আকাশী পর্ব ৩২

“আকাশী”
পর্ব ৩২.

অপূর্ব প্লেইন একটা শার্ট পরে তার ওপর টাই বাঁধছে। আকাশীও ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে বাহিরে যাওয়ার জন্য। কিছুটা দ্বিধার সাথে সে তার সামনে এসে বলল, আমরা দুজন একত্রে বেরুলে কেমন হয়?
অপূর্বকে ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, ‘কেমন হয় মানে? আমিই তো তোমাকে ড্রপ করব।’
‘ড্রপ?’
‘হ্যাঁ, আমি যে কার করে যাই, তাতে তোমাকেও নিয়ে কলেজে ড্রপ করে দেবো।’
আকাশী ইতস্তত করে বলল, ‘আপনাদের কার?’
অপূর্ব কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘আপনাদের এই ওয়ার্ডটা মানানসই হয়নি।’
আকাশী তার ভুল বুঝতে পারল।
‘তাছাড়া তুমি এই বাড়ির বউ। কার থাকতে তুমি লোকালে যাওয়ার কথা ভাবছিলে?’ অপূর্ব একটুও অপেক্ষা না করে কোট না পরে হাতে নিয়ে বাহিরে বেরিয়ে গেল। আকাশীও পিছু পিছু যায়।
সে বাইরে এসে দেখে একটা হোয়াইট কার রাস্তার একপাশে পার্ক করানো, যেটা সম্ভবত সে বিয়ের দিন দেখেছে। এটি যে তাদেরই নিজস্ব কার আকাশী ধারণা করতে পারেনি। অপূর্ব তার মৃদু বিস্ময় বুঝতে পেরে গাড়িতে বসার সময় বলল, ‘বাবা সম্ভবত শীঘ্রই একটা মাইক্রোও কিনবেন।’
আকাশী কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বলল, ‘বাবার কাছে সম্ভবত আমার ধারণার চেয়েও অগাধ টাকা আছে। এই টাকা কি… উনি কেবল বিলাসিতায়…’
আকাশী কথাটা সম্পূর্ণ শেষ না করলেও অপূর্ব অর্থ বুঝে তার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়, ‘বাবা যদি ওরকম হতেন, অন্তত আমি উনাকে ওরকম বেশিদিন থাকতে দিতাম না।’ সে গাড়ি চালাতে শুরু করল, ‘উনি ডোনেশনও কম করেন না। ইউ সি, তোমার ফেভারিট জায়গা আই মিন খামারের পাশে বাবার যে জায়গাটা আছে, তিনি ওখানে ভবিষ্যতে একটা ক্লিনিক গড়ার চেষ্টা করবেন, যদি পাওয়ার আরেকটু বাড়ে। এমনটা হলে খামার তুলিয়ে ওখানে একটা ডিস্পেন্সারি গড়া হবে। কিন্তু বাবার কাছে ততদিন পর্যন্ত আরেকটু স্যাটল হতে হবে। বাবা গ্রামে গরিবদের জন্য পড়ার খরচ থেকে নিয়ে শুরু করে বিধবা ভাতা পর্যন্ত তাঁর কাঁধে বহন করেন। এসব সামাজিক কাজ, কেবল সামাজিক কাজে জড়িত কিছু মানুষদের জানা থাকে। আর তাদের জানা থাকে, যারা সুবিধাগুলো ভোগ করে। তোমার মা কি এই সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলেননি? উনিও সম্ভবত বিধবা হিসেবে সুবিধা ভোগ করেন। অন্তত দু’একটা বছর আগে থেকে তিনি তাঁর মাসিক খরচ পেয়ে যেতেন।’
আকাশীকে মা কথাটা বলেননি। না বললেও কিছু আসে যায় না। ভাতা আর আকাশীর পাঠানো টাকা মিলিয়ে তাঁর প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। অপরদিকে বিভা মায়ের কাছে চলে আসায় দুলাভাই তার জন্য খরচ পাঠালে মায়ের জন্যও পাঠাতেন। তাহলে মায়ের কাছে যথেষ্ট টাকা ছিল। নইলে সেও ভাবে, আকাশীকে তিনি আর বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেননি কেন। বিভার কথা মনে পড়ায় আকাশী বলল, ‘বিভার একটি ছেলে হয়েছে।’
‘ওহ্ অভিনন্দন।’
‘এটা সম্ভবত বিভাকে বলা উচিত। বেবি আমার হয়নি।’
অপূর্ব ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু তুমি তো খালা হয়েছ।’
দুই রাস্তার মোড়ে এলে আকাশী বলল, ‘লেফট নিন।’
‘তুমি কি আমার সাথে অফিসে যাওয়ার কথা ভাবছ?’
