এক জীবনে অনেক জীবন পর্ব ২৩

#এক_জীবনে_অনেক_জীবন(২৩)
**********************************

বাড়ির পরিবেশ থমথমে তো ছিলই, জারা’র বিয়ের কথাটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর কেমন একটা চাপা আতংক আর ফিসফিসানি চলছে এর ওর মাঝে । তাবাসসুমের মুখে জারা’র বিয়ের কথাটা শুনেই বড় বোন সোজা গিয়ে হাজির হলেন শাফিনের রুমে । সাদাত চুপচাপ শুয়ে ছিল । বড় খালাকে দেখে উঠে বসলো । ইয়াসমিন সাদাতকে বললেন –

কী রে সকাল থেকে এতো কিছু হয়ে গেল আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না ! তুই ঐ মাস্তানের বাড়ি থেকে ঘুরে এলি তারপর কায়সার তার বন্ধুর খোঁজও পেয়ে গেল, জারা যে পালিয়ে বিয়ে করেছে এটাও তো আমি এইমাত্র জানলাম ।

কোন মাস্তান খালা ?

যার সাথে আমাদের জারা পালিয়েছে ।

সে তো মাস্তান না ।

তার চেয়ে কম কী বল ? মাস্তান আর ধাপ্পাবাজ একই হলো ।

সাদাত কথা বললো না, কথা বললেই কথা বাড়বে ।

মেয়েটা এমন একটা কাজ করতে পারলো ! এভাবে বাবা-মা’র মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিলো !

খালা আস্তে আস্তে , কেউ শুনে ফেলবে । ওদের সবার এখন মন খারাপ ।

মন খারাপ তো হবেই । মেয়ে তো আর জজ ব্যারিস্টার ধরেনি, ধরেছে একটা ফেউ ।

ফেউ আবার কী !

ফেউ চিনিস না ? বাদ দে, পরে বলবো । এই ছেলে না-কি তোরও বন্ধু ছিল ? তখন কতোবার করে বললাম হুজুরের কাছ চল আমার সাথে , না যাবে না । হুজুরে তাদের ভরসা নেই । এবার বাজলো তো মানসম্মানের বারোটা ।

খালার সামনে থাকলেই এখন যতো সব আজগুবি কথাবার্তা শুরু হয়ে যাবে । সাদাত বললো –

খালু আমাকে ডেকেছিলেন অনেকক্ষণ আগে । আমি দেখা করে আসছি ।

সাদাত বেরিয়ে যেতেই ইয়াসমিন নিলুফারকে ফোন দিলেন।

নিলুফার ঘটনার কিছুই জানেন না তখনো । ছেলে তাঁকে কিছু বলেনি । তিনিও দারুণ উৎকন্ঠায় ছিলেন কিন্তু বারবার ফোন করে কারো টেনশন বাড়িয়ে দিতে চাননি । ফোন ধরে বললেন –

হ্যাঁ আপা বলো কী অবস্থা ? জারা’র খোঁজ পাওয়া গেল ?

তুই কী রে নিলু ? দুনিয়ায় সবাই জেনে গেল আর তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস জারা কোথায় ? সাদাত কী তোকে কিছুই বলেনি ?

নিজে থেকে জিজ্ঞেস না করলে সাদাত কিছু বলে কোনোদিন ?

আরে দস্যি মেয়ে কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে ।

কী হয়েছে আপা ? নিলুফারের কন্ঠে উদ্বিগ্নতা ।

ইঁচড়েপাকা মেয়ে সর্বনাশ যা করার করে ফেলেছে । বাসায় আসলেই দেখি বিছানা ভরা পুতুল ! মনে হয় যেন পুতুল খেলার বয়স ওর অথচ দিব্যি বিয়ে করে বসে আছে ।

কে বিয়ে করলো আপা ? ঠিকমতো বলো তো । কখন থেকে অপেক্ষায় আছি জারা’র খবরটা জানার জন্য ।

আরে বাবা জারা’র কথাই বলছি । বিয়ে করে ফেলেছে । যে বদটার সাথে পালিয়েছিল, তাকেই বিয়ে করেছে । তাবাসসুমের নাক একেবারে ভেঙে দিয়েছে এই এক মেয়ে ।

জারা বিয়ে করেছে ?

