#হৃদয়ের দহন
#পর্বঃ৯ এবং শেষ
#সামিরা পপি
নাবিল পপির সামনে গিয়ে বলল,
—“তুমি কোন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে আসছ?কই সে?”
পপি নাবিলকে দেখে মুচকি হাসল।মনে মনে বলল,
—–“রিহানের কথা এখন বলব না।পরে সারপ্রাইজ দিব।”
মনে মনে ভেবেই মুচকি হাসল।পপির কোন জবাব না পেয়ে নাবিল ভ্রু কুঁচকালো।আর বলল,
—-“কি হলো কথা বলছ না যে?”
পপি নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-“এসেছিল আবার চলে গেছে।তবে তার সাথে তোমাকে আমি রাতে মিট করিয়ে দিব।আজ তো আমার বার্থডে তুমি জানো।রাতে বাসায় আসবে সে।তখন মিট করিয়ে দিব।”
নাবিলের কাছে পপির কথাটা ভালো লাগল না।কুঁচকানো ভ্রু জোরা আরেকটু কুঁচকে বলল,
—-“ওহ।তা সে ছেলে না’কি মেয়ে?”
—-“সেটা রাতেই দেখবে।আচ্ছা এখন চলো কলেজে যাই।”
—-“হ্যাঁ চলো।”
পপি ও নাবিল কলেজের দিকে যেতে লাগল।পপি নাবিলের সামনে রিহানের সাথে কথাও বলতে পারছে না।তাই রিহানকে একটা টেক্সট করে দিল।কিছুক্ষন পর দুইজনেই কলেজে পৌঁছে গেল।
এইদিকে সামিরা রিহানকে বলল,
—-“আচ্ছা ভাইয়া আমি তো এখন কলেজে যাবো।তা তুমি কি বাড়ি চলে যাবে?”
—-“না।পপির সাথে ঘুরব আর তোকে নিয়েও।দাঁড়া পপিকে ডাক দিচ্ছি।”
বলেই বসা থেকে উঠে এদিক ওদিক তাকাল কিন্তু পপিকে দেখতে পারল না।তাই মোবাইল বের করল কল দিতে।তখনি দেখল পপির ম্যাসেজ।ম্যাসেজ ওপেন করে দেখল।
—-“আমি এখন কলেজে যাচ্ছি।আজকের দিনটা তোমার আর সামিরার।তাই তোমাদের ভাই বোনের মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি হলাম না।আর হ্যাঁ তুমি কিন্তু বাড়ি যাবে না।রাতে যেন আমাদের বাড়িতে উপস্থিত থাকো।সাথে সামিরাকেও নিয়ে আসবে।”
রিহান ম্যাসেজ পরে হাসল।সামিরা বলল,
—-“কি হলো ভাইয়া কই আপু কল দাও?”
রিহান মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
—-“তোর আপু কলেজে চলে গেছে।তুই চল আজকে সারাদিন আমার সাথেই কাঁটাবি।”
—-“কিন্তু ভাইয়া আমার কলেজ?”
—–“কলেজে একদিন না গেলে কিছুই হয়না।তুই চল।”
বলেই সামিরাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেল।সেখানে দুইজন একসাথে নাস্তা করে নিল।তারপর দুইজন একসাথে অনেক ঘুরাঘুরি করেছে।একসাথে লাঞ্চ করেছে।কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও সামিরার মাথায় ঘুরছে অন্য কথা।আর তা হলো নাবিলদের ঘরে যাবে না সে।আবার মামার বাড়িও যাবেনা।ওইদিকে সোমার বাসায় যাওয়ার প্ল্যান।আবার এইদিকে রিহান।তাই সিদ্ধান্ত নিল এখন নাবিলদের বাসায় যাবে।যা করার রাতে করবে।যেইভাবা সেই কাজ।রিহান সামিরাকে নাবিলদের বাড়ির সামনে রেখে গেল।যদিও সামিরা রিহানকে অনেক বলেছে ভেতরে যাওয়ার জন্য কিন্তু রিহান যাইনি।বলেছে আগামীকাল আসবে।কিন্তু তা কি আসা হবে?
