এক মুঠো গোলাপ পর্ব ১৬+১৭

এক মুঠো গোলাপ
sinin tasnim sara
১৬-১৭
১৬
___
(তৌহিদ-রাফনিদ)
খুব ভোরে উঠে ঘরের কাজে লেগে পড়েছে রাফনিদ। ক্লিনিং ডাস্টিং শেষে হট শাওয়ার নিয়ে এখন রান্নাঘরে ঢুকেছে। এক মাসের মত রংপুরে থাকবে সে। তৌহিদ টাকে একাই থাকতে হবে এখানে। যদিও সে সাথে যাবে বলে তৈরি হতে নিচ্ছিলো কিন্তু রাফনিদ মানা করে দিয়েছে । এ নিয়ে এক পশলা ঝগড়া হয়েছে দু’জনার মধ্যে । বললেই তো আর আঁচলে বেঁধে নিয়ে যাওয়া পসিবল না। ওর ক্লাস আছে, এক্সামস আছে ইনফ্যাক্ট অফিসও আছে।
শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী চলে না। ফিউচারটাকে সিকিওর করতে হলে কত বিরহ সইতে হয়, কত সুখের বিসর্জন দিতে হয়!
তাছাড়াও ওদের জীবনটা অতটাও সহজ স্বাভাবিক নয়। কিছু তিক্ত সত্যি, কিছু অভিযোগের মধ্য দিয়ে তৈরি এ সম্পর্ক। এখন পর্যন্ত রাফনিদের শ্বশুর মশাই তাকে মেনে নেন নি। বরং চ্যালেঞ্জ করেছেন তৌহিদ কে, এই মেয়েকে নিয়ে সে সুখী হয়ে দেখাক। ভালো রেজাল্ট করে দেখাক, তার চাইতে বড় বিজনেসম্যান হয়ে দেখাক। বিয়ের পর রাফনিদ বুঝতে পারছে সুখ প্রাপ্তি সহজ নয়। কণ্টকাকীর্ণ এক পথ মাড়ানোর পর এর দেখা মেলে।
সবেমাত্র এই পথে যাত্রা শুরু। জানা নেই কতটা হাঁটতে হবে, কতটা সইতে হবে। এও জানে না তৌহিদকে সব সময় পাশে পাবে নাকি যন্ত্রণা সইতে না পেরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে দুজনের পথ।
,

কিছুক্ষণ পর পর খুট খাট, টুং টাং শব্দে ঘুমটা হালকা হয়ে এলো তৌহিদের। বিরক্তিতে “চ-কারান্ত” একটা শব্দ মুখ থেকে বের করে বালিশের নিচে ঢুকে গেলো, যদি এই ভয়ানক শব্দদূষণের হাত থেকে একটু রেহাই পাওয়া যায়!
কিন্তু এ অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া ভারী দুষ্কর। বেগম সাহেবা যেন আজ পণ করেছেন শান্তির ঘুম তার কপালে নেই।
ভাবনার মাঝেই পুরো বাসা কাঁপিয়ে প্রেসার কুকারের সিটি বেঁজে ওঠে। সাথে সাথে তৌহিদও লাফ দিয়ে উঠে বসে। হার্ট খুব জোরে বিট করতে শুরু করে , মাথা চেপে ধরে চোখ বড় বড় করে বসে থাকে সে। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে একদম।
কিছুটা সময় নিজেকে ধাতস্থ করে ধপাধপ্ পা ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
রাগে সমস্ত গা রি রি করছে তার। রাফনিদকে তুলে আছাড় না দিয়ে থামবে না আজ।
রান্নাঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই ভয়ানক রাগটা ফুসস করে উড়ে যায়৷ দরজায় হেলান দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে ভেতরটায়।
তার বউ কি সুন্দর ছুটোছুটি করে রান্না করছে।
পরনের বেগুনি শাড়িটার আঁচল কোমরে গুঁজে রেখেছে সে।
অবহেলিত ভাবে কাঁধের দিকটায় খোঁপার মত পেঁচিয়ে ফেলে রাখা সপসপে ভেজা চুলগুলো দিয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ে ভিজে যাচ্ছে সুতির বেগুনি ব্লাউজ।
এদিকে তার খেয়াল নেই। সে তো এক মনে কড়াইয়ে চামচ নাড়াতে ব্যস্ত।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় ভেতরে প্রবেশ করে তৌহিদ । সোজা রাফনিদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
দু হাত বাড়িয়ে ওর কোমর আঁকড়ে ধরে চিবুকটা কাঁধে রেখে জিজ্ঞেস করে_
— কি হচ্ছে এসব সক্কাল সক্কাল।
হুট করে জড়িয়ে ধরায় ভয় পেয়ে যায় রাফনিদ। চমকে উঠে বলে-
— এভাবে কেউ আসে?