তাবাসসুম ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব গর্ব করতো সবসময় , মেয়ে তো মা’র মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে এক্কেবারে ।

আপা তুমি কেন এমন করে কথা বলছো ? জারা কী আমাদের পর ? ওর খারাপ কিছু মানে তো আমাদেরও খারাপ কিছু । এসব না বলে তাবাসসুমের কাছে যেয়ে বসো । সানজিদা ফিরলে আমি আসবো ।

তাবাসসুমের কাছে যাওয়া যাচ্ছে না রে । রাগে ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে । সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে জারা যেন এখানে ফিরে না আসে । রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল আর এখন তো নিজের রুম থেকে বের হচ্ছে না । ওর কাছে যেতেই তো ভয় লাগছে ।

তোমার কীসের ভয়, ও কী তোমাকে মারবে না বকবে ? তাবাসসুমের এখন তোমার সাপোর্ট দরকার । যাও আপা ওর কাছে যেয়ে বসো ।

ফোন রেখে নিলুফারের মনটা খারাপ হয়ে গেল । জারাটা এতো বড় একটা বোকামি কেমন করে করলো ! তাবাসসুমের মনের অবস্থাটা চিন্তা করে তাঁর টেনশন হলো । তাঁদের এই ছোটো বোনটা এক হাতে সংসার, ব্যবসা আর বাচ্চাদের সুন্দর করে সামলেছে সারাজীবন । বাচ্চাদের যেমন স্বাধীনতা দিয়েছে, প্রয়োজনে শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরেছে । ওর মেয়ে কেন এমনটা করবে? কিসের এতো জলদি ছিল জারা’র ? অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে নিলুফারের মনে ।

.
.

জারা’র সাথে কথা শেষ করে রোজা’র হাত-পা ভয়ে কাঁপছে, আতংকে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে । ছুটে যেয়ে আব্বুর কাছে কথাটা এখনই বলা দরকার কিন্তু তার শরীর যেন আটকে আছে এক জায়গায় । ওপরতলায় না যেয়ে সে নিচে থেকেই কায়সারকে ফোন করে নিচে আসতে বললো ।

কায়সার নিচে এলে রোজা পেপারটা এগিয়ে দিয়ে বললো –

আব্বু আমি জারা’র সাথে কথা বলেছি এখনই ।

কী ! কোথায় জারা ? কখন ফোন করেছিল ? এগুলো কী লিখেছো ?

আব্বু জারাকে নিয়ে ছেলেটা টাঙ্গাইল চলে গেছে, তার আত্মীয়ের বাসায় । এই যে এখানে লিখে রেখেছি সব ।

নাম্বারটা দাও, আমি জারা’র সাথে কথা বলবো ।

আব্বু কী বলছো তুমি ! এটা তো রফিকের আত্মীয়ের ফোন নাম্বার । এখন ফোন দিলে ওরা সতর্ক হয়ে যাবে । তুমি এখনই জহির আংকেলকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দাও ।

হঠাৎ একটু আশার আলো ফুটে ওঠায় কায়সারের মুখে হাসি ফুটে উঠলো । তিনি তাড়াতাড়ি জহির সাহেবকে ফোন করে বললেন –

জহির আমার মেয়ের খোঁজ বোধহয় পেয়ে গেছি । ও ফোন দিয়েছিল ।

কোথায় আছে জারা ?