এইভাবে সারাদিন চলে গেল।গড়িয়ে এলো রাত।আজ পপির বার্থডে।তাই নাবিল পপির জন্য বেশ কিছু গিফট নিল।সাথে একটা রিংও।আজ পপিকে চমকে দিবে।সুন্দর করে একটা মিষ্টি কালার শার্ট আর উপর সাদা কোর্ট আর সাদা প্যান্ট পড়ে,হাতে ঘড়ি।চুলে জেল দিয়ে চুল গুলো ঠিক করে নেয়।আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নেয়।না এত খারাপ লাগছে না।তখন রাত আটটা নাবিল ঘর থেকে বের হয় পপির বাড়ির উদ্দেশ্য। একবার ভেবেছিল সামিরাকে বলবে যাওয়ার কথা।পরে আবার ভাবল না তার যাওয়া ঠিক হবে না।তাই আর সামিরাকে না ডেকে নিজেই চলে গেল।এতক্ষন সামিরা হয়তো নাবিলকেই পাহারা দিচ্ছিল।নাবিল বের হওয়ার পর সামিরা গুটিগুটি পায়ে নাবিলের রুমে যাই।গিয়ে সারা রুম একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই রুমে।যখন নাবিলের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল তখন দুইজনে কত আড্ডা দিত এই রুমে।কত দুষ্টুমি করত।আর এখন সেই সব স্মৃতি।ভাবতেই সামিরার দুই চোখে পানি টলমল করে উঠল।বুক ভারি হয়ে এলো।এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে যে মারা যাবে।তাই আর দেরি না করে নাবিলের খাটের উপর একটা লেটার আর তার মোবাইলটা রেখে বেড়িয়ে পড়ল।মোবাইলটা নাবিল দিয়েছিল তাই নাবিলের রুমে রেখে গেল।তারপর মামনির রুমে গেল।গিয়ে দেখল মামনি নামাজ পড়ছে আঙ্কেল নেই।আর কিছু না ভেবে হাতে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সামিরা।যাওয়ার আগে সারা বাড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।
ওইদিকে পার্টি জমজমাট।সারাবাড়িতে মেহমানের হৈ চৈ।সব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।পপিও সুন্দর করে সেজেছে।সাদা একটা গাউন।সাদা পাথরের ছুড়ি,সাদা পাথরের চুলের পাশে লাগানো ক্লিপ,সাদা পাথরের কানের দুল,সাদা পাথরের ছোট্ট নেকলেস।সব মিলিয়ে পপিকে একটা সাদা পরি মনে হচ্ছে।যাকে বলে হোয়াইট এঞ্জেল।নাবিলও এসেছে।ভাগ্যক্রমে নাবিলের সাথে পপির ড্রেস ম্যাচিং হয়ে গেছে।পপি নাবিলকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে যাই।আর বলে,
—-“ওয়াও তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।”
নাবিল মাথা চুলকে হেসে বলল,
—-“থ্যাঙ্কিউ। তোমাকেও হোয়াইট এঞ্জেল লাগছে।”
—-“থ্যাঙ্কিউ।”
নাবিল সামিরার দিকে গিফট এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-“ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্ন অফ দ্যা ডে। হ্যাপি বার্থডে। ”
পপিও হাসি মুখে গিফট নিয়ে বলে,
—-“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
নাবিল আবার বলল,
—-“আচ্ছা কই তোমার সেই ফ্রেন্ড?মিট করাবে না?”
পপি বলল,
—-“ওহ হ্যাঁ ওয়েট।রিহান এদিকে এসো।”
ছেলের নাম শুনে নাবিলের ভ্রু আপনা আপনি কুঁচকে এলো।তখনি রিহান সামনে এসে দাঁড়াল।পপি নাবিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—-“এই হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড।”
নাবিল রিহানকে দেখে অবাক হলো।বলল,
—-“এইটা তোমার ফ্রেন্ড?উনাকে তো আমি সকালে পার্কে দেখেছি সামিরার সাথে!কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার ফ্রেন্ড চলে গেছে।কিন্তু তখন উনি সামিরাকে জড়িয়ে ধরেছিল।”
পপি আর রিহান অবাক হলো।পপি বলল,
—-“তারমানে তুমি ওকে দেখেছ?”
