কুয়াশা মন পর্ব ১

#কুয়াশা মন

পর্ব ১…

আমার বিয়ের কথা চলছে। পড়ালেখা শেষ না হতে এরই মাঝে বিয়ে! ছেলেপক্ষের লোক এসেছে কিন্তু ছেলেটিই আসেনি। এটিও বা আজব কম কিসে!
বিয়ের বয়স আমার হয়েছে। তবু কোথাও যেন ফাঁকা রয়েছে। বিয়ে করতেই ইচ্ছে হচ্ছে না। বিয়ের পর শ্বশুরঘরের লোকগুলো কেমন ঠেকবে এই নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা। আব্বা বলেছেন, ছেলেটির খান্দান মোটামুটি ঠিকই আছে। আমাকে তারা একবার দেখে গিয়েছিল। তবে ছেলেটির ধরনের আভাস কেউ কিঞ্চিত আদৌ পায়নি। তার পরিবারের লোক এই নিয়ে দুইবার এসেছে আমার বাসায়। একবারও ছেলেটি আসেনি। ছেলেটিকে না হয় নাই বা দেখলাম, তবে তার পরিবারের লোকে কোনদিকে যেন খটকা দেখছি বলে মনে হচ্ছে। কিছু লুকাচ্ছে নাকি তারা? ছেলে আরিফের কথা উঠলে, প্রশংসার বন্যা বয়ে যায় তাদের মুখে। তাদের ছেলে এরকম এবং তাদের ছেলে ওরকম, নানান ধাঁচের কথা। এসব অহেতুক ঢাকঢোল পেটানো লোককে আমি হারে হারেই চিনি। একবার ছেলেটিকে দেখেই বুঝব, কী চলছে। কিন্তু সেই তো আসে না। আমরা মেয়েপক্ষের লোক বিধায় আব্বারা মুখ ফুটে অধিক মিনতি করতে পারছেন না, ছেলেকে একবার দেখার কথা। বাবা এসবের কারণে নেহাত না করে দিতেন। কিন্তু ওই পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। তাই তিনি সবই হাতে হাত রেখে দেখে চলেছেন। আমার বংশের দিক থেকে আমার বড় ফুফিরা ব্যতীত ধনী আর কেউ নেই। আব্বার ওদেরই বরাবরি করার প্রবল তেষ্টা।
আমার ছবি অনেক আগেই ওই পক্ষে চলে গিয়েছে। আরিফের খালা বলেছেন, ছবি দেখে আমি আগেই বলে দিয়েছি, হীরা পেয়েছি আমাদের ছেলেটির জন্য। কিন্তু ছবি এখনও ছেলেপক্ষেরটা আসেনি। কি অদ্ভুত! আমিও যে বাবার কথার পিঠে কথা বলতে পারি না। আব্বা যাই বলেন বা করেন তাই আমার মেনে নিতে হয়। যেমনটা এখন মেনে নিতে হচ্ছে। এখনও সবে পড়ালেখা শেষ হয়েছে। নানান দিকে ঘুরব ভেবেছি। তা আর হয়ে উঠল না।
এসব ভাবার সময় সামনের মহিলাটির দিকে বিরক্তিকরভাবে তাকিয়ে থেকেছিলাম। তিনি আরিফের খালা। একটু বেশিই কথা বলার অভ্যাস। আজ দ্বিতীয়বার এসেছেন, আরিফকে আনেননি। এটিই হয়তো ঢাকার জন্য কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে বকবক করে যাচ্ছেন। বলছেন, আরিফ আগামীবার আসবেন। আংটি আজই আমায় পরিয়ে যাবেন। সবাই সহমত হওয়ায় তিনি আমায় আংটি পরিয়ে দিলেন। তারপর সদলবলে চলে গেলেন।
জানালার পাশে আমার পড়ার টেবিল। এধারে বসে ভাবছি, আমি কি এতটাই ফেলনা? কোনো এক অচেনা মানুষের নামে এংগেজমেন্ট হয়ে গেল। অথচ তাকেই দেখলাম না। ছবিটা তো দিতেই পারত।
এমন সময় আব্বা রুমে ঢুকলেন। তিনি আমার পাশে চেয়ার পেতে বসলেন। আমার মনে এখন কোনো ভাবনাই নেই। তিনি আমার সাথে যেটুকু অন্যায় করার আছে তা করে ফেলেছেন। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। নইলে এভাবে আব্বা একা এসে আমার পাশে বসলে আমার খুব ভয় করে।
