চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫২

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫২

🍂🍂🍂

চিত্রা আর নাফিসার সাথে কথার সময় দৌড়ে এলো তরী।
~ভাবী, ভাবী, রিদিতা আপু বেহুঁশ হয়ে গেছে।

বলেই যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ছুট লাগালো। ঘটনাটা এতই দ্রুত হলো যে কিছুই বুঝতে পারলো না ওরা। অবোধ চোখে একে ওপরের দিকে তাকালো। তরীর কথা বোধগম্য হতেই সবাই একত্রে চেঁচিয়ে উঠলো,
~কি!!!!

শাড়ি কোনোমতে ধরে দৌড় লাগলো রিদিতার ঘরে। অচেতন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে রিদিতা। মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছে তিলোত্তমার মা। পাশে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে রেনু। রিদিতার পায়ের কাছে বুকে হাত ভাঁজ করে গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে মাহাদ। তিলোত্তমা সোজা রিদিতার পাশে গিয়ে বসলো। হাতের তালু মালিশ করতে করতে জানতে চাইলো,
~ওর কি হয়েছে? হটাৎ বেহুস হলো কেনো?

কারো মুখে কোনো জবাব নেই। শুভ্রতা রিদিতার কাছে না গিয়ে দরজার কাছেই দাড়িয়ে রইলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো সকলকে। ঘরে মাহাদ আর রাহেলা খাতুনের মুখটাই গম্ভীর। আর বাকি সবাই মিট মিট করে হাসছে। শুভ্রতার কপালে সুক্ষ্ণ ভাঁজ পড়লো। একটা মানুষ বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে আর এরা হাসছে? মনুষ্যত্ব কি বিদায় নিয়েছে নাকি? বেশি রাগ লাগলো যখন দেখলো শ্রেয়া, উপমা আর রুপা এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। তাদের পাশেই আহাদ, অরণ্য আর অর্ণব দাড়িয়ে। হাসি আটকানোর কারণে ওদের মুখ লাল হয়ে আছে। মাহাদের পাশে মাহতাব আর চন্দ্র দাড়িয়ে ঠোঁটে দু আঙ্গুল চেপে দাড়িয়ে আছে। চেষ্টায় আছে কারো মুখের দিকে না তাকানোর। তাকালেই হেসে দিবে। নিঃসন্দেহে এখানে রিদিতা বাদে অন্য কেউ হলে ওরা এই মানও রাখতো না। সোজা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতো। শুভ্রতা রাগান্বিত হয়ে ওদের কাছে যেতে নিতেই রেনু বলে উঠলো,
~আপামনির জ্ঞান ফিরছে।

শুভ্রতা আগে রিদিতার কাছে যাওয়াই ঠিক মনে করলো। রিদিতা কোনোমতে উঠে বসে। সামনে মাহাদকে দেখতেই “আল্লাহ গো! আমি শেষ” বলে পুনরায় জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ে। এবার আর কেউ হাসি চেপে রাখলো না। সকলেই এক সাথে হু হা করে হেসে উঠলো। শ্রেয়া, উপমা আর রুপা পেট চেপে হাসছে, মাহতাব পাশের জনের অর্থাৎ মাহাদের গায়ের ওপর ঢলে পড়ে হাসছে, অর্ণব আর আহাদ দেওয়াল ঘেঁষে বসে হাসছে। চন্দ্র আর অরণ্য তো আরো এক ধাপ উপরে। হাসতে হাসতে ওরা মাটিতেই গড়াগড়ি করছে। ওদের এমন হাসতে দেখে রাহেলা খাতুন মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মাহাদ নাক ফুলিয়ে চেয়ে রইলো রিদিতার দিকে। এই মেয়ের জন্য আজকে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। মন চাইছে তুলে এক আছাড় দিতে। আছাড় দেওয়া ও সম্ভব নয়। তাকে দেখলেই তো জ্ঞান হারায় এই মেয়ে।
_________________________________

মাথায় বরফ দিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছে রিদিতা। তার এক পাশে তিলোত্তমা আর শুভ্রতা গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তাদের স্থির দৃষ্টি উপমা আর রুপার দিকে। যারা এখনো ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। শুভ্রতা এবার ধৈর্য হারা হয়ে ধমকে উঠলো,
~হাসছিস কেনো অযথা? বান্ধবী জ্ঞান হারিয়েছে আর তোরা হাসছিস? সমস্যা কি?

