চরিত্রহীনা – ২ পর্ব ১

‘চরিত্রহীনা২’ পর্ব-১
.
লেখক : Mahian Khan
.
– ভাইয়্যা তুই, এমন হয়ে গেলি কিভাবে?
.
– কেমন?
.
– এই যে রোবটের মত, সম্পুর্ন অনুভূতিহীন। জীবনে কত কষ্ট করেছ কিন্তু মুখ থেকে হাসি কখনো সরেনি কিন্তু হঠাৎ তোর কি এমন হল? হাসি নাই, চঞ্চলতা নাই। শুধু সারাদিন কাজ কর, একা একা থাকো, কারো সাথে কথা বল না,বাসায় যাও না প্রায় ৯-১০ বছর হতে চলল। কি সুন্দর ঠোট ছিল আমার ভাইটার! ঐ হাবিজাবি খেয়ে আজকে সুন্দর ঠোটটা কয়লা বানিয়ে ফেলেছিস। দেখ আমার বান্ধবীর ছোটবোন এইবার অনার্স থার্ড ইয়ারে। ওর জন্য পাত্র খুজতেছে, ছবি আছে আমার কাছে দেখবি?
.
– কি হবে ছবি দেইখ্যা? আমি তো প্রেমে পড়ব না। বেশিজোর অনেক ভালোলাগবে কিন্তু প্রেমে পড়তে পারব না।
.
– মানে কি? তুই আবেগের কথায় আর কত চলবি? তোর প্রায় ৩০ বছর হইতে চলল। আজকাল ছেলেপেলে মাস্টার্স কোনোরকম কমপ্লিট করেই বিয়ে করে ফেলে আর তোর কাছে ভালো চাকুরী আছে, বেতন আছে তারপরও এরকম জীবনযাপনের কোনো মানে হয়?
.
– কিন্তু মন তো নাই, শরীরের জন্য বিয়ে করে কি করব?
.
– সেই এক বাশি আর কত বাজাবি? তোর কথাগুলো আবেগ, বাস্তবতায় আয়।
.
– সবই পৃথিবীতে বাস্তব, আবেগও বাস্তব।
.
– নারে ভাইয়্যা, আবেগ শুধু কল্পনা আর এই কল্পনার জগতে থেকে পৃথিবী চলে না।
.
– আমি তো পৃথিবীকে চালাতে চাই না। আমি চাই, আবেগগুলো পরে থাকুক আমার বুকের এক গভীর কোনায়। আমি তো আর আবেগে ভাত খাওয়া বন্ধ করিনি, টাকা ইনকাম বন্ধ করিনি, করেছি?
.
– তাহলে বিয়েটা করে ফেল।
.
– শরীরের জন্য একটা মেয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কি লাভ? আমি তো তাকে মন দিতে পারব না।
.
– এটাইতো আবেগ। বাস্তবে তো বেশীরভাগ বিয়েই এরেঞ্জড ম্যারেজ। স্বামী-স্ত্রী কেউ কাউকে চিনে না তবুও আজীবন একসাথে কাটিয়ে দেয়।
.
– আজীবন একসাথে কাটিয়ে দেয় কারণ, তারা ভালোবাসে একে অপরকে।
.
– তাহলে? আমি তো একই কথা বললাম। বাস্তবে একটা পুরুষ আর নারী একসাথে থাকাকে ভালোবাসা বলে।
.
– তাহলে তো তুই ভুল। তুই যেটা বললি সেটাকে বলে ভালোলাগা, সেটাকে বলে চাহিদা। একটা পুরুষের জীবনে অনেক নারীকেই ভালোলাগে, অনেক নারীকেই পাশে চায়, অনেক নারীকেই সে আদর করতে চায় কিন্তু শুধু একজন নারীকেই সে ভালোবাসে। আমার সাথেও কোনো মেয়ে ১ মাস একঘরে থাকলে আমার তাকে ভালোলাগবে, হয়ত তাকে আমার পাশে রাখতে চাব কিন্তু ভালোবাসতে পারব না।
.
– এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে, আরে বাবা! তুই বলতে চাও ক্লাস সিক্স-সেভেনের ছেলে পেলেরা আজকাল বলে আমি অমুককে ভালোবাসি, তমুককে ভালোবাসি তো তারা সত্যিকারের ভালোবাসে? আজকাল ছেলে মেয়েরা হাত কেটে নাম লিখে, ট্যাবলেট খায় ছ্যাকা খেলে এগুলো কি বাস্তবে ভালোবাসা?
.
– না, মোটেও না। ভালোবাসা এক মাস, দুই মাস, তিন মাস অথবা ৬ মাসে হয় না, প্রচুর সময় প্রয়োজন। আর তা ক্লাস সিক্স, সেভেনে পড়ে অথবা স্কুল-কলেজের ছেলে মেয়েদের পক্ষে সম্ভব না। আর প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকারা হাতও কাটে না, ট্যাবলেটও খায় না। এগুলোতো আবেগ না, এগুলো তো মানসিক রোগের লক্ষণ। ভালোবাসার অনুভূতিগুলো সংরক্ষিত থাকে যে হৃদয়ের অভ্যন্তরে সেই হৃদয়কে ধ্বংস করা তো ভালোবাসাকে ধ্বংস করা। যে নিজের হৃদয়কে নিজ হাতে ধ্বংস করে অথবা ধ্বংসের চেষ্টা করে সে তো, নিজের হৃদয়কেই মূল্য দিতে জানে না, ভালোবাসা এই জন্মে তার পক্ষে তার পক্ষে সম্ভব না। যে হাত কেটে নিজের প্রিয় মানুষের নাম লিখে সে কিভাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হয়? নিজের প্রেমিক/প্রেমিকার নাম যে মনে রাখতে পারে না সে কিভাবে ভালোবাসতে পারে? প্রেমিকা/প্রেমিক সংরক্ষিত থাকে হৃদয়ে যারা হাত কেটে প্রেমিক/প্রেমিকার নাম সংরক্ষণ করতে চায় তারা তো জানে না, এই হাত তো কেটে পরে যেতে পারে কিন্তু হৃদয় শুধুমাত্র মৃত্যু ছাড়া ধ্বংস হতে পারবে না। এরা তো হৃদয়ের মূল্য বোঝে না, ভালোবাসা আরো বহু দূরের কথা। ভালোবাসা কখনো এক পলকে হয় না। অনেক সময়ের ব্যাপার, অনেক মানে প্রচুর।
.
– এগুলো তো চরম ফালতু কথা। ভাই তোর হল কি? আমি তো আগাগোড়া কিছুই বুঝলাম না। তার মানে পৃথিবীতে যারা নিজেদের প্রেমিক অথবা প্রেমিকা হিশেবে দাবি করে তাদের দাবিগুলো মিথ্যা?
.
– না,তবে অনেকে না বুঝে করে। ভালোবাসা হল, যখন ভালোলাগা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায় তখন তা ভালোবাসায় পরিনত হয়। যেকোনো সুন্দরি, রুপবতি মেয়েকে দেখলেই আমার ভালোলাগতে পারে, মনে নানা ধরনের চিন্তা আসতে পারে। কিন্তু যেই মেয়েকে দেখতে দেখতে, তার বকবকানি শুনতে শুনতে, আমার অসহ্য লাগে, বোরিং লাগে সেই মেয়েকেই আমি ভালোবাসি কেননা,যেদিন সেই মেয়েকে টানা ২ দিন দেখা যাবে না, তার বকবকানি শোনা যাবে না আর সেদিন স্বর্গীয় হুরও যদি আমার পাশে এসে বসে আমি তার দিকে ফিরে তাকাতে পারব না। কারণ আমি তাকে ভালোবাসি। এটাকেই ভালোলাগার সর্বোচ্চ স্তর বলে। যেই স্তরে হরমোনের কারণে বিপরীত লিঙ্গের কাউকে দেখে ভালোলাগতে পারে হয়ত দেহে শিহরণ জাগতে পারে, হয়ত মস্তিষ্কে নানা চিন্তা আসতে পারে কিন্তু হৃদয়ের গভীরে শুধু বিপরীত লিঙ্গের একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির ছবি কোনো আধ্যাত্মিক সুপারগ্লু দিয়ে লাগানো থাকে যেই সুপার গ্লু এতটা শক্তিশালী যে, সেই ছবিকে হৃদয় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে কলিজা কাটা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। এটাই ভালোলাগার সর্বোচ্চ স্তর যেটাকে আমরা ভালোবাসা বলি। কিন্তু এর উপরেও একটা স্তর আছে যেটা ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তর এই স্তরের নাম আমার জানা নেই তবে এই স্তরটা সর্বোচ্চ। এই স্তরে ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা থাকে না বরং একটা বিশ্বাসে পরিনত হয়। এতটা শক্তিশালী বিশ্বাস যে, প্রিয় মানুষটি যদি গলায় ছুরিকাঘাত করে খুন করে ফেলে তবুও শেষ শ্বাস পর্যন্ত প্রিয় মানুষটি কেন এমন হয়ে গেল সেই ব্যাখা খুঁজতে মস্তিষ্ক ব্যস্ত থাকে। এটাই ভালোবাসার সর্বোচ্চ ধাপ আমি আজব্দি শুধু একজন মানুষকে ভালোবাসার এই লেভেলে দেখেছি।
.
