কুয়াশা মন পর্ব ৩

#কুয়াশা মন

পর্ব ৩…

ভাইয়া এভাবে দরজা কেন বেঁধে দিয়েছেন? আমার হাত তো দরজার উপরের দিকে পৌঁছবে না। কিছু যদি হয়ে যায়, পালাব কী করে? তাকে দেখে লাগছে, তার মেজাজ যেন চরমভাবে চটে আছে।
“কী মনে করো তুমি নিজেকে?”
“মানে? কী বলছেন?”
“সবসময় আমাকে নিয়ে ঝামেলা পাকানো লাগে তাই না? আমার কোনো ক্ষতি না করলে তুমি শান্তি খোঁজে পাও না তাই তো?”
“এসব কী বলছেন আপনি?”
“আসলেই তুমি অনেক বড় একটা চালবাজ। উপর থেকে যতটা নম্র আর ভদ্র দেখায় না তোমাকে, ততটা তুমি নও। আমাকে নিয়েই কেন প্রতিবার ঝামেলা করো? কী ক্ষতি করেছি তোমার?”
“আমি আপনার কোনদিক দিয়ে ক্ষতি করলাম?”
“করোনি? কাল কি কিছু হয়েছিল আমাদের মাঝে? নাকি আমিই তোমাকে একা পেয়ে সুযোগের হাতছাড়া করিনি?”
“ভাইয়া..”
“শুনো, অনেক হয়েছে তামাশা। আমি আর একটা মুহূর্তও তোমার মুখ দেখতে চাই না। প্লিজ চলে যাও আমার জীবন থেকে।”
“আমি কী করেছি ভাইয়া?”
“কী করোনি তাই বল। বাবা কেন বলছে, আমি পরশু রাত তোমায় একা পেয়ে সুযোগ খুঁজেছি? এমন কী বলেছ ববাবাকে? এমনিতেই তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন না। তার ওপর কত কত মন্দ কথাই না শুনতে হলো তোমার কারণে। বলো আমি তোমাকে কি ছুঁয়েও দেখেছি?”
“ছিঃ আমি ফুফাকে এমন কিছুই বলিনি।”
“আর কীভাবে বললে সত্যিটা বের করবি বল্? তাহলে বাবা কালরাত কেন আমার রুমে এলেন? কেন ভ্রূ কুঁচকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আমি তোর সাথে কিছু করেছি কিনা। নিশ্চয় তুই প্যাঁচ লাগিয়েছিস। জানি, সত্য কথা বলবি না। তোর মতো মেয়েরা সবই পারে। মেয়েরা কাউকে ধোঁকা দিতে, নিজ স্বার্থ আত্মসাৎ করতে এক মুহূর্তও ভাবে না। তুই তো ওদেরই জাত।”
“ভাইয়া, আমি এমন কিছু করিনি। কেবলই আমাকে অপমান করছেন।” বলার সময় আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল।
“থাক, তোর সাফাই। তোর প্রতি ঘৃণাটা এখন প্রবল হয়ে গিয়েছে। আমি এক মুহূর্তও তোকে সহ্য করতে পারব না। এই ঘরে হয়তো তুই থাকবি, নয়তো আমি। আমি বাসায় রাতে ফিরে আসব। তোকে যেন এই বাসায় না দেখি। তুই থাকলে আমি বেরিয়ে যাব। বছরখানেক পর দুবাই চলে যাচ্ছি। ততদিন পর্যন্ত আমি তোকে এখানে এক পলকের জন্যেও দেখতে চাই না। আর খবরদার, বাবার কাছে এসবের জন্য আমাকে দায়ী করতে যাবি না।”
ভাইয়া দরজা খুলে চলে গেলেন। আমি ওইখানেই দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী থেকে কী হয়ে গেল। ভাইয়াকে এসব কথা ফুফা কেন বললেন? আর ভাইয়া আমাকেই বা ওটার জন্য কেন দোষারোপ করছেন? এমন কী কাজ করলাম যার কারণে ভাইয়া আমার সাথে তুই-তোকারি করে কথা বলেছেন? এযাবৎ আমি এমন অপমানিত বোধ কখনও করিনি। নিশ্চয় ভাইয়ার কোনো ভুল হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই আমি তার সম্বন্ধে কেন প্যাঁচ লাগাতে যাব? যাইহোক, আমি এখানে আর থাকতে পারব না। শীঘ্রই বাসায় চলে যেতে হবে। কারণ বিগত সময়ে আমার কারণে অনেক কিছুই উলট-পালট হয়ে গিয়েছে। ফুফি আর ফুফার মাঝে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছি। এখন আমার কারণে ভাইয়া ফুফার বিশ্বাস হারিয়েছেন। এই দুই ব্যক্তির সামনে মুখ দেখানোর যোগ্য আমি আর নই।