‘না তো। আমি শুনেছি এদিক দিয়েই ডিজাইনিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটা পাব।’
‘তুমি কি যাওয়া শুরু করেছ?’
‘আজই প্রথম। আপনি যেদিন কার্ড দিয়েছিলেন, সেদিন আপনার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, আমি যেন চার-পাঁচদিন পর যাই।’
‘ওহ্, বিয়ের তো এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কলেজে যাওয়া কি শুরু করছ না?’
‘এইতো কাল থেকে রেগুলার ক্লাস করছি।’ আকাশীর মনে পড়ল, ‘বিভার কথা তো পেছনেই পড়ে গেল। কাল থেকে তো পড়াশোনা শুরু করতে হবে। আমি আজ বিভার বেবিকে দেখতে যেতে চাচ্ছি।’
আকাশী চাইলে একাই যেতে পারত। কিন্তু সমস্যা এটাই, সে তা পারবে না। কোনো না কোনোভাবে সে অন্যের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। তার এখন স্বামী আছে। স্বামীকে ফেলে একা বাড়িতে যাওয়া অনেক সদ্য বিবাহিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু দেখায়। অপূর্ব না গেলে তারও যাওয়া হবে না। তিনি তো যাবেনই না। যিনি কিনা বাসায় তার কাছে থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন, কোনোদিকে ঘুরতে নিয়েও যান না, তিনি তাকে গ্রামে নিয়ে যাবেন?
অপূর্ব তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘আমরা কবে বেরুচ্ছি?’
আকাশী থ হয়ে যায়।
‘কী?’ অপূর্ব বুঝতে পারল, ‘শোন, হয়তো ভাবছ আমি কোনোদিকে ঘুরতে নিয়ে যাই না, ওখানে যেতে কীভাবে রাজি হয়ে গেলাম। আমি তো অস্বীকার করতে পারি না, তুমি আমার স্ত্রী। সব অধিকার দিতে না পারলেও তুমি স্ত্রী হিসেবে কিছু অধিকার দিতেই পারি। তাছাড়া বিয়ের কয়দিন পর নাকি কোন একটা প্রথানুসারে বাবার বাড়ি যেতে হয়। তাও যাওয়া হয়ে যাবে।’
‘প্রথার কথা কে বলল?’
‘মা বলেছেন। তাঁর ওসবের প্রতি তেমন ইন্টারেস্ট নেই।’
‘আমার তো বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। এখন দশটা বাজছে,’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আজকে যাস্ট টুকটাক কিছু ইনফরমেশন জেনে আসব। এগারোটার মধ্যেই বেরিয়ে যেতে পারব। আপনার অফিস…’
অপূর্ব ধরতে গেলে ছুটির দিনই কাটাচ্ছে। কেবল বাসা থেকে দূরে থাকার জন্য সে বিয়ের তৃতীয়দিনই অফিসে চলে যায়। বস তাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, আই থিংক ইউ শোড স্টে উইথ ইউর ফেমিলি, স্পেশালি উইথ ইউর ওয়াইফ। অপূর্ব বলল, ছুটির সময়টা কাটছে না। ভেবে নিন, ছুটিটা আমি অফিসেই কাটাচ্ছি।
অপূর্ব মিথ্যা বলল, ‘আমি বসকে বলে ছুটি নিতে পারি। আমি অফিসে গিয়ে এগারোটা নাগাদ চলে আসব। তোমাকে পিক করব। আচ্ছা, বেশি দেরি হয়ে যাবে না বেরুতে?’
‘আমি দেরি করতে চাই। আমি জোহরের আগে পৌঁছতে চাই না। কারণ মাকে বলছি না, ওখানে যাওয়ার কথা। নইলে উনার কাছে আমাদের জন্য কষ্ট করে খাবারের আয়োজন করতে হবে। আমরা যেতে যেতে দেড়টা বেজেই যাবে। পথে আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলে আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
অপূর্ব মাথা দোলায়। বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ।’
‘কী?’
