কুয়াশা মন পর্ব ২

#কুয়াশা মন

পর্ব ২…

আমি একা একই ঘরে একটি ছেলের সাথে। ভাবতেই বারবার ঘাবড়ে উঠছি। নিজেকে সামলে রাখলাম। আমি মুক্তার রুমে থাকি। তার রুমেই বসে রইল। বাহির থেকে মাঝে মাঝে খুটখুট শব্দ ভেসে আসছে। রাতের খাবার তৈরি করার তো কেউ ছিল না। নিশ্চয় মিহির ভাইয়া রান্নাঘরে কাজ করছেন। আমার কি যাওয়া উচিত? তিনি ছেলেমানুষ। রাঁধতে পারবেন তো? না, আমি এ কি করছি? তিনি আমার ফুফির ছেলে। ছিঃ তার সম্বন্ধে কিরূপ বদখেয়াল মনে আনছি। তাতে কী হয়েছে, মা বললেন ছেলেদের আশেপাশে না ঘেঁষতে?
আপন মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে চলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি রান্নাই করছেন। আমি একপা-দুইপা করে এগিয়ে গিয়ে বললাম, “পারছেন তো করতে? আমি সাহায্য করব?”
“না, আমি করে নিতে পারব।”
“রান্না করতে জানেন?”
তিনি কিছুই বললেন না। তিনি কোনোভাবে দুটো ডিম সিদ্ধ করেছেন আর চাল ধুয়ে রেখেছেন। বাকিটা কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তা স্পষ্ট দেখছি। আমি ভাতসহ দু’একটা তরকারি রাঁধতে পারি। ভাইয়ার বলার অপেক্ষা না করে ভাত রাঁধতে দিলাম। ফ্রিজ থেকে কিছু সবজি বের করে নিলাম। তারপর যেটুকু পারি কেটে, ধুয়ে রাঁধতে লাগলাম। ভাইয়া তখনও পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছু একটা হয়তো বলতেও চাইছেন বিধায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
“কিছু কি বলবেন?”
“ইয়ে মানে মা কি তোমাকে কিছু বলেছেন, কোথায় যাচ্ছেন সেই ব্যাপারে?”
“কক্সবাজারে তাঁর এক বান্ধবী বাসায়।”
“তা তো আমাকেও বলেছেন। কিন্তু..”
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু তোমাকে রেখে যাওয়ার মানে কী? কিছু জিজ্ঞেস করোনি?”
“না, আমার যাওয়াতে হয়তো কোনো সমস্যা হবে। তাই নেননি। এছাড়া আর কিই বা জিজ্ঞেস করব?”
কথাগুলো ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলতে গিয়ে অজান্তেই বৃদ্ধা আঙ্গুলে ছ্যাকা লাগল। পুড়ে গেলাম। ভাইয়া খেয়াল করতেই আঙ্গুল পানিতে দিতে বললেন। আমার সেন্স তখন কাজ করছিল না। অগত্যা ভাইয়া নিজেই চলন্ত পানির ধারার নিচে আমার আঙ্গুল দিয়ে রাখলেন। বেশি পুড়ে যাওয়ায় আঙ্গুলের ডগা লালছে হয়ে গিয়েছিল। ভাইয়া মলম এনে লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন, “এই মলমটা অনেক ভালো, ঠিক তোমার মতো। শুধু পুড়ে গেছ ওটা কাউকে বলবে না প্লিজ। বাবা যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে, আমি থাকতে তোমার কাছে রান্নাবান্না করতে হয়েছে তবে… আই হোপ বুঝেছ। ব্যথা কমেছে?”
আঙ্গুল জ্বলার সত্ত্বেও কী ভেবে যেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। রান্না প্রায় শেষ দেখে আমাকে তিনি আর কিছুই করতে দিলেন না। রান্না শেষে টেবিলে দুজন খেতে বসলাম। তার রান্না ডিমসহ অতিরিক্ত কেবল একটিই তরকারি। তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ খেয়ে গেলেন। একসময় জিজ্ঞেস করলেন, “মা কখন আসবেন বলেছিল যেন?”