– বাপরে বাপ! তুই দেখি প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে পুরা পি.এইচ.ডি করে ফেলেছিস। এরকম ব্যাখা তো সিনেমাতেও পাইনি। তুই কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলি? যে তোকে এভাবে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। আর তুই যে বললি,সেই একটা মানুষের কথা, সেই মানুষটা কে?
.
– ২ টা উত্তর একবারে দিব? অসুবিধা আছে?
.
– মানে? বুঝলাম না!
.
– তিন্নি।
.
– মানে কি?
.
– মানে হল, আমি এই মেয়েটার প্রেমে পড়েছিলাম আর ও আমার আজব্দি দেখা একমাত্র মানুষ যে, ভালোবাসার সর্বোচ্চ স্তরে যেতে পেরেছিল।
.
– তুই আমাকে এতদিন পর নামটা জানালি? এতদিন লুকিয়ে রাখলি কেন?
.
– এতদিন আমাদের খুব একটা কথা হত কোথায়? তুই শহরে আসার পর এই ১-২ সপ্তাহ কথা শুরু হল এই যা। আর এতদিন পর তোর সাথে দেখার পর যদি নিজের জীবনের হিস্টোরি বলেই সময় নষ্ট করতাম তাহলে কি বিষয়টা ভালো দেখাতো?
.
– বুঝসি, তুই তো ভালোবাসো না তোর আপুকে। তোর কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা তো নারী-পুরুষ রোম্যান্স, আর কি বলব!
.
– আরে, আপু! তোর জন্য তো বাসা ছেড়ে এখানে এসেছিলাম, মনেআছে? ভাই-বোন সম্পর্ককে ভালোবাসা কেনো বলবি? এই সম্পর্কের কি কোনো নাম আছে? নারী তো নারী আর বোন তো বোন, বোনের সাথে কি অন্যকোনো নারীর তুলনা দেওয়া যাবে?
.
– বুঝসি আর পটানো লাগবে না। এইবার বল, সেই মেয়ের কথা যেই মেয়ের জন্য এরকম ফালতু পাগলামি কর।
.
