সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ৩৫+৩৬ ও শেষ পর্ব

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#পঁয়ত্রিশ

সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দিদান কিছুটা সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। তার শরীর আগের থেকে এখন অনেকটা ভালো। নিরারও যাওয়ার সময় এসে গেছে। সে প্রকাশক সাহেবের সাথে দেখা করে এসেছে। এমন সময় কিয়া কল দিল।

“লিরা কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”

“আমিও ভালো।”

“আজ প্রকাশক স্যারের সাথে কথা বলে এসেছি কিয়া। তিনি খুব করে চাচ্ছেন আমি যেন সকলের সামনে আসি। তার শরীর খারাপ যাচ্ছে। তাই তিনি চাইছেন আমার সামনে আসাটা তিনি নিজে এনাউন্স করবেন। হয়তো তিনি ভয় পাচ্ছেন কখন কী অঘটন ঘটে যায়।”

“তোমার কী মত লিরা?”

নিরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি বারন করে দিয়েছি। আসলে আমি এখনো মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই। তাছাড়া এভাবে তো বেশ আছি। আমি জানি স্যার হয়তো কষ্ট পাবেন, তাও তিনি আমাকে বুঝেন বলেই বারন করা।”

“তুমি কবে আসছো?”

“আগামীকাল সন্ধ্যায় ফ্লাইট। তোমার জন্য কী নিয়ে আসব বলো?”

“লিরা আমার জন্য তুমি নিজেই গিফট। আবার কী আনবে। কিচ্ছু লাগবে না।”

“আমি আজ শপিংয়ে যাব। আর হয়তো দেশে আসা হবে না। কিছু কেনাকাটা করব। তুমি গতবার বলেছিলে না, জামদানী শাড়ি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার জন্য কয়েকটি নিয়ে আসব।”

কিয়া গম্ভীর গলায় বলল,” অর্নব কী তোমায় আটকাচ্ছে না লিরা?”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিরা বলল,”প্রথমে চেষ্টা করেছে। যখন বুঝল আমাকে আটকে রাখা যায় না। তখন থেকে সাধারণ আচরণ করছে। যেন আমি বেড়াতে এসেছি। সে আমার দেখভাল করছে।”

“তুমি একবার ভাবো লিরা। একটা জীবন। একা কাটানোটা কঠিন কিছু নয়। আবার সহজও নয়।”

“আমি ভেবে ফেলেছি ডিয়ার। এখন শুধু তোমাকে জ্বালাব বলে আসছি। থাকবে তো আমার পাশে?”

“আজীবন থাকব।”

“খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে।”

নিরা ফোন রাখতেই ওহি এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদান তোমায় ডাকছে ভাবী।”

“চলো।”

নিরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওহি পেছন থেকে বলল,”থেকে যাও না ভাবী। এ বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি চলে যাওয়ার পর এখানে মানুষ বাস করে বলে মনে হয় না। সবাই কেমন রোবট হয়ে গেছে। বাঁচতে হবে বলে খাবার খায়, ঘুমাতে হয় বলে ঘুমায়। কিন্তু কারো মনে শান্তি নেই। কেউ হাসে না। সবার চেহেরায় দুঃখের ছাপ। এত দুঃখের সাগরে ভাসতে কার ভালো লাগে বলো?”

নিরা ওহির দু’গালে হাত রেখে বলল, “কদিন পর বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। তখন দেখবে বরের সাথে কেমন সুখে থাকো। দুঃখী দুঃখী মুখগুলো তখন দেখতে হবে না।”

“বাদ দাও তুমি বুঝবে না। আমার পরিবার অশান্তিতে থাকবে আর আমি শান্তিতে থাকব এটা কি করে ভাবছো!”

ওহি কথা শেষ করে চলে গেল। নিরা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দিদানের রুমে গেল। দেখল অর্নবও তখন ঢুকছে। দিদানের পাশে বসে আছেন রেহেনা বেগম। ওহি গাল ফুলিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে। নিরাকে দিদান নিজের কাছে বসালেন। খাটের হেড বোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে, নিরার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললেন,”আমি আজ নয়, কাল মরে যাব। কিন্তু আমার দাদু ভাইয়ের কষ্ট দেখে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারব না। তুই তারে একা ফেলে যাস না বোন। বাবা-মা পরিবার সব ধীরে ধীরে চলে যায়। তখন নারীর জীবনে স্বামী, পুরুষের জীবনে স্ত্রী একমাত্র অবলম্বন হয়। একে-অপরের মাঝে সুখ খুঁজে। সন্তান পৃথিবীতে আসে বংশ পরম্পরায় এভাবেই সমাজ-সংসার টিকে আছে। তুইও জানিস অর্নব তোকে ছাড়া কাউকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে না। আমিও জানি তুই আর কখনো বিয়ে করবি না। তাহলে কেন এত দ্বিধা বল। আমার ছেলে তার পাপের জন্য শাস্তি পাচ্ছে। আমার হাসিখুশি সংসারটা মরুভূমি হয়ে গেছে। আর কী করলে তুই থাকবি বল?”

অর্নব গলা চড়িয়ে বলল,”দিদান প্লিজ তুমি আর এসব বলবে না। কাউকে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না।”

“তুই একটা কথাও বলবি না। আমি আমার বোনের সাথে কথা বলছি। তুই কে মাঝখানে কথা বলার?”

“তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।” অর্নব রাগ করে চলে যেতে লাগলে দিদান বললেন, “কোথাও যাবি না চুপ করে বসে থাকবি।”

রেহেনা বেগম নিরার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুই যাস না মা। আমার পরিবারের খুশি নিয়ে চলে যাস না। একজন মা হয়ে আমার অনুরোধ তোর কাছে।”

নিরা মাথা নিচু করে বসে রইল। এভাবে অনুনয় করলে কীভাবে কাউকে বারন করা যায়। সে চুপ থেকে বলল,”দিদান, মা, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনাদের কথা রাখতে পারছি না। আমার মনে হয় আমার মা-বাবা আমায় দেখছেন। তাদের কাছে কী জবাব দেব বলুন? এখানে থাকলে সারাজীবন আমায় অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হবে। আমি পারব না।”

নিরা হাত জোড় করে ক্ষমা চাইল সবার কাছে। দিদান, রেহেনা বেগম দুজনেই কাঁদছেন। ওহি তখন আচমকা এক কাণ্ড করে বসল সে হাতের ফোনটা মেঝেতে আছাড় মেরে চিৎকার করে বলল,”দিদান তুমি কী পাগল! তোমার মহান নাতবউ তোমার কথা শুনবে বলে মনে হয় তোমার? তিনি এখানে থাকলে অনুশোচনায় পুড়বেন। অথচ এতগুলো মানুষের জীবনের সুখ কেড়ে নিয়ে খুব ভালো থাকবেন। আমার বাবা তো তোমার বাবা-মাকে মেরেছে। জানি তা মহাপাপ। কিন্তু তুমি তো আমাদের পুরো পরিবারটাকে মেরে ফেলেছো। এর কী কোনো বিচার হবে না। এর জন্য কী কোনো শাস্তি হবে না?”

অর্নব বলল,”চুপ কর ওহি। কী বলছিস এসব তুই?”

“তুই চুপ কর ভাইয়া। আমি দেখেছি তুই কীভাবে দিনদিন একটু একটু করে মরছিস। কীভাবে তোর রাত কাটে। কীভাবে তুই গভীর রাতে পাগলের মতো আহাজারি করিস। তোর অনুশোচনা হয় তোর বাবা তোর স্ত্রীর বাবা-মায়ের খুনি। তুই নিজেকে বাবার মতোই সমান অপরাধী ভাবিস। আমি বোন হয়ে তোর এমন অবস্থা কী করে সহ্য করি বল তো? আমি জানতাম মেয়েরা মায়ের জাত ক্ষমা করে দেয়। কারণ সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা নারীকে দিয়েছেন, পুরুষকে নন। তাই পুরুষের চেয়েও নরম মন হয়ে থাকে নারীর। কিন্তু আজ দেখলাম তুমি পুরুষদের চেয়েও অনেক কঠিন ভাবী। আমার বাবাকে দেখেছো কতটা কষ্ট পাচ্ছে। তারপরও কী চাও তুমি? এই বুড়ো ভদ্রমহিলা মরতে গিয়ে আমার আর ভাইয়ার নাম নেয়নি, নিয়েছে তোমার নাম। বুঝতে পারছো কতটা ভালোবাসে তোমায়? আর এই দেখো আমার মা। প্রায় কাঁদেন কারণ তিনি বিয়ের শুরুতে তোমায় মেনে নেননি। তাই তিনি অপরাধবোধে ভুগেন। কী লাভ বলো এমন জীবনের। তারচেয়ে বরং এক শিশি বিষ এনে তুমি আমাদের সবাইকে খাইয়ে যাও। দিনে দিনে মরার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়া অনেক ভালো ভাবী, অনেক ভালো।”

ওহি মাটিতে বসে পড়েছে হাউমাউ করে কাঁদছে। তার কান্না দেখে সবাই কাঁদছে। অর্নব রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। নিরা নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে যথাসম্ভব চোখের জল আটাকানোর চেষ্টা করছে।

সে ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওহির কাছে গিয়ে বসল। ওহিকে ধরলে গেলে ওহি হাত সরিয়ে দিল। নিরা আবার জোর করে ধরতেই ওহি তাকে ঝাপটে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। নিরা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সেও কাঁদছে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।

★★★

রাত বারোটা। নিরা নিজের রুমে জামা কাপড় গোছাচ্ছে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ল। না তাকিয়েই বলল, “আসুন ডক্টর।” যেন সে জানত অর্নব আসবে।

“সব গোছানো হয়েছে?” অর্নব স্বাভাবিক গলায় বলল।

“প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।”

“নিরা আমি ওহির হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আসলে ও ছোট তাই আবেগ বেশি। তোমাকে অনেক কটুকথা শুনিয়েছে। প্লিজ ওকে ক্ষমা করো।”

নিরা কাজ রেখে অর্নবের দিকে ফিরে বলল,”ওহি আমার বোন। ও কোনো ভুল করলে সেটা আমি বুঝে নেব। আপনি কেন এসব বলছেন? তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা আজকে ওহি ভুল কিছুই বলেনি। আমি ওর জায়গায় থাকলে এভাবেই রিয়াক্ট করতাম। আমাদের দুই – বোনের মধ্যে আপনি কেন আসছেন বলুন তো?”

অর্নব হাসল যেন আজ কিছুই হয়নি, কালও কিছুই হবে না এমনভাবে বলল, “আচ্ছা যাক বাঁচা গেল।”

নিরার অবাক লাগল। মানুষটাকে এতটা স্বাভাবিক দেখে তার ভয় করছে। কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। দুজন মানুষ যখন সামনাসামনি থাকে তখন চুপ করে থাকাটা খুব অস্বস্তি দেয়। পরিবেশটা থমথমে মনে হয়। তাদের হয়তো অনেক কথা বলার আছে। কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারছে না।

নিরা অস্বস্তিটা কাটাতে আবার সুটকেসে হাত দিল। অর্নব হাতে ধরে থাকা একটা শপিং ব্যাগ তার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, “এটা তোমার জন্য। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা।”

নিরা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ব্যাগটা নিয়ে দেখল একটা জামদানী শাড়ি নীল রঙের সাথে মেজেন্টা রঙের পাড়ে কাজ করা। নিরার খুব পছন্দের দুটো রঙের কম্বিনেশন। সে হেসে বলল,”খুব পছন্দ হয়েছে। এটার জন্য ধন্যবাদ।”

“এতটা ফরমালিটি না করলেও পারো।”

“আচ্ছা স্যরি আর করলাম না ফরমালিটি।”

অর্নব হেসে বলল,”আবারও তো করলে।”

নিরাও হাসল কিন্তু কিছু বলল না।

“কফি খাবেন ডক্টর?”

