চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫৩

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫৩

🍂🍂🍂

সকলের সাথে সময় ভালোই কাটছিলো শুভ্রতার। বিয়ের ১ সপ্তাহ পরই ঢাকায় এসেছে। বাড়ির বউ হওয়ায় সে সোজা চন্দ্রের বাড়িতেই এসেছে। সপ্তাহে একদিন শ্বশুর বাড়ি কাটায় সে। রাত্রি দিনভর ছায়ার মত শুভ্রতার পাশে থাকে। রেনুকেও শুভ্রতার সাথে তাদের বাসায়ই নিয়ে এসেছেন চিত্রা। সারাদিন চিত্রা, রাত্রি, তিলোত্তমা আর রেনুর সাথে গল্প করেই সময় কাটে। সপ্তাহভর কাজ থাকলেও আশহাবের আদেশ প্রতি শুক্রবার সারা পরিবার এক সাথে সময় কাটাবে, ঘুরতে যাবে, আড্ডা দিবে। এই দিন উসমান, অনিকা, অরণ্য, অর্ণব আর শুভ্রতার বন্ধুমহলকেও চন্দ্রদের বাড়ি আসতে হয়। কেউ না এলে আশহাব নিজে গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। রাত্রির পর শুভ্রতা আর তিলোত্তমা যেনো তার আরো দুটি মেয়ে। আশহাব চায় না শুভ্রতা কোনো কারণে মন খারাপ করুক। সবার এতো এতো ভালোবাসায় চোখ ভরে উঠে শুভ্রতার। কখনো নিজের আবেগ বশে রাখতে পারে, কখনো আবার কেঁদে বুক ভাসায়।
_____________________________

বিকেলের সময়। টানা ৩ ঘন্টার অপারেশন শেষ করে কেবিনে ফিরলো অরণ্য। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। মুহূর্তেই তার মাথা গরম হয়ে এলো। সকাল থেকে একটু বসার সুযোগ পায়নি সে। সে কপাল চাপড়ে সোজা হয়ে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনুমতি দিতেই কেবিনে প্রবেশ করলো অনুরাধা। অরণ্য ভ্রু কুঁচকালো।
~কি হয়েছে? কিছু বলবে?

অনুরাধা হাতের ফাইলটা অরণ্যের হাতে দিয়ে বলল,
~শুভ্রতা ম্যামের রিপোর্ট।
~আমাকে দিচ্ছো যে? আহনাফকে দাও।

অনুরাধা মুখ কালো করে বললো,
~প্রতিবার রিপোর্ট দেখতেই স্যারের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। আমার সামনে হয়তো কান্না করতে লজ্জা পায়। আপনি তো স্যার এর বেস্ট ফ্রেন্ড। আপনি নিয়ে গেলেই ভালো হয়।

অরণ্য নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে রইলো অনুরাধার দিকে। রিপোর্টটা হাতে নিয়ে বিনয়ী সুরে বললো,
~ধন্যবাদ।

অনুরাধা যেতেই তপ্ত শ্বাস ফেললো অরণ্য। রিপোর্ট যে এবারও ভালো আসেনি সে জানে। তবুও মনে মনে দোয়া করলো। এবার যদি ভালো কিছু আসে? যদি কোনো উন্নতি হয়?
______________________________

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে প্রায় ১৫ মিনিট যাবৎ বসে আছে অরণ্য। সে বিরক্ত হয়ে চন্দ্রকে কল করতেই চন্দ্র কল রিসিভ করলো। অরণ্য তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
~কোথায় তুই?
~ডানে তাকা।

অরণ্য তাকাতেই দেখলো চন্দ্র তার দিকেই ছুটে আসছে। অরণ্য অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে বললো,
~এসেই যখন পড়েছিস তাহলে কল রিসিভ করলি কেনো? রাখ ফোন!!!!

ওপাশ থেকে চন্দ্রের হাসির আওয়াজ। অরণ্য কল কেটে নিজেও হাসলো। চন্দ্র পাশের সিটে বসে বললো,
~আজকে সকাল থেকে টানা অপারেশন ছিল। তোর বোনের সাথে ঠিকমতো কথা বলারও সুযোগ হয়ে উঠেনি। লাঞ্চ এর সময় একটু কল দিয়েছিলাম। বেজায় রেগে আছে। আজকে নির্ঘাত বাড়িতে গেলে মাইর খাবো। তুই আমার সাথে চল।

অরণ্য সরু চোখে তাকালো।

~বউ এর মাইরের ভয়ে আমাকে নিয়ে যাবি সাথে। সিরিয়াসলি?

চন্দ্র হতাশার শ্বাস ছেড়ে বললো,
~তোর বইন যেই লেভেলের ডেঞ্জারাস! আমার তো মনে হয় নিজেকে প্রোটেক্ট করতে আরো ছয় সাতটা বডিগার্ড হায়ার করতে হবে।

অরণ্য হাসতেই চন্দ্র যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,
~শালা হাসবি না। তোর বইন এর মাইর খাইতে খাইতে আমি শেষ। এত রাগ ঠেলতে ঠেলতে আমার কোমর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে দেখ।

নিজের কোমরের দিকে ইশারা করতেই অরণ্য ফের হাসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,
~ভালোবেসে এইটুকুন রাগ সহ্য করতে না পারলে কি ভালোবাসলি?