— কীভাবে আসতে হয় তাহলে?
কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে প্রশ্ন করে তৌহিদ । শিরশিরে অনুভূতি হতেই ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করতে শুরু করে রাফনিদ । তৌহিদ ভারী বিরক্ত গলায় বলে_
— ডিস্টার্ব করো কেন?
— আমি ডিস্টার্ব করছি নাকি তুই ডিস্টার্ব করছিস? ফ্রেশ ট্রেশ হওয়া নেই, এভাবেই আমাকে জাপটে ধরেছিস। ছাড়, ছাড়
— আবার তুই তোকারি শুরু!কামড়ে দিবো একদম।
কাঁধে আলতো করে কামড় বসিয়ে বললো তৌহিদ। মৃদু চিৎকার দিয়ে ওকে ধাক্কা মেরে সরাবার চেষ্টা করলো রাফনিদ, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারলো না।
তৌহিদ দুষ্টু হেসে রাফনিদের বা হাত চেপে ধরে নিজের এক হাত শাড়ির আঁচল গলিয়ে ওর পেট খামচে ধরলো। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ধমকে উঠলো রাফনিদ_
— কি হচ্ছে কি তৌহিদ
— রোম্যান্স হচ্ছে । তুমি এত সফট কেন নিদ? মনে হচ্ছে এক তাল মাখনের মধ্যে হাত ডুবে গেলো আমার।
— ফাইজলামির জায়গা পাও না তাইনা? ভালোভাবে বলছি সরো নইলে খুন্তি পেটা করবো বলে দিলাম৷
— আমিও দেখি তুমি কি করে আমায় পেটাও।
এক ঝটকায় নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো রাফনিদকে। ত্রস্তে সরে যাবার চেষ্টা করে রাফনিদ বললো_
— করো কি, করো কি। রান্না চাপিয়েছি না আমি?
— কেন চাপিয়েছ ।
— প্লিজ তৌহিদ সরো। এখন এসব করার সময় না, আমার অনেক কাজ আছে।
— কাজ টাজ গোল্লায় যাক। এখন আমরা প্রেম করবো।
রাফনিদের নিষেধ সত্বেও ওকে কোলে তুলে নিলো তৌহিদ ।
রাফনিদ অনুনয়ের সুরে বললো_
— আমার তরকারি পুড়ে যাবে তৌহিদ ।
— হাত বাড়িয়ে গ্যাস স্টোভ টা অফ করে দাও।
— নাহ্ প্লিইজ।
— কিচ্ছু শুনিনা আমি, কানে তালা লাগিয়েছি।
— তোরে কিন্তু খুন করবো আমি।
— করিস। আগে একটু সোহাগ করতে দে।
______
(নিদ্র)

বেলা বারোটা। সারারাত প্রেমালাপ শেষে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে নিদ্র। ভাগ্যিস আজ অফিস নেই, কাজই তো করতে পারতো না সে।
নুহা কখন থেকে দরজা ধাক্কাছে আর ডাকাডাকি করছে । সে ডাক কর্ণকুহরে পৌঁছুচ্ছেই না, এত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে নিদ্র।
একসময় বিরক্ত হয়ে ডাকাডাকি বন্ধ করে দিলো নুহা। খাবারের ট্রে টা দুম করে ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে বিড়বিড় করে নিদ্রকে গালাগাল করতে লাগলো।
অনিমা বসে বসে পেপার পড়ছিলেন। নুহাকে রাগতে দেখে পেপার সরিয়ে ওর দিকে তাকালেন। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন_
— কি হয়েছে?