“উঁহু! পান করব।” অর্নবের কথা বলার ঢঙে নিরা হাসল।

নিরাও হেসে কফি করতে চলে গেল। অর্নব নিরার খাটের উপর বসে হাত দিয়ে বিছানাটা ছুঁয়ে দেখছে। সে ভাবছে আর কোনোদিন নিরা এখানে ঘুমাবে না। তার কথা, তার গায়ের ঘ্রাণ কোনোকিছুই সে পাবে না। এ ঘরে আসলেই তার কাছে অদ্ভুত মিষ্টি একটা ঘ্রাণ লাগে। নিরা যেখান দিয়ে হেঁটে যায় সেখানেও একইরকম ঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে থাকে। এই অদ্ভুত সুভাষে বুকের ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়। যেন ক্ষণিকের জন্য তার শ্বাস আটকে আসে। মুগ্ধতায় তাকে আবিষ্ট করে ফেলে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এমন গূঢ় অনুভূতি তার একজীবনে কারো জন্য হয়নি। সে ভাবছে পৃথিবীর সব মানুষরা কী তাদের প্রিয় মানুষের এমন মিষ্টি সুভাষ পায়? পেলেও সব সুভাষ কী ঠিক একই রকম হয়! নাকি মানুষ ভেদে সবকিছুর পার্থক্যও আলাদা হয়!

নিরা কফি হাতে ঘরে ঢুকতেই অর্নব চমকে ওঠল। যেন তার গভীর ধ্যান কেউ এসে ভেঙে দিয়েছে। নিরা কফি নিয়ে বারান্দায় ছোট্ট গোল টেবিলটার উপর রেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,”ডক্টর এখানে আসুন।”

অর্নব তার কথা মতো উঠে তার কাছে গিয়ে বসল। দুজনেই চুপচাপ কফিতে চুমুক দিচ্ছে কেউ কিছুই বলছে না।

“ডক্টর?” নিরা শান্তস্বরে ডাকল।

“হুম, বলো?”

“আমার কেন যেন ভয় লাগছে আপনার নীরবতা।”

অর্নব ম্লান হেসে বলল, “আমার পাগলামো ভয় লাগেনি তোমার?”

“না।”

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই নিরা। আমি যাওয়ার সময় তোমায় কষ্ট দিতে চাই না। আমি এতদিন ভুলে গিয়েছিলাম জোর করে কাউকে আটকে রাখা যায় না। আবার দূরে সরে গেলেও ফিরে পাওয়া যায় না। তুমি যেখানেই থাকো আমাদের ভালোবাসা একইরকম থাকবে। আমরা তো সময়ের হাতে বন্দী। চাইলেও ভাগ্যকে অস্বীকার করতে পারি না। তোমার মনে আছে তুমি একদিন আমায় ভাগ্যের ব্যাখ্যা বলেছিলে। আজ আমি তোমায় সে ব্যাখ্যাটা ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমাদের ভাগ্যে ছিল আমাদের বিয়ে হবে, তাই হয়েছে। আমাদের ভাগ্যে লেখা আছে আলাদা হব। আলাদা হয়েছি। তাহলে শুধু, শুধু জীবনের প্রাপ্ত এই সময়টুকুকে কেন হেলায় হারাব বলো?”

নিরা চুপ করে শুনছে অর্নবের বলা প্রতিটি কথা তার হৃদয়ে তীরের বাণ হয়ে ক্ষতবিক্ষত করছে। তাও সে চুপ করে রইল। চুপ থাকাটাই নিয়তি।

অর্নব আবার বলল,”নিরা আমার মনে হয় কী জানো এই যে এই সময়টুকু আমি এখানেই বেঁধে রাখি৷ যদি আমার কাছে টাইম-ট্রাভেল করার ক্ষমতা থাকত। তবে আমি বারবার তোমার সাথে কাটানো সময়গুলোতে ভ্রমণ করতাম। অতীতে ফিরে যেতাম অসংখ্যবার। কিন্তু আফসোস এমনটা তো শুধু রূপকথায় হয়। আমাদের রূপকথার সবগুলো গল্প যে অসমাপ্ত। তাই তো চুপ করে আছি।”

“আমায় ক্ষমা করতে পারবেন ডক্টর?”

“ক্ষমা তুমি আমাদের করো নিরা। আমার বাবার জন্য তুমি একটা সুন্দর পরিবার থেকে বঞ্চিত হয়েছো। তার প্রায়শ্চিত্ত কী করে করি বলো তো?”

“প্লিজ, ডক্টর এভাবে বলবেন না। আমার কষ্ট হয়। আমাদের জীবনের সবকিছু এভাবেই লেখা আছে। আমার কারো উপর এই নিয়ে রাগ নেই।”

“এটা তোমার মহানুভবতা। তার জন্য কৃতজ্ঞতা।”

নিরা অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। আজকে এতটা সিরিয়াস হয়ে কথা বলছে যে মনের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দেয়। কেমন ব্যথা অনুভব করে।

অর্নব উঠে চলে গেল। তার কষ্ট বাড়ছে, সে চাইছে না সেটা নিরার সামনে প্রকাশ পাক। তারচেয়ে বরং দূরে সরে যাওয়াই ভালো। নিরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার হাতের মগটা টেবিলে রেখে রুমে এসে শুয়ে পড়ল। চোখের জলে বালিশের কোণটা ভিজে গেছে। সে জানে পাশের রুমের মানুষটাও কাঁদছে।

★★★

সারাদিন পরিবারের সবার সাথে কাটিয়ে বিকেলে সব নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আসার সময় রেহেনা বেগম আহাজারি করলেন, দিদান তাকে আসতেই দিবে না। আর ওহি তো কেঁদেই যাচ্ছে। গাড়িতে বসে আছে অর্নবের সাথে। সে’বার যখন লন্ডন যাচ্ছিলো অর্নব তাকে এভাবেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছিল আজও দিচ্ছে। চোখের সামনে সব স্মৃতি ভেসে ওঠছে।