– কি বলব ওকে নিয়ে? আমার দেখা পৃথিবীতে সবচেয়ে সাহসী মেয়ে। সিনেমা,গল্প, উপন্যাসেও এত সাহসী মেয়ের কথা দেখিনি এবং শুনিনি। নিজের প্রেমিকের জন্য কাউকে খুন করা ওর জন্য কোনো কঠিন কাজ ছিল না। এতটা শক্তিশালী প্রেমিকা পুরো পৃথিবীতে কয়জন পাওয়া যাবে সেটা হয়ত গবেষনার বিষয়। কোনো ভয় ছিল না ওর মধ্যে, কোনো ব্যাথা ছিল না ওর দেহে। ওর চোখ দুটো ছিল কালো কিন্তু ওর কালো চোখের দিকে যে ব্যক্তি একবার তাকিয়েছে সে অন্তত পক্ষে ১০ বছর ওর চোখদুটোর কথা নিজের মস্তিষ্ক থেকে বের করতে পারেনি। ওর ছিল বিশাল ঘন, লম্বা কালো চুল। অন্য ১০ টা বাঙালি নারীর মত নিজের চুলকে সে রঙ করত না। কারণ সে হয়ত জানত, তার কালো চুলের যে রুপ তা পশ্চিমা নায়িকাদের টকটকে হলুদ চুলেও নেই। ওর ঠোট ছিল পুরু, একদম টকটকে গোলাপি, মুখ ছিল উজ্জ্বল, দেহ ছিল কাঠি, আঁকতে পারত সে অনেক সুন্দর ছবি। তার সমগ্র দেহ ছিল চঞ্চল যেন তার দেহ, মুখের সব কথা বলে দিত। দেখেছিলাম তখন ও কিশোরী ছিল সেখান থেকে দেখেছি ওর বিবর্তন। কিভাবে একজন কিশোরী হয়ে যায় তরুণী, কিভাবে একটা চঞ্চল কিশোরীর দেহ পরিনত হয় নারীতে। দেখেছিলাম একজন কিশোরীর ‘মা’ নামক পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করা। শুধু একটাই আফসোস, মা হতে পারলেও ওর সন্তান কোনো বাবাকে খুঁজে পায়নি।
.
– মানে কি? কিছুই বুঝলাম না।
.
– মানে, আমাদের সমাজের প্রচলিত সংজ্ঞায় ও চরিত্রহীনা।
.
– তোর কথা কিছুই বুঝতেছি না।
.
– মানে ও একজন অবিবাহিত মা ছিল।
.
– কি! তাহলে তো ও সত্যিকারের অসভ্য মেয়ে। তোর রুচি এতটা নিম্নমানের জাভেদ!
.
– কুরুচিও তো একটা রুচি। ওকে চরিত্রহীনা বললে তো তুইও চরিত্রহীনা আর আমি চরিত্রহীন।
.
– আল্লাহ, মাফ করুক। তোর মাথাটা সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, জাভেদ।
.
– কেন? সত্যি বলেছি দেখে? তিন্নি হল সেই মেয়ে যে নিজের হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের সন্তানকে পেটের মধ্যে ৯ মাস ধারণ করেছে, তিন্নি হল সেই মেয়ে যে ৪ বছর আমাকে পাশে পেয়েও তাকে বিপদে ফেলে যাওয়া সেই প্রেমিকের জন্য ৪ বছর অপেক্ষা করেছে। তিন্নি হল সেই মেয়ে যে ক্লাস নাইনে থাকতে ধর্ষিতা হয়ে বাবার মুখে চরিত্রহীনা উপাধি পেয়েছে, তিন্নি হল সেই মেয়ে যে, সকল ভয়কে উপেক্ষা করে, নিজের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পালিয়ে শহরে এসেছে। তিন্নি হল সেই মেয়ে যার কাছে জগত বলতে শুধু প্রেমিক আর ওর সন্তান ছিল। তিন্নি হল সেই মেয়ে যে পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় করত না। তিন্নি হল, একজন আর্টিস্ট, লেখিকা, ফটোগ্রাফার। যে কোনো একসময় আমার সাহায্যে বেচে থাকত, সে নিজ চেষ্টায় আমার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ উঁচু পজিশনে গিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে। তিন্নি হল সেই মেয়ে যে আমাকে ভালোবাসার সংজ্ঞা শিখিয়েছে। নাহলে,আমি ভালোলাগাকে ভালোবাসা বুঝতাম চিরকাল। আমিও প্রথমবার ওকে দেখে প্রায় বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম ওকে ভালোবেসে ফেলেছি কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তিন্নি আমাকে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিয়েছে, ভালোবাসার মানে বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে, ভালোবাসা ক্ষণিকের বিষয় না বরং প্রচুর লম্বা একটা টপিক। আজকে তিন্নিকে চরিত্রহীনা বললে তুই, আমি কিভাবে সেই লিস্ট থেকে বেচে যাব? তুই,আমি নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকি বলেই তিন্নিকে সমাজ চরিত্রহীনা ডাকার সাহস পায়। তাহলে ওকে অসভ্য ডেকে কি তুই নিজেকে বাচাতে পারবি?
