চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৪৩

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৪৩

🍂🍂🍂

ভার্সিটির বাইরে দাড়িয়ে আছে অরণ্য। প্রচন্ড গরমে কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। সে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে ব্যস্ত। একটু দূরেই কিছু মেয়ে দাড়িয়ে আছে। বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে আর ফিসফিস করছে তারপর আবার খিলখিল করে হেসে উঠছে। একদিকে এই মেয়েদের এমন অদ্ভুত আচরণ, অন্যদিকে চন্দ্রের টানা মেসেজ আর কল। অরণ্য পড়েছে ফ্যাসাদে।
ক্লাস শেষ হতেই বাইরে বের হলো শুভ্রতা। অরণ্যকে দেখতেই তার কাছে দৌড়ে এলো। অরণ্য আলতো হেসে বোনের দিকে তাকালো।

~আস্তে আয়! ব্যাথা পাবি তো!
~ভাইয়া নুর এসেছে আজ। চল না ওর সাথে কথা বলবি।

অরণ্য শুভ্রতার কথায় ওদের ক্লাসের দিকে তাকালো। তারপর কিছু সময় চুপ থেকে বোনের মাথায় হাত রেখে বললো,

~একা এসেছিস কেনো? আহনাফ যে কতো রাগারাগি করছে সেই খবর আছে তোর? অপারেশন না থাকলে আমার জায়গায় সেই আসতো আর এতক্ষণে দুই চারটা চর থাপ্পড়ও তোর গালে পড়তো।

শুভ্রতা সে কথায় তোয়াক্কা করলো না। সে অরণ্যকে আবারো বললো,
~নুর এসেছে ভাইয়া। কথা বলবি চল।

শুভ্রতা অরণ্যের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। তবে অরণ্য এক পা ও নড়লো না। সে ধমকে উঠলো,

~যে আমাকে বিশ্বাস করে না। আমাদের সম্পর্কের মান রাখলো না তার সাথে আমি আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না শুভ্রতা। বাড়ি চল।

শুভ্রতা করুন চোখে চেয়ে রইলো। অরণ্য আবারো ক্লাসরুমের দিকে চাইলো। এবার চোখাচোখি হলো নুরের সাথে। নুরের চোখ ছলছল করছে। অরণ্য চোখ ফিরিয়ে নিলো। আর মায়ায় জড়াতে চায় না সে।

~শুভ্রতা, নুর চলে গেছে। আর ক্লাসের সবাই অপেক্ষা করছে। (শ্রেয়া)
~একটু অপেক্ষা কর ভাইয়া। আমি আসছি। (শুভ্রতা)

শুভ্রতা ক্লাসের দিকে যেতে শুরু করলো। শ্রেয়া অবাক চিত্তে প্রশ্ন ছুড়লো,
~তুই না ভাইয়াকে আগে আপনি করে বলতি? (শ্রেয়া)
~শিক্ষা হয়েছে তাই অন্যদের মত তুই করেই বলি। (শুভ্রতা)
~অনেক পরিবর্তন করছিস ইদানিং নিজেকে। (শ্রেয়া)
শুভ্রতা হাসলো। ক্লাসে প্রবেশ করতেই তার হাসি গায়েব হয়ে গেলো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো গম্ভিরতা। সে বুকে হাত গুজে সবাইকে একবার পর্যবেক্ষণ করলো। যারা ওদের নিয়ে আলোচনা করছিল তাদের চোখে মুখে ভয়ের আভাস। শুভ্রতা থমথমে গলায় বললো,

~ভেবেছিলাম ক্লাসের সবকটা কে থাকতে বলবো। পরে দেখলাম ঝামেলা তোদের এই এক সার্কেলেরই। হ্যা তো আমরা ফ্রেন্ডরা আলাদা বসেছি বলে কার কি সমস্যা হচ্ছিলো একটু হাত তোলো দেখি!

কেউ হাত তুলছে না দেখে শুভ্রতা ওর ক্লাসমেট টুম্পার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,

~তোর একটু বেশি সমস্যা হচ্ছিলো তাই না?
~হ্যা…! হ্যা? ক.. কই না তো!
~আচ্ছা? তো আমার পেছনে বসে কোন শুভ্রতা আর নুরের কথা বলছিলি তুই?

টুম্পার মুখটা সরবই ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করলো। শুভ্রতা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। পিছিয়ে গিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

~বন্ধুত্বে ঝগড়া, রাগ, অভিমান চলেই। এই নিয়ে কারো ফিসফিসানির কারণ দেখছি না আমি। পরবর্তীতে যদি দেখেছি আমাদের ঝগড়া হয়েছে, আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে, কার জন্য হয়েছে এই নিয়ে কথা বলছো তবে আই উইল মেক সিওর তোদের সবার একেকটা কু কীর্তির খবর তোদের বাড়িতে পৌঁছেছে। গট ইট?

সবাই হ্যা বলে উঠলো। শুভ্রতা টুম্পার বেঞ্চে দু হাত ঠেকিয়ে ঝুঁকে বললো,

~আর শুনবো?