নুহা যেন এরই অপেক্ষা করছিলো। সে চোখ ছোটো ছোটো করে ফুপিকে পাল্টা প্রশ্ন করলো_
— তোমার ছেলেটা এমন অবাধ্য কেন বলতে পারো ফুপি?
নুহার বলার ভঙ্গিতে অনিমা হেসে ফেললেন। হাসিটা ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করলেন_
— এবার কি করলো আমার ছেলে?
— হাসবে না তুমি ফুপি। সেই কখন থেকে ডাকছি আমি তাকে, সাঁড়াই দিচ্ছে না।
— ঘুমুচ্ছে হয়তো। কাল তো সারারাত জেগে কাজ করছিল, দেখলাম ঘরের লাইট জ্বালানো।
— রাত জেগে কাজ তাকে কে করতে বলে? বাপি এত করে বললো অফিসে জয়েন কর অফিসে জয়েন কর। নাহ্ তার তো অন্যের আন্ডারে জব করতে ভালো লাগে।
— ওর এই ডিসিশান টাকে কিন্তু আমি সম্মান করি। এত কষ্ট করে ছেলেকে পড়ালাম সে যদি এখন নিজের যোগ্যতায় জব না পেয়ে মা, মামার ব্যবসায় বসে তাহলে লোকে নানা কথা বলবে।
— কে কি বলবে তা ধরে আমাদের লাভ কি? আমরা সবাই জানি নিদ এ ওয়ান স্টুডেন্ট । ওর মত ব্রিলিয়ান্ট আর হয়না৷
— থাক মা এসব নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। জানিস তো ও এসব প্রসঙ্গ সবসময় এড়িয়ে যায়। টানাটানি করলে আবার হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। আমি চাইনা ঘর ছেড়ে যাযাবরের মত জীবনধারণ করুক ও আবার।
— হ্যাঁ তাই তো। তাকে তো আবার কিছু বলা যায়না। করো তোমাদের যা মন চায় করো আমি কিচ্ছু বলবো না।
— ও কি কই যাস?
— তাওসিফের সাথে দেখা করতে যাবো। তোমার ছেলে তো আমায় পাত্তাই দিলো না। রিজেক্টেড মানুষটাকে একজন করুণা করে কাছে টেনে নেবার আগ্রহ প্রকাশ করলো । কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকে খানিক সময় তো দিতেই হবে।
হাসতে হাসতে কথাটা বললেও হাসির আড়ালে ওর বুক ভাঙা কষ্টটা ঠিকই দৃষ্টিগোচর হলো অনিমার।
ওর যাবার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন কেবল। তার নিজের দোষেই হয়তোবা মেয়েটা এত কষ্ট পেলো।
নুহার আকৈশোর নিদ্রকে পাবার স্বপ্নটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিলে এই বিশ্রী ঘটনাটা আজ ঘটতো না। এখন তো জোর করে বিয়ে করানোও সম্ভব নয়। জোর করে যে সংসার হয়না এ কথা অনিমার চাইতে ভালো আর কে ই বা জানে?

