#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২৪
.
.
” তো মিসেস অতলের ঘুম ভাঙলো তাহলে?”
” হুম। আপনি কখন উঠেছেন? ”
” বেশ অনেকক্ষণ হলো। তো কেমন লাগছে এখন তোমার শরীর ? ”
” আমার আবার কেমন লাগবে? আমি তো দিব্যি আছি। ”
” এখন হয়তো দিব্যি আছো তবে.. কিছুক্ষণ আগ অবধি দিব্যি ছিলে না। গা টা হালকা গরম গরম ছিল।আমি তো বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমার শরীর গরম দেখে। ”
” ও কিন্তু এখন ঠিক আছি। গা টা একেবারেই ঠান্ডা। আগে জ্বর থাকলেও এখন নেই।”
” ঠান্ডা তো হবেই। এই আমার দুটো হাতের সেবা যে পেয়েছ।”
” হুম, তো কিছু খেয়েছেন? মানে…. ব্রেকফাস্ট করেছেন? ”
” ক’টা বাজে দেখেছ? বেলা ১২ টা বাজে। এখনো কি ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় আছে? আর সময় থাকলেও খবোই বা কি? ঘরে তো পাউরুটি আর জেলি ছাড়া কিছুই নেই। ”
“এতো বেলা হয়ে গিয়েছে আর আমি পরে পরে ঘুমোচ্ছিলাম! ছি ছি! ”
” আরে ছি ছি করছ কেন, এতো বেলা অবধি ঘুমিয়েছ তো কি হয়েছে? এখানে কি তোমার শ্বশুর শাশুড়ি আছে যে, বেশিক্ষণ ঘুমালে লজ্জায় পড়তে হবে? কিংবা কথা শুনতে হবে? ”
” তারপরও এসব মোটেও ঠিক না। মা বলতো ঘরের বউকে এতো বেলা অবধি ঘুমাতে নেই।লক্ষী অলক্ষী বলেও তো কিছু কথা আছে না-কি।”
” ইশ! এসেছে ঘুমোতে নেই। বউ কি মানুষ না? ”
” কিন্তু…”
তানহাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে অতল বলল,
” কোনো কিন্তু না, কাল রাতে যে ধকল গিয়েছে তোমার উপর দিয়ে তারউপর ভোর থেকে গায়ে জ্বর। তুমি ঘুমোবে না তো কি করবে! ”
অতলের কথা শুনে তানহার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। লজ্জায় যেন তার চোখ মুখ ফুটে আগুনের ফুলকি বের হবার উপক্রম। অতল ব্যাপারটি বুঝে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
” চোখ বড় করলে কেন, লজ্জা পাচ্ছো বুঝি? ”
” না মানে…. ”
” মানে টানে কিচ্ছু না। এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই তানহা। আমরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ আর সেই সুবাদে এরকম একটু আধটু কথা তো হতেই পারে। তা না হলে হসপিটালের কেবিনে ছোট্ট ছোট্ট হাত পা বুকে জড়িয়ে ধরবো কি করে বলো? ”
” আপনি কি যে বলেন না এসব, আল্লাহ!”