অর্নব আজ খুব স্বাভাবিক। আগে যেভাবে কথা বলত সেভাবে বলছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তাদের জীবনে কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না। পাগলামো করা অর্নবের সাথে এখনকার অর্নবের কোনো মিল নেই৷ এতটা স্বাভাবিক দেখে নিরার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসল। তার মন কু ডাকছে। মনে হচ্ছে ঝড়ের আগের পূর্বাভাস দিচ্ছে৷

তারা এয়ারপোর্টে এসে নামল। নিরা সবরকম ফরমালিটি সেরে অর্নবের পাশে এসে বসল। আর একটুপর সে চলে যাবে হাজার, হাজার মাইল দূরে। যেখানে গেলে আর চাইলেও আসতে পারবে না।

“ভালো থাকবেন ডক্টর।”

“থাকব।” শ্লেষের হাসি হাসল সে।

“সত্যি ভালো থাকবেন তো? নিজের খেয়াল রাখবেন?”

“সত্যি ভালো থাকব।”

“তুমিও ভালো থেকো।”

নিরা কিছু বলল না।

অর্নব আবার বলল, “শোনো নিরা, যদি তোমার কখনো খুব বেশি ইচ্ছে করে আমায় কল দিতে, তাও তুমি আমায় কল দিবে না। আমার শেষ চাওয়া তোমার কাছে।”

নিরা অবাক চোখে তাকাল সামনে থাকা মানুষটার দিকে। কোনো এক রহস্যময় কারণে কেউ কারো মুখ থেকে চোখ নামাতে পারছে না। যে চোখে, চোখে সব না বলা কথা হয়ে যাচ্ছে।

তখনই শুনতে পেল তাকে ভেতরে চলে যেতে হবে।
অর্নব হাসার চেষ্টা করে বলল,”তোমাকে যেতে হবে নিরা।” তার হাসিটা জোর করে হাসার মতো মনে হলো। সুটকেসটা নিরার দিকে বাড়িয়ে ধরল সে।

নিরা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, “ডক্টর, উইল হাগ মি টাইটলি ওয়ান্স?”

অর্নবের হাত থেকে সুটকেসটা নিচে পড়ে গেল। এতক্ষণ দমিয়ে রাখা গলায় আটকে থাকা কান্নাটা মুহূর্তে ঝরঝরিয়ে জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। নিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুজনের চোখের জলে দুজনের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। এমন সময় মায়ান, দিয়া তাদের দিকে এগিয়ে আসল। তারা দূর থেকে দুজনকে এতক্ষণ দেখছিল। মায়ান বলল, “অর্নব নিরাকে যেতে হবে। ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে।”

অর্নব নিরাকে ছাড়তে চাইল না। দিয়া নিরাকে টেনে সরিয়ে আনল। নিরা সুটকেসটা নিয়ে একটু একটু করে ভেতরে চলে যাচ্ছে। অর্নব হাঁটুগেড়ে বসে কান্না করছে। নিরা ভেতরে চলে গেল।

হঠাৎ মায়ান অর্নব বলে জোরে চিৎকার দিল। অর্নব কেমন যেন করছে চোখ উল্টে কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। দিয়া পাগলের মতো তার মাথাটা ধরে কাঁদতে লাগল। মায়ান বুকে হাত দিয়ে শ্বাস -প্রশ্বাস চেক করছে। মায়ান কেঁপে ওঠল। ভয়ার্ত গলায় বলল, “এটা হতে পারে না। নো ওয়ে দিয়া।” মায়ানের চোখে জল। দিয়া পাগলের মতো কাঁদছে। অস্পষ্ট স্বরে বলছে, “অর্নব এভাবে চলে যেতে পারে না মায়ান।”
#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#শেষ_পর্ব

দু’দিন পর। মায়ানকে জড়িয়ে ধরে দিয়া অঝোরে কাঁদছে। জীবন মাঝে মাঝে আমাদের কঠিন সব পরীক্ষার সম্মুখীন করে দেয়। সেসব পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে শক্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা চাইলেও মানব জনমের এদিকটায় অস্বীকার করতে পারি না। না নিজেকে বুঝাতে পারি। তাই তো সব মেনে নিতে হয়। আজকের এই মুহূর্ত পর কী হবে কেউ জানে না। তাই তো তারাও জানত না। হঠাৎ করে কিছু সময়ের মধ্যে সবকিছু এমন হয়ে যাবে। রেহেনা বেগমের অবস্থা ভালো না। অর্নবের কথা শুনে সিড়ি বেয়ে পড়ে গেছেন। ভাগ্য ভালো তিনটা সিঁড়ি থেকে পড়েছেন নয়তো কি যে হত আজ। মাথায় একটু ব্যাথা পেয়েছেন। এখন অবশ্য আগে থেকে কিছুটা ভালো আছেন।

ওহির পাশে তার হবু বর সাদিদ বসে আছে। ওহিকে এ দু’দিন সেই সামলেছে। মেয়েটা বড্ড ভেঙে পড়েছিল। সাদিদ ছেলেটা ভালো, যত্নবান। এর সাথে ওহি ভালোই থাকবে। মেয়েরা স্বামী হিসেবে যত্নশীল ছেলেদের বেশি পছন্দ করে। সংসার করতে করতে একসময় দু’বেলা নিয়ম করে ভালোবাসি বলা না হলেও, এই যত্ম দিয়ে সেটা বোঝানো যায়।

মায়ান দিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল, “চল দিয়া ওহির কাছে যাই।”

দিয়া উঠে মায়ানের সাথে ওহির কাছে আসল। ওহি দিয়াকে দেখে জড়িয়ে ধরল। দিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

