো ভালো মেয়ে ছিলো। আমাদের নিভৃতের নখের সমানও তো মৌন না।’
নাজমার কথায় চা খাওয়া থামিয়ে স্বামীর দিকে তাকান মিরা। নাজমুল ব্যাপারটা বুঝে বলেন,
‘বড়আপা মৌন মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো।’
‘মেয়ে ভালো সে তো আমরাও জানি। ছোট থেকেই তো এই বাড়িতে আসছে। আরু, নিরুর সাথে খেলে বড় হয়েছে। তবে সামান্য প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মেয়েকে বউ করে ঘরে তুললি! আমি একজন এডভোকেট ছিলাম, বড় ভাই হাইস্কুলের হেডমাস্টার, তুই এতো বড় ইন্জিনিয়ার। আমাদের সাথে ওদের যায়!’
‘থাক না বড়আপা। আমরা তো শুধু এমন কাউকে চেয়েছিলাম যে আমাদের ছেলেকে ভালো রাখবে। রুহানি মারা যাওয়ার পর থেকে ছেলেটা জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে।’
‘তা ঠিক। তবে কোথায় রুহানি আর কোথায় মৌন! আকাশ-পাতাল তফাৎ। তা নিভৃতের মাঝে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?’
‘আস্তে আস্তে হচ্ছে বড়আপা। যতযাই হোক এতো সহজে তো আর রুহানিকে ভুলবেনা সে।’
‘তোদের ছেলে তোরাই ভালো বুঝিস।’
নাজমুল এবিষয়ে আর কথা বাড়ালেন না। মৌন শুনলে কষ্ট পাবে। তার বড়আপা সবসময় এভাবেই কথা বলেন। তিনি বাস্তববাদী।
___________________
‘আহা, বাবুইপাখি ছাড়ো। কেউ চলে আসবে।’
‘কেউ আসবেনা। নিভৃতের ঘরে অনুমতি ছাড়া কেউই আসেনা। তারউপর নতুন বিবাহিত দম্পতিকে কোন পাগলে ডিসটার্ব করতে আসবে।’
রুহানি খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
‘তা নিভৃত মহাশয় এখন কি চায়?’
‘জাস্ট এ্যা কিস্।’
‘বাবুইপাখি! কিসব লাগামছাড়া কথাবার্তা!’
নিভৃত রুহানির ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললো,
‘তোমার জন্য আমি আরো বেহায়া, বেশরম হতে পারি জান।’
শিউরে উঠলো রুহানি। তখনই ঘরে ঢুকেছে আরু,নিরু। রুহানি, নিভৃত দুইজন ছিটকে দু’দিকে সরে যায়। রুহানি লজ্জা পেয়ে দৌঁড়ে চলে যায় বারান্দায়। নিভৃত বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বলে,
‘কি চাই তোমাদের?’
‘ছোট ভাইয়া তোমাদের ছোটমা ডাকে।’
‘আসছি, যাও।’
আরু, নিরু চলে আসে। বেচারিরাও লজ্জা পেয়েছে। নিভৃত দৌঁড়ে যায় বারান্দায়। আকাশে পুর্নিমার চাঁদ উঠেছে। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে।
‘জান।’
‘তুমি আমার সাথে কথা বলবেনা বাবুইপাখি। তোমার জন্য আজ লজ্জা পেলাম।’
‘আমার যে তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে দম বন্ধ লাগবে! তুমি কি চাও তোমার বাবুইপাখি শ্বাস নিতে না পেরে কষ্ট পাক।’
রুহানি জড়িয়ে ধরে নিভৃতকে। বুকে মুখ গুঁজে বলে,
‘উঁহু।’
‘তাহলে দাও।’
‘কি দিবো?’
‘জাস্ট এ্যা কিস্।’
‘ইস্, বাবুইপাখি তুমিও…..
আর বলতে পারলোনা রুহানি তার ঠোঁট এখন অন্যকারো দখলে।
রুহানি সামনে দাঁড়িয়ে। পিছনে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে নিভৃত।
‘বাবুইপাখি?’
‘হুম?’
‘আমি যদি কখনো মরে যাই। তুমি কি আমায় মনে রাখবে?’
‘রুহানি!’
