#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৪
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল রিফাত কপালে হাত রেখে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“শ্যাম লাইট অফ করে দে। আলো সূচের মত বিঁধছে চোখেমুখে।”
নোভা কিছু না বলে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল রিফাতের মাথার কাছে। খাবারের ট্রে পাশে রেখে কপালে হাত রেখে বলল,
“রিফাত ভাই!”
রিফাত চমকে উঠল। ঝটপট করে উঠে বসতেই মাথা চেপে ধরল। অসহ্য যন্ত্রণা আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
কপালে হাত চেপে বলল,
“তুই? এখানে কেন?”
নোভা মাথা নিচু করে বলল,
“তোমার জন্য খাবার আর মেডিসিন নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও। ব্যথা কমে যাবে।”
রিফাত ট্রেতে নজর বুলিয়ে বলল,
“চায়ের কাপ রেখে চলে যা। খাবার, মেডিসিন কিছু লাগবে না আমার।”
নোভা বিছানার এক কোণে বসে অনুরোধের সুরে বলল,
“খেয়ে নাও না রিফাত ভাই প্লিজ।”
“ওফ, নোভা জ্বালাস না তো। যা এখান থেকে।”
নোভা মাথা নিচু করে বলল,
“আর জ্বালাব না। কিন্তু তুমি না খেলে মায়ের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আমাকে। প্লিজ খেয়ে নাও না। মা আবার জানতে চাইবে ব্যথা উপসম হলো কি-না।”
রিফাত ওঠে বসতে বসতে বলল,
“আন্টি জানে তুই সাতসকালে আমার কাছে এসে বসে আছিস?”
নোভা বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল,
“তোমার রুমে এসেছি রিফাত ভাই। কাছে নয়। মা জানে। মা-ই তার ঘর থেকে মেডিসিন দিয়েছে।”
“আর কেউ ছিল না বাড়িতে? তোকেই আসতে হলো?”
নোভা ধীর কণ্ঠে বলল,
“ছিল। তবে তাদের কারোরই তোমার ব্যথায় কিছু যায় আসে না।”
রিফাত ভ্রুকুটি করে বলল,
“তোর যায় আসে?”
নোভা মুচকি হাসল।
“যায় আসে রিফাত ভাই। কিছু আমার দূর্ভাগ্য তুমি তা বুঝলে না। হয়তো আমিই বোঝাতে পারি নি। নয়তো আমার চাওয়াতে কোনো কমতি ছিল। যাইহোক এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কোনো অভিযোগ নেই। না নিজের ভাগ্যের ওপর। আর না তোমার ওপর। আমি আর তোমাকে জ্বালাব না রিফাত ভাই। নিজের ভাগ্যকে সাদরে বরণ করে নিয়েছি। কাল রাতের জন্য আমি দুঃখিত। এখন তুমি খেয়ে নাও। পারলে গোসল করে নিও। তাহলে ব্যথা তাড়াতাড়ি কমে যাবে। আমি আসছি। ভাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকের আপ্যায়নের দায়িত্ব তো আমাকেই দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর এসে সব নিয়ে যাব। তুমি রেস্ট নাও।”
নোভা চলে যেতেই রিফাত ফোঁত করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“এ মেয়ে ব্যথা কমাতে এসেছিল না বাড়াতে!”
“বাবা!” দুই বর্ণের ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ কত গভীরতা তার। কত মায়া, ভালবাসা আর দায়িত্ববোধ। একটি চলন্ত বটগাছের নাম ‘বাবা’। তুমি যেখানেই যাও এই ‘বাবা’ নামক মানুষটা তোমার মাথায় ছায়া হয়েই থাকবে। সে তুমি এক বছরের বাচ্চাই হও আর একশ বছরের বুড়ো। বাবা সে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়েই যাবে।
নোভা ইয়াসিন মোন্তাজ কে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবা! এত দেরি করলে কেন? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমি। তুমি না কাল বললে ভোর হতেই চলে আসবে। তাহলে এলে না কেন?”
ইয়াসিন মোন্তাজ কিছু বলার আগেই ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই পাঁচ মিনিট তুই বাবাকে দেরি করিয়েছিস তাই না? পাঁচ মিনিট করে করে পাঁচ ঘন্টা লাগিয়েছিস?”