উপমা আর রুপা তৎক্ষণাৎ নিজ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ধরলো। মাথা তুলে রিদিতার দিকে চেয়ে, আরেকবার একে অপরের দিকে চেয়ে ফের শব্দ করে হেসে উঠলো। রিদিতা গাল ফুলিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। ওদের এক দফা হাসির পর শুভ্রতার আর তিলোত্তমার গম্ভীর মুখশ্রী দেখে কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। বলতে শুরু করলো রিদিতার বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার কারণ….

🍂 ফ্ল্যাশব্যাক 🍂

বিকেলে ছাদ থেকে নামতেই দেখা মেলে মজিদের। মজিদ পানের বাটা হাতে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
~ওইদিকের উঠানটায় যাইবেন নি আপারা? ওই জায়গা ডা বেজায় সুন্দর। বড় মা আর বড় বাপজান রোজ ওইদিকে বইসা চা পান খায়।

উপমা ওরা একে অপরকে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
~যাবি?

রিদিতা দু হাত মেলে দিয়ে হেলেদুলে মজিদের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,
~তোরা ভাবতে থাক। আমি গেলাম।

উপায়ন্তর না পেয়ে উপমারাও গেলো ওদের সাথে। ওরা এসে দেখলো মাহাদ, অর্ণব, অরণ্য, মাহতাব, আহাদ, চন্দ্রও সেখানেই বসে আছে। রিদিতা প্রথমেই গিয়ে আতাউরের মাথার ওপর দিয়ে উকি দিলো,
~এই দাদু, কি করো?

আতাউর হেসে বললেন,
~বই পড়ি।

রিদিতা নাক কুচকে রাহেলা খাতুনের পাশে বসে বললো,
~ইশ! আমি এদিকে একাডেমিক বই পড়তে পড়তেই ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর তুমি এখনও বই পড়? কি অদ্ভুত শখ!

উপমা রিদিতার মাথায় চাটি মেরে বললো,
~সবাই তো আর তোর মত পড়া চোর না।

রিদিতা ঠোট বাঁকালো। রুপা আর উপমা ফোনে আগের দিনের সব ছবি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রিদিতা গালে হাত ঠেকিয়ে মজিদের পান বানানো দেখছে। চন্দ্র ওরা নিজেদের মধ্যেই খোশ গল্পে মশগুল। কথার মাঝে মাঝেই মাহাদ আড়চোখে রিদিতাকে দেখছে। সবাই না দেখলেও তা দৃষ্টিগোচর করেছেন রাহেলা। রিদিতা আগ্রহী কন্ঠে বললো,
~দাদী তুমি পান খাও কবে থেকে?

মজিদের হাত থেকে পান নিয়ে বললেন,
~আমার বিয়ের পর থেকেই। আমার শাশুড়ির এই অভ্যাস ছিলো। তার থেকেই এই অভ্যাস পেয়েছি আমি।
~ওওওও… আচ্ছা, আচ্ছা। তুমি ঢাকায় থাকো না কেনো?
~কারণ আমার গ্রাম ভালো লাগে।
~তোমাদের গ্রামে ঘর ভাড়া দেয় না?
~কেনো?
~আমি বিয়ের পর স্বামী সংসার নিয়ে এখানে চলে আসবো। জায়গাটা বেশ সুন্দর তাই।

রাহেলা খাতুন যেনো এই সুযোগই খুঁজছিলেন। তিনি বেশ শান্ত গলায়ই বললেন,
~স্বামী নিয়ে এখানে আসার কি প্রয়োজন? এখানের এক ছেলেকে বিয়ে করলেই হয়।
~তুমি কি পার্ট টাইম ঘটকালি করো নাকি?

