চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৩২

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩২

🍂🍂🍂

হাসপাতালের করিডোরে এদিক ওদিক ঘুরে শুভ্রতাকে খুজে চলেছে তিলোত্তমা। কপালে তার গাঢ় চিন্তার ভাঁজ। একটু আগেই মেয়েটা তার চোখের সামনে ছিল। চোখের পলকেই ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো। একদম দৃষ্টি সীমানার বাহিরে। রিকশা থেকে নেমে শুভ্রতার পিছু করে এই পর্যন্ত এসেছে। আরেকটু সাবধান থাকা উচিত ছিল তার।

~আমাকে খুঁজছিস?

তিলোত্তমা ভীষণ চমকালো। ভয়ে রুহ তার গলায় এসে আটকে আছে। মনে মনে নিজেকে বকলোও অনেক। শুভ্রতাকে জিজ্ঞেস করলেই সব বলে দিতো। অকারণে পিছু নিয়ে এখন শুভ্রতার ধমক খেতে হবে। তিলোত্তমা চোখ মুখ কুচকে পেছন ফিরে তাকালো। শুভ্রতা কোমরে এক হাত রেখে, অন্য হাত রুপার কাধে ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে। কপালে তার সূক্ষ্ম ভাঁজ। তিলোত্তমার থেকেও বেশি ভীতি রুপার চেহারায়।

~ও এখানে?
~যে কারণে তুই এসেছিস, রূপও একই কারণে এসেছে। আমার ওপর নজরদারি করতে, তাই না রূপ?

রুপা দাত দিয়ে ঠোঁট চেপে দাড়িয়ে আছে। শুভ্রতা লিফটের দিকে পা বাড়ালো।

~চেয়েছিলাম তোদের বাড়ি গেলে সব জানাবো। এখন দেখছি তোরা নিজ থেকেই এসে হাজির।
~আমি মানে আমরা তোর পেছন নিয়েছি এটা জানলি কি করে?
~আমার হাসিমাখা চেহারা দেখেও যদি তোরা আমার মনের হাল আন্দাজ করতে পারিস তবে তোদের সন্দিহান চাহনী দেখে তোদের মনের খবর জানা আমার জন্য অতোটাও কঠিন কিছু নয়।

লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই শুভ্রতা এক ঝলক ইতিকে দেখতে পেলো। যার ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি। শুভ্রতার মনটা ছটফট করতে লাগলো মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। লিফট যেনো চলছেই না। লিফটের গতি মনে হয় একদম কমে গেছে। সে তর সইতে না পেরে রেনুকে কল দিলো। নেটওয়ার্ক নেই। তার চিন্তা আরো বাড়লো। লিফট তার নির্দিষ্ট ফ্লোরে থামতেই শুভ্রতা ছুট লাগালো মায়ের কেবিনের দিকে। দুর থেকে দেখতে পেলো চিত্রা, জমেলা, রেনু আর অনিকাকে। সকলের মুখেই চিন্তার ছাপ। অনিকা কাদঁছে আর তাকে জড়িয়ে বসে আছে রাত্রি। রেনু আর চিত্রা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিচ্ছে। জমেলা এক পাশে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে। শুভ্রতা দরজার সামনে গিয়েই থামলো। স্বচ্ছ কাচের ওপাশে দেখতে পেলো উমার ছটফটানো। অরণ্য চেষ্টা করছে উমাকে বাঁচানোর। অরণ্যের পাশেই চন্দ্র। জোর করে সে কেবিনে এসেছে। শুভ্রতার চোখটা মুহূর্তেই জলে ভরে উঠলো। সে দরজা খুলে কেবিনে ঢুকতে চাইলে চিত্রারা বাধা দিলো। শুভ্রতা সে বাধা মানলো না। তার মা কষ্ট পাচ্ছে এটা তার সহ্য হচ্ছে না। শুভ্রতা কেবিনে ঢুকতেই নার্স চেঁচিয়ে উঠলো “আপনারা কেবিনে ঢুকছেন কেনো? বাহিরের মানুষ এলাউড না। বের হন বলছি!”। শুভ্রতা সেদিকে কর্ণপাত করলো না। শুভ্রতা অশান্ত কণ্ঠে ডাকলো,

~আম্মু!

উমা ওর দিকে তাকালো। ডান হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে লম্বা এক শ্বাস নিলো। মুহূর্তেই শেষ হলো উমার ছটফটানো। উমা শান্ত হয়ে গেলো। নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো, সাথে শ্বাস প্রশ্বাসও। শুভ্রতা দৌঁড়ে গিয়ে মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরারও সময়টা পেলো না। অরণ্য দু কদম পিছনে সরে দাঁড়ালো। মনিটরে হার্টবিটের সেই উচুনিচু রেখাটা নেই। ভেসে উঠেছে লম্বা রেখা। সব নিশ্চুপ হয়ে গেলো, একদম নিস্তব্ধ। শুভ্রতা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মায়ের মুখের দিকে।

~আল্লাহ রে! এটা কি হইয়া গেলো!!!!