সেদিন পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেল। মুক্তাও রক্ষা পেল। শেষে সন্ধ্যার দিকে গিয়ে ফুফার সাথে দেখা করলাম। ফুফির পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ানোর কারণে ফুফি আমাকে হয়তো সহ্য করতে পারবেন না। এখন ফুফাই বাকি। ফুফাকে অনেক করে বুঝালাম, আমার এই জায়গায় থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আপনজনের কথা খুব করে মনে পড়ছে। আমি এখনই বাসায় চলে যাব।
ফুফা আসল কথাটা অনেক করে জানতে চাইলেন। আমার মন খারাপের ভাবটা উপরেও স্বচ্ছ ছিল। কাজেই আমার কথাগুলো ফুফার সত্য লেগেছিল। বুঝতে পারেননি আসলে মন কী কারণে খারাপ ছিল। আমার দুঃখ বুঝে ফুফা আমাকে আমার বাসায় নিয়ে এলেন। তারপর কী কারণে যেন সরিও বললেন।
কিছুটা দিন আমার অস্বাভাবিকভাবেই কেটেছে। এরপর থেকে একবারও যাইনি ফুফির বাসায়। অনেক চেষ্টা করেছি। তবু মিহির ভাইয়ার অবয়বটা মন থেকে সরাতে পারিনি। ভাইয়া নিজ থেকেই এতটা খারাপ কথা আমাকে শুনাতে পারেন না। নিশ্চয় এমন কিছু হয়েছে যার কারণে তার মেজাজ চটে গিয়েছিল। ফুফি হয়তো আমাকে ঘৃণা করেন। তাই আর যাওয়া হয় না। মুক্তা অনেক করে জোর করত। আমি প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার জন্য ওকে এখানেই চলে আসতে বলতাম। বছরখানেক পর মিহির ভাইয়া আর মঈন ভাইয়া দুবাই চলে গেলেন। এরপর থেকে ফুফা প্রায়ই আমাকে যেতে অনুরোধ করতেন। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ফুফার মন রক্ষার্থে দিন কয়েক থেকে আসতাম। সেসময় ফুফির অগোচরেই থাকতাম। কখনও তাঁর মুখোমুখি হলে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দিতেন না। তবে কথাও বলতেন না, মুখ ফিরিয়ে নিতেন। ফুফি আমাকে আর পছন্দ করেন না ভেবে আমি তেমন একটা যাওয়া-আসাও করতাম না। সেই শেষবারের মতো গিয়েছিলাম মুক্তার বিয়েতে। আনন্দের সময়ে ফুফি আমার সাথে রাগারাগি তেমন করেননি। কারণ কোথাও না কোথাও আমার কারণেই মুক্তা এতো ভালো এবং কেয়ারফুল একটা বর পেয়েছে। প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ফুফাদের বরাবরি করতে না পারলেও তাঁর খান্দানটা খুব ভালো। সেই হিসেবে ফুফি ভেতরে তো খুশি হয়েছেনই। সেই বিয়ে থেকে আসার পর আর যাইনি। কেননা মিহির ভাইয়ারা মুক্তার বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন। থেকেছিলেন বেশ ক’দিন। আমি দ্বিধা বোধ করে কোনোভাবে বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলাম। বিয়ে শেষে চলে এসেছি।
এখন পড়ালেখা শেষ হয়েছে। আমারও বিয়ের কথা চলছে। আজ আমায় আংটি পরিয়ে গেছে। বাবার কাছে শুনেছি কালই ছোটখাটো আয়োজন করে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হবে। পরে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। বিয়েতে আমার কোনো সায় নেই তা বুঝারই কথা। আমার মন আজও আটকে আছে ওই কুয়াশা মনের প্রাচীরে। পারিনি এখনও ওই কুয়াশা ভেদ করতে। আচ্ছা, ওই কুয়াশা কেটে যখন তার মনের আকাশটায় সূর্য হাসিমাখা মুখে উদয় হবে তখন কি সে আমায় দেখবে ওই মনেরই কোনো এক কোণোয়? আছে কি ওখানে আমার জন্য কোনো জায়গা? না, আমি একটু বেশিই ভেবে ফেলছি। এমন কুয়াশা আচ্ছাদিত তার মন, সহজেই প্রবেশ করা অসম্ভব। আচ্ছা, ওই কুয়াশার আড়ালে কী আছে? কারও জন্য ঘৃণা? নাকি অন্য কিছু?