‘তুমি।’ অপূর্বের এক পলক আকাশীর দিকে তাকায়, ‘তোমার মতো মেয়ে খুব কমই দেখেছি। আমরা তাহলে রাতেই ফিরে আসব। রাতের খাবারটাও কি…’
‘না, না রাতের খাবার ওখানেই খাব। রাতেরটার আয়োজন করার জন্য তো আমি থাকব।’
আকাশীর মাথায় বুদ্ধি আসে, খাবারের সাথে অন্য কোনো আয়োজন করলে মন্দ হয় না। নইলে সে এভাবে গতানুগতিক অবস্থায় কী করে থাকতে পারে। স্ত্রী হিসেবে তার চেষ্টা করতে হবে, তার আর অপূর্বের সম্পর্ক ঠিক করার। তারা যে যার গন্তব্যে পৌঁছে গিয়ে এগারোটায় পুনরায় মিলিত হয়ে বাসায় চলে আসে। তারপর তারা গ্রামের জন্য বেরিয়ে পড়ে। আকাশী ভাবে, এখন থেকে তাদের মাঝে ব্যস্ততা বাড়বে। আজকে যে সময়টুকু আছে, তার মাধ্যমে জানতে হবে অপূর্বের মনে তাকে নিয়ে কিসের এতো বিদ্বেষ আছে। কিন্তু এসব গাড়িতে জিজ্ঞেস করার পরিবেশ তৈরি হয় না। আকাশীরা তাদের ইউনিয়নের সামনে সেই বহু পরিচিত রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেয়। একসময় তারা বাড়িতে পৌঁছায়। রোকসানা দুজনকে দেখে খুশি হলেন। কিন্তু পরক্ষণে বিচলিত হলেন এই ভেবে যে, তিনি খাবারের কোনো ব্যবস্থা করেননি। তাদের অকস্মাৎ আসার কথা তো তিনি জানতেনও না। অচিরে আকাশী তাকে স্বস্তিবোধ করার জন্য বলল, তারা খেয়ে এসেছে। সে তাদের রুমে গিয়ে বিভার সাথে দেখা করে। বাচ্চাকে আকাশীর দেখতে আসায় বিভা ভেতরে কিছুটা খুশি হয়। সে দ্বিধান্বিত হয়ে বলল, ‘তুই ভাগিনা চেয়েছিস, ভাগিনাই এসেছে। বাকিরা তো কেবল মেয়ে বলে আমাকে ভড়কিয়ে দিচ্ছিল।’
‘মেয়েতে সমস্যা কী?’
বিভা কিছু বলল না। আকাশী চেয়ে দেখল, বাবুর চেহারা বিভার চেয়ে আরেকটু উজ্জ্বল হয়েছে। সে শুনেছিল, একসময় দুলাভাই উজ্জ্বল বর্ণের ছিলেন। পরে কাজের চাপ গায়ের রঙে প্রভাব ফেলেছে। বাবা-মাকে দেখে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না, এই শিশুটি তাদেরই। বিভাই এসব কথা অনর্গল বলে চলেছে।
‘নাম কী দিবি ভেবেছিস?’
‘ওর বাবা কিছু ভাবলে ওটাই রাখব।’
‘ওর ডাকনাম কিরণ রাখিস।’ আকাশী বাবুর দিকে চেয়ে বলল। একটিবারও মাথায় আসেনি, সে কখনও কারো মামলায় হস্তক্ষেপ করতে যায়নি। আপন নামের পরদেরও কোনো অধিকারে কখনও কিছু বলতে যায়নি।
কিন্তু বিভার কেন যেন তা ভালো লাগল। হয়তো এজন্য যে, এতো এতো লোকমুখের বিপরীতে আকাশীই একমাত্র মেয়ে যে কিনা বলেছিল, অনাগত সন্তান ছেলে হবে বলেই লাগছে। তাই তার দেওয়া নামটা রাখলে মন্দ হয় না।
আকাশী সারা বিকেল এদিক-ওদিক ঘুরে কাটিয়ে দেয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অপূর্ব তার সাথে যেতে চেয়েছে। কারণ নিজের বাসার চাবি সে আনেনি। একাধারে বাসায় থাকার মতো ছেলেও সে নয়। কে জানে, আকাশী তাকে কেন নেয়নি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়। আকাশী এসে রান্নাবান্না করার পর সকলে খাওয়ার পর্ব শেষ করল। অপূর্ব বলল, খাবার একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে ফেললাম না? তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাচ্ছ নাকি?’