★★★

কেবিনে শুয়ে আছে অর্নব। নিরা ইমিগ্রেশনে ঢোকার পর সে হঠাৎ পড়ে যায়। মায়ান পরীক্ষা করে বুঝতে পারে স্ট্রোক করেছে। দিয়া তখন পাগলের মতো কান্না করে। প্রিয় বন্ধুর এমন অবস্থা দেখে মায়ান দিশেহারা হয়ে পড়ে। কোনোরকমে হাসপাতালে নিয়ে আসে। এ দু’দিনের চিকিৎসায় এখন অবশ্য ভালো আছে। শরীর কিছুটা স্থির হয়েছে। অর্নব চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল তার পাশে চেয়ার পেতে একটা হাত ধরে কেবিনে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে নিরা। সে ভাবল স্বপ্ন দেখছে সে। নিরা তো তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে। তারপর চোখ বন্ধ করল। দুই নয়নের কোণ বেয়ে অশ্রু পড়ছে। নিরা চলে গেছে ভাবতেই বুকটা ফাঁকা হয়ে আসছে। চোখের পানি মোছার জন্য হাতটা টেনে আনতে চাইলে বুঝতে পারল কেউ টেনে ধরে রেখেছে। দুই আঁখি খুলে দেখল নিরা। আবার মনে হলো ভুল দেখছে। হাতের টানাটানিতে নিরার ঘুম ভেঙে গেছে। গতকাল থেকে এভাবেই বসে ছিল অর্নবের কাছে। কখন যে ক্লান্তিতে ঘুম এসে গেছে বুঝতে পারেনি। অর্নবের জ্ঞান ফিরেছে দেখে নিরা উঠে দাঁড়াল। দু’হাতে মুখ খানা আঁজলা ভরে ধরে বলল, “তুমি ঠিক আছো অর্নব? কষ্ট হচ্ছে না তো?”

অর্নব অশ্রু চোখে তাকিয়ে হাসল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “আমাকে চিমটি দাও তো। আমি কী স্বপ্ন দেখছি নিরা?”

নিরা অর্নবের হাতটা কপালে ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগল। নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিল। অর্নবের চোখের জল যেন লাই পেয়ে আরও বেশি উপচে পড়তে লাগল।

হঠাৎ তার মনে হলো এ সুখ ক্ষণিকের। সে সুস্থ হলেই নিরা চলে যাবে। আচমকা বুকের ভেতর চাপা যন্ত্রণা জেগে উঠল। সে বলল, “কেন কষ্ট বাড়াচ্ছো নিরা তুমি তো চলেই যাবে।”

“হ্যাঁ চলে যাব। তবে আগে আপনাকে সুস্থ হতে হবে ডক্টর।”

“তুমি চলে যাও। আমি তোমার কেউ নই নিরা।”

“কিন্তু আমি তো আপনার কেউ ডক্টর।”

অর্নব চুপ করে রইল। তখনই ওহিসহ সবাই ভেতরে ঢুকল। ওহি ভাইকে দেখে কাঁদতে লাগল। অর্নব
তাকে ভরসা দিল। দিয়া বলল, “তুই তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি। যাক এখন আর কোনো ভয় নেই।”

মায়ান বলল,”তোর ভেতরে এত ক্রেইজি প্রেমিক লুকিয়ে আছে বোঝা যেত না।”

উপস্থিত সবাই কান্না চোখেও হাসল। অর্নব মায়ের আর দিদানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। ওহি জানাল দিদানকে বাসায় রেখে এসেছে। এখানে থাকলে শরীর বেশি খারাপ হতে পারে। তাকে কিছু জানানো হয়নি। শুনলেচিন্তা করবেন। আর মা এখন অনেকটা ভালো আছেন ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

★★★

সাতদিন পর। অর্নব এখন অনেকটাই সুস্থ। আজ নিরার চলে যাবার দিন। অর্নব আজ আর তাকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে গেল না। নিরাই চায়নি সে যাক। সে গেলে আবার অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই নিরা কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ কী! অর্নব তাকে কথা দিয়েছে সে নিজের খেয়াল রাখবে। নিরা বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল৷

অর্নব নিজের রুমের বারান্দায় বসে নীরবে অশ্রুবিসর্জন দিচ্ছে। তার মন খুব খারাপ। তার কাছে মনে হচ্ছে জীবন একটা নদীর মতো। এখানে কখন জোয়ার আসে, আর কখন ভাটা পড়ে কেউ বলতে পারে না। সবার জীবনের এক একটা আলাদা গল্প থাকে। তার ধারণা সে গল্পে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণই বেশি থাকে। তাই তো নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। সবাইকে নিজের কষ্টগুলোকে নিজেকেই সামলাতে হয়। পৃথিবীতে সুখের ভাগ নেয়ার মানুষ থাকলেও, দুঃখের ভাগ নেয়ার মানুষের বড্ড অভাব।

“সেল্ফ হিলিং ইজ দ্যা বেস্ট হিলিং।”

তাই তো নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। এমন সময় তার পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে তাকাতেই দেখল মায়ান দাঁড়িয়ে আছে। চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করে বলল,”আয় বোস।”

“চোখের জল আড়াল করলে কী মুখের আদলের যন্ত্রণার রেখা আড়াল করতে পারবি?”

অর্নব কিছুই বলল না দেখে, সে আবার বলল,”মানুষ এ পৃথিবীর সবচেয়ে বিচিত্র প্রানী। তারা চোখের জল আড়াল করার চেষ্টায় এতটাই মত্ত থাকে যে। মুখের অবয়বে জমে থাকা কষ্টকে আড়াল করে না। অথচ সবার আগে সেটাই করা উচিত। নয়তো মানুষ সহজেই সবটা ধরে ফেলতে পারে।”

অর্নব বিরক্ত হয়ে বলল,”কী সব ফিলোসফি শুরু করে দিলি? এসব এখন বন্ধ কর।”

“আচ্ছা সব বন্ধ করলাম বন্ধু আমার। এখন তোকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। কোনো না শুনতে আমি চাই না। তুই যদি এখন বসে বসে লাইলির বিরহে নিজেকে পোড়াতে চাস তার সময়ও পাবি না। কারণ সেটা রাতের জন্য তোলা রইল। তুই এখন চুপচাপ আমার সাথে যাবি। সারা সন্ধ্যা আমার সাথে থাকবি। রাতে বিছানায় বালিশ জড়িয়ে মেয়েদের মতো কাঁদবি।” কথাটা বলে নিজেই জোরে হাসল মায়ান। যেন নিজের কথায় নিজেই বেশ আনন্দ পেল।