“একটু রাত হবে। তবে চলে আসবেন।”
বাকিটা সময় নিঃশব্দে খেয়ে গেলাম। ফুফা এক ভাইকে দেখতে গিয়েছিলেন। কাল নাগাদ চলে আসবেন। এভাবে ফুফার অনুপস্থিতিতে ফুফি কী করছেন কিছুই বুঝছি না। মিহির ভাইয়া নানা প্রশ্ন করার পর থেকে এই চিন্তাগুলো মাথায় বারবার আসছে। ফুফির আসার পর আমি মুক্তার সাথে শুয়ে পড়লাম। বামপাশে ফিরতেই কানে বাজছে, ‘আইসক্রিম খাবে?’
মনে মনেই উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, খাব তো। কেন খাব না? আপনি দিলে অবশ্যই..’ এসব আমি কী ভাবছি? আবার ডানপাশে ফিরলাম।
‘এই মলমটা অনেক ভালো, ঠিক তোমার মতো।’
‘সত্যিই কি!’
না না, এ কী ভাবছি আমি? ভাইয়াকে ভালো করে চিনি। ফুফাকে কিছু না বলার জন্যই আমার প্রশংসা করেছেন। তবে যাই হোক, আজ তাকে যেভাবে দেখেছি ওভাবে কোনোদিন দেখিনি। আমার মন খারাপে তার আইসক্রিম কিনে দেওয়া, পুড়ে যাওয়াতে মলম লাগিয়ে দেওয়া। আজ যেন অন্য কোনো এক মিহিরকে দেখলাম। আজ যেরূপ নম্রভাবে কথা বলেছেন, তা এইবারের মতো প্রথমই। তার ভেতর নম্রতাও আছে তা সেদিনই জানলাম। সারাটা রাত এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে চলে গেল। বলতে গেলে এরপর থেকেই তাকে ঘৃণা করা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেদিন গভীর রাতে মঈন ভাইয়া অফিসের কাজ শেষে ফিরে এলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠলে দেখি আমি ফ্লোরে ঘুমাচ্ছিলাম। এমনটা প্রতিবারই হয়, যদি আমি রাতে উত্তেজিত হয়ে ঘুমাই। ঘুমের ঘোরে রাতের বেলায় নিচে পড়ে যাই। সেদিন পড়ে গিয়ে পাশে টেবিল থাকায় কয়েকদিকে আঁচড় পড়েছে।
সকালে ফুফাও চলে এলেন। বিকেলের দিকে তিনি বারান্দায় বসেছিলেন। আমাকে ডাক দিলেন। কেন ডাক দিয়েছেন তা জেনে তেল নিয়ে চলে গেলাম। ফুফা রীতিমতো আমাকে তাঁর মাথায় তেল দিয়ে ম্যাসেজ করে দিতে বললেন। ফুফা বড় আনন্দের সাথে বললেন, “দুপুরে যা খেলাম না, এমন খাবার এতদিন একবারও খাইনি। এতো মজার খাবার অনেকদিন পর খেলাম। সত্য বলতে এই খাবারটা খেয়ে খুব প্রিয় একজনের কথা মনে পড়ে গেছে।”
“তাই? কোন খাবারের কথা বলছেন ফুফা?”
“ওই যে দুপুরে টমেটো আর শুটকি একসাথে মরিচ-মশলা ঘন করে রান্না করা তরকারি একটা খেলাম না -ওটার কথা বলছি। সেও এভাবে আজব-আজব খাবার নিজের আইডিয়া দিয়ে রাঁধত।”
মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল, কালরাত যখন কিছুই বানাতে পারছিলাম না, তখন টমেটোকে শুটকির সাথে ঘন ঝোল দিয়ে নিজ আন্দাজেই রান্না করেছিলাম। ফুফা হয়তো ওটার কথাই বলছেন।
“সে কে ফুফা? কে ওভাবে রাঁধত?”
“কেউ না।” ফুফা ইতস্তত করলেন, “তুই বল, দুপুরে যেটা খেলাম কে রেঁধেছে? নিশ্চয়ই মুক্তার মা নয়।”
কিছুটা ইতস্ততভাবে বললাম, “আমি রেঁধেছি।”
ফুফা আচমকিত হয়ে গেলেন। আমার হাত ধরে আমাকে সামনে এনে বললেন, “তুই রান্না করেছিস?”