‘পথ তো তিন ঘণ্টার বেশি নয়। আমি অবশ্য ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরি করে যাওয়ার কথা ভাবছি। কারণ আমি রাত এগারোটার পর শহরের আকাশ কখনও দেখিনি।’
‘কিন্তু আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কী করব? আটটায় বা খাবার খেয়ে ফেলেছি কেন?’ অপূর্ব বিরক্ত হয়। নিজের বাসায় থাকলে ভিন্ন কথা ছিল। রুমে বসে গেমস খেলতে পারত। শ্বশুরবাড়িতে এই প্রথমবারের মতো আসায় কিছু করতে সঙ্কোচ বোধ করছে।
আকাশী বলল, ‘একটু বাইরে বেরুনোর জন্যই এরকম করেছি। চলুন, বিশ্রাম তো নিলাম। নয়টার আগে চলে আসব।’
অপূর্ব বাধ্য হয়। তারা দুজন বেরিয়ে পড়ে ক্ষেতের মাঝের রাস্তায় উঠে। এখন রাস্তার কিছু দূরে দূরে লাইট লাগানো হয়েছে। আকাশীর তা দেখে মোটেই ভালো লাগছে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের সাথে কথা বলার তার একমাত্র অবলম্বন ছিল। খারাপ যতটা লাগার কথা, ততটা লাগছে না। সম্ভবত পায়ের সাথে পা মিলিয়ে পাশে অপূর্ব হাঁটছেন বলেই এমনটা লাগছে। আকাশী নীরব রইল। কিছু বলতে গিয়েও সে বলতে পারছে না। কেন যেন লাগছে, তারা এখনও অপরিচিত। একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ অজানা। অপূর্বও নীরব আছেন বিধায়, তাকে আকাশীর আরও ভালো লাগে। ক্রমে তারা স্কুল প্রাঙ্গণ পেরিয়ে রাস্তার মোড়ে উঠে।
অপূর্ব জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
‘চলুন।’
হাঁটতে হাঁটতে তারা মাদ্রাসার পেছনে চলে আসে। অপূর্ব বুঝতে পারল, আকাশী কোথায় যেতে চাইছে। দ্বিধাও হচ্ছে, আবার ওই জায়গায় যেতেও ইচ্ছে হচ্ছে। অনেক মনোমুগ্ধকর একটি জায়গা।
অপূর্ব বলল, আমার মনে হয় না আমরা নয়টার আগে পৌঁছাতে পারব।
আকাশী কিছুই বলল না। আচ্ছন্নের মতো আশেপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশ চেয়ে চেয়ে হাঁটছে। অপূর্ব বেশ বুঝেছে, এতদিন পরিবেশের সাথে কথা বলতে না পারায়, আকাশী এতটা খামখেয়ালি হয়ে পড়েছে যে, অপূর্বের অস্তিত্বও তার বোধ হচ্ছে না। তারা হাঁটতে হাঁটতে খালের ধারে চলে আসে। অপূর্ব অবাক হয়। আগে তারা যে দোকানটায় বসেছিল, তা এখন কিছু ফুল দিয়ে সাজানো। এখন ওটা আর দোকানের মতো লাগছে না, যেন এখানে বসে চাঁদ দেখার জন্য এটা তৈরিকৃত। আকাশী তার হাত হাল্কাভাবে ধরলে অপূর্ব সম্বিৎ ফিরে পায়। তার বলার অপেক্ষা না করে আকাশী তার হাত ধরে ভাঙা দোকানটার কাছে নিয়ে যায়। কিছু ফুল শুকিয়েও এসেছে। সম্ভবত এই কাজগুলো রাত শুরু হওয়ার আগে করা হয়েছে। হয়তো আকাশী এই আয়োজনের কারণেই তাকে বাসায় একা ফেলে বাইরে বেরিয়েছিল। মেয়েটা একা এতদূর কেন যে এসেছে!