“তুই বড্ড বাজে বকিস মায়ান। আমি এখন কোথাও যাব না। তুই ভাবছিস তোর সাথে বাইরে গেলে আমার মন ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস কর এমন কিছুই হবে না। কিছু মন খারাপ কখনো যায় না। কারণ এ মন খারাপের কারণ নির্দিষ্ট একজন। তাই সে ছাড়া মন ভালো কেউ করতে পারে না। আমার ইহজীবনে আর কোনোদিন এই মন খারাপটা যাবে নারে।”

মায়ান করুণ গলায় বলল, “প্লিজ অর্নব আমি জানি তোর মন খারাপটা যাবে না। কিন্তু আজকের জন্য চল। দিয়াও বের হবে আমাদের সাথে। আমরা আগের মতো আজকে তিনজন ঘুরব, খাব বেড়াব। এটুকু সময় তো আমারা তোর কাছে চাইতেই পারি বল?”

মায়ানের বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে অর্নব বারন করতে পারল না। সে যাবে বলে জানাল।

শার্ট পরে বেরিয়ে পড়ল দুজনে। প্রায় দশদিন বাড়ি ও হাসপাতালে থেকে বের হয়ে খোলা বাতাসে কিছুটা ভালো লাগছে অর্নবের। মায়ান ফোন করে দিয়ার সাথে কথা বলে নিল। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে তাকে গাড়িতে তুলে নিল। অনেক জায়গায় ঘুরে ঠিক হলো তারা নেভাল যাবে। সেখানে সমুদ্রের গর্জন শুনতে যেত আগে তারা। তাদের গাড়ি চলছে নেভালের উদ্দেশ্য।

সন্ধ্যা নেমে আসছে আকাশে ক্ষণিকের জন্য সন্ধ্যাতাঁরার দেখা মিলল। গাড়ির জানালায় হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকছে। অর্নবের মনে হলো এ বাতাসটা মনকে শীতল করে দিচ্ছে। বাতাস শরীরে কামড়ে ধরছে। না এ কামড়ে ব্যথা নেই, বরং ভালো লাগা আছে।

তারা এসে নামল নেভালে। গাড়ি পার্কিং করে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল সমুদ্রের পাড়ের দিকে। পশ্চিম আকাশে সূর্য মামা তলিয়ে গেছে। তার ডুবে যাওয়ার প্রমাণস্বরূপ কিছু সোনালী আভা ছড়িয়ে রেখেছে সাদা-কালো মেঘেদের রাজ্যে। এ এক অপূর্ব মুহূর্ত। শরীর মন সব কেমন করে যেন ভালো করে দেয়।

দিয়া পাশে লক্ষ্য করে বলল, “দেখ, দেখ ওদিকটায় কী সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মনে হয় কোনো কিছু হচ্ছে সেখানে চল গিয়ে দেখি তো।”

দিয়াকে অনুসরণ করল দুই বন্ধু। সত্যি সমুদ্রের পাড়ে এমন মোহনীয় সৌন্দর্য খুব কম দেখা যায়।

অর্নব মুগ্ধ হয়ে দেখছে চারপাশ। নানা রঙের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। নীল-সাদা বেলুনের লাভ গেইট। নানা রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো, সে কাপড়ের উপর আলো দেয়া। পাশ থেকে সমুদ্রের গর্জন মিষ্টি হিমেল বাতাস। সব যেন অপার্থিব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে অর্নবের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। সে একটা জায়গায় স্থির হয়ে যায়। যেন চেয়েও নড়তে পারছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে গেইটটা থেকে চার হাতের দূরত্বে। সেই গেটের মুখে এক রমনী একগুচ্ছ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে নীল ও মেজেন্টা রঙের মিশ্রণে জামদানী শাড়ি। সে শাড়িটা চেনে। কিছুদিন আগে নিরা নামের একটা মেয়ের জন্য এমন একটা শাড়ি সে কিনেছিল। পরক্ষণেই ভাবল এমন শাড়ি পৃথিবীতে অনেক আছে।

সময়টা সন্ধ্যা নামার পরের মুহূর্ত। এই সময়টা পৃথিবীটা স্বর্গের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। না তীব্র আলো, না অন্ধকার, কেমন মন ভোলানো সুখি, সুখি পরিবেশ। কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীটা ঠিক এই সময়টায় কেমন শান্ত শিশুর মতো মনে হয়, শুভ্র, পবিত্র। কিছু মুহূর্তের জন্য মনের অসুখটা সরে যায়। এমনটা অর্নবেরও হচ্ছে। তার শরীর কাঁপছে। একবার ভাবল স্বপ্ন দেখছে। বুঝতে পারল হৃদপিণ্ডটা কয়েক গুণ বেশি গতিতে লাফালাফি করছে। সে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সামনে থাকা মানবী তার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মানবীর চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপিস্টিক, খোঁপায় বেলীফুলের মালা। এই সুন্দর পৃথিবীর সুন্দর মুহূর্তে এসে তার মনে হলো, এ কোনো মানবী নয় স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী। সেই পরী এসে তার সামনে দাঁড়াল। অর্নবের মনে হলো বাতাসে সেই সুন্দর মিষ্টি সুভাষ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সেই সুভাষ তাকে জানান দিচ্ছে তার সামনে থাকা মানবী আর কেউ নয় তার জীবনের পরম আরাধ্য নারী নিরা।

সে দেখছে নিরা তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। ভ্রু উঁচিয়ে, ঠোঁট বাঁকা করে বোঝাচ্ছে কেমন লাগছে ডক্টর। অর্নবের বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। সে চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না। কিছু সময় দুজন দুজনের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর নিরা বলল, “উইল ইউ ডেইট মি ডক্টর?”

অর্নব উত্তরে বলল, “উইল ইউ গিভ মি আ পিঞ্চ?”