ইভান বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“বাবা! আমি কিছু করেছি? আমি সকাল থেকে রেডি হয়ে বসে ছিলাম। বলো আপুকে।”
ইয়াসিন মোন্তাজ মৃদু হেসে বললেন,
“ওর দোষ নেই মা। ও তো পারে না ফজরের নামাজের পরই চলে আসে। আলো ফুটতেই মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল আমার। আমিই পাঁচ মিনিট করে করে দেরি করেছি।”
ইভানা বিস্মিত হয়ে বলল,
“কেন বাবা?”
ইয়াসিন মোন্তাজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“এত সকালে আসলে লোকে কি বলবে?”
ইভানা কিছু বলার আগেই ফাহিমা করিম এগিয়ে এসে বললেন,
“লোকে কিছু বলবে না ভাইজান। ইভানা আপনার মেয়ে। সারাজীবন আপনার মেয়ে হয়েই থাকবে। বিয়ে দিয়েছেন বলে কি সম্পর্ক চুকে গেছে? না তো। আমি ওকে যতই ভালবাসি ও কিন্তু আমার মেয়ে হয়ে যাবে না। যেই অধিকার আপনার ওর উপর আছে সেটা আমি হাজার ভালবাসলেও কেড়ে নিতে পারব না। আপনার মেয়ে আপনারই থাকবে। মেয়ে আপনার, দেখতেও আপনি আসবেন। এতে লোকের কি? আমরা সমাজের ধরাবাঁধা নিয়ম বিরুদ্ধ ভাইজান। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বলে যে বাবা মাকে মাথা নিচু করে থাকতে হবে এই নিয়ম আমরা মানি না। বরং তাদের মাথাই উঁচু থাকা উচিৎ। তিল তিল করে বড় করা মেয়েকে নিঃশর্তে দিয়ে দেয় তারা। তাদের মাথা কেন নিচু থাকবে? আপনার যখন ইচ্ছা আপনি আসবেন। প্রয়োজনে ইভানা কে নিয়ে যাবেন। এখানে আমি বা আমরা বলার কে?”
ইয়াসিন মোন্তাজের ভারাক্রান্ত মনটা মূহুর্তেই ফুরফুরে হয়ে গেল। মেয়ের জন্য ভুল জায়গা বেছে নেন নি তিনি। ভালবাসার দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন- এই সুখে কারো নজর না লাগুক।
ফাহিমা করিম ইভানার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি মা, বাবাকে শুধু জড়িয়ে ধরে থাকলেই হবে? খেতে দেবে না?”
“আমরা খেয়ে এসছি আপা। আপনি ব্যস্ত হবেন না।”
ফাহিমা করিম কৃত্রিম রাগী কণ্ঠে বললেন,
“খেয়ে কেন আসলেন? এরপর থেকে মেয়েকে দেখতে এলে না খেয়ে আসবেন। পারলে দুদিন থেকে না খেয়ে থাকবেন। আর কিন্তু কখনো বলবেন না, খেয়ে এসছি। ইভান বাবা তুমিও এসো। ভাইজান আসুন।”
ইভানাও তাল মিলিয়ে বলল,
“বাবা চলো।”
“আরও একজন তো এসেছে আমাদের সাথে। সে তো এখনো ভেতরেই এলো না।”
ইভানা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি মেলতেই এক নারীকণ্ঠ উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“ইভা!”
ইভানা পেছনে ঘুরে সায়মা কে দেখে খুশি ধরে রাখতে পারল না। উৎফুল্ল হয়ে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আসবি বলিস নি তো।”
সায়মা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“আগে থেকে অ্যাপয়েনমেন্ট দিয়ে আসতে হবে?”
ইভানা হেসে ফেলল। বলল,
“হ্যা। ইভানা আফরোজ অ্যাপয়েনমেন্ট ছাড়া কারো সাথে দেখা করে না।”
সায়মা পুনরায় কিছু বলার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো আবরার। সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে ইভানার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি একটু বের হচ্ছি। আধঘন্টার মধ্যেই ফিরব।”
ইভানা নিচু গলায় বলল,
” তা আমাকে বলছেন কেন? আমি জেনে কি করব?”