আকাশী বলল, বসুন।
অপূর্ব দ্বিমত না করে বসে পড়ল। আজকের পরিবেশটা ঠিক সেদিনটার মতোই। কিন্তু মাঝখানে কত পরিবর্তনই না হয়েছে। সম্ভবত দুটো বছর অতীত হয়ে গেছে। ঠিক এভাবেই তার ভাঙা এই বেঞ্চটায় বসে চাঁদনি রাত উপভোগ করেছিল। অপূর্ব দেখল, একটা খুব সুন্দর ফুলেল হ্যারিকেন আকাশী জ্বালিয়েছে। সে অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টা করল। কেন আকাশী এই জায়গায় তাকে এনেছে, তা এখনও বুঝতে পারছে। তার কল্পনায় বাধা দিয়ে আকাশী তার হাতে দুটো নূপুর দেয়। সে এগুলোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘এগুলো তো…’
‘আপনি কিনে দিয়েছিলেন। সেদিন যেভাবে পরিয়ে দিয়েছিলেন, আজও সেভাবে পরিয়ে দিন না।’ আকাশী আবদার করে শাড়ি কিছুটা উপরে তুলল।
অপূর্ব তার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনের কথা পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু এতটা সহজ নয়। আকাশীকে যেন কোনো বিষণ্ণতা পুরোপুরিভাবে দগ্ধ করে রেখেছে।
সে বলল, ‘সেদিন পরিস্থিতি আর মনগুলো ভিন্ন ছিল। আমি পরাব না।’ নূপুরগুলো তাদের মাঝখানে রেখে দেয়।
‘ভিন্ন কেন? মনগুলো তো এখনও একই রকম আছে।’
‘আমার মন বয়স্ক হয়েছে। চুল পেকেছে তার।’
আকাশী হাসতে চেয়েও পারল না, ‘আপনি মাঝে মাঝে এমন উদ্ভট কথা বলেন না… হাস্যকরই শোনায়।’
অপূর্ব নীরব রইল। আকাশী হ্যারিকেনের পাশে রাখা তার হাতটা ধরল। অপূর্ব হাতগুলোর দিকে চেয়ে উপরে তাকালে দেখল, আকাশী তার নাক বরাবর চলে এসেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, আজ সে অপূর্ব। আকাশী চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। তার নাক দিয়ে অপূর্বের নাক ছুঁয়ে দেয়। সে চাইছে অপূর্ব আজ আকাশী হয়ে তার হাত পুড়ে দিক। ইচ্ছাকৃতভাবেই হাতটা সে অপূর্বের হাতে দিয়েছিল, যাতে যে শাস্তিটা একসময় সে অপূর্বকে দিয়েছিল, আজ যেন তিনি তাকে দেন। আকাশীর দীর্ঘ, মাতাল করা নিশ্বাস তার ঠোঁটের ওপর পড়লে সে আকাশীর হাত ছাড়িয়ে উঠে যায়। সে পরিত্যক্ত দোকান থেকে বেরিয়ে খালের পাড়ের কাছাকাছি চলে আসে।
পকেটে হাত রেখে সে গম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে আছে। আকাশী তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল, ‘কী হয়েছে বলুন তো? আপনি এতটা পালটে কেন গেছেন? এতটা চুপচাপ তো আপনি ছিলেন না। প্লিজ বলুন। আমার তর সইছে না।’
অপূর্ব তার হাত দিয়ে আকাশীর ঠান্ডা হাতগুলো সরিয়ে দেয়। আকাশী তবু ছাড়ার পাত্র নয়। সে তার হাত ধরে বলল, ‘প্লিজ, কিছু বলুন। আজ সাতটা দিন কেবল নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, আমিই হয়তো কিছু করেছি যার জন্যে আপনি এমনটা করছেন, কিন্তু কী করেছি এই প্রশ্নটার উত্তর আমি আদৌ পাচ্ছি না।’
আকাশী চাঁদের আলোয় চেয়ে দেখে এটা অপূর্বের সেই হাত, এই একই জায়গায় যেটা সে একদিন পুড়ে দিয়েছিল। হাতের ছলকে যাওয়া চামড়ার স্থানটা সে তার গালে স্পর্শ করায়। অপূর্ব তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে নেয়, ‘আকাশী এমনটা করো না। আমার ইচ্ছা নেই তুমি আমার মনকে পড়।’
‘পড়লে ক্ষতি কী? জেনে অন্তত বুঝতে পারব, কেন আপনি এতটা পালটে গেছেন।’
‘বুঝার দরকার নেই।’
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here