এক মুঠো গোলাপ
১৭
_____
(সুপ্ত)

নিদ্রর থেকে লুকিয়ে ওর ডায়েরি নিয়ে এসেছিলাম। বলাই হয়নি। ইনফ্যাক্ট আমার নিজেরই মনে ছিলো না। কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হতে নিচ্ছিলাম তখন ব্যাগের ভেতর ডায়েরি টা দেখে মনে পড়ে যায় দেড় দুই মাস থেকে ব্যাগের ভেতরেই পড়ে রয়েছে জিনিস টা।
আজ পড়ে দেখবো ভাবছি। কলেজ ব্যাগ থেকে সন্তর্পণে ডায়েরিটা বের করে হাতে নিলাম। ব্ল্যাক চামড়ার ডায়েরি, আমারটার মতই। আমি জানি ডায়েরি মানুষের ব্যক্তিগত জিনিস। না বলে হাত দেয়া ঠিক নয় বাট আমি তো বাইরের কেউ নই। তাছাড়াও সেদিন আগ্রহ দমিয়ে না রাখতে পেরেই ডায়েরি সরিয়েছিলাম। যদি না দেখতাম তাহলে খেয়ালেই আসতো না নিদ্রেরও ডায়েরি লেখার অভ্যেস আছে।
ও হয়তোবা বুঝতে পারেনি নইলে এতদিনে ঠিকই খোঁজ করতো। মনে মনে প্রার্থনা করলাম ডায়েরির কথা যেন সে একেবারেই ভুলে যায়।
–“বাবু তুমি রেডি?”
বসার ঘর থেকে বাপির গলার আওয়াজ আসছে। উমহু লেইট হয়ে যাচ্ছে আমার, সময় নষ্ট না করে ডায়েরিটা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখলাম।
–“এইতো বাপি আসছিই”
বেরুনোর মুহুর্তে নিদ্রকে আর ফ্রেন্ডস গ্রুপে মেসেজও করে দিলাম আমি কলেজে যাচ্ছি ।
,
–“বাপি আ’ম রেডি”
আমার কথা শুনে বাপি পেপার থেকে মুখ তুললেন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন_
–” আজ এতদিন বাদে ইউনিফর্মে ভীষণ ভালো দেখাচ্ছে তোমাকে মা। একদম ছোট্টো বাবু সুপ্ত”
সোফা থেকে উঠে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন বাপি।
আমি তার কমপ্লিমেন্ট শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বললাম_
— চলো বাপি লেইট হয়ে যাচ্ছে ।
বাপি মৃদু হেসে বললেন_
— চলো।
দরজার দিকে যেতে যেতেই আবার মায়ের ডাক পড়লো। মা ছুটে এসে টিফিন বাটি হাতে ধরিয়ে বললেন_
— তোর বন্ধুদের না আচার পছন্দ সুপ্ত? কাল আমড়ার আচার করেছিলাম। দিস সবাইকে।
আমি বাটিটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বললাম,
— তুমি কি জানো? তুমি একজন বেস্ট মা।
মা চমৎকার হেসে আমার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বেবী হেয়ারগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বললেন,
— তুইও বেস্ট মেয়ে। দুই বেণীতে আমার ছোট্টো সুপ্ত। ইশশ মনেই হচ্ছে না তুই ইন্টার দিবি।
মায়ের চোখ ছলছল করে উঠলো। বাপি গলা ঝেড়ে বললেন_
— এটা ইমোশনাল হওয়ার সময় নয় মিসেস কবির। চোখের পানিটা মুছে ফেলুন।
নিজের হাত দিয়ে মায়ের চোখের কোনে আসা পানি টুকু মুছিয়ে দিলেন বাপি। মা লজ্জা পেয়ে বাপির হাত সরিয়ে বললেন_
— কি যে করো না তুমি। মেয়ের সামনে!