” কি আবার বললাম? ভুল কিছু কি বলেছি? সত্যি তো বলেছি। কাল রাতে তো কেবল মাঠে নামার ট্রেনিং হলো। তাইতো শর্ট টাইমেই ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু দৈনন্দিন বিশ্বকাপ তো পরেই রয়েছে। আর এতেই এতো লজ্জা পেলে তাহলে দৈনিক বিশ্বকাপের ম্যাচে করবে কি? ”
” ধ্যাৎ! আপনার মুখে কিছুই আটকায় না। কিছু বুঝেন না, নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করেন কোনটা? ”
” কি বুঝব গো? তোমার লজ্জাকে বুঝার কথা বলছ? তাহলে বলব সেটা আমি বুঝতে চাই না আর বুঝার জন্য চেষ্টাও করি না এবং করবোও না। কারণ সবকিছুতে লজ্জা পেতে নেই এবং অপরপক্ষকে লজ্জা পাওয়ার সুযোগ করে দিতেও নেই। তাই আমি খুবই দুঃখিত আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে না পারায়। ”
” বুঝেছি, আপনার সাথে এই মুহূর্তে কথা বলা আর কলা গাছের সাথে কথা বলা একই হবে। তারচেয়ে বরং আমি গিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করি সময়টা আমার কাজে লাগবে। ”
কথাটুকু বলে তানহা বিছানা থেকে নামতে নিলেই অতল তানহার একহাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের বুকের উপর ফেলে দেয়। তানহা হঠাৎ করে পরে যাবার ভয়ে চোখ মুখ কুচকে অতলের বুকের উপর শুয়ে থাকে। আর অতল নিচ থেকে তানহার ভয়ার্ত মুখটা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় তানহা চোখ দুটো মেলে নিজের চোখ বরাবর অতলের তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো দেখে নিজেকে অতলের বুকের উপর আবিষ্কার করে। অতলের থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলে অতল তার দু’হাত দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তানহাকে। আর শান্ত গলায় বলল,
” চোখে চোখ রাখবে একটু? কিছু কথা ছিল। ”
” বলুন আমি শুনছি। ”
” আগে তো রাখো তারপর না’হয় বলি। ”
তানহা কথা না বাড়িয়ে অতলের চোখে চোখ রাখল। আর বলল,
” এবার তো বলুন। ”
অতল স্মিত হাসি দিয়ে বলল,
” আমায় ভালোবাসো তানহা? ”
” জ্বি। ”
” তার পরিমাণটা কতটুকু হবে? ”
” স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার যে পরিমাণ হয় না অতল। ”
“আমাদের ভালোবাসা কিংবা দাম্পত্য জীবনের প্রথম স্পর্শগুলো কি তোমায় কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছে?তোমায় কোনোভাবে আঘাত করেছে?”
তানহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। ডুগ গিলে বলল,
“এই প্রশ্নের মানে কী অতল? আর এসব কোন ধাঁচেরই বা প্রশ্ন?”
“রাতে বিছানা ছেড়ে আমায় ছেড়ে ভেজা বেলকনিতে এসে ঘুমিয়েছিলে কেন? আমি ঘুমোনোর আগে তো তোমায় আমার বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলাম। তাহলে কখন তুমি বেলকনিতে এসেছিলে আর কেনই বা এসেছিলে?”
“আসলে…. আসলে ঘুমের মাঝে হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ে বেলকনিতে পড়ে থাকা আমার ওড়না আর আপনার শার্টের কথা। তো ওই দুটো কাপড় আনতে গিয়ে সাগরের উত্তাল ঢেউ দেখতে বসে গিয়েছিলাম। সেই ফাঁকে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে আসলে বুঝতে পারিনি।”
তানহা নিজের মত উত্তর দিলেও অতলের তা মনে ধরেনি। গভীর গলায় বলল,
“সত্যিই ভালোবাসো তো তানহা?”
“হুম।”
” আমিও ভালোবাসি। ”
” হুম। ”
কথাটুকু বলে তানহা অতলের চোখে চোখ রেখে মনে মনে বলল,
” মুখে বলতে পারলাম না ভালোবাসি। অতলকে যে আমি শ্রদ্ধা করি। তবে…তিহানকে মনে প্রাণে ভালোবাসি। ”
তিহানের কথা মনে পড়তেই তানহার বুক জুড়ে নেমে এলো এক দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাসকে তানহা কখনোই প্রকাশ করতে পারবে না, দিতে পারবে না প্রশ্রয়। সর্বদাই সেই দীর্ঘশ্বাসকে আড়াল করে মাটিচাপা দিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলতে হবে।
তাইতো এই মুহূর্তেও তানহা মুচকি হাসি দিয়ে অতলের বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর আলমারি খুলে এক সেট জামা হাতে নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমের দিকে।
.