অর্নবের উত্তর শুনে মায়ান, দিয়া ওহি একসাথে উচ্চ শব্দে হেসে উঠল। তার কাছে জানতে চাইছে প্রেম করবে কিনা! সে চাইছে চিমটি! নিরাও হেসে বলল,”এই লোক নাকি আমার জন্য মরে যাচ্ছে। আমার চলে যাওয়াই উচিত ছিল। গাধা একটা!”

কথাটা শেষ করতেই অর্নবের একদম কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ওষ্ঠে গাঢ় চুম্বন খেল। নিরার আচমকা আক্রমণ সে বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নিরা কানে কানে বলল, “এবার বিশ্বাস হয়েছো তো ডক্টর অর্নব?”

অর্নবের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। আজ এক অন্য নিরাকে আবিষ্কার করল সে। চুপচাপ নিজেকে আড়াল করে রাখা নিরার আত্মপ্রকাশে শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকায় সুখের দোলা বয়ে গেল।

অর্নব হেসে উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বুঝাল বিশ্বাস হয়েছে। তারপর নিরার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে হা উঁচু করে দু’পাশে মেলে বলল,” আই উইল ডেইট ইউ আনটিল আই ডাই নিরা।”

নিরা তার দিকে ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বলল, “আই হেইট ইউ ডক্টর অর্নব।”

ফুলগুলো হাতে নিয়ে নিরাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অর্নব বলল, “আই হেইট ইউ সো মাচ মিসেস ডক্টর অর্নব।”

নিরার কাঁধে অর্নবের চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। দুজনেই বুঝতে পারছে। এই জল দুঃখের নয়। সুখের। অর্নব নিরার জীবনের নতুন পথচলা, নতুন সুখের সূচনা। মায়ান, দিয়া হাসছে। ওহি কাঁদছে অবশেষে তার ভাইয়ের জীবনে, তাদের সবার জীবনে সুখ ফিরে এলো। নিরা ফিরে এলো। তার বাবার করা পাপের ভার কিছুটা হলেও কমলো।

ওহি তাদের কাছে গিয়ে বলল, “মানে এখানে আমরাও আছি মিঃ এন্ড মিসেস অর্নব।”

নিরা লজ্জায় নিচের দিকে তাকাল। অর্নব ওহির কান ধরে বলল, “ওরে পাকনা মেয়ে। তুইও ওদের সাথে যোগ দিয়েছিস! ভাইকে এত কষ্ট পেতে দেখে ভালো লাগছিল তাই না?”

“তোমাকে শেষ বারের মতো কষ্ট পেতে দেখলাম ভাইয়া। এবার আমাদের জীবনে শুধু সুখ থাকবে। আমরা সবাই জানি ভাবী তোকে ছেড়ে যাবে না। ভাবী সব বলেছে আমাদের মা, দিদানও জানে। তোদের দুজনের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। মায়ান ভাইয়া, দিয়া আপুর সাথে মিলে সব করেছি।”

মায়ান এগিয়ে এসে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল,”খুব ভালো থাক।”

দিয়া হেসে বলল, “আজকে আমি সবথেকে বেশি খুশি অর্নব।”

তখনই নিরা এসে অর্নবকে বলল, “আরেকটি সুসংবাদ আছে ডক্টর।”

“কী সুসংবাদ? ”

“মায়ান ভাইয়া আর দিয়া আপু বিয়ে করছে।”

অর্নব অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”

দিয়া বলল,”একশো ভাগ সত্যি। তুই কী ভেবেছিস তোর বিরহে বসে সারাজীবন কাটিয়ে দেব?”

অর্নব বলল, “আর লজ্জা দিস না। আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন। তোরা ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব।”

সবাইচলে গেল। শুধু অর্নব নিরা সমুদ্রের পাড়ে হাত ধরে হাঁটতে লাগল।

★★★

এক সপ্তাহ পর। আজ লেখক ইপ্সিতা রাহমানের বই “সন্ধ্যা নামার পরে” পাবলিশ হবে। প্রকাশক সাহেবের অনেক ব্যস্ততা তিনি একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। আজ অনেক খুশি তিনি। তার অতি আদরের মেয়ে নিরা লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। বহুদিন ধরে এ দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন। তার ও নিরার ফেসবুক পেজে ও টাইমলাইনে এ বিষয়টা পোস্ট করার পর থেকে মোটামুটি ভাইরাল হয়ে গেছে। নানা নিউজ পোর্টালে এ খবর চলছে। “অবশেষে সবার সামনে আসতে চলেছেন এ সময়কার জনপ্রিয় লেখক ইপ্সিতা রাহমান।”

মানুষের কৌতূহল বেড়ে গেছে। অনেকে দূর থেকে এসেছে এই অনুষ্ঠানে তাদের প্রিয় লেখককে দেখতে। অর্নবও আজ বেশ খুশি ফেসবুকে খবরটা দেখার পর নিরাকে বলল তার প্রিয় লেখক ইপ্সিতা রাহমান সকলের সামনে আসবে সে দেখতে যাবে। নিরাকেও অনুরোধ করল তার সাথে যেতে নিরা মাথা ব্যাথার দোহাই দিয়ে গেল না। অর্নবও যেতে চাইল না। কিন্তু নিরাই জোর করে পাঠালো। অর্নব বেরিয়ে যাওয়া ঘণ্টা খানেকের ভেতর নিরাও বেরিয়ে গেল।

আজ সে অফ হোয়াইট ও কালো পাড়ের জরি সুতার কাজ করা জামদানী শাড়ি পরেছে। হালকা সাজে তাকে অপূর্ব লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে অনুষ্ঠানে পৌঁছে গেল। প্রকাশক স্যারকে সালাম করে বসল তার বইটা প্রথম হাতে নিয়ে দেখছে। স্যার স্টেজে গিয়ে ঘোষণা দিলে সে যাবে। সামনের সারিতে অনেক উৎসুক পাঠকের সাথে বসে অপেক্ষা করছে অর্নব।