—-“হ্যাঁ।কিন্তু সামিরার সাথে উনার কি সম্পর্ক?নিশ্চয় বিএফ তাই না?যাইহোক সামিরা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
রিহান অবাক হয়ে বলল,
—-“মানে?কি বলছেন?বিএফ হতে কেন যাবো সামিরাতো আমার বোন।”
নাবিল অবাক হয়ে বলল,
—-“বোন মানে?কেমন বোন?কিসের বোন?সামিরা তো আমাদের বাসায় দুই বছর ধরে থাকে।কই কখনও তো আপনার কথা শুনিনি।”
পপি বলল,
—-/”আরে নাবিল রিহান সত্যি বলছে।সামিরা রিহানের ফুফাতো বোন।দুই বছর আগে সামিরা চলে এসেছিল।আর আজকেই তাদের দুইজনের দেখা হয়েছে আমার মাধ্যমে।তাই ভাই বোন দুইজনে কান্না করছিল আর জড়িয়ে ধরেছিল।”
নাবিল যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।আপাদত সামিরার কথা বাদ রেখে বলল,
—-“তোমার মাধ্যমে মানে?আর তুমি উনাকে কেমনে চিনো।”
এইবার পপি মাথা নিচু করে লজ্জার ভঙ্গিতে বলল,
—-“আসলে রিহান আমার ফ্রেন্ড না।ও আমার বয় ফ্রেন্ড।ওর সাথে আমার দুই বছরের রিলেশন।সেটা এতদিন কেউকে বলিনি।তাই আজকে সারপ্রাইজ দিব বলে এইখানে এনেছি।”
পপি সাথে সামিরার সাথে রিহানের দেখা হওয়াটাও বলে।কিন্তু নাবিল যেন এইসব কিছুই শুনছে না।তার মাথায় একটা কথায় ঘুরছে আর তা হল, “রিহান আমার বয়ফ্রেন্ড।”নাবিলের এই মূহুর্তে যেন দুনিয়া ঘুরছে।চোখে সব অন্ধকার দেখতে লাগল।প্রচুর কান্না আসতে লাগল।বুকের ভেতর চিন চিনে ব্যাথা অনুভব হতে লাগল।এইদিকে পপিকে কেক কাঁটার তাড়া দিল।সে সেদিকে চলে গেল।আর নাবিল পেছনে হাঁটা দিল।সে এক মুহুর্তও আর এইখানে দাঁড়াতে পারবে না।
হয়তো সে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে।সোজা ঘরে এসে নিজের রুমের দরজা দিল।ফ্যান জোড়ে চালিয়ে দিল।মাটিতে বসে পড়ে জোরে চিৎকার করে কান্না করতে লাগল।কি হয়ে গেল তার সাথে?কান্না করতে করতে চোখ গেল খাটের উপর।একটা খাম আর একটা মোবাইল।চোখ মুছে মোবাইল হাতে নিল।চিনতে একটুও কষ্ট হলো না এইটা সামিরার মোবাইল।মোবাইল রেখে খাম খুলল,
” আপনাকে কি বলে সম্বোধন করব তা জানিনা।যদিও জানতাম আগে কিন্তু তা এখন আর নেই।তাই “প্রিয় বা প্রিয় নাবিল” কিছুই বললাম না।সোজা লিখে ফেললাম।আমি জানি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি।আপনাকে অনেক বিরক্তও করেছি।কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি একটুও ইচ্ছে করে করতে চাই নি।শুধু ভালবাসি বলেই পাগলামী করেছি।আর এই পাগলামীর কারনে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।একবারও বুঝতে চাইনি আপনার মনের কথা।একবারও জানতে চাইনি আপনি কেউকে পছন্দ করেন কি’না।সব সময় নিজেরটাই ভেবেছি।কিন্তু যখন জানতে পারলাম আপনি অন্যকেউকে ভালবাসেন তখন আর নিজেকে আঁটকাতে পারলাম না।তাই প্রচুর কান্না করেছি।তখন মনে হয়েছিল কেউ আমার কলিজার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।আর আমি সেই আগুনের দহনে দগ্ধ হয়েছি।আর এইখানে থেকে কখনও চোখের সামনে আপনাকে অন্যকারো সাথে দেখতেও পারতাম না।এখন না হোক কয়েক বছর পরে হলেও তো বিয়ে করতেন তখন কষ্ট পেতাম।আমি সে কষ্ট আর পেতে চাই না।তাই চলে যাচ্ছি আপনার জীবন থেকে।ভালো থাকবেন।ভালবাসার মানুষটাকে আগলে রাখবেন আর মামনি ও আঙ্কেলের খেয়াল রাখবেন
—-“সামিরা”—-
নাবিল লেটার পড়ে আরো জোরে কেঁদে উঠল।এখন সে বুঝতে পারছে এতদিন সামিরা কতটা কষ্ট পেয়েছে।ভালবাসার মানুষটাকে না পেলে যে কত কষ্ট সে বুঝতে পারছে।সে এতদিন সামিরার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারেনি।নিজেকে বেশ অসহায় লাগছে।নাবিলের কান্নার আওয়াজ শুনে নাবিলের মা পাশের রুম থেকে আসে।এসে নাবিলের এমন কান্না দেখে তিনি আৎকে উঠলেন।নাবিলের কাছে গিয়ে বসে বলল,
—-“বাবা কি হয়েছে তুই কাঁদছিস কেন?”