রাহেলা খাতুন সরু চোখে তাকাতেই রিদিতা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। আমতা আমতা করে বলল,
~তুমি যেভাবে বললে। তাই মনে হলো। আচ্ছা ছাড়ো এসব কথা। ভালো ছেলে আছে নাকি তোমার নজরে? থাকলে বলো একেবারে বিয়ে করে থেকেই যাই। শহরে আর ফিরছি না।

বলেই খিল খিল করে হাসতে লাগলো রিদিতা। যেনো সে কোনো মজার কৌতুক বলেছে। হাসতে হাসতে মাহাদ এর দিকে চোখ পড়তেই দেখলো মাহাদ এক ভ্রু উচু করে তার দিকে চেয়ে আছে। রিদিতা তাকে ভেংচি কাটলো। মাহাদকে খেপাতে তার বেশ লাগে। এইযে তার মুখ ভেংচি দেওয়ায় মাহাদ কপাল কুঁচকে রাগে নাক ফুলালো। এই দৃশ্যটা বেশ মজার লাগে তার কাছে। রাহেলা পান চিবাতে চিবাতে বললেন,
~আমার নজরে খুব ভালো একটা ছেলে আছে। তুই রাজি থাকলেই হলো।

এতক্ষণে সবার মনোযোগ তাদের ওপর স্থির হয়েছে। সকলের মধ্যেই টানটান উত্তেজনা। এর পর কার কার কি জবাব আসবে তাতে সবার অধীর আগ্রহ। রিদিতা আবারো খিল খিল করে হেসে উঠলো।

~আচ্ছা? কোন ছেলে? দেখা করিয়ে দিও। কবে নিয়ে যাবে বলো।

রাহেলা খাতুন কুটিল হাসলেন। জানালেন,
~দেখা করতে আবার নিয়ে যেতে হবে কেনো? এখানেই উপস্থিত সে। দেখে নে।

রিদিতা এবার একটু সিরিয়াস হলো। জানতে চাইলো,
~কার কথা বলছো?
~কার আবার? আমার মাহাদ এর।

মাহাদ তৎক্ষণাৎ তাকালো রিদিতার দিকে। শকের বসে মেয়েটা বসা থেকে এক লাফে উঠে দাড়িয়েছে। ঝট করে দাড়ানোর ফলে চেয়ারটা ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গেলো। রিদিতা জোর পূর্বক হেসে মাহাদের দিকে আঙ্গুল তাক করে প্রশ্ন ছুড়লো,
~তুমি কি ওনার কথা বলছো?

রাহেলা খাতুন হ্যা বোধকে মাথা নাড়াতেই রিদিতা কাঁদো কাঁদো মুখ করেই হাসলো। রিদিতার এমন রিয়াকশন দেখে কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল মাহাদের।

~এই গোমড়া মুখোকে বিয়ে? জীবন শ্যাষ!!!!
বলতে বলতেই জ্ঞান হারালো রিদিতা। ঢলে পড়লো মাটিতে। রিদিতা যে এমন জ্ঞান হারাবে তা ভাবনায়ও ছিলো না রাহেলার। তিনি চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন রিদিতার মুখের দিকে। বিস্ময়ে মাহাদের হাতে থাকা কাপটা পড়ে গেলো। অস্থির চিত্তে ছুটে গেলো রিদিতার কাছে।
.
এসব শুনে কি রিয়াকশন দিবে বুঝে পেলো না শুভ্রতা আর তিলোত্তমা। ওরা স্বাভাবিক মুখ করেই বসে রইলো মিনিট দুয়েক। হাসবে না কাঁদবে তা নিয়ে আপাতত প্রচন্ড দ্বিধায় আছে তারা। শুভ্রতার মস্তিষ্কে চলছে অন্য বিষয়। এর মধ্যেই তিলোত্তমা হেসে উঠলো। একে একে হেসে উঠলো উপমা আর রুপাও। মাথায় বরফ চেপে নত মস্তকে বসে রইলো রিদিতা। বলার মত কোনো ভাষা খুজে পেলো না। মাহাদ বলতেই আঁতকে উঠে সে। এর মত এতো গম্ভীর মানুষের সাথে তার আদৌ কখনো পরিচয় হয়েছে কিনা সন্দেহ। তার কাছে মাহাদ বলতেই এক আতঙ্কের নাম। বিয়ে দূরে থাক তার ত্রিসীমানায়ও পড়তে চায় না সে।
___________________________________