— আরে মেয়ে বাবা মায়ের প্রিভেসি বোঝে, দেখো ওদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে।
হাহা করে হেসে উঠলেন বাপি। মা আঁচলে মুখ গুঁজে লাজুক হাসলেন।
আমি আঁড়চোখেই একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম তাদের দিকে। আমার চোখে দেখা সেরা কাপল।
আমার মনে হয় পৃথিবীর সকল সন্তানের কাছেই তার বাবা-মা সেরা কাপল। যুগ যুগ বেঁচে থাকুক তাদের ভালোবাসার এই অটুট বন্ধন।
,
কলেজ গেইটে আমার বন্ধুরা সব দাঁড়িয়ে ছিলো। আজ ঠিক কতটা দিন পর সবাই একসাথে এক ইউনিফর্মে দাঁড়ালাম খেয়াল নেই। হুট করে মনে হলো এইতো সেদিন এডমিশান নিতে এলাম কলেজে, চোখের পলকেই আজ বিদায়ের ঘণ্টা বেঁজে গেলো।
আজ কারো চোখে মুখে আগের মত উচ্ছ্বাসটা নেই। কৃত্রিম হাসির আড়ালে বিচ্ছেদের ভয় লুকিয়ে। কত-শত স্মৃতি নিউরনে আঘাত করছে বলে বা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
গুটি গুটি পায়ে ওদের কাছে যেতেই সমস্বরে চিত্কার করে উঠলো ওরা_
— হাউ আর ইউ চাইনিজ স্যুপ?
আজ স্যুপ সম্বোধন করেছে বলে একদমই রাগ হলো না আমার, বরং অজানা কষ্টটা বেড়ে গেলো।
করতলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি।
আমার কান্নার শব্দে ছুটে এলো সব। আভা-জেরিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর্দ্র কণ্ঠে বললো_
— কাঁদছিস কেন পাগল? এটাই কি আমাদের শেষ দেখা নাকি!
আমি ছলছল নয়নে সবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম_
— বোর্ড এক্সামের পর কি তোরা আমাকে ভুলে যাবি?
সাথে সাথে সবাই হ্যাঁ সূচক ভাবে মাথা নেড়ে বললো,
— অফকোর্স ভুলে যাবো। তুই কি ভিআইপি যে মনে রাখতে হবে?
সাজ্জাদ, ধ্রুব অট্টহাসি দিয়ে বললো_
— চাইনিজ স্যুপ তোকে মনে রাখতে যাবো কেন! তুই কি স্পেশাল কেউ?
আমি নাক টেনে অসহায় ভাবে শুধালাম_
— সত্যিই ভুলে যাবি?
আমার অসহায় দৃষ্টি ওদের ইমোশন টাকে আর আটকে রাখতে পারলো না। পিছু ঘুরে চোখের পানি আড়াল করে ফেললো ওরা।
চোখে পানি আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের বন্ধুত্ব দীর্ঘ নয় বছরের । সেই ক্লাস থ্রী থেকে একজন একজন করে বন্ধু যোগ হয়েছে আমাদের গ্রুপটায়। কম্বাইন্ড স্কুল না হওয়া সত্বেও আমাদের বন্ধুত্ব এত গাঢ় যে ধ্রুব আর আদিব ভালো কলেজে চান্স পেয়েও আলাদা পড়বে না বলে আমাদের কলেজে এডমিশান নিয়েছে।
চাইলেই বন্ধুত্বের এই অটুট বন্ধন যুগ যুগ টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু সব ক্ষেত্রে লাক ফেভার করে না। ইউনিভার্সিটি লেভেলটা একটা আলাদা জিনিস। এটার ওপর ডিপেন্ড করে ক্যারিয়ার। কলেজ অবধি বাবা-মা বন্ধুত্বের খাতিরে চয়েজেবল জিনিস হাত ছাড়া করার টেন্ডেন্সি মেনে নিলেও এর পরের ধাপ গুলিতে মানবে না । আমরা সবাই জানি লাক ফেভার না করলে আমাদের গ্রুপটা ভেঙে যাবে। একেকজন একেক শহরে চলে যাবো। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার একমাত্র ওয়ে হবে গণমাধ্যম ।