“হ্যাঁ, কালরাত রান্না করেছিলাম।”
“কেন? তোর রান্না করার বয়স হয়েছে? তোর ফুফি থাকতে তুই কেন রান্না করেছিস?”
“ফুফি কিছুই রান্না করে যাননি বিধায় রাঁধতে হয়েছে।”
“মানে? কেথায় গিয়েছিল তোর ফুফি?”
“আপনাকে বলেননি?”
“বল, কোথায় গিয়েছিল তোর ফুফি?”
“আমাদের নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। এরপর মুক্তাকে নিয়ে তাঁর এক বান্ধবীর বাসায়।”
“বান্ধবীর বাসায়? আমি যেটুকু জানতাম, তোরা কেবল কক্সবাজারে গিয়েছিলি। এরপর কী হলো? তোর কাছে কেন রাঁধতে হয়েছে?”
“আসলে ফুফি আমাকে তাঁর বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যাননি। স্রেফ মুক্তাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে এক দোকানদারের কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফুফি মিহির ভাইয়াকে বলে রেখেছিলেন আমাকে নিয়ে আসার জন্য। সন্ধ্যার দিকে তিনি গিয়ে আমাকে নিয়ে এলেন।”
আমি কথা শেষ না করতেই তিনি বললেন, “তাহলে কাল বাসায় তুই আর মিহির ছাড়া কেউ ছিল না?”
“না”, আমি কানের সামনে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে কিছুটা নম্রভাবে বলি।
ফুফার চোখ হঠাৎ আমার হাতের আঁচড়ের দিকে পড়ল। এরপর কী ভেবে যেন ফুফা উঠে চলে গেলেন। আমি তেলের কৌটা রেখে ভীত পায়ে ভেতরে গেলাম। ফুফা গর্জে উঠে ফুফিকে ডাকছেন। আমি শুকিয়ে গেলাম। আমার কথায় কিছু হয়ে গেল না তো? আমি তো জানতামই না, ফুফি যে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা ফুফাকে জানাননি। ফুফি এলে ফুফা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, “কাল কোথায় গিয়েছিলে?”
“কেন? তোমাকে তো বলেছিলামই কক্সবাজারে যাওয়ার কথা।”
“শুধুই কি কক্সবাজারে গিয়েছিলে?”
ফুফি ক্ষেপে গিয়ে আমার দিকে দেখছেন।
“বলো, শুধুই কি কক্সবাজারে গিয়েছিলে? আর কোথাও যাওনি?”
“না, যাইনি।”
“মিথ্যে একদম বলবে না। আমি ভালো করেই জানি তুমি তোমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলে।”
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। কী অপরাধ করেছি আমি?”
“কী করেছ আমি ভালই জানি। সাবিহাকে নাওনি কেন?”
“আমার ইচ্ছা, আমি নিইনি।”
“দেখ, মেজাজ খারাপ করবে না কিন্তু। কক্সবাজারে তোমার কোন বান্ধবী আছে তা আমি কি জানি না? ওই বান্ধবীটাই না, যার ভাইয়ের সাথে মুক্তার বিয়ে দেওয়ার ধান্দা আগেও করেছিলে?”
ফুফি রাগে কটমট করে মুখ নিচু করে ফেললেন।
“জবাব দাও।” ফুফা চিল্লিয়ে উঠায় বাকিরা রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
“হ্যাঁ, মুক্তাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটা যে শ্যাম বর্ণের, কোনোদিক থেকে প্রস্তাব কি আসে? আর আগে থেকেই ফাহিমার সাথে আমার কথা হয়ে গিয়েছে। ও কত ধনী নিশ্চয় আপনি জানেন। মুক্তাকে দেখাতে নিয়ে গেলাম ওর ভাইয়ের সাথে। এতে সমস্যা কী?”