“মা, আমি জানি আমি তোর বিরুদ্ধে এসব কাজ করে অনেকটা অন্যায় করেছি। তবে যা করছি তোর ভালোর জন্যই তো। আরিফের পরিবার খুব ভালো। তোকে অনেক সুখে রাখবে। শুধু একটা বিষয়ে আক্ষেপ রয়ে গেল যে, ছেলেটিকে একবার দেখলাম না। তবে তুই নিশ্চিন্তে থাক। ছেলের কাছে তো আগামীতে আসতে হবেই শত ব্যস্ততার পরও। তখন যদি আমাদের পছন্দ না হয়, তবে ফিরিয়ে দেবো তাদের সবকিছু।”
আব্বা এইটুকু বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমার ঠোঁটের কোণে হাসির একটি রেখা ফুটে উঠল। তাহলে বিয়ে ভাঙার সম্ভাবনা এখনও আছে। আর আব্বাকে যেমন কঠোর ভেবেছি তিনি তেমনটা নন। তাঁর কথাগুলোতে খানিকটা আশ্বাস পেলাম।
বিয়ের কথা শুনতেই খুব খারাপ লাগে। এতদিন আপনজনের সাথে ছিলাম। বিয়ে হলে পরের ঘরে চলে যেতে হবে। ভালবাসবে তো তাঁরা আমাকে? এসব ভেবে বিয়েটা আর করতেই মন চায় না। আবার মিহির ভাইয়ার কথা মনে পড়লে বুকের ব্যথার হাহাকার শতগুনে বেড়ে যায়। তিনি কেমন এক মায়ায় আমাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছেন। কিন্তু কখনও মুখ ফুটে তাকে কিছুই বলতে পারিনি। খুব ভয় করার দরুন এমনটা হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, তিনি খুব গম্ভীর স্বভাবের। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকে তাকে যতটুকু না ভয় করতাম, তার চেয়েও বেশি করতাম ঘৃণা। একবার বড় ফুফা আমাদের বাচ্চা-কাচ্চা সকলকে নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখন হয়তো বয়স আমার বছর দশেক ছিল। ফুফা মিহির ভাইয়াকে কিছুটা টেনে-হিঁচড়ে আমাদের সাথে করে নিয়েছিলেন। আমি, আমার আপু, ফুফাতো বোন মায়া আপু, মুক্তা সকলেই ছোট ছিলাম বিধায় দেখাশুনা করার জন্য মিহির ভাইয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি হয়ে গিয়েছিলেন যেমনটা তিনি সবসময় থাকেন। আমরা সমবয়সীরা সকলে আইসক্রিম হাতে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিলাম। এমন সময় আমি না দেখেই মিহির ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খাই। তিনিও অপ্রস্তুত থাকায় আইসক্রিমের অর্ধেক অংশ তাঁর শার্টের কিনারায় লেপ্টে গেছে। আমি এর আগেও এই ধরনের অনেক কাজ করে ভাইয়াকে রাগিয়ে দিয়ে এসেছি। এবারও আমাকে তিনি কম ঝাড়লেন না। অনেক বকা দিয়েছিলেন। দেখে দৌড়াতে পারো না? এভাবে দৌড়াতে হয়? আমার পুরো জামাই যে নষ্ট করে দিলে। এসব কে পরিষ্কার করে দেবে? আজকাল বেশি বেড়ে যাচ্ছ। মামিকে বলতেই হবে তোমার কাণ্ড-কাহিনিগুলো।
আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, বকা দিলে তো লেগে যাওয়া দাগ আর ঠিক হয়ে যাবে না! ভয়ে বলতে পারিনি। দৌড়ে গিয়ে ফুফার কাছে নালিশ দিলাম। ফুফা এসে তাকে আস্ত গিলে খেয়েছেন, আমাকে বকাঝকা করার দায়ে। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি ভাইয়াকে বললেন, “মামাতো বোন তোর। এটুকু তো লজ্জা করতে পারিস। তা না হলে মেয়েটি যে তোর চেয়ে বছর ছয়-সাতেক ছোট হবে এটা তো দেখতে পারতি। এতো ছোট একটি মেয়েকে বকাঝকা করতে লজ্জা করে না? ও তো আর ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি।”
ভাইয়া মুখ নিচু করে ফেলতেন। বলা বাহুল্য, আমি আমার বাবাকে যতটা ভয় করি, তিনিও তার বাবাকে তারচেয়ে অধিক ভয় করেন। সেদিন তিনি ফুফার বকুনি খেলেই আমার মনটা ঠান্ডা হয়। খুব মজা পেয়েছিলাম। সেদিন ভাইয়াকে বকা শুনাতে খুব ভালো লেগেছিল। এর পরবর্তী সময়ে ভাইয়া যখন আমাদের বাসায় এসেছিলেন, একপ্রকার লুকিয়ে লুকিয়ে থেকেছিলাম। কিন্তু একসময় তার হাতে ধরা পড়ি। আমার কারণে ফুফার বকা খাওয়ায় সেদিনের অনুরূপ আমায় কীভাবেই না ঝেড়েছেন! তার এসবের পেছনে তার বয়সের অনুযায়ী কোনো ভাব ছিল না। রাগারাগির দিক থেকে ছোট বাচ্চার মতোই। তাইতো, আমি ছোট, তা তার মাথায় থাকত না।
বয়স বাড়ার পর থেকে তার প্রতি ভয় যতটুকু বেড়েছে, তার চেয়ে অধিক ঘৃণা বেড়েছে। তিনি কেবল নিজেকেই চেনেন। কার মনে কতটা আঘাত লেগেছে বুঝারই চেষ্টা করেন না। নিজেকে যেন অনেক বড় কিছুই ভাবেন। এককথায় সামনের জনকে পাত্তাই দেন না। আমিও ভাইয়ার পেছনে উঠেপড়ে লাগতাম। তবে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে কখনও রাগাতে যেতাম না। কীভাবে যেন প্রকৃতি আমার বিরুদ্ধে হয়ে ভাইয়ার সাথে প্রতিবার কিছু অঘটন ঘটিয়েই ফেলত। ওই যে, অকস্মাৎ ধাক্কা খেয়ে আইসক্রিম তার কাপড়ে লেগে যাওয়াটাও উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ।
এসএসসি পরীক্ষা শেষে ছুটির সময় একবার ফুফির বাসায় কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। বড় হয়েছি বিধায় ভাইয়ার থেকে দূরে দূরেই থাকতাম। ভাইয়াও আমাকে পছন্দ করতেন না। দেখেই বুঝা যেত।
যাওয়ার দুইদিন পর ফুফি আমাকে আর মুক্তাকে নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। মুক্তারও আমার মতো পরীক্ষা শেষে ছুটি চলছিল। কক্সবাজারের কিছুটা দূরে ফুফির এক বান্ধবীর বাসা। আমাদের ওখানেও যাওয়ার কথা ছিল। ঘোরাফেরা শেষে যখন ফুফিরা ওখানে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, তখন কী ভেবে যেন ফুফি আমায় যেতে নিষেধ করে দিলেন। আমি হতভম্ব রয়ে যাই। আমি একা একটি মেয়ে কোথায় বা যাব? এমনটা জিজ্ঞেস করার আগেই ফুফি বললেন, মিহির আজ বাসায় আছে। আমি ওকে একটু আগে আসতে বলেছি। ও এসে তোকে নিয়ে যাবে। আমি আজ অনেকদিন পর বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছি। ফিরতে রাত অনেক হবে। তোকে দেখে ওরা অনেক কিছু ভাববে। তাই নিচ্ছি না।