আমাদের বন্ধন ঠুনকো নয় কিন্তু একটা প্রচলিত কথা আছে , “চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়ে যায়।”
চিরন্তন সত্যের মধ্যে এটাও একটা, জীবনের ব্যস্ততা নামক চাদরে শৈশব-কৈশোরের সোনালী স্মৃতিগুলো ঢাকা পড়ে যায়। সাফল্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে এক সময়ের হাসিখুশি সত্তাটা কোথায় যে হারিয়ে যায় কেউ টেরই পায়না।
আমরা সকলেই একসময় একা হয়ে যাবো। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
____
বিশেষ কারণ বশত আ্যাডমিটটা ওঠানো পসিবল হলো না। বরং লাস্ট মুহুর্তে আরেকটা ফেয়ারওয়েলের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। শুধুমাত্র আমার অসুস্থতার কারণে আমাদের সেকশন ক্লাস পার্টি আ্যারেঞ্জ করতে পারেনি। কিন্তু এখন করবে ভাবছে। লাস্ট মুহুর্তে আমাদের ভয়ানক সিদ্ধান্তে মত দিলেন না প্রিন্সিপাল স্যার। অনুনয় বিনয় করে তাকে রাজি করাতে হলো।
আগামী পরশুই আমাদের ক্লাস পার্টি এবং ফেয়ারওয়েল হবে, ঘোষণা করা হলো।
এ যাবৎ সকল প্রোগ্রামের দায়িত্ব আমাদের সার্কেলটার কাঁধেই তুলে দেয়া হতো এবং আমরা হাসিখুশি ভাবেই সব কাজ করেছি। দায়িত্ব কাঁধে নেবার অদ্ভুত আনন্দ খেলা করতো আমাদের মাঝে।
আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি কলেজের সামনে বকুল তলায় বসে সব পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলাম। সময় খুব কম হওয়ায় সীমিত আয়োজন করা হবে, সবাই এতেই খুশি। বিদায়ের মুহুর্তটাকে একটু আনন্দঘন করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা । স্মৃতি জমা করাটাই তো আসল।
আমাদের ডিসকাশনের মাঝে হুট করে ফাগুন উঠে চলে গেলো, কেউ কিছুই বুঝতে পারলাম না।
একে অপরের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিতে দিতেই আবার ফিরে আসলো।
ওর হাতে গোলাপের তোড়া দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো একদম । ফাগুনের
চোখে মুখের উচ্ছ্বাস এবং লাজুকতার মিশ্রণ ভেতরের অনুভূতি জানান দিচ্ছে যে । আমি আর আভা ছাড়া সার্কেলের কেউই জানে না হি লাভস মি। হয়তো সন্দেহ করেছিল তারাও কিন্তু পাত্তা দেয়নি।
এখন কি ফাগুন আমায় প্রপোজ করবে?
শুকনো ঢোক গিলে আমি সবার দিকে তাকালাম। আভা বাদে সকলে পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে ফাগুনের দিকে তাকিয়ে।
আমি আভাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম_
— আমি যা ভাবছি তুই ও কি তাই ভাবছিস?
আভা মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলো। আমার চোখমুখের অবস্থা আরো করুণ হয়ে গেলো। আমি আঁড়চোখে জেরিনের দিকেও তাকাতে ভুললাম না। জেরিনেরও চোখেমুখে হাজারটা প্রশ্ন খেলা করছে।
সকলের এত আগ্রহ উৎকণ্ঠা দমন করে দ্রুত পদে ফাগুন আমাদের দিকে এগিয়ে এলো।
সোজা আমার সামনে হাঁটু মুড়ে প্রপোজ করার ভঙ্গিমায় বসে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলল_
— ইয়ে মানে সুপ্ত। আই থিংক আই আ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ। উইল ইয়ূ বি মাইন?