আবরার কপাল চাপড়ে বলল,
“দাদীর কথা শুনে সতেরো বছরের স্বপ্নাকে বিয়ে করলেই ভালো হতো। এটাও বাচ্চা, ওটাও বাচ্চা। আসছি আমি।”
ইয়াসিন মোন্তাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা আমার একটু বের হতে হবে। জরুরী দরকার। আপনারা আছেন তো? ফিরে এসে আলাপ করি?”
“আমরা চলে যাব কিছুক্ষণেই। তুমি বের হও। সমস্যা নেই। সন্ধায় তো দেখা হচ্ছেই।”
আবরার মৃদু হেসে বলল,
“তাহলে আসি আমি। আসছি।”
ইভানার দিকে তাকিয়ে সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো।
“রিফাত ভাই। কোথায় তুমি?” ঘরের ভেতর কোথাও রিফাত কে দেখতে না পেয়ে গলা বাড়িয়ে বলল নোভা। তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রিফাত। সদ্য গোসল সেরেছে সে। খালি গায়ে, ভেজা চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে। নোভা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“ব্যথা কমেছে রিফাত ভাই?”
রিফাত ভ্রুকুটি করে নোভার ফিরিয়ে নেওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অনেকটা। শ্যাম কোথায়?”
নোভা ট্রেতে প্লেট, কাপ গোছাতে গোছাতে বলল,
“শ্যামদা বেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মাত্র দাদাভাইও গেল।”
“কেন? কোথায় গেছে?”
নোভা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“জানিনা তো। তুমি রেস্ট নাও। আসছি।”
বাইরে বেরিয়েই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল নোভা। চেপে রাখা নিশ্বাস ছেড়ে দিল শব্দ করে। আরেকটু হলে মরেই যেত বোধহয়। ওইভাবে কেউ সামনে আসে? কেন বোঝে না ওই চেহারা নোভা ঠিক হজম করতে পারে না।
বছর তিনেক আগের একটা ঘটনা মনে হতেই নোভা মুচকি হেসে মাথা নুয়ে ফেলল। লজ্জারা সেদিনের মতই ঝিমিয়ে পড়তে বাধ্য করল তাকে।
বছর তিনেক আগের ঘটনা অথচ মনে হয় যেন জলের মতো পরিষ্কার ভাবে ভাসছে স্মৃতির পাতায়।
নোভা তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। সবে বয়ঃসন্ধি কালের সূচনা। দেহের পরিবর্তনের সাথে মনের পরিবর্তন ঘটার উপযুক্ত সময়। সেদিনের সেই কিশোরী নোভা কোমল মনের অধিকারিণী। আর রিফাত? সে তখন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের টগবগে যুবক। চাকরি পাওয়ার আনন্দে এতিম ছেলেটা সর্বপ্রথম দেখা করতে আসে ফাহিমা করিমের সাথে। যে তাকে মায়ের মত মমতা দিয়েছেন। আবরার তখন ইতালির মাটিতে পা দিয়েছে। শ্যামলও কর্মসূত্রে বাইরে। একমাত্র রিফাতই ছিল যে এই পরিবারের খুঁটিনাটি প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলের মত আগলে রেখেছে। ফাহিমা করিম রিফাত কে বাড়িতে থাকতে বললেও রিফাত থাকতে পারেনি সংকোচে। তবে কাছাকাছিই থেকেছে। যদি প্রয়োজন হয়।
সেদিন রিফাত বাড়িতে এসে ফাহিমা করিম কে ডেকে হয়রান হয়ে পা বাড়ায় নোভার রুমে। নোভা তখন উল্টো হয়ে শুয়ে স্কুল লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসা #ঘুম উপন্যাসটি পড়ছিল। রিফাত কে দেখে হকচকিয়ে যায় নোভা। হাত থেকে বইটি ফেলে দিয়ে ভীতু কণ্ঠে বলল,
“রিফাত ভাই! তুমি এসময়?”
রিফাত সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তুই কি করছিলি এতক্ষণ?”