নিভৃত গর্জন করে উঠে। রাগে ভিতরে চলে যায় সে। রুহানি গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। নিভৃত ভগ্ন স্বরে বলে,
‘আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাববেনা তুমি।’
‘আমি আমার বাবুইপাখিকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারি!’
কে জানতো রুহানির কথাটাই সত্যিই হবে!
#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৯
২৫.
‘নিভৃত তুমি মৌনকে নিয়ে ওঁর বাড়িতে দিয়ে আসো।’
‘বাবা, তোমার কথায় ফরিদপুর এসেছি। এসব আমি পারবোনা।’
বিরক্ত কন্ঠে বলে নিভৃত। নাজমুল রহমান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেন,
‘আজ দিয়ে আসো। পরে আর যাওয়া লাগবেনা।’
‘আচ্ছা।’
_________________
বিকেলবেলা। আরু,নিরুর সাথে বড় জামগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছে মৌন। পাশে রুমি লাউগাছ থেকে পাতা ছিঁড়ছে। ছোটমার জন্য লাউপাতা ভর্তা করবে। দিথি, মিথি পাশেই দঁড়িলাফ খেলছে। এবার সাতবছরে পড়লো দুইটা। এতো দুরন্ত!
আরু হাসিমুখে বললো,
‘কিরে ভ্যাবলি কপাল লেগেছে তোর। এতো সুন্দর বর পেয়েছিস। আমাদের তো বিয়ের পর একটা ফোনও করলিনা।’
মৌন মলিন হেসে বললো,
‘হ্যাঁ রে খুব কপাল লেগেছে। একেবারে সোনায় সোহাগা।’
সে যে কতটা কষ্টে আছে তাদের কি করে বুঝাবে। একটা মেয়ে জীবনে সবচেয়ে বেশি চায় স্বামীর আদর, সোহাগ, ভালোবাসা। টাকা, পয়সার ঊর্ধ্বে এক টুকরো ভালোবাসা। মৌনর তো এই আসল জিনিসটাই নেই। আদোও কখনো পাবে কিনা সন্দেহ। সব জেনে শুনেই তো সে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। বাকিটা কি হয় সময়ই বলবে।
নিরু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মৌনর মতো মেয়ে যে এতো বড় ঘরের বউ হবে তা এখনো অবিশ্বাস্য লাগে নিরুর। যদিও ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে মৌন। তবুও এই মেয়ের এতো রাজকপাল! রুমি লাউপাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে,
‘কেন গো মৌন! আমাদের নিভৃতকে স্বামী করে পাওয়া সোনায় সোহাগা না?’
‘সেটাই তো বললাম বড়ভাবি।’
রুমির ডাক পড়ায় সে চলে যায়। নিরু জামগাছটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
‘রুহানি ভাবি ছিলো ছোটভাইয়ার যোগ্য স্ত্রী। যেমন সুন্দর তেমন গুণ। গানে শুনেছিলাম জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল। তার উপর রুহানি ভাবির বাবা বড় ব্যবসায়ী। ভাগ্য কত নির্মম। এক হয়েও তারা এক হলোনা। মাঝখানে তোর কপাল লাগলো।’
নিরুর মুখের কথা প্রচুর গাঁয়ে লাগে মৌনর। তবে সে কিছু বলেনা। এই বাড়িতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাকে পছন্দ করলেও কিছু কিছু মানুষের কাছে সে চক্ষুশূল।
‘আহ্, নিরু এসব কেমন কথা।’
‘কেন আরু ভুল কিছু বললাম?’
‘সামান্য স্কুল মাস্টারের মেয়ে হয়ে….
আর কথা বাড়াতে পারেনা নিরু। মিনা হাতে প্লেট নিয়ে এগিয়ে আসে। তাদের সাথে বসে। মৌনর কাছে শ্যামবর্ণের ছিপছিপে গড়নের মিনাকে খুব ভালোলাগে। মৌন তাকে ছোটভাবি ডাকে। তবে মিনার জন্য কষ্টও হয়। বিয়ের দশবছরেও কোনো বাচ্চা হয়নি। তা নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাকে। তবে সুজন তাকে ছেড়ে দেয়নি। প্রত্যেকটা বিপদে আগলে রাখে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে।
‘কেমন আছো মৌন?’