নাবিল কান্নারত অবস্থায় ডুকরে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-“মা সব শেষ হয়ে গেছে।শুধু মাত্র আমার ভুলের জন্য মা।শুধু মাত্র আমার ভুলের জন্য।”
—-“বাবা শান্ত হ।কি হয়েছে সেটা বল নয়তো বুঝব কি করে?”
—–“মা আমার ভুলের জন্য সামিরা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।সব দোষ আমার মা”
সামিরার চলে যাওয়ার কথা শুনে রোমানা যেন শকড হয়ে গেছে।উত্তেজিত হয়ে বলল,
—-“মানে কি?কোথায় গেছে সামিরা?আর তুই কি করেছিস ওর সাথে?”
নাবিল কান্না করতে করতে এতদিনের সব কথা বলে রোমানাকে।রোমানা সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যাই।আর সে বুঝতে পারে সামিরা সকালে এমন কথা গুলো কেন বলেছিল।রোমানা যেন মূর্তি হয়ে গেছে।একভাবেই বসে রয়েছে।হঠাৎ নাবিলের খেয়াল হলো সামিরাকে খুঁজতে যাওয়ার কথা।দ্রুত উঠে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।সারা রাত সামিরাকে খুঁজল কিন্তু পেল না।শেষ রাতের দিকে বাড়ি ফিরে।এসে দেখে রোমানা ও আজাদ সাহেব বসে আছে।রোমানা নাবিলকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল,
—-“কিরে পাসনি সামিরাকে?কই সামিরা?”
নাবিল মা’য়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।আর মা’য়ের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
চলে গেছে এক সপ্তাহ।সামিরাকে অনেক জায়গায় খুঁজেছে নাবিল কিন্তু পায়নি।পুলিশ কেস ও করেছে কিন্তু সামিরার দেখা সাক্ষাত মিলল না।না কোন হদিস।সেই থেকে নাবিল কেমন জানি হয়ে গেছে।না ঘর থেকে বের হয় না কারো সাথে কথা বলে আর না ঠিক মত খায়,ঘুমাই।নাবিলের মারও একি অবস্থা।তবে নাবিলের অবস্থা খুবই খারাপ।নাবিল এর মধ্যে পপির কথা ভুলে গেছে।কারন সে বুঝতে পেরেছে সামিরার ভালবাসা।কিন্তু সেটা অনেক দেরিতে।এখন মনে মনে শুধু সামিরাকেই খোঁজে।সামিরার জন্যই তার হৃদয়ের দহন হয় প্রতি নিয়ত।
আসলেই আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝিনা।যখন কারো থেকে বেশি পাত্তা পায় তখন আমরা পাত্তা দেয়না।আর যখন মানুষটা দূরে চলে যাই তখনি বুঝি জীবন থেকে কি হারিয়েছি।
নাবিল রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।এই দৃষ্টিতে শুধু না পাওয়ার বেদনা।আকাশ পানে চেয়ে আনমনে নাবিল বলতে লাগে____
“থাকিতে তুমি নড়েনি কড়া আমার এই মনের কোণে…
তুমিহীনা প্রতি নিয়ত জ্বলছি আমি হৃদয়ের দহনে”
______সামিরা পপি______
সমাপ্ত
কেমন লাগল গল্পটা প্লিজ সবাই জানাবেন।