আমার বয়স বাড়ার পর পাক্কা বুঝেছি মিহির ভাইয়ার সাথে হওয়া গোলযোগটা কেন ঘটেছিল। বোধ হচ্ছে, সেদিন ফুফা আমার হাতের আঁচড় ভালোভাবে দেখেছেন। তার একটু আগে আমার মুখে শুনেছিলেন, আমি আর ভাইয়া তার আগের রাত বাসায় একা ছিলাম। ভাইয়া যেসব কথা নিয়ে আমাকে ঝেড়েছিলেন তদানুযায়ী ফুফা হয়তো অন্যকিছু ভেবেছিলেন যে, ভাইয়া সেরাতে আমার সাথে কোনোকিছু করেছেন। কথা হচ্ছে, ফুফা নিজের ছেলের সম্বন্ধে এমনটা কেন ভাববেন? মিহির ভাইয়াকে নিয়ে কেন এমন নোংরা চিন্তাধারা রাখবেন? ফুফা তো এমন ব্যক্তি নন। তবে কি মিহির ভাইয়া আগে কখনও কোনো মেয়ের সাথে…না না, কী যা-তা ভাবছি? মিহির ভাইয়াকে সেই ছোট থেকে দেখে আসছি। মেয়েদের সাথে তাকে কখনও ঘেঁষতে দেখিনি। বরং দূরে-দূরে থাকতেই দেখেছি। এমনকি সেরাত আমিও তো একাই ছিলাম তার সাথে। যদি মিহির ভাইয়া ফুফার ওই কল্পনা মোতাবেক হয়ে থাকেন, তবে আমার সাথে অঘটন কিছু ঘটার কথা। আর আমি সবসময় মেয়েদের প্রতি মিহির ভাইয়ার অনীহা দেখে এসেছি। না, সব মিলিয়ে এটাই তো দাঁড়ায়, মিহির ভাইয়া খারাপ স্বভাবের লোক নন। এই চিন্তা অনেক আগে থেকে মাথায় আছে, যার কারণে মনের গহীন কোণে তাকে বড় একটি স্থান দিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমরা যাকে চাই তাকে তো সবসময় পাই না। আমার ভাগ্যও হয়তো এই প্রথার পুনরাবৃত্তি করবে। কে জানে! কাল হয়তো বা অন্যের জীবনের সাথে যুক্ত হয়ে যাব। অন্যকে আপন করে নিতে হবে। আমার সকল আশা-প্রত্যাশার জলাঞ্জলি দিতে হবে এই হলফ করে বলছি।
আমি পূর্বে কাউকে নিয়ে এমনটা মনোভাবনা রাখিনি। মিহির ভাইয়ার জন্যই প্রথম। তাও এই ভাবনা ইচ্ছাকৃতভাবে উদয় হয়নি। সময়ের তালে চলতে চলতে ওই অপ্রত্যাশিত জিনিসের মোহে পড়ে গেছি। দেখছি, আজ আর ঘুম হবে না। ডায়েরিতে যতই লিখছি, লেখা যেন ফুরাচ্ছেই না।
.
.
ডায়েরির এতটুকু পড়ে সামিরা ঘুমাতে গেল। লাইট বন্ধ করে দিয়ে সে সাবিহার কথাই ভাবছে। প্রবল উত্তেজনা কাজ করছে বাকিটা পড়ার জন্য। কী হয়েছে পরবর্তিতে? সে কি মিহিরের মনের কুয়াশাকে ভেদ করতে পেরেছিল? যদি না পারত তবে সামিরার অস্তিত্বও থাকার কথা নয়। সামিরা এটুকু ভেবে লাইট অফ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। একটু পর দরজা খোলার মৃদু শব্দ হলো। মিহির এসে রুমের দরজা খুলেছে। উঁকি মেরে দেখছে সামিরা ঘুমাল কিনা। লাগছে তো ঘুমিয়েছেই। নড়চড় যে নেই। মিহির নিশ্চিন্তে দরজা বেঁধে চলে গেল। ইচ্ছে ছিল, ভেতরে ঢুকে সামিরার কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে আলতো করে স্নেহময় চুমু খাবে। কিন্তু এ অধিকার মিহিরের নেই। এ নিয়ে তার মনে কোনো গ্লানিও নেই। সামিরাকে একটু দেখতে পেলেই তার সব আশা পূরণ হয়। সামিরাও প্রতিরাত দেখে, লাইট অফ করার কিছুক্ষণ পর মিহির আসে। কিছুক্ষণ সন্ধানী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তারপর দরজাটা আস্তে করে লক করে চলে যায়। সামিরা অল্পক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে নাস্তা করে বসে রইল। আজ তার ছুটি। মিহির বাসা থেকে যায় না কেন? চিন্তায় মগ্ন সামিরা। খানিক পর সামিরার মনের দুঃখটা গুছল। মিহির চলে গেল। ছুটির দিনও সে কোনো না কোনো কাজ খুঁজে নেয়। যাক, সেরেছে। এখন জমে পড়বে। ওঠে রুমে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে ডায়েরি বের করে সামিরা পড়তে শুরু করল।
.
.
আজ চারিদিকের সরঞ্জামাদি দেখে মনটা বিষাদে ভরে যাচ্ছে। অল্প-অল্প মেহমানের ছুটাছুটি। ছেলেপক্ষ খানিক বাদেই চলে আসবে। একটু পর থেকে হয়তো আর লিখতে পারছি না। হয়তো বিয়ের পর সে সুযোগটা আর খুঁজে পাবও না। থাক, যেটুকু লিখেছি তাতেই মনটা হালকা হয়েছে। মুক্তারা একটু পর এসে পড়বে।
.
আমি হতবাক! ভেবেছিলাম এই ডায়েরিতে লেখার আর সুযোগই পাব না। ঘণ্টাখানেক পার না হতেই আবার লিখতে পারলাম। যা ঘটল না! যাস্ট ওসাম একটা মিরাকল। আমার বিয়েটাই ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here