ফুফি কথাটি সরলভাবে বলে গেলেন। আমার ছোট মস্তিষ্ক কথাগুলোকে খুব সহজেই মেনে নিয়েছিল। পরে ফুফি আমাকে এক বিশ্বস্ত দোকানদারের হাতে সঁপে দিয়ে চলে যান। সন্ধ্যার দিকে মিহির ভাইয়া এলেন। তাকে তখন দেখতে খুব আতঙ্কিত এবং বদমেজাজি দেখাচ্ছিল। এসে নিজ থেকে তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন, তোমার কারণে আমি আর পারলাম না। একা এতো মাইল অতিক্রম করে এলাম কেবল তোমায় নেওয়ার জন্য? অবিশ্বাস্য! আমি যাকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তাকেই এতদূর নিতে এসেছি? শুনো, মা ধমক দিয়েছিলেন বলে তোমাকে নিতে এসেছি। বাবাকে তো চেনো, আমার কোনো দোষ পেলে আমাকে আর কোনোকূলের জন্য রাখেন না। মায়ের কথা না মানলে বাবার কাছে যে নালিশ দেওয়ার কথা ছিল! একপ্রকার বাধ্য হয়েই আসা। তোমার জন্য আর কত কী করতে হবে বলো? আজ বেঁচে কোনোভাবে এসেছি। বাইকটা বাবা নতুন কিনে দিয়েছেন। সবেই চালানো শিখেছি। ভালো করে না শিখতেই তোমার জন্য মায়ের কড়া হুকুমে এতদূর রিস্ক নিয়ে এলাম। আর হলে না! কখন আমার পিছু ছাড়বে বলো?”
আমি কিছুই বলিনি। ভাইয়া আমাকে বাইকের পেছনে নিলেন। দেখলাম, বাইক ভালোভাবেই চালাচ্ছেন। মনে হচ্ছিল না রিস্ক নিয়ে চালাচ্ছেন। আমি কিছুক্ষণ ঘৃণার চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এটা তিনিও খেয়াল করে বললেন, “কী হয়েছে? এভাবে কী দেখছ?”
আমি কিছুই না বলে মুখ ফিরিয়ে নেই। তিনি সবসময় আমাকে বকা দেওয়ার কেবল সুযোগ খুঁজে এসেছেন। আজও এমনটা করেছেন। আমি কি জানতাম না বাইকটা কখন কিনেছেন? বাইক নতুন চালাচ্ছিল না। আমারই বা দোষ কিসে? আমি কি ফুফিকে বলেছিলাম, আমাকে এখানে রেখে যান? ফুফিই তো অকস্মাৎ রেখে গেলেন।
আর আমি অল্প অভিমানেও কাঁদা শুরু করার মতো মেয়ে। তখনও চোখ খানিকটা ভিজে গেল ভাইয়ার বকাগুলো মনে পড়ায়। এক সময় ভাইয়া বাইক থামিয়ে বললেন, “আইসক্রিম খাবে?”
আমি কিছুই বললাম না। চোখ মুছে একদিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভাইয়া কিছুটা জোর করে আমাকে বাইক থেকে নামালেন। আইসক্রিমের দোকানে নিয়ে আমাকে আমার পছন্দের আইসক্রিমটা কিনে দিলেন। খাওয়ার পর্ব শেষে আমরা ফিরে আসি।
সেদিন আমার ভয়ের পরিমাণ খুব বেড়ে গিয়েছিল। বাসায় ভাইয়া ব্যতীত কেউ নেই। মিহির ভাইয়ার বড় ভাই মঈন ভাইয়া কাজের উদ্দেশ্যে বাহিরে গিয়েছিলেন। মায়া আপু শ্বশুর বাড়িতে। সেদিন রুম থেকে বেরই হতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। বলতে গেলে আমি আর মিহির ভাইয়া একাই ছিলাম। আমি কিনা ওই বয়সে সেই যাবৎ প্রথমই একটি ছেলের সাথে একাই ছিলাম।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here