অফিসে বসে আছে তিহান। কিন্তু কোনো কাজে তার মন নেই। আর এই মন না থাকার কারণে প্রতিটি কাজে কিছু না কিছু ভুল করছে তিহান। এইতো কিছুক্ষণ আগেই তার বস এসে বেশ ক’টা কথা শুনিয়ে গিয়েছেন তার কাজের ভুলের জন্য। আর খুব রুড ভাবেই বলেছেন। তারপরও তিহানের মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। আর না আত্মসম্মানে লেগেছে। বস একের পর এক কথা বললেও তিহান তার স্থানে চুপটি করে বসেছিল। এমনকি সরি বলার বোধটুকুও তিহানের মাঝে লক্ষ্য করা যায়নি। যার ফলে তার বস আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়। তবে সেই ক্ষিপ্ততাকে সামাল দিতে নিজের কেবিন থেকে ছুটে আসে তিহানের বন্ধু শান্ত। আর বসকে সরি বলে কোনোমতে ম্যানেজ করে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তোলে।কিন্তু স্বাভাবিক করতে পারে না তিহানকে। তিহান যে তার আগের মতোই চুপটি করে বসে আছে। মুখে কোনো কথা নেই,শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে এক অজানা দৃষ্টিপটে। সেই দৃষ্টির রহস্য খুঁজতে শান্ত তিহানের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
” দৃষ্টিবিলাস করার জন্য উপযুক্ত অনেক স্থান রয়েছে, কিন্তু অফিস যে সেই স্থানগুলোর কাতারে পরে না তিহান। ”
” আমার দৃষ্টিবিলাস করার স্থান কি আদৌ আছে শান্ত? সেই অধিকার, সেই যোগ্যতাই যে আমার নেই। থাকলে কি আর অফিসে বসে আনমনে অজানা দৃষ্টিতে বিলাস করতে ব্যস্ত হতাম? ”
” দেখ তিহান, সবকিছুর যেমন শুরু আছে তেমনি শেষও আছে। তবে সবার শেষটা বোধহয় এক হয় না। কারো হাসিমুখে হয় তো কারো অশ্রুসিক্ত নয়নে। ঠিক তেমনি তোর শেষটাও না-হয় হাসি মুখে না হলো, তাই বলে কি নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে দূর্বিষহ করে তুলবি? একটি অপ্রাপ্তির জন্য জীবনকে বলি দিবি? তুই ভুলে যাস না তোর জীবনকে ঘিরে কেবল একজনের বাস না,আরও কয়েকজনের আনাগোনা আছে। যাদের পক্ষে তোকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। আংকেল-আন্টি কথা ভেবে হলেও জীবনকে নতুন করে সাজা। সুযোগ দেয় আরও একটিবার প্রাণ খুলে বাঁচবার। ”
” চেষ্টা করছি, খুব করে চেষ্টা করছি জীবনে রঙের মেলা বসাতে কিন্তু…আমি যে পারছি না। ”
” আজকের দুনিয়ায় পারছি না বলতে কোনো শব্দ নেই তিহান। তুই ১৯৫০ সালে বাস করিস না যে, চেষ্টা করা সত্ত্বেও পারবি না। আজকের যুগে সব সম্ভব সব। এটা ২০২০ সাল আর এই যুগে অসম্ভব বলতে কোনো শব্দ নেই। হয়তো শব্দটি খুঁজেও পাবি না ডিকশনারিতে। ”
” এটা একটু বেশি বেশি বলে ফেললি না?”