নোভা মাথা নিচু করে হাটুর নিচে বই লুকোনোর চেষ্টা করে বলল,
“কিছু না তো। শুয়ে ছিলাম।”
রিফাত স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে নোভার হাতে বই ছিল। এগিয়ে এসে বলল,
” কি লুকিয়েছিস ভালভাবে দিয়ে দে।”
নোভা দিল না। গুটিশুটি মেরে বসে রইল। রিফাত এগিয়ে এসে হাত ধরে সরাতে চাইলেও নোভা স্টিল শক্ত হয়ে বসে রইল। বাধ্য হয়ে হাঁটুতে হাত দিয়ে উঁচু করে লুকোনো বইটি নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। মুখ বেকিয়ে বলল,
“ঘুম! কি আছে বইতে? লুকিয়ে রেখেছিলি কেন?”
বলতে বলতে নোভা যে পৃষ্ঠা পড়ছিল সেই পৃষ্ঠা বের করল। লেখার উপর নজর বুলিয়ে দেখতেই চোখ বড় বড় করে তাকাল নোভার দিকে। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“তুই বড় হয়ে গেছিস?”
নোভা মাথা নিচু করে ফেলল। সে এতক্ষণ যে পৃষ্ঠা পড়ছিল সেখানে নায়ক নাইকার খোলামেলা কিছু আলাপন এবং দৃশ্যপট ছিল। দেখে দেখে রিফাতও সেই পৃষ্ঠাই বের করে পড়ে ফেলেছে।
নোভা কিছু বলছে না দেখে রিফাত বিছানায় বসে বলল,
“এগুলো বাচ্চাদের বই নয় নোভা। তুই পড়বি বাচ্চাদের বই। তুই পড়বি আম আঁটির ভেঁপু, কাজলের দিনরাত্রি, দীপু নাম্বার টু এসব বই। তুই কেন অ্যাডাল্ট বই হাতে নিলি? এখন যদি আমি তোর সাথে অ্যাডাল্ট কোনো কাজ করে ফেলি ভালো লাগবে? লাগবে না তো। এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ছিলি এতে ক্ষতি কার হচ্ছিল? আমার? আন্টির? না নোভা, তোর ক্ষতি হচ্ছিল, হচ্ছে। এগুলো পড়ে তোর মাথায় এগুলোই ঘুরবে। নিশ্চয়ই বান্ধবীদের চক্করে এসব হাতে নিয়েছিস? একজনে পড়ে বাকি সবাই কে উৎসাহ দিচ্ছে পড়ার জন্য । একদিন বান্ধবীদের চক্করে ছেলে ঘাটিত মামলায়ও ফেঁসে যাবি। দেখতে তো পরীর মত। প্রপোজাল নিশ্চয়ই পাচ্ছিস। এই তুই এখনই জড়িয়ে পড়িস নি তো? প্রেম করিস?”
এতক্ষণ মনোযোগী ছাত্রীর ন্যায় শুনলেও শেষ কথাটা শুনে নোভা লাজে রাঙা হয়ে মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইশারা দিল।
রিফাত সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“সত্যি বলছিস তো?”
“তোমার কসম।”
রিফাত হেসে বলল,
“আমি কি তোর অপছন্দের তালিকায়?”
নোভা মুচকি হেসে বলল,
“পছন্দের তালিকায় সবার উর্ধ্বে।”
চলবে….#সেদিন_বসন্ত_ছিল
#রাহনুমা_রাহা
#পর্বঃ১৫
ফাহিমা করিম আসতে দেরি হওয়ায় রিফাত চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু নোভা বাঁধা দিয়ে বলল,
“একটু বসো। মা চলে আসবে এক্ষুণি।”
রিফাত ফাহিমা করিম কে ফোন দিয়ে জানতে পারে আধঘন্টা সময় লাগবে তার। ফাহিমা করিম এটাও জানান আজ রাতের আগে ছাড়বে না তাকে। এসে রান্না করে খায়িয়ে তবেই ছুটি।
ফাহিমা করিমের কথা রিফাতের কাছে শিরোধার্য । মানতেই হবে। থাকতে যেহেতু হবেই তাই ছুটল ওয়াশরুমে। গোসল সেরে তবেই শান্তিতে একটু বসতে পারবে।
নোভা হালকা নাস্তা নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখল রিফাত গোসল করে বের হয়েছে। খালি গায়ের কালচে শরীর দেখে প্রথম কাঁপন ধরল কিশোরী শরীরে। শিরায় শিরায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে পোঁছে গেল সুক্ষ্ম অনূভুতির দল। অদ্ভুত অনুভূতির আন্দোলনে আন্দোলিত হলো কিশোরী মনটাও। হাতে ধরে রাখা খাবারের প্লেট স্বশব্দে গর্জন করে লুটোপুটি খেলো ঝকঝকে মেঝেতে।
রিফাত শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে নোভার দিকে নজর ফেলতেই দেখল নোভা তার দিকেই হা করে তাকিয়ে আছে। যাকে বলে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা।
ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে এলো তার। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কি দেখছিস এমন করে?”
