চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৩৪

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩৪

🍂🍂🍂

টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে রেনু। বরাবরের মতো আজও শুভ্রতা খেতে আসেনি। ঘড়ির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। গত ৩ ঘণ্টা যাবত অপেক্ষা করছে সে। একটাবার গিয়ে যে শুভ্রতাকে ডাকবে সেই সাহসটাও তার মধ্যে নেই। আগে ইচ্ছা হলেই শুভ্রতার ঘরে ছুট লাগাতো। নিজের মতো কথা বলতে থাকতো আর শুভ্রতা সব মন দিয়ে শুনতো। ঝড়ের বেগে সময়ের মতো শুভ্রতাও পাল্টে গেছে। দিনভর রেনু আপা, রেনু আপা বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে না। মন চাইলে খেতে আসে। কখনো সারাদিনেও খেতে আসে না। নিজ ঘরে দরজা আটকে ঘুমায়। এত ঘুম তার কোত্থেকে আসে রেনু তা বুঝে পায় না। অরণ্যদের ৩য় দিনই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছে সে একা থাকতে চায়। কেউ চেয়েও মানা করতে পারেনি। চন্দ্র আর তিলোত্তমা রোজ দেখা করতে আসে। ওরা এলেই শুভ্রতা দরজা খুলে। অন্য কেউ এলে দরজা ভাঙার জোগাড় হলেও শুভ্রতা দরজা খুলে না। চিত্রা, রাত্রি আর অনিকা রোজ সকালে এসে হাজির হয়, সন্ধ্যায় যায়। ঘুম ভাঙ্গলে শুভ্রতা দেখা করতে আসে নয়তো তাকে চোখের দেখাটাও দেখা যায় না। রেনুর মধ্যে আর সাহস নেই যে আগের মত খেতে না আসা পর্যন্ত তাকে তাড়া দিবে। সে এখন আর শুভ্রতার সেই শান্ত, চঞ্চল রূপটা খুজে পায় না। শুভ্রতা এখন গম্ভীর, ঘর কুনো মেয়ে হয়ে উঠেছে।

~শুভ্রতা আজও খেতে নামেনি?

তিলোত্তমার দিকে রেনু মলিন হাসলো। খাবার গুলো পুনরায় রান্না ঘরে রাখতে চলে গেলো। তিলোত্তমা বললো,

~খাবার বাড়ো, আমি ওকে নিয়ে আসছি।

নুর তিলোত্তমার যাওয়ার দিকে চেয়ে খাবার বাড়তে শুরু করলো।
_______________________________________

দরজায় তিনবার টোকা দিতেই দরজা খুললো শুভ্রতা। চোখে তার প্রচন্ড ক্রোধ। তিলোত্তমা সেদিকে পরোয়া করলো না। স্বাভাবিক গলায় বললো,
~ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।

শুভ্রতাকে ঠেলে ঘরে ঢুকতেই শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
~কতবার বলেছি খাওয়ার জন্যে আমাকে ডাকবি না? মরার খাবারের জন্য রোজ এত কিসের ডাকাডাকি?
~তুই এতো ঘুমাস কি করে বলতো শুভি? সময় মেনে চলা মেয়ে এখন দিন নেই, রাত নেই, শুধু ঘুমায়।
~সেসব তোর না জানলেও চলবে।

কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো শুভ্রতা। হতাশ হয়ে ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে রইলো তিলোত্তমা। শুভ্রতার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলে কথা লুকাতো না। আর এখন…
________________________________________

~১০ দিন হয়ে গেলো। নুর ওরা একবারের জন্যও এলো না। ওরা কি জানে না?

তিলোত্তমা ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা চন্দ্র, অরণ্য আর শুভ্রতার দিকে চাইলো। শুভ্রতা খাচ্ছে। অন্যদিকে চন্দ্র আর অরণ্য ভ্রু দ্বয় কুচকে তার দিকে চেয়ে আছে।