” না’হয় বলেছি তাতে কি হয়েছে? তবুও তো তোর ভাবনার মোড় অন্যদিকে ঘুরাতে পেরেছি। ”
” হুম। ”
” কি হুম হুম করছিস? সময় তো কম পার হয়নি। এখনো কেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছিস না? এভাবে কি জীবন চলবে? তারউপর তানহাও তো বেশ ভালো ভাবেই সংসার করছে। হয়তো মন থেকে করছে না কিন্তু, করছে তো! জীবনের চাকা সচল রাখার জন্য হলেও করছে। তাহলে তুই কেন পারবি না? মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। তাহলে তুই কেন পারবি না? কেন নিজের সোনালী দিনগুলোকে টেনে হিঁচড়ে সাদাকালো রঙহীন জীবনে ঠেলে দিচ্ছিস? তুই তো পারিস অন্তত একটিবার নিজের জীবনের জন্য লড়াই করতে। কি পারিস না বল? আর না পারলেও চেষ্টাতো করতে দোষ নেই। চেষ্টা করার ফলে জীবন পরিবর্তন হলে হবে, নাহলে না হবে। তবুও নিজের মনকে বুঝ তো দিতে পারবি যে,তুই চেষ্টা করেছিস। তবে আমার বিশ্বাস তুই চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবি। কেননা এতদিন যখন তানহাকে ছাড়া থাকতে পেরেছিস বাকি জীবনটাও পারবি ইনশাআল্লাহ। ”
” বুঝলাম। ”
” কি বুঝলি? কচু বুঝেছিস? এ ছাড়া আর কিছুই বুঝিসনি আমি জানি। তোর এরকম চালচলন আমার মোটেও ভালো লাগে না। তুই তো আগে এরকম ছিলি না তাহলে এখন কেন এরকম হয়ে যাচ্ছিস? আর সবচেয়ে বড় কথা, তুই কি জানিস তোর পার্সোনালিটির সাথে তোর এখনের বিহেভিয়ার একেবারেই যায় না? ”
” হয়তো। ”
” কিসের হয়তো? ১০০% এর মাঝে ২০০% এই বিহেইভিয়ার মানান সই না তোর সাথে। আবার বলছিস হয়তো! ”
” আচ্ছা, বাদ দেয় এসব কথা। ”
” কেন বাদ দিব? কোনো বাদ দেয়া দেই নেই। তুই এভাবে কুঁড়ে কুঁড়ে মরবি আর আমি তাকিয়ে থাকব? এটা কখনোই সম্ভব না বুঝলি? তাই এবার যা করার আমিই করব। ”
” তুই আবার কি করবি? ”
” সেটা না’হয় সময় এলেই জানতে পারবি।”
” মানে? ”
” আরে অফিস ছুটির পর। ”
” ও আচ্ছা। ”
” হুম, এখন আমি চললাম অনেক কাজ পড়ে আছে। আর শোন, এবার দয়া করে একটু মনোযোগ দিয়ে কাজটুকু কর। তা নাহলে বস এবার কি যে করবে সে একমাত্র আল্লাহ-ই জানে। ”
” হুম। ”
” তাহলে ছুটির পর দেখা হচ্ছে কেমন? ”
” আচ্ছা আচ্ছা,যা এবার। ”
শান্ত দাঁত কেলিয়ে চলে যেতেই তিহান বেশ ক’টা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাজে মন দিল।
.
” গল্প করতে বসলে তোর আর হুশ থাকে না। মনে হয়, একবেলাতেই সারা বছরের গল্প করে দিবি। যত্তসব ফালতু পোলাপান। ”
মাঝরাতের যানজট বিহীন রাস্তায় একহাতে বাইক চালাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে পেছনে ফিরে শান্তর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছে তিহান। কিন্তু, শান্ত সে তো এসব কথার একটিও গায়ে লাগাচ্ছে না। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেবার মতো হাসছে। আর হাসির ছলে বলছে,
“আরে বাবা,এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন, গল্পই তো করেছি বেশি কিছু তো করিনি। ”
” কেন? আরও কিছু করা বুঝি বাকি ছিল? ”
” তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুই এতক্ষণ হাজতে ছিলি! হা.. হা..”
.
.
চলবে….