নোভা নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকেই কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে রিফাত ভাই।”
রিফাতের চোখ এবার কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। শার্ট গায়ে জড়িয়ে বলল,
“এখনো মাথার ভেতর বইয়ের পোকারা কিলবিল করছে তাই না? ঠাটিয়ে এমন চড় মারব যে সিধে হয়ে যাবি।এই বেয়াদব তোর বয়স কত জানিস? মাত্র পনেরো বছর। এখনই এসব বলে কয়ে বেড়াচ্ছিস। আমার বয়স জানিস? তোর দ্বিগুণ। আবরারের বোন নাহলে তোর আমাকে আংকেল ডাকা উচিৎ ছিল। আর সেই হাঁটুর বয়সী তুই আমাকে এভাবে সুন্দর বলছিস। লজ্জা করে না?”
নোভা ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“ওমা! সুন্দর কে সুন্দর বলব, এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?”
রিফাত মাথার চুল একহাতে খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“নোভা চড়িয়ে সিধে করে ফেলব কিন্তু আমি। থেমে যা বলছি। নইলে আন্টিকে বলে দেব তুই কিসব বই পড়ছিস। কিসব করে বেড়াচ্ছিস।”
নোভা হেসে বলল,
“তাই! কি বলবে মা’কে? কিভাবে বলবে? বইয়ে কি কি লেখা ছিল বলতে পারবে? তুমি তো পড়োই নি জানবে কি করে কি ছিল?”
রিফাত এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে নোভার মুখ বরাবর হয়ে বলল,
“তুই কি চাইছিস আমি বইয়ের কার্যকলাপগুলো তোর ওপর অ্যাপ্লাই করি? তার জন্য আমাকে উসকাচ্ছিস? আমার সমস্যা নেই। আমি ছেলে মানুষ। তার উপর প্রাপ্ত বয়স্ক। যা হওয়ার তোর হবে। চাইছিস সত্যি সত্যি? করব অ্যাপ্লাই?”
নোভা লাফিয়ে পেছনে সরে গেল। রুম ত্যাগ করতে করতে বলল,
“তুমি খুব অসভ্য হয়ে গেছো রিফাত ভাই।”
নোভা কে দেয়ালের সাথে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাহিমা করিম নমনীয় গলায় বললেন,
“নোভা, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
নোভা চকিতে তাকাল। আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে মা মাথাটা ঘুরে গেছিল। তাই একটু দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।”
ফাহিমা করিম চিন্তিত হয়ে বললেন,
“ঠিক আছো তো? ডাক্তারের কাছে যাবে?”
নোভা মৃদু হেসে বলল,
“আমি একদম ঠিক আছি মা। হয়তো ছুটোছুটির জন্য এরকম হলো। তুমি চিন্তা করো না তো। তুমি কি রিফাত ভাইয়ের কাছে এসেছো?”
ফাহিমা করিমের মনে বোধহয় তবুও চিন্তার রেশ রয়েই গেল। আনমনে বললেন,
“হ্যা। দেখে আসি ছেলেটাকে। তুমি যাও। একটু জিরিয়ে নাও। এত ছুটোছুটি করো না।”
নোভা মাথা নেড়ে সায় জানালো। পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে।
ফাহিমা করিম মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিফাতের ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে বললেন,
“আসব?”
রিফাত ফাহিমা করিমের কণ্ঠ শুনে নিজেই দরজার সামনে এসে বলল,
“আন্টি তুমি! ভেতরে এসো না । অনুমতি কেন চাইছো?”
ফাহিমা করিম মৃদু হেসে বললেন,
“ছেলে বড় হলে মায়েদের অনুমতি নিয়েই প্রবেশ করতে হয়।”
রিফাত আহ্লাদী গলায় বলল,
“আমি তো এখনো ছোটই আছি আন্টি। তাই যখন ইচ্ছে হুটহাট চলে এসো।”
ফাহিমা করিম মাথা নেড়ে হাসলেন।
রিফাতের কপালে হাত রেখে বললেন,
“এত মাথা ব্যথা কেন করছে বাবা? জ্বর টর এলো নাকি?”