‘ভালো আছি ছোটভাবি। আপনি কেমন আছেন?’
‘আল্লাহ রাখছে ভালো।’
‘কোথায় ছিলেন দেখলাম না এতক্ষণ?’
‘আর বলোনা তোমার ভাইয়ের সাথে চর কমলাপুর ব্রিজ গিয়েছিলাম। তোমার ভাইকে তো চিনো যখন যেটা মাথায় আসে। সে নাকি ঘুরতে যাবে।’
বলেই মিষ্টি করে হাসলো মিনা। কি নির্মল সে হাসি! মৌনর মনটা ভালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগের খোঁচা মারা কথাগুলো শুনে যেই খারাপ লাগা কাজ করছিলো তা যেন কেটে গেলো নিমিষেই।
‘মৌন ছোটভাবিকে ভুলে গেছো। ছোটভাবি কিন্তু তোমার কথা ভুলিনি। আজ জানতাম তোমরা আসবে তাই চর কমলাপুর ব্রিজ থেকে কবুতরের মাংসের চপ আনছি। তোমার যে খাবারটা পছন্দ তা কিন্তু ভুলিনি।’
বলেই প্লেটের ঢাকনাটা সরিয়ে একটা চপ মৌনর হাতে দেয় মিনা। আরু, নিরুকেও দেয়। মৌন অবাক হয় মানুষ এতো ভালোও হয়!
২৬.
গল্প, আড্ডা, হাসি ঠাট্টায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। জামগাছের হালকা টিয়া পাতাগুলো শো শো বাতাসে উড়ছে। মগডাল থেকে একটা কাঠবিড়ালি উঁকি দিয়ে চার রমণীর কথোপকথন শুনছে। তবে তার মস্তিষ্ক কিছু ঠাউর করতে পারছে কিনা সন্দেহ! বোকা কাঠবিড়ালি একসময় ক্লান্ত হয়ে যায় তবুও রমণীদের গল্প ফুরায় না। তবুও কাঠবিড়ালি দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে বসে বসে গল্প শুনে। রমণীদের হাসি দেখলে তার ঠোঁটটাও প্রসারিত হয়। যদিও তার ঘরের রমণী এসব দেখলে তাকে ত্যাগ করবে। এমনিতেই তার বদনাম। সে নাকি অন্য নারীতে আকৃষ্ট। এই স্ত্রী জাত মানেই ভেজাল!
__________________
নিভৃত কিছুক্ষণ যাবত ঘুরঘুর করছে। বাবা বলে দিয়েছে মেয়েটাকে তার বাড়ি দিয়ে আসতে। নিভৃত বাবা-মাকে বলেছিলো সাথে যেতে। তবে তারা নাকি কাল একেবারে বিয়েতে যাবে। একদিকে নিভৃত খুশিই হয়েছে। বেয়াদব মেয়েটাকে বাড়িতে পাঠাতে পারলে সে শান্তিতে রাতে থাকতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো নিভৃত মেয়েটার নাম ভুলে গেছে। তাই চাইলেও ডাক দিতে পারছেনা। এখন তাদের আড্ডার মাঝে গিয়েতো বলতেও পারবেনা,
‘এই মেয়ে আসো।’
আরু নিভৃতকে খেয়াল করে বললো,
‘ছোটভাইয়া কিছু বলবে?’
আরুর কথায় বাকি তিনজনও সেদিকে তাকালো। নিভৃত থতমত খেয়ে বললো,
‘হ্যাঁ।’
আরু উৎসাহী হয়ে বললো,
‘কি?’
‘ওকে একটু দরকার?’
আঙুল উঁচিয়ে মৌনকে দেখালো। মৌন অবাক। বাহ্বা! হঠাৎ ভূতের মুখে রামনাম!
মিনা হেসে বললো,
‘বউকে দরকার ভাই?’
নিভৃত জবাব না দিয়ে তাকিয়ে আছে কেবল। এসব আদিখ্যেতা তার বিরক্ত লাগে। মৌন এগিয়ে এলো নিভৃতের দিকে। খোঁচা মারা কন্ঠে বললো,
‘আজ সূর্য বোধহয় পশ্চিম দিকে উঠেছে।’
‘কেন?’