~কাল পরশু আসবে হয়তো। আন্টির কথা ওদের জানাতে শুভ্রতা মানা করেছে। বিয়ের আমেজ নাকি নষ্ট করতে চায় না সে।
~এ সময়েও বান্ধবীর খুশির চিন্তা করে এই মেয়ে। (অনিকা)
~বিয়ে ছাড়া মেয়েকে আমাদের বাড়ি নিলে মানুষ মেয়েটার চরিত্রে দাগ দিবে। এভাবে একা রাখতেও আমার ভয় হয়। উমার মৃত্যুর ৪০ দিনও হয়নি এখনো। আমি বলিকি ভাবি আপনারা হয় এখানে চলে আসুন নয়তো ওকে নিজেদের সাথে নিয়ে যান। মেয়েটার অবস্থা দেখেছেন! কি করেছে নিজের হাল। (চিত্রা)
~অরণ্যও আজ সকালে এই কথাই বলেছে। কিন্তু শুভ্রতা কি যেতে রাজি হবে? (অনিকা)
_________________________________________

~নুরের সাথে কথা হয়েছে?
~না। কেনো বলতো?
~না এমনি জানতে চাইলাম।

অরণ্য কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলো। শুভ্রতা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।

~আমার মনে হচ্ছে তোমার খাওয়া দাওয়ায় খেয়াল রাখতে ৩ বেলা তোমার বাড়ি এসে হাজির হতে হবে।
~কেনো? আমি কি বেশি খাচ্ছি?
~খাবার খাচ্ছো কোথায়? দিনে যে একবেলা খাও। আমি বা তিলোত্তমা না এলে তো তাও খেতে না।
~রেনু আপা খেয়েছে?
~বাড়িতে কি আমি থাকি নাকি তুই? আমি কি করে জানবো সে খেয়েছে কিনা?

শুভ্রতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো। ভাবলো একবার রেনুকে ডাকবে। কিন্তু ডাকলো না। নিচে নেমেছে পর থেকে তার সামনে আসেনি। কেনো আসেনি সে জানে। অভিমানে ভেবে নিলো সাহস করে যেদিন তার সামনে আসতে পারবে সেদিনই কথা বলবে সে।
_______________________________________

~কাল মামী ওনাদের বাড়িতে আসার প্রয়োজন নেই। অরণ্য ভাইকে জানিয়ে দিবো আমি। বাকিটা তুই সামলে নিস।
~কেনো? কে আসবে?
~এলেই দেখতে পাবি।
~আমি কিন্তু আসবো। মানা করলেও শুনছি না।
~তোকে মানা করেছি একবারও?

তিলোত্তমা মুচকি হাসলো। শুভ্রতা ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধ নিয়ে খেতেই তিলোত্তমা প্রশ্ন করলো,
~ওটা কিসের ওষুধ খেলি?
~ঘুমের।
~কি? ঘুমের ওষুধ কেনো খাস?

শুভ্রতা আরাম করে খাটে বসলো। ইশারায় তিলোত্তমাকেও বসতে বললো।

~মায়ের ওষুধ এটা। মা বলেছিল একবার। এটা অতিরিক্ত খেলে হ্যালুসিনেশনস হয়।
~তোর এখন হ্যালুসিনেশন হয়?

তিলোত্তমা উৎকন্ঠা হয়ে প্রশ্ন করলো। শুভ্রতা হাসলো। এই হাসিতেই তার জবাব লুকানো।

~কেনো খাস এই ওষুধ?
~মাকে দেখতে।
~যাকে দেখিস সে তো মা না। তোর হ্যালুসিনেশন। জেনেও খাস?
~মাকে চোখের সামনে একটু দেখতে পাওয়াও যে কি এক শান্তির রে তিলো! তুই বুঝবি না।
~ঘুমের ওষুধ অতিরিক্ত খেলে তো শরীরের জন্য ক্ষতি।

শুভ্রতা তিলোত্তমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বুজে বললো,
~হুশে থাকলে মা চলে গেছে ভাবতেই দম বন্ধ লাগে। এই ওষুধে অন্তত মাকে দেখতে পাই তিলো। সে আমার সাথে কথা বলে। আমি জানি সে নিতান্তই আমার ভ্রম। তবুও এতে শান্তি খুজে পাই আমি….
~কিন্তু শুভি….

তিলোত্তমা খেয়াল করলো শুভ্রতা ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে গেছে। সে ঠিক করলো কালই সে চন্দ্র আর অরণ্যের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবে। এই ভাবে ওকে আঁধারে হারিয়ে যেতে সে দেখতে পারছে না।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here