রিফাত ফাহিমা করিমের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলল,
“জ্বর নেই আন্টি। রাতে ঘুমোতে পারিনি। তাই হয়তো…”
ফাহিমা করিম আফসোসের সুরে বললেন,
“ঘুমের আর কি দোষ। এই ঘুপচি ঘরে কি আর ঘুম হয়। আজকের দিনটা একটু মানিয়ে নে বাপ। কাল থেকে নোভার পাশের ঘরটা খালি হয়ে যাবে। কি করব বল? এত আত্মীয় স্বজন। তাদের এই ঘরে থাকতে দিলে নানান কথা হত। তুই তো আমার নিজের ছেলে। তাই কষ্টটা তোকেই পেতে হলো। আমি জানি তোর এক অঙ্গ ক্ষয় হয়ে গেলেও তুই অভিযোগ করবি না। তাই সেই সুযোগটাই নিতে হলো। মায়েরা খুব স্বার্থপর তাই না রে?”
“ওফ আন্টি সেন্টি খাচ্ছো কেন? আমি ঠিক আছি। আমার এমনিতেই ঘুম হয় নি। শ্যাম তো মরার মত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল। তাই ঘরের দোষ দিয়ে নিজেকে অপরাধী করো না। এখন চলো। আজ তো বৌভাত। কাজে হাত লাগাতে হবে তো।”
ফাহিমা করিম রিফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমি যদি তোকে পেটে ধরতে পারতাম!”
রিফাত জোর করে হেসে চাপা গলায় বলল,
“ভাগ্যিস ধরো নি!”
শ্যামল বাইরে থেকে এসে বারান্দা পেরিয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দ করা ছোট্ট ঘরে প্রবেশ করার ঠিক আগ মূহুর্তে একটা হাতের হ্যাচকা টানে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি কক্ষের ভেতর প্রবেশ করল। এহেন কাজের জন্য ব্যবহৃত হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই প্রসন্ন হলো। সায়মা হাস্যজ্বল নেত্রে পরখ করছে তাকে।
মৃদু হেসে বলল,
“তুমি! কখন এলে?”
“তুমি যখন বাইরে ছিলে। কোথায় গিয়েছিলে?”
শ্যামল ঘুরে সায়মাকে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল,
“একটা কাজে ফেঁসে গিয়েছিলাম। আর কে কে আসছে?”
“আংকেল আর ইভান এসছিল। ওরা চলে গেছে। আমি নোভার সঙ্গে সন্ধ্যায় যাব।”
শ্যামল মুচকি হেসে বলল,
“আমিও যাচ্ছি।”
সায়মা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“তবে তো শাপে বর হলো।”
শ্যামল ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সায়মা পুনরায় বলল,
“তোমার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটানো যাবে। এটা শাপে বর নয়?”
শ্যামল চোখে চোখ রেখে নিচু গলায় বলল,
“ছোঁবো?”
“আর তো মাত্র দু’মাস।” সায়মার কোমল গলায় বলা উত্তর।
শ্যামল পিছিয়ে গেল। মাথা চুলকে হেসে বলল,
“এরকম আইটেম বম সেজে থাকলে তো ছোঁয়ার ইচ্ছে জাগবেই। তখন দু’মাস মাথায় থাকে? তুমি আমার পণ ভাঙার চেষ্টা করছো মেয়ে?”
বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন্য নিজেকে পরিপাটি করে আয়নায় দেখছিল ইভানা। এহেন সময় আবরার আয়নায় ইভানার প্রতিবিম্ব দেখে অপলক চেয়ে রইল। কিঞ্চিৎ সময় পর ইভানার চোখ আবরারের উপর পড়তেই দেখতে পেল তার চোখ দুটোও আরশিতে নিবদ্ধ।
ইভানা পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। নিচু গলায় বলল,
“আপনি রেডি হবেন না?”
আবরার উত্তর দিল না। নির্বিকার চেয়ে রইল। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল,
“একটু ছুঁই?”
চলবে…