রফিকের আত্মীয়ের বাসায় । তুমি তাড়াতাড়ি কাগজে টুকে নাও ইনফরমেশনগুলো ।

জহির সবকিছু লিখে নিয়ে বললেন –

এখনই কাজ শুরু করে দিচ্ছি । তুমি টেনশন কোরো না । থ্যাংকস কায়সার, খবরটা পাওয়ায় জারাকে পাওয়া এখন সহজ হয়ে যাবে । আশা করছি সে ওখানেই স্টে করবে ।

রোজা ওকে ভালো করে বলে দিয়েছে ও যেন ঐ বাড়ি থেকে কোথাও না যায় । জহির যদিও তুমি আমার জন্য অনেক বেশি করছো তবুও বন্ধু হিসেবে একটা অন্যায় রিকোয়েস্ট করবো ।

বলো, শুনি তোমার অন্যায় আবদার ।

টাঙ্গাইল কখন রওনা দেবে ?

ইনফরমেশনগুলো ক্রস চেক করেই বেরিয়ে পড়বো । কায়সার জারা তো আমারও কেউ হয়, না-কি ? জন্ম থেকে দেখে আসছি ওকে । ওর সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে আমিও ভীষণ কষ্ট পাবো । আমি আমার সাধ্যের মধ্যে যতদূর করা যায় সব করবো । তুমি কী যেন বলতে চেয়েছিলে ?

আমি কী টাঙ্গাইল আসতে পারি তোমাদের সাথে ? মানে আমি আমার গাড়ি নিয়েই যাবো, তোমাদের কোনো বিরক্ত করবো না ।

অন্য কেউ হলে না বলে দিতাম, তোমার মনের অবস্থাটা আমি ফিল করতে পারছি কায়সার ৷ তুমি রেডি থেকো । আমি ফোন দেয়া মাত্র বেরিয়ে যাবে ।

অনেক ধন্যবাদ বন্ধু ।

হুম, রাখছি ।

কায়সার জারা’র খবরটা দেয়ার জন্য ওপরে চলে এলেন । রুমে এসে দেখলেন তাবাসসুম আলমারিতে কিছু একটা খুঁজছে । কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন –

কিছু খুঁজছিলে ?

কেন কিছু বলবে ?

এখানে এসো । কায়সার তাবাসসুমের হাত ধরে বিছানায় এনে বসালেন । তারপর বললেন –

মুখটা এতো কঠিন করে রেখো না প্লিজ । একটু সহজ হও ।

কী বলবে বলো, আমার কাজ আছে ।

জারা’র খোঁজ পাওয়া গেছে , ও ফোন করেছিল রোজাকে । বাসায় আসার জন্য খুব অস্থির হয়ে আছে । কান্নাকাটি করছিল খুব ।

তাবাসসুমের কঠিন চোহারাটা হঠাৎ যেন একটু কমনীয় হলো আবার সাথে সাথেই কাঠিন্য ফিরে এলো ।

কী হলো জানতে চাও না জারা কোথায় ?

তাবাসসুমকে তবুও নিশ্চুপ দেখে কায়সার বললেন –

ভুল যা করার সেটা তো করেই ফেলেছে । জহির যাচ্ছে একটু পরে, আমিও যাচ্ছি সাদাতকে নিয়ে । জারা টাঙ্গাইলে আছে ।

আর কিছু বলবে ?

তুমি এমন করছো কেন তাবাসসুম ?

আমার যা বলার আমি তোমাকে বলেছি । তোমার মেয়ে যদি ঐ ছেলের সাথে খুশি থাকে তো খুবই ভালো আর যদি সে ফিরে আসার জন্য কান্নাকাটি করে, আমি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি তোমাকে, সে এই বাড়িতে আসতে পারবে না ।

তাবাসসুম ! আহত গলায় ডাকলেন কায়সার ।

শোনো স্পষ্ট করে আবারো বলছি, সে যখন আমাদের সাথে গেম খেলতে পেরেছে এতোদিন ধরে, ওকে আমি আর বিশ্বাস করি না । সে যা করেছে সেটা তোমার কাছে ছোটোখাটো কিছু হতে পারে কিন্তু আমার কাছে অনেক বড় অন্যায় । আমি আমার সব বাচ্চাকে সমান স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি । ভালোমন্দ বুঝতে শিখিয়েছি, কোনো অন্যায় প্রশ্রয় দেইনি কখনো । তাহলে আজকে তার এই অন্যায় আমি মেনে নেবো কেন ?