অনিকার চিৎকার শুভ্রতার কানে ভেসে এলেও সে যেনো কিছুই শুনছে না। তিলোত্তমা আর রূপা এসে শুভ্রতাকে ধরলো। দুজনেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। চিত্রা করিডোরের এক চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। ভেতরে গিয়ে প্রিয় বান্ধবীর নিথর দেহ দেখার সাহসটা তার মধ্যে নেই। সে চাইলেও তার শরীর, মন সায় দিলো না। ঢলে পড়লো রাত্রির ওপর। তার কানে বাজছে উমার শেষ কথা,

~আমার অবর্তমানে আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস চিত্রা। আমি চলে গেলে আমার মেয়েটাকে ভেঙে পড়তে দিস না।
_____________________________________

করিডোরে চোখ বন্ধ অরণ্যের কাধে মাথা হেলিয়ে বসে আছে শুভ্রতা। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিল দেখে এখানে জোর করে বসিয়ে গেছে চন্দ্র। ফুফুর মৃত্যুতে কাতর অরণ্যকেও বসিয়ে গেছে। দু ভাই বোন চুপ করে বসে আছে। রেনু, চিত্রা, অনিকা তো চিৎকার করে কাঁদছে। রুপা আর তিলোত্তমাও কাঁদছে তবে কাঁদছে না শুভ্রতা। জমেলা বেহুঁশ হয়ে যাওয়ায় তাকে কোনো এক কেবিনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাহতাব এসে জানালো সবাইকে এখন বাড়ি যেতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সে লাশ তোলা হয়েছে। চন্দ্র লাশের কাছেই আছে।
____________________________________

~তিলোত্তমা আপা, শুভ্রতা আপামনি তো কাঁনতাছে না।

তিলোত্তমা শুভ্রতার দিকে তাকালো। উমার লাশের কাছে বসে আছে শুভ্রতা। চোখ মুখ একদম গম্ভীর তার। বিশাল বকুল গাছটার নিচে তার মায়ের লাশের খাটিয়া রাখা। কে তার মাকে দেখবে আর কে দেখবে না তার দিকে নজর রাখছে বেশ কড়াভাবে। আবসারের বাড়ির কেউ উমাকে দেখতে আসেনি। হয়তো ছেলের কাজে লজ্জিত তারা। মায়ের কাছে যাকে তাকে আসতে দিচ্ছে না শুভ্রতা। উমার মৃত্যুর পর কান্না দূরে থাক, কারো সাথে কথাও বলেনি।

~এমনে কান্না নিজের মধ্যে আটকায় রাখলে তো আপা পাথর মনের হইয়া যাইবো। কষ্ট মনে পুইষা রাখতে নাই। নিজের মধ্যে কষ্ট চাইপা রাখলে তার ভার সারাজীবন নিয়া চলতে হয়।

তিলোত্তমা শুভ্রতার কাছে গিয়ে বসতেই শুভ্রতা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে চাইলো। ধীর কণ্ঠে বলল,

~আমার চোখের পানি আম্মুর সব থেকে অপছন্দের জিনিস। আমি কাঁদছি আর আম্মু আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে না ব্যাপারটা আমাকেও ভেঙে দিবে তিলো। আম্মু তো আমাকে কাঁদতে দেখলে কষ্ট পাবে।

একটু থেমে শুভ্রতা ফের বললো,

~আম্মুর মুখটা দেখেছিস তিলো? কি সুন্দর হয়ে উঠেছে না? মাশাহ্’আল্লাহ বল।

তিলোত্তমা চুপ করে উমার লাশের দিকে চেয়ে রইলো।

~নুর ওদের জানানো হয়নি। ওদের এখন জানাতে যাস না। বিয়ের আমেজ নষ্ট হয়ে যাবে ওদের। রিদি এমনিও ওর দাদীকে নিয়ে চিন্তিত। অকারণে চিন্তা বাড়বে।
~শুভ্রতা, তোর বাবা, বাবা এসেছে। বাইরে অরণ্য ভাই আর তোর মামার সাথে ঝগড়া করছে। জলদি আয়। (রুপা)
~মাহতাব ভাইয়াকে গিয়ে বল শুভ্রতা ডাকছে।
~কেনো?(রুপা)

শুভ্রতা জবাব দিলো না। চোখ গরম করে তাকাতেই রুপা চলে গেলো।

~হ্যা ভা…শুভ্রতা বলো।
~বাহিরে যে লোকটা এসেছে সে যেনো মায়ের জানাজায় অংশগ্রহণ না করে। জোর করে গেলে আপনার লোকদের দিয়ে হাত পা বেঁধে আটকে রাখবেন। এভাবে চেয়ে আছেন কেনো? ভুত দেখেছেন? রাজনীতিবিদদের কাছে মারামারি, খুনাখুনি তেমন ব্যাপার না। আমি তো মাত্র হাত পা বেঁধে রাখতে বললাম।

মাহতাব অবাক হলেও শুভ্রতার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেকে শান্ত করলো। চলে গেলো ভাবির আদেশ পালন করতে।
_____________________________________

~লাশ নেওয়ার সময় হয়ে গেছে।

রাত্রি এসে জানিয়ে গেলো। শুভ্রতা শেষবারের মত মায়ের মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে দিলো। মৃদু স্বরে শুধালো,

~ওপারে ভালো থেকো আম্মু। আমার জন্য অপেক্ষা করিও।

চন্দ্র খাটিয়ার কাছে এসে দাঁড়ালো। মনে মনে আওড়ালো,

~ওপারে নিশ্চিন্তে থেকো আম্মু। তোমার মেয়ের খেয়াল রাখতে আমি আছি। আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি ওর পাশে থাকবো। এটা আমার ওয়াদা।

লাশ নেওয়ার সময় মহিলারা চিৎকার করে কান্না করতে শুরু করলো। অনিকা চিৎকার করে বলছে সে তার ননদকে যেতে দিবে না। অনিকা আর চিত্রা একে অপরকে জড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদছে। উপস্থিত সকলের চোখে পানি। শুভ্রতার নানি এসে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কাঁদছে না শুভ্রতা। সে এক দৃষ্টিতে মায়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। উমার খাটিয়া দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই শুভ্রতার গাল বেয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। “আমার মা” বলেই ঢলে পড়লো মাটিতে। অনিকাও চিৎকার দিয়ে উঠলো,

~শুভ্রতা রে! ও মা!!!
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here