টুম্পা সাথে সাথে মাথা নাড়ালো। শুভ্রতা ফের সবার উদ্দেশ্যে বললো,

~ছুটির পর যে এই মিটিংয়ে বসেছে এই খবর যেনো ভুলেও নুরের কানে না যায়। তাহলে প্রত্যেকের খবর করে ছাড়বো।

শুভ্রতা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতেই টুম্পা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। শুভ্রতাকে তার যেমন অপছন্দ তেমনি ভয় পায় সে। ভুলক্রমেও কোনো ভুল করলে বাড়ি গিয়ে মা বাবার সামনেই ধুয়ে আসতে দ্বিধা বোধ করে না এই মেয়ে। একদিন একবার নিজের বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় বলেছিলো নুর অসহ্যকর একটা মেয়ে। সেই কথা কি করে যেনো শুভ্রতা জানতে পারে আর সেদিনই ওর বাসায় গিয়ে জব্বর এক চর খায় সে। বাড়িতে থাপ্পড় আর সবার বকা খাওয়া শেষ হতেই ছোট ভাই একটা চিরকুট ধরিয়ে গিয়েছিল। চিরকুটটা শুভ্রতাই রেখে গিয়েছিল। সেটা পড়েই জানতে পারে ও কয়টা প্রেম করে, কার সাথে ঘুরতে যায় সবকিছু প্রমাণ সমেত ওর মা বাবার হাতে ধরিয়ে এসেছে শুভ্রতা। মেয়েটা কি সুন্দর ভদ্র ভঙ্গিতেই একটা বাঁশ দিয়ে এসেছিল তাকে। এরপর থেকেই হারে হারে ভয় পায় সে শুভ্রতাকে। কখনোই ক্লাসের ঝগড়া, ঝামেলায় ওকে দেখা যায়নি। নুর ওরা আসলেও শুভ্রতাকে এক কোণে কানে ইয়ারফোন গুজে বসে থাকতে দেখেছে। সর্বদাই বেপরোয়া মনোভাব তার। শুভ্রতার বন্ধুমহলের কারো সাথে ঝগড়া লাগলেও শুভ্রতা মুখ খুলতো না। শুধু কান থেকে ইয়ারফোন খুলে শান্ত দৃষ্টি মেলে বসে থাকতো। কিন্তু পরবর্তীতে অন্যভাবে ঠিকই শাস্তি দিয়েছে। যাদের শাস্তি দিয়েছে শুধু তারাই জানে শুভ্রতা এতটাও শান্ত মেয়ে নয় যতটা দেখলে মনে হয়।
_________________________________________

~তোমাকে কতবার বলেছি সকাল। আমি আর তোমার কথা মত কিছু করবো না। তুমি বলেছিলে তোমার কথা মত চললে শুভি আর আহনাফ আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা তো আলাদা হলোই না উল্টো আমাদের বন্ধুমহল নষ্ট হলো।

~কথা তো এমন ভাবে বলছো যেনো কতই না ভালোবাসো তোমার এই সো কল্ড বন্ধুমহলকে। এতোই যদি প্রিয় হতো তাহলে বান্ধবীর ভালোবাসার দিকে নজর দিলে কিভাবে?

~বাজে কথা বলবে না সকাল। আমি প্রথমে জানতাম না আহনাফ শুভিকে ভালোবাসে। কিন্তু তুমি তো জানতে!

সকাল তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বললো,

~জানলেও বা কি? শুভ্রতা আমার। ওকে সারা দুনিয়া ভালোবাসলেও ও আমার। ওকে আমার করেই ছাড়বো।

সকালের কথায় রূপা হুহা করে হেসে উঠলো। সকালের ক্রোধিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তবে এই রাগকে পাত্তা দিলো না রুপা। সে নিজের মতো হাসতেই থাকলো। হাসতে হাসতেই বললো,

~সে আশা ছেড়ে দাও সকাল। আহনাফ থাকতে শুভ্রতা তোমার হচ্ছে না। একচুয়ালি আহনাফ না থাকলেও শুভ্রতা তোমার হবে না।

দরজার দিকে পা বাড়ালো রুপা। সে আর এখানে থাকতে চায় না।

~আমার কথা মতো চলো রুপা। আহনাফ তোমার হবে এই গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি।

সকালের কথায় থমকে দাড়ালো রুপা। জবাব ভাবতে একটু সময় নিলো। বাঁকা হাসলো সকাল। তার ধারণা রুপা রাজি। এখনি হয়তো রুপা ঘুরে ঠিক আগের মতই কাতর কণ্ঠে বলবে,

~সত্যি সকাল? আহনাফ আমার হয়ে যাবে তো?

কিন্তু সকালের হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না। তার ভাবনা নিমিষেই ভুল প্রমাণ হলো রুপা যখন পেছন ফিরে বললো,

~আহনাফ ভাইকে আমার আর চাই না। সে শুভির। আমি ভেবেছিলাম শুভি আমার থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অবশেষে বুঝলাম আহনাফ শুধু শুভ্রতার। শুভ্রতা তাকে খুঁজে বা ছিনিয়ে নেয়নি। আহনাফ নিজেই শুভ্রতার কাছে সারাজীবনের জন্য ধরা দিয়েছে। আমি আর তার পিছু ছুটবো না। আমি এক ভুল বার বার করি না।

সকালের বাড়ি থেকে বের হতেই দেখা মিললো ইয়াদের। ইয়াদের শান্ত চাহনীতে রুপার রাগ কমে এলো। সে জানে ইয়াদ সকালের মত নয়। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,

~আপনার বন্ধুকে বুঝান ইয়াদ ভাই। সে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। আমি এই পথ থেকে ফিরে যাচ্ছি। পারলে তাকে ফেরান। আসি।

রুপা চলে গেলো। পেছনে ফিরলে হয়তো দেখতে পেত এক জোড়া কাতর, মুগ্ধ চোখ। যার চাহনী বলছে সে তাকে কতটা চায়। আফসোস তার ভালোবাসার মানুষ অন্য কেউতে মুগ্ধ।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here