‘না, আপনে আমায় ডাকলেন?’
‘ইচ্ছায় ডাকিনি। যাও গিয়ে রেডি হয়ে নাও। সময় দিলাম দশমিনিট।’
‘কোথাও যাবো আমরা?’
উৎসাহী গলায় বলে মৌন। নিভৃত বিরক্তি কন্ঠে বলে,
‘কেবল বাবার কথায় তোমাকে তোমার বাড়িতে দিয়ে আসবো। তোমার সাথে ঘুরতে যাবো! মানে তুমি ভাবলে কিভাবে!’
মৌন কথা বাড়ায় না। ঘরে গিয়ে শাড়ি পাল্টে আসে। সুমনা, মিরা, নাজমুল সবার সাথে কথা বলে নিভৃতের সাথে রওনা দেয় নিজের বাড়ির দিকে। যদিও মৌন বলেছিলো হেঁটে যেতে। কেবল দশ মিনিটের রাস্তা। তবে নিভৃত তার কথায় পাত্তা দেয়নি।
কালকে বিকেলে আলম কল করে জিজ্ঞেস করেছিলো পুষ্প, রথিকে পাঠাবে কিনা। মৌন মানা করে দিয়েছে।
২৭.
পাকা রাস্তা ধরে সোজা গেলেই মৌনদের বাড়ি। দুইপাশে কেবল ধানক্ষেত। সবই ব্যারিষ্টার বাড়ির। এক দুইটা বাড়িও আছে। মার্সিডিজ গাড়িটা এসে থামলো মৌনদের বাড়ির সামনে। আর সামনে যাওয়া যাবেনা। কারণ বাড়ির সামনে চিচিঙ্গা, কুমড়োর টাল। নিভৃত গাড়ি থামিয়ে বলে,
‘এই মেয়ে এখন কি আমার ভিতরেও যেতে হবে?’
‘আপনি না গেলে আমার অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই সাথে আসলে ভালো হয়।’
নিভৃত মুখটা বিকৃত করে বললো,
‘চলো।’
গাড়ি থেকে নামতেই পুষ্প, রথি দৌঁড়ে আসে। রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়ের সাথে বানানো মাচায় বসে গল্প করছিলো দুজনে। বাড়িতে গেলেই মা কাজ দেয়। তারউপর আজ তাদের আপা আসবে। দুজনে তো তৈরিও হয়ে গিয়েছিলো ব্যারিষ্টার বাড়ি যাবে বলে। তবে বাবা মানা করেছে বলে যাওয়া হয়নি।
‘আপা, কেমন আছো?’
‘ভালো, তোরা কেমন আছিস?’
‘আমরাও ভালো।’
অতঃপর তারা তাকায় ছয়ফুট লম্বা সুদর্শন দুলাভাইয়ের দিকে। পরনে দামি জ্যাকেট, প্যান্ট, জুতা। নিভৃত এসবে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে কেবল! বাবা-মায়ের উপর রাগ লাগছে প্রচন্ড। রথি কিছু বলবে তার আগেই মর্জিনা এগিয়ে এলেন। মাকে দেখে দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপটে ধরলো মৌন। এই পান খেয়ে মুখ লাল করা মানুষটাকে সে ভিষণ ভালোবাসে। মর্জিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। তারপর নিভৃতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাবা, তুমি আসছো আমি অনেক খুশি হইছি। ভিতরে আসো।’
‘জ্বি, আন্টি।’
উঠানে এসে দাঁড়াতেই নিভৃতকে ঘিরে ধরলো একঝাঁক মহিলা। যেন সে কোনো এলিয়েন। আগেরবার গোপনে বিয়ে করে চলে গিয়েছিলো সেটাই ভালো ছিল। এখন এই একঝাঁক মহিলার কাছ থেকে তাকে কে বাঁচাবে! অস্বস্তিতে মুখ কালো হয়ে আসে তার। কাঙ্খিত ব্যাক্তিটিকে খুঁজে সে। তবে মেয়েটি তো বোনদের পেয়ে তাকে রেখেই পালিয়েছে। একবার মেয়েটাকে হাতে পাক। নিভৃতও মজা বুঝাবে।
(চলবে)…….
(চলবে)…..