এমন কোরো না তাবাসসুম । জারা ফিরে আসুক, ওর কথাগুলো আগে শুনি আমরা……

না, একদম না। চিৎকার করে বললেন তাবাসসুম । তোমার মেয়েকে যদি এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চাও তো আমাকে এখনি জানিয়ে দাও । আমি চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে ।

তোমার কী সত্যিই মাথা নষ্ট হলো না-কি, কী বলছো নিজে বুঝতে পারছো ? এটা তোমার বাড়ি, তুমি বাড়ি ছেড়ে কেন যাবে !

তুমি বাধ্য করলে আমাকে চলে যেতেই হবে । আর কিছু বলতে চাও ?

কায়সার তাবাসসুমের হাতটা ধরে অনুনয় করে বললেন –

মানসিকভাবে খুব খারাপ অবস্থায় আছি আমি । তুমি কী আমাকে একটু বুঝবে না ?

আমার মানসিক অবস্থাটা কী তুমি বুঝতে পারছো ? তাবাসসুম আর কোনো কথা বললেন না । দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো । তিনি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন, মুখে আগের মতোই কাঠিন্য ধরে রেখেছেন ।

কায়সার বুঝলেন এখন তাবাসসুমকে ঘাটানো ঠিক হবে না । জারা’র দেয়া আঘাত সে কিছুতেই হজম করতে পারছে না । তাবাসসুমের আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন । দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন –

ঠিক আছে জারা এ বাড়িতে আসবে না তুমি যতদিন না চাও । তুমি তোমার কাজ করো, আমি আর বিরক্ত করবো না ।

কায়সার রুম থেকে বেরিয়ে গেলে তাবাসসুম শব্দ করে দরজারটা বন্ধ করে দিলেন । রাগগুলো যেন দরজার ওপরেই দেখালেন তিনি । ফিরে এসে বিছানায় বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন । কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তাঁর তবুও যেন কান্না থামছে না । দরজার বাইরের সবাই জানলো কঠিন আর পাষাণ হৃদয়ের এক মা দরজার এপাশে নিজের অহংবোধ আঁকড়ে ধরে বসে আছেন অথচ অসহায় আর অভিমানী মা’য়ের কষ্টটা কেউ অনুভব করতে পারলো না । সন্তানের অমঙ্গল আশংকায় তাঁর হৃদয়টাও তখন ধুকপুক করছে অবিরত ।

.
.

মানুষটা যত এগিয়ে আসছে জারা ভয়ে তত কুঁকড়ে যাচ্ছে । সে এখন কিছুতেই একে আদি বলে ভাবতেই পারছে না । কীভাবে সম্ভব ! রফিক একেবারে কাছে চলে এলে জারা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো ।

রফিক কাছে এসে জারার চুলগুলো মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে গালে আলতো করে হাতের ছোঁয়া দিয়ে বললো –

তাকাও আমার দিকে ।

জারা বাধ্য হলো চোখ খুলতে ।

কী হয়েছে বলো তো, মন খারাপ ?

জারা একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো । কিছু জিজ্ঞেস করতে যেয়েও থেমে গেল ।

বললে না কাকে ফোন করেছিলে আর নাম্বারটা মুছে দিয়েছো কেন ?

ফ্লোরাকে ফোন দিয়েছিলাম । ওদের বাড়িও তো এখানেই তাই জানতে চাচ্ছিলাম ঠিক কোথায় থাকে ওরা ।

কোথায় থাকে?