“সমস্যা কোথায় তুমি কি জানো না? ষোল বছরের বাচ্চা মেয়েটিকে তুমি বিয়ে দেবে? তাও বয়স্ক, কালো একটা ছেলের সাথে?”
“কালো-ধলো এগুলো দেখে লাভ কি! মেয়ে পরের জীবনে সুখী থাকলেই তো হলো।”
“ওর পরের জীবনের কথা বেশি চিন্তা করতে যেও না। এভাবে বেশি চিন্তা করলে মেয়েটা অসুখীই হবে। আর তোমার কেমন মন-মানসিকতা? একটা বাচ্চা মেয়েকে তুমি এক দোকানদারের কাছে রেখে গিয়েছিলে? কীভাবে পারলে?”
“যার-তার কাছে রেখে যাইনি। লোকটাকে আমি আগে থেকেই চিনি। আর সাবিহাকে রেখে যেতে হয়েছে। কারণ ওকে নিয়ে গেলে মুক্তাকে দেখার স্থলে সবাই সাবিহার রূপকেই দেখত।”
এরপর তাঁদের দুজনের বাড়াবাড়ি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। শেষে ফুফা একদম পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছেন, মুক্তার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই ফুফি নিতে পারবেন না।
যখন আমি আর মুক্তা ঘুমাতে গেলাম, তখন মুক্তা হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। পরে সে বলল, ফুফি তাকে জোর করেই ছেলেকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটিকে তার একদমই ভালো লাগেনি। কিন্তু ফুফির দেওয়া চাপে কিছুই বলতে পারেনি। সে আন্দাজ করেছে, আমার কারণেই কথাগুলো উঠেছে। মুক্তা আমাকে শত ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তার জীবনের মোড় পাল্টানোর জন্য। বলছে, আমি কথাটা না তুললে ওকে লুকিয়ে ছেলেকে দেখিয়ে আনার কথা ফুফা জানতে পারতেন না। না জানলে বিয়ে ওই ছেলের সাথে হয়ে যেত। ছেলেটি না জানি কত খারাপ কাজে জড়িত। বিয়ের সম্বন্ধে ফুফা শেষের দিকে জানলে এবং বিয়েটা অস্বীকার করলে গুণ্ডা ভাড়া করে এনে ফুফাকে ধমকাবার কথাও উঠেছিল। ফুফা এখন কথাগুলো সময় থাকতেই জেনে গেছেন। খারাপ কিছু ঘটার পূর্বে ফুফা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। ফুফারও যে ক্ষমতা কম নয়।
আমি মুক্তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ওর কান্না মুছে দিয়ে দুজনই হাসি মুখে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ফ্লোর থেকে উঠে দেখলাম, বাইরে গোলযোগ বেঁধেছে। ফুফারা একদল লোক আরেকদল লোকের সাথে কথা কাটাকাটি করছেন। মুক্তা ওই ব্যক্তিকে চিনিয়ে দেয়, যার সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা ফুফি পাকা করে এসেছিলেন। দু’পক্ষেই বল খুব বেশি। কেউ কাউকে কিছুই করতে পারছে না। পরক্ষণে আশেপাশের সকল মানুষ ফুফার পক্ষে জুটে। যাক, তাঁর বল বেড়েছে। এরপর মারামারিতে না গিয়ে ফুফারা বৈঠক বসলেন। পুরোটা দিন এসব মামলায় কেটে গেল। এরপর মামলা শীতল হয়ে আসে। কোনোভাবে ফুফা মুক্তার বিয়েটা ক্যান্সেল করাতে সক্ষম হলেন। যখন তারা শান্ত হয়ে কথাবার্তা বলছিল তখন চারিদিকে সবাই ভিড় জমিয়েছিল। আমিও ভিড়ে ছিলাম। ঠিক তখনই কে যেন আমার হাতটা শক্তভাবে ধরল। পিছনে ফিরে দেখলাম, আমার হাত মিহির ভাইয়াই ধরেছে। তিনি আমাকে টেনে ছাদে নিয়ে গেলেন। আশেপাশে কেউই ছিল না। তিনি আমার হাত ছাড়েননি। দরজা বন্ধ করে দিয়েই হাত ছাড়লেন। কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here