ফাগুনের প্রপোজাল শুনে আমি সহ সবাই দুম করে উঠে দাঁড়ালাম।
সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় । বিদায়ের দিনগুলিতে একটা খারাপ স্মৃতি জমা হতে চলেছে এই ভেবেই আমার শরীর হিম হয়ে আসছিল , বুক ভাঙা কষ্টে আমি নীরব-নিস্তব্ধ।
সবাইকে দাঁড়াতে দেখে ফাগুনও উঠে দাঁড়ালো। লজ্জা হাজার গুণে বেড়ে রক্তিম হয়ে উঠলো তার ফর্সা মুখ।
সে কম্পিত কণ্ঠে পুনরায় উচ্চারণ করলো ভয়ানক কয়েকটি বাক্য _
— জানিনা কখন কীভাবে তোমায় এত ভালোবেসে ফেললাম। এতদিন মনের মনিকোঠায় সকল অনুভূতি লুকায়িত ছিলো। জানিনা কেন আজ অবাধ্য মনটা কোনো বাঁধাই মানলো না।
আর কিছু বলতে পারলো না ফাগুন । সাজ্জাদ আর ধ্রুব লাফ দিয়ে ওর দু কাঁধে হাত রেখে মজার সুরে টেনে টেনে বলতে থাকলো_
— ওরে ব্যাটা এই ছিলো তোর মনে? আমাদের পড়কুট বন্ধু ভেতরে ভেতরে পাগল প্রেমিক হয়ে গিয়েছে আমরা টেরই পাইনি? হুমম্
ওদের মজা করতে দেখে মুখ নামিয়ে মৃদু হাসি দিলো ফাগুন ।
আমি শুকনো মুখে আভার দিকে তাকালাম। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইশারা করলো যার অর্থ এখন সময় এসেছে সবাইকে সবটা জানানোর।
আমিও উপায় না পেয়ে ফাগুনের দিকে তাকিয়ে বললাম_
— আ’ম স্যরি ফাগুন । আমি অন্য কারো সাথে কমিটেড।
আমার উত্তর সবাইকে দ্বিতীয় বারের মত চমকে দিলো। ফাগুন সহ সবাই বজ্রাহতের মত তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো_
— কিহ্?
আমি মাথা নেড়ে নিদ্র আর আমার সম্পর্কের কথা বলে দিলাম ওদের।
সব শুনে ওরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো।
ফাগুন আহত স্বরে বললো_
— কই সুপ্ত আগে তো বললে না সম্পর্কের কথা!
— আসলে হুট করে সব হয়ে গেলো…. স্যরি ফাগুন
কাতর স্বরে বললাম আমি।
— ইটস ওকে।
ফিঁকে হাসি হাসলো ফাগুন । বাকিরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে । বন্ধুর রিলেশনের কথা শুনে খুশি হবে নাকি এক বন্ধুর রিজেকশন দেখে কষ্ট পাবে বুঝে উঠতে পারলো না তবে সকলের মধ্যে একজন খুশি হলো।
কথায় আছে ভালোবাসা মানুষকে স্বার্থপর বানিয়ে দেয়। ফাগুনকে কষ্ট পেতে দেখে তারও কষ্ট কম হলো না কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুখময় একটা অনুভূতিও হতে শুরু করলো। এই অনুভূতিই তাকে সাহস সঞ্চার করবে, ফাগুনকে মনের কথা জানিয়ে দিতে।
ভগ্ন হৃদয় এক তাল কাদার মত। সঠিক উপায়ে শৈল্পিক ছোঁয়ায় একে মন মত সাজানো যায়। একথা সে জানে। আজ ফাগুন ব্যর্থ হবার কষ্ট পেলো, সে প্রতিজ্ঞা করছে এই চমৎকার ছেলেটাকে জীবনে আর কখনোই কষ্ট পেতে দেবে না। কক্ষনোই না..

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here