সন্ধ্যার সময় বারান্দায় দাড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে শুভ্রতা। প্রচন্ড চিন্তায় তার মাথা ভার হয়ে আছে। নাক দিয়ে রয়ে রয়েই পড়ছে তাজা রক্ত। হাতের কালো রুমাল দিয়ে ক্ষণে ক্ষণেই নাক মুছছে। নিচে উঠানে সবাই রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ বাহিরেই বড় ডেগ এ রান্না করবে। একদম বিয়ে বাড়ির মত। চন্দ্র সকলের সাথে আমোদিত হয়ে ঘুরা ফেরা করছে। শুভ্রতা মুচকি হেসে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আনমনেই আওড়ালো,

মধ্যরাতের তমসা আমি,
স্নিগ্ধ ঊষা তুমি।
উপাখ্যানের বিরামে আমি,
সূচনায় প্রিয় তুমি।
(শুভ্রতা আনজুম শিখা)

আকাশে আপাতত একটাই তারা দেখা দিচ্ছে, সন্ধ্যাতারা। শুভ্রতা মনোযোগ দিয়ে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখতে লাগলো। কোমরে কারো বলিষ্ঠ হাতের ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই সে কেঁপে উঠলো। চন্দ্র পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বললো,
~মন খারাপ?
~নাহ।
~তাহলে?
~ভালোবাসি।

শুভ্রতার কথায় থমকালো চন্দ্র। হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই শুভ্রতা কপাল কুঁচকে চন্দ্রের দিকে ফিরে তাকালো। চন্দ্র অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে। শুভ্রতা বুঝলো তার এমন করার কারণ। প্রিয় কিছু হটাৎ করে পেয়ে গেলে বিশ্বাস না হওয়াই স্বাভাবিক। শুভ্রতা ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইলো চন্দ্রের স্নিগ্ধ মুখপানে। চন্দ্র কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
~আমি কি ঠিক শুনেছি?
~কেনো আপনি কি বয়রা নাকি?
~আহহা! তর্ক করো না তো। আবারো বলো না প্লীজ।
~কি বলবো?
~ওই এক শব্দ যা শুনে আমার হৃদয় থমকে গেছে।

শুভ্রতা লাজুক হাসলো,
~ভালোবাসি।
~আবার
~ভালোবাসি
~আবারো
~ধ্যাত!

লজ্জা, বিরক্তি নিয়ে ঘরে যেতে চাইলো শুভ্রতা। চন্দ্র হাত ধরে আটকালো। শুভ্রতা ফিরে তাকাতেই চন্দ্র তার সারা মুখে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। খুশিতে চন্দ্রের শরীর কেঁপে উঠছে। শুভ্রতা তা বুঝতে পেরে তাকে জড়িয়ে ধরলো। চন্দ্র কিছুটা শান্ত হলো। কম্পিত গলায় বললো,
~এই একটা শব্দ শোনার জন্য কত কাঠখড় পুড়িয়েছি তুমি নিজেও জানো না শুভ্রতা। আমার জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া তুমি। আমার ভালোবাসা।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here