স্যার এসে অনেক কথার পর বললেন, “এখন আপনাদের সামনে উপস্থিত হবে লেখক ইপ্সিতা রাহমান।”

স্টেজ অন্ধকার হালকা আলোর বাতি জ্বলছে। সে আলোয় লেখক ইপ্সিতা রাহমান ধীর পায়ে স্টেজে ঢুকলেন। হঠাৎ করে সব আলো জ্বালিয়ে দেয়া হলো। ইপ্সিতা রাহমান ফুল দিয়ে সাজানো মাইকের সামনে দাঁড়াল। অর্নব বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে। পেছনের সারির একজন লোক খুব বিরক্ত হয়ে তাকে টেনে বসালেন। সম্মুখে সবাই উৎসাহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

প্রকাশক স্যার সবার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে কিছু বলার জন্য বললেন। নিরা বলল, “আসসালামু আলাইকুম! আমি ইপ্সিতা রাহমান। যদি বলেন এটা আমার আসল নাম কিনা, তবে বলব সত্যি বলতে এ নামটা আমার ছদ্মনাম হলেও এ নামেই আপনাদের কাছে বেঁচে থাকতে চাই। আমার ব্যক্তি জীবনে যে নামে পরিচিত সে নামটা না হয় সেখানেই বরাদ্দ থাকুক। আমি নিরা হই বা ইপ্সিতা আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে থাকতে চাই।”

প্রকাশক স্যার নিরার দিকে তার নতুন বইটি এগিয়ে দিয়ে বই সম্পর্কে অনুভূতি জানাতে বললেন।

নিরা বইটা হাতে নিয়ে বলল,”এই বইটা আমার আবেগ, আমার প্রাণ। আমি জানি না আমার লেখা আপনাদের কতটা ভালো লাগে। কিন্তু এইটুকু বলতে পারি এই বইয়ের প্রতিটি শব্দে আপনারা আমাকে অনুভব করতে পারবেন। এই বইয়ের প্রথম কপিটা আমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, আপন মানুষকে উপহার দিতে চাই। তিনি আমার স্বামী, আমার বন্ধু, ডক্টর অর্নব। আমি জানি তুমি এখানে আছো প্লিজ আমার কাছে এসো।”

অর্নবের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। নিরা তাকে ডাকছে নাকি লেখক ইপ্সিতা রাহমান ডাকছে বুঝতে পারছে না। নিরা আবার ডাকলে সে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। নিরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। নিরা বলল,”আমি জানি তোমাকে না বলাটা আমার অন্যায় হয়েছে। আজ সবার সামনে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তোমার প্রিয় লেখক বইটা উপহার দিতে চাইলে তুমি কী নেবে?”

অর্নব হেসে হাত বাড়িয়ে বইটা নিল। তার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার প্রিয় লেখক তারই স্ত্রী যেন ভাবতেই পারছে না। নিরা তাকে উৎসর্গ পত্র পড়তে অনুরোধ করল। সে মাইকের সামনে এসে পড়তে লাগল, “বহুদিন আগে একটা গ্রামে সন্ধ্যা নামার পরে এমন সময়ে বকুল তলায় ছোট্ট কিশোরী এক বালিকাকে দেখে প্রেমে পড়েছিল, মেডিক্যালে পড়ুয়া ছাত্র অর্নব। অনেকটা দিন কেটে গেল। কিন্তু তাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ হলো না। এরপর আরেকটা দিন এমনই সন্ধ্যা নামার পরের মুহূর্তে ডক্টর অর্নব নিরাকে তার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাদের সে গভীর ভালোবাসা তাদের আলাদা করে দেয়। ঠিক তার তিন বছর পর তেমনই মুহূর্তে সারাজীবনের জন্য একে-অন্যের হয়ে গেল লেখক ইপ্সিতা রাহমান ও ডক্টর অর্নব। আজও ঠিক তেমনই মুহূর্তে তাদের জীবনে যোগ হলো নতুন এক অধ্যায়।
তাদের ভালোবাসা অমর করে রাখতে এই বইটি উৎসর্গঃ করলাম আমার প্রাণের মানুষ অর্নবকে। যার সাথে আজীবন পথচলার কথা দিয়েছি।”

পড়তে পড়তে অর্নবের চোখের জল উপচে পড়ছে।
সামনে থাকা মানুষের করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠেছে হল রুম।

অর্নব, নিরা বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে গেল। স্যার তাদের দোয়া করলেন, বললেন, “মাই ডিয়ার আমি বলেছিলাম এই বইয়ের এন্ডিং পাঠককে সুখে কাঁদাবে।”

নিরা হাসল। গাড়ি চলতে লাগল।

অর্নব বলল, “আমি গর্বিত আমি লেখক ইপ্সিতা রাহমানের প্রাণের মানুষ হতে পেরেছি।”

“ডক্টর, আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি। আমার ফ্লাইটের আগের দিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম বাবা-মা দুজন আমার সামনে এসেছেন। জীবনে প্রথম তাদের আমি স্বপ্নে দেখেছি। তারা আমাকে বললেন তুই অর্নবকে একা রেখে যাস না। তার বাবার শাস্তি তাকে দিস না। এই পৃথিবীতে সুখী মানুষের খুব অভাবরে মা। সুখী হওয়ার সুযোগও খুব কম মানুষ পায়। তুই অর্নবকে আপন করে নে। তোদের হাতে সুখী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তুই সুখী আছিস দেখে আমরা শান্তি পাব। এটুকু বলতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখলাম ফজরের আজান দিচ্ছে। উঠে নামাজ শেষ করলাম। সেই প্রথম আমি নিজেকে হালকা মনে করলাম ভাবলাম আমার ভাগ্যটা সত্যি খুব ভালো আমি আপনার কাছে থেকে যেতে পারব।”

অর্নব তার দিকে তাকিয়ে হাসল। নিরাও হেসে তার কাঁধে মাথা রাখল। শুরু হলো তাদের জীবনের অনিন্দ্য সুখের দিন। তারা আপনাদের দোয়া প্রার্থী।

প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here