এদিকেই তো বললো কিন্তু এখন ওরা বেড়াতে গেছে নানার বাড়ি আর আমি তো নাম্বার মুছে দেইনি, খালার হাতের চাপ লেগে বোধহয় ডিলিট হয়ে গেছে ।

নাম্বার কোথায় পেলে ? তুমি তো মোবাইল রেখে এসেছো ।

কথা ঘোরাতে জারা দু’হাতে রফিকের মুখটা ধরে বললো –

একটা কথা বলবে আমাকে? এতক্ষণে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিলো জারা । ভয়টা এখন কমতে শুরু করেছে ।

কী কথা ? জারা’র চোখের দিকে তাকিয়ে বললো রফিক ।

জারা’র খুব কষ্ট হচ্ছে, ভীষণ কষ্ট । এই চোখে চোখ রেখে কতো স্বপ্ন দেখেছে সে এতোদিন । এর সবই কী মিথ্যে ? এতোদিনের ভালোবাসার মানুষটা কেমন করে হঠাৎ অন্য কেউ হয়ে যেতে পারে ? রোজা’র নিষেধ সে মনে রাখতে পারলো না । জিজ্ঞেস করেই ফেললো কথাটা –

তুমি কে?

আমি কে মানে? আমি তোমার আদি ।

তাহলে সবাই তোমাকে রফিক নামে ডাকছে কেন ? তুমি আসলে অন্য কেউ আর আমি তোমাকে অন্য কেউ ভাবছি, তাই না ?

রফিক জানতো এই প্রশ্নটা আসবে যে কোনো মুহূর্তে । সে দু’হাতে জারা’র গলা জড়িয়ে ধরে বললো –

সত্যি করে বলবো তোমাকে, আমাকে ভুল বুঝবে না তো জারা ?

সত্যিটাই বলো আদি । তুমি রফিক হও বা আদি, আজ আমাকে সত্যিটা বলো ।

তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো জারা ?

রফিকের চোখে জল টলমল করতে দেখে জারা অবাক হয় । এটাও কী অভিনয় !

জারা আজকে তোমার কাছে সত্যিটা বলতে চাই । আরেকটু সময় নিয়ে গুছিয়ে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু খালা মাঝখানে ভেজাল করে দিলো । এই যে তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, আমি রফিক হই বা আদিত্য, আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি ।

তুমি কী রফিক?

তোমার কাছে আমি আদি ।

সবাই তোমাকে যেভাবে চেনে সেটা বলো ।

হুম আমার নাম রফিক ।

জারা’র কান্না পাচ্ছে খুব । শেষ পর্যন্ত সে আশায় ছিল সামনে বসা মানুষটা বলবে আমি আদি, অন্য কোনো পরিচয় নেই আমার । আমি আর খালা মিলে তোমার সাথে মজা করেছি এতক্ষণ ধরে ।

জারা বিশ্বাস করো আমি তোমার সাথে মিথ্যে বলতে চাইনি ।

তাহলে বললে কেন ? কেন আদিত্য সেজে আমাকে বোকা বানালে ? হঠাৎ হাঁপিয়ে উঠলো জারা ।

জারা একটু বুঝতে চেষ্টা করো । আমার যেটা পরিচয় তা জানলে তুমি আমাকে তোমার জীবনে আসতেই দিতে না । আমার শুধু পরিচয়টুকুই মিথ্যে আর সবকিছু সত্যি জারা ।

জারা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে কথা শুনতে থাকলো । তার ভেতরে ভীষণ রকমের ভাঙচুর চলছে । যার কারণে সে আব্বু মা’র সাথে এতো বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে বাড়ি ছেড়েছে, যাকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে এখন জানতে পারছে তার পরিচয়টাই মিথ্যে । এতোটা শাস্তি সে কেন পেলো, সে কী এমন অপরাধ করেছিল ? জীবন হঠাৎ করে তাকে এ কোন অনিশ্চিত ঠিকানায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো ? সে যেন চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে, পরিচিত মুখগুলো সব ঝাপসাভাবে ভেসে উঠেই হারিয়ে যাচ্ছে নিমিষেই । কেউ যেন তার কথা শুনতে চাইছে না । সবাই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে ।

জারা তুমি এমন করে তাকিয়ে আছো কেন, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না ?

ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে বাস্তবে এসে দাঁড়ালো জারা, কঠিন বাস্তব ।

আমাদের দুই ফ্যামিলির মাঝে যে অর্থনৈতিক পার্থক্য, আমি কখনোই তোমার মনের নাগাল পেতাম না জারা ।

প্রেম কী টাকাপয়সা দেখে হয় আদি ?

হয় জারা হয় । মানুষ তার সমসাময়িক কাউকে খুঁজে নেয় সঙ্গী হিসেবে, সুযোগ থাকলে আরো ওপরের দিকে তাকায় কিন্তু নিচে কেউ তাকায় না ।

তুমি আমার সাথে মিথ্যে কেন বললে আদি ? আমি তো রফিককে চিনি না, চিনতে চাই না । আজ তো আমি কোনোভাবেই রফিককে মেনে নিতে পারবো না । আমি তো আদিকে ভালোবেসেছি ।

জারা তুমি একই কথা বারবার বলছো কেন ? আমি তো আমার দোষ স্বীকার করে নিলাম । আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করো কিন্তু আমার ভালোবাসায় কোনো অভিনয় নেই । পুরোটাই সত্যি । কথাগুলো বলে রফিক জারাকে জড়িয়ে ধরলো ।

জারা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো –

আমি এই তোমাকেই হয়তো ভালোবাসতাম, পরিচয় লুকানোর দরকার পড়তো না তোমার কিন্তু এখন তোমাকে ভীষণ অচেনা মনে হচ্ছে । একদম নতুন একজন মানুষ, যার সাথে মাত্রই আমার পরিচয় হয়েছে । আমি এই তোমাকে মেনে নিতে পারছি না । সত্যিকারের ভালোবাসলে এতোটা মিথ্যে বলা যায় আদি, এভাবে বোকা বানানো যায় কাউকে ? জারা আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না ।

জারা তুমি এভাবে কেঁদো না । দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে । আমার শুধু নামটাই তোমার কাছে পাল্টে গেছে, মানুষটা তো আমিই আছি । এই যে আমাকে ছুঁয়ে দেখো, আমি তোমার আদিত্যই আছি জারা ।

তুমি আমাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়েছো, সবাই বুঝতে পেরেছে শুধু আমি এতোটাই গাধা ছিলাম যে কিছুই বুঝতে পারিনি । তানিশা আমাকে সাবধান করেছে । ওর কথা শুনিনি বলে আমাদের এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে । আব্বু বুঝিয়েছেন, আপু বুঝিয়েছে আর মা ! মা যে আমাকে কতোবার কতো কিছু বলেছেন । মা’কে তখন মনে হয়েছে আমার সবচেয়ে বড় শত্রু । যখন তোমার হাত ধরে বাড়ি ছাড়লাম, মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম মা’কে দারুণভাবে জব্দ করেছি ভেবে । অথচ দেখো আজ আমি নিজেই কী ভীষণভাবে জব্দ হলাম ! মা তো আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবেন না । তুমি আমার সাথে কেন এমন করলে আদি ? কেন আমার সব কিছু শেষ করে দিলে ?

কিচ্ছু শেষ হয়নি জারা তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো । দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে । আমরা দুজন মিলে সব ঠিক করে ফেলবো ।

কিন্তু আমি তো রফিককে ভালোবাসি না ।

হঠাৎ যেন অধৈর্য হয়ে উঠলো রফিক । ধমকে উঠলো জারাকে –

তখন থেকে বুঝিয়ে যাচ্ছি অথচ সেই একই ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছো বারবার ৷ সমস্যা কী তোমার ?