.
– কিন্তু ও যেটা করেছে সেটাতো পাপ। আর কিছুই বুঝলাম না, ও নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসত। তাহলে তুই এসব কি উল্টাপাল্টা বল?
.
– চুরি করাও পাপ, চুরি করলে খোদা হাত কেটে দিতে বলেছে কিন্তু এটাও বলেছে সে যদি অনুতাপ বোধ করে তবে খোদা তাকে মাফ করবে। কেন মাফ করবে জানো? কারণ, খোদা জানেন যে,এই চোরটাকে চোর বানিয়েছে তার চেয়ে হাজার গুণ বড় চোরেরা। আমি ওকে ভালোবেসেছি, ও আমাকে কখনো ভালোবাসেনি তবে বেস্ট ফ্রেন্ডের মত মনেকরত সব সময়। কিন্তু আমি অনেক ভুল বুঝেছি, আমার ওকে অতিরিক্ত মাত্রায় ভালোলাগত আর এই ভালোলাগাকে আমার ভালোবাসা মনেকরেছিলাম। ওর অবহেলা, ওর রাগ আমাকে ক্রমেই খিটখিটে বদমেজাজি করে তুলছিল। আমি তখনো বুঝিনি ভালোবাসা হয় সহ্য দিয়ে, আকাঙ্খা দিয়ে না। শুধু কাছে পেতে চাওয়াটা ভালোবাসা না বরং প্রিয় মানুষের হাসি অথবা তার সাথে কথা বলতে পারাটাই ভালোবাসা, প্রিয় মানুষের পছন্দকে সম্মান জানানোকেই ভালোবাসা বলে। তাকে পেতেই হবে, নিজের হাতের পাশে না পেলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে এই চিন্তাটা ভালোবাসার অন্তর্ভুক্ত না। ভালোবাসা হবে স্বার্থহীন আর আমি ৪ বছর ওর পাশে থেকেও বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারিনি পেরেছি যে দিন ও চলে গিয়েছে। সেদিন বুঝতে পেরেছি যে, ভালোবাসা কাকে বলে আর আমার জীবনে শুধু একজনকেই আমি ভালোবেসেছি।
.
– বাপরে, বাপ! আমার মাথা এখনো ঘুরাচ্ছে, এটা কি সত্যি তুই জাভেদ? আর তুই বলতে চাও যে, তুই কখনো বিয়ে করবি না?
.
– হয়ত করব, নিজের দেহের চাহিদা মেটানোর জন্য কিন্তু আর কখনো অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারব না।
.
তামান্না, জাভেদের কাছে এগিয়ে জাভেদের গাল আর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।
.
– আমার ভাইটার যে, কী হল? চুলের কি অবস্থা, নাক-মুখের কি অবস্থা! বোন হয়েও তোকে কখনো বুঝে উঠতে পারিনি পাগলা।
.
মুহূর্তেই তামান্নার ২ চোখ থেকে পানি ঝড়তে থাকে। জাভেদ, তামান্নার দুচোখ মুছে দেয়।
.
– তুই, কাদো কেন?
.
– এমনি,হে আল্লাহ! ৫টা বেজে গিয়েছে! আমি এখন আসি, তাহলে। সিয়ামের কোচিং আছে আজকে সাড়ে ৫টায়, খেয়াল ছিল না। এখন গেলাম আবার পরে আসব। তুই নিজের খেয়াল রাখিস, হোটেলের খাবার ভুলেও যে না খাও।
.
– বুজছি, বাবা! তুই এখন তাড়াতাড়ি যা।
.
তামান্না মুহূর্তের মধ্যে চলে যায়। জাভেদ দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে সোফায় বসে পড়ে। বেশ জোরে একটা নি:শ্বাস ছেড়ে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে আজকে তারিখের দিকে তাকায় আর যথারীতি নিজের রুটিন অনুসারে আজকেও নিজের নতুন ফেইক আইডি থেকে তিন্নিকে উদ্দেশ্য করে মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ লিখতে থাকে,
.