জারা কঠিন স্বরে বললো –

সমস্যা তুমি । মিথ্যের ওপর ভর করে তুমি আমার সাথে রিলেশন করেছো, এটাই সমস্যা ।

সরি বলেছি তো, বলেছি না ? তারপরও সেই একই কথা কেন বলছো বারবার । ইচ্ছে করলেই কী তুমি আমাকে অস্বীকার করতে পারবে জারা ? আমাদের বিয়েও হয়ে গেছে জারা ।

বিয়ে হয়েছে তাতে কী হয়েছে, তুমি তো মিথ্যে বলে বিয়ে করেছো ।

বিয়েটা তো সত্যি ।

জারা যেন নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল ক্রমাগত । রফিককে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ তীব্রভাবে নখের আঁচড়ে রফিকের দুই গাল রক্তাক্ত করে ফেললো সে । নখে আঁচড়ানো জায়গাগুলো নিমিষেই ফুলে উঠলো ।

ব্যাথায় আর্তনাদ করে রফিক হাত তুলে তেড়ে এলো জারা’র ওপর । চড় কষাতে যেয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে থামিয়ে ফেললো সে । বললো-

কেন এমন করছো , কেন ? বলেছি তো ভালোবাসি । আমি রফিক না আদিত্য তাতে এই ভালোবাসায় এতোটুকুও কমতি হবে না । আমি তোমাকে ভালোবাসি জারা । তোমাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না এখন । প্লিজ জারা ভুলে যাও বিষয়টা ।

জারাও মনে মনে সেটাই ভাবছিল । যদি ভুলে যাওয়া যেত, যদি জীবন থেকে গত কয়টা দিন মুছে দেয়া যেত, কত ভালোই না হতো । এটা যদি একটা দুঃস্বপ্ন হতো ! জারা চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করলো, চোখ মেললেই যেন জাদুর ছোঁয়ায় সে তার নিজের রুমে পৌঁছে যায় । নিজেকে কিছুক্ষণ মিথ্যে প্রবোধ দেয়ার পর জারা চোখ মেলে দেখলো সে ঠিক সেখানেই বসে আছে আর আদি মাটিতে বসে দু’হাতে জারা’র পায়ের পাতা দুটো জড়িয়ে রেখেছে । তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানার আরেক মাথায় যেয়ে এলোমেলো কী সব বিড়বিড় করতে লাগলো জারা । আদির চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মায়াও হলো ভীষণ । আদিকে সে এতো হিংস্রভাবে আঘাত করলো কেমন করে ! একবার মনে হলো কাছে গিয়ে আদর করে দেবে পরক্ষণেই মনে হলো এ তো আদি না, এ তো রফিক নামের এক ছদ্মবেশী । এর কাছ থেকে তাকে পালাতেই হবে যেভাবেই হোক ।

অপেক্ষার প্রহরগুলোয় ঘড়ির কাঁটা থেমে যায় কেন কে জানে ? জারা’র মনে হচ্ছে সে অনন্তকাল ধরে এই রুমটার ভেতরেই আটকে আছে । শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না । উঠে বসে রফিকের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ঠিক সেভাবেই মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ । চোখাচোখি হতেই রফিক বললো –

রাগ কমেছে তোমার ? আরও আঁচড়াবে, খামচাবে আরো ? নাও আমার হাত দুটোতে যতো খুশি খামচে দাও তবুও তুমি রাগ করে থেকো না জারা ।

দরজায় নক হতেই দু’জনেই চমকে উঠলো । রফিক উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলে সীমা খালা ভেতরে ঢুকে বললেন –

কী রে তোর মুখে কী হয়েছে এগুলো ! পুরো মুখ তো শেষ । কে করলো এমন ?

রফিক কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলো ।

রফিক সত্যি করে বল তো তোরা কী বিয়ে করেছিস না-কি বিয়ে না করেই ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিস ?

তোমাকে তো বললাম খালা । কাবিননামার ছবিও তো দেখালাম ।

হুম দেখিয়েছিস তো, তাহলে পুলিশ আসলো কেন তোর খোঁজে ? আয় তাড়াতাড়ি বাইরে আয় ।

সীমা খালা চলে যেতেই রফিক ছুটে এসে জারা’র হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিলো –

জারা তুমি কাকে ফোন দিয়েছিলে ?

জারা তেমনই নির্বাক হয়ে রইলো ।

জারা তুমি কাকে ফোন দিয়েছো জারা ! পুলিশ কেন আসলো ?…………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here