“প্রিয় তিন্নি, এই নিয়ে আমি এই ৯৮৫ দিন তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন, এটা আমার ১৬তম ফেইক আইডি। আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না কিন্তু নিজের ধৈর্যকেও ধরে রাখতে পারি না তোমাকে এই নিয়ে ২৯৫৩ তম মেসেজ পাঠাচ্ছি। জানিনা তুমি আদৌ মেসেজেগুলো পড় নাকি! কিন্তু তবুও পাঠাই, আমি তোমার সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করেছি তা আমি জানি! কিন্তু অন্তত একটাবার, আমার মেসেজটার জবাব তো তুমি দিতে পারো, নাকি? এর চেয়ে বেশী কিছু চাই না। মাঝে তোমাকে একটা টকশোতে দেখেছিলাম টিভিতে, তোমার রুপের সামান্য পরিবর্তন হয়নি, তোমাকে দেখতে এখনো সেই কিশোরী তিন্নির মত। আমি জানি, তুমি আমার চেয়ে অন্তত শতগুণ উঁচু পজিশনে চলে গিয়েছ,আরো উপরে যেন যেতে পারো খোদার কাছে সেই প্রার্থনা করি। তোমার লেখা বই আজকে ৮-১০ হাজার কপি করে বিক্রি হয়। বিগত প্রায় ৩ বছরে তোমার লেখা প্রত্যেকটা বই আমি কিনেছি, মনযোগ দিয়ে পড়েছি, ফেইসবুকে তোমার প্রতিটা লেখায় লাইক দিয়েছি, তোমার প্রতিটা পেইন্টিং, তোমার তোলা প্রতিটা ছবি আমি আমার মোবাইলে,ল্যাপটপে সেইভ করে রেখেছি। ইরার সেদিন একটা ছবি দেখলাম আপলোড করেছ, সেই ছবিটা মোবাইলে ওয়ালপেপার হিশেবে ব্যবহার করছি। ইরাকে দেখতে একেবারে তোমার মত লাগে। একই রকমের চোখ, একই রকমের চুল সবকিছু হুবুহু এক! জানো, আমার না খুব ইচ্ছে হয় ইরার সাথে একটু কথা বলতে। আগে কি সুন্দর আমার ঘাড়ের উপর বসে থাকত, মনেআছে? দয়াকরে আমাকে ক্ষমা করো আর একটাবার শুধু আমাকে একটা রিপ্লাই দাও, একটাবার জানিয়ে দাও, তুমি আমাকে মাফ করেছ। হয়ত, এই ৯৮৫ দিনব্যাপী মনের ভিতর যে প্রচন্ড ব্যাথা আর অস্থিরতা তা একটু হলেও হয়ত কমবে। তোমাকে আমি আজও খুজি আর খুজতে থাকব। খুঁজে পেলে তোমাকে জোর করে সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব না, অযথা তোমার সময় নষ্ট করব না। শুধু জানতে জানতে চাব, তুমি আমাকে মাফ করেছো নাকি? আর ইরা কেমন আছে? এই দুটো উত্তর নিয়ে আর তোমার মায়াবী চেহারাটা মনমত, একবার দেখে চলে যাব। এতটুকু আমার বেচে থাকার জন্য যথেষ্ট। ”
.
বেশ গভীরভাবে ম্যাসেজটা পড়ে, জাভেদ সেন্ড বাটন নিজের আঙুল দ্বারা স্পর্শ করে অতপর মোবাইলটা বন্ধ করে পাশে রেখে দেয়। বেশ জোরে একটা নি:শ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়। বেশ মনযোগ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তায় এই হাজার মানুষের ভিড়ে কোনোভাবে তিন্নিকে যদি জাভেদের দুচোখ খুঁজে পেতে পারে হয়ত সেই আশাতেই এতটা গভীরভাবে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা হতে এখনো এক-দেড় ঘন্টা! আর এক-দেড় ঘন্টা পর ৯৮৫ তম দিন শেষ হয়ে যাবে তারপর হয়ত ৯৮৫ তম রাতও এভাবেই কেটে যাবে তারপর হয়ত শুরু হয়ে যাবে ৯৮৬ তম দিন! তবে এভাবেই কি কাটবে, জাভেদের চিরদিন?
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here