চন্দ্র হেসে চোখ ফিরিয়ে নিলো। জানালার বাহিরে চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ। চন্দ্র বললো,
~শুভ্রতার চিন্তায় ভালো লাগছে না। দিন দিন অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। আমার কি মনে হয় জানিস? এই মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় এই মেয়ের আগে আমিই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবো।

বলেই চন্দ্র ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। অরণ্য আড়চোখে চন্দ্রের দিকে তাকালো। বলার মত কিছুই পেলো না। চন্দ্র আবারো বললো,
~শুভ্রতার রিপোর্ট অনুরাধা তোর কাছে দিয়েছে, তাই না?
~তোকে কে বললো?

চন্দ্র জবাব দেয় না। চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।
___________________________

ব্যস্ত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুভ্রতা। মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। হাতে শ্রেয়ানের বিয়ের কার্ড। ড্রাইভিং সিটে বসতে নিতেই ড্রাইভার এসে বাঁধ সাধলো। শুভ্রতা রাগী চোখে তাকাতেই সে ইতস্তত করে বললো,
~ম্যাডাম, চন্দ্র স্যার বলেছে আপনাকে ড্রাইভ করতে না দিতে। আপনি পেছনে বসুন যেখানে যাবেন আমি নিয়ে যাচ্ছি।

শুভ্রতা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করলো। চাপা সুরে বললো,
~করিম ভাই, আপনি পেছনে বসুন আমি গাড়ি চালাবো। কোনো সমস্যা হলে তখন আপনি চালিয়েন।

শুভ্রতার কথায় করিমের মধ্যে কোনোরূপ হেলদোল দেখা গেল না। সে আগের ন্যায় দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে স্পষ্ট ভীতি। চন্দ্র জানতে পারলে তাকে মেরে গুম করে দিবে তা করিম বেশ ভালো ভাবেই জানে। ৬ বছর যাবত সে চন্দ্রের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছে। মানুষটার ভীষণ রাগ। করিমকে ভয় পেতে দেখে শুভ্রতা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। রাগে গিজগিজ করতে করতে বললো,
~আপনার স্যারকে আপনি না বললে সে জানবেই না যে আমি গাড়ি চালিয়েছি। আপনার যদি জানাতে গিয়ে চাকরি হারানোর ইচ্ছা থাকে দ্যান গো এহেড। আমি একাই যাচ্ছি।

গাড়ির দরজা জোর করে লাগাতেই করিম দ্রুত ব্যাক সিটে এসে বসলো। গাড়ি যেতেই এক পায়ে জুতা পড়ে আরেক হাতে জুতা নিয়ে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তিলোত্তমা। লাফিয়ে লাফিয়ে বলতে লাগলো,
~এই মহিলা! আমাকে নিয়ে যা!

গাড়ি থামলো না। আদৌ তার ডাক শুভ্রতার কানে পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ।

বাসায় এসে রিদিতার সামনে আচমকা দাড়াতেই হকচকালো রিদিতা। সে আরামে শুয়ে টিভি দেখছিলো। চমকে যাওয়ায় হাতে থাকা পপকর্নের বাটিটা মেঝেতে উল্টে পড়লো। সেদিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট উল্টে শুভ্রতার দিকে তাকালো। অসহায় কন্ঠে বলল,

~আমার পপকর্ণ!

এই এক বাক্য শুভ্রতার রাগে যেনো ঘি ঢাললো। দাঁতে দাঁত চেপে বিয়ের কার্ডটা রিদিতার দিকে ছুড়ে ফেলে বললো,
~নিকুচি করি তোর পপকর্নের। এটা কি?
~বিয়ের কার্ড।
~কার?
~সেটা তো তুই জানিস।

শুভ্রতা চোখ গরম করে তাকাতেই কিছুটা দমে গেলো সে। কার্ড পড়ার পরও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলো না শুভ্রতা।
~তোকে না শ্রেয়ান ভাই পছন্দ করতো? আমার জানা মতে তুইও…
~পছন্দ করতাম।

শুভ্রতার কথার মাঝেই বললো রিদিতা।

~পছন্দ আর ভালোবাসা আলাদা জিনিস। হয়তো তার সাথে আর কিছুদিন কথা বললে আমিও ভালোবাসতাম তাকে।
~এতোই যখন পছন্দ করতি তবে যেতে দিচ্ছিস কেনো?
~পছন্দ বলেই যেতে দিচ্ছি। ভালোবাসা হলে তো জীবনেও ছাড়তাম না।

শুভ্রতার দিকে চেয়ে আলতো হেসে বললো,
~মেয়ের বিয়ে আমাদের জন্য দিতে পারেনি। ছেলের বিয়েটাও যদি আমাদের কারণে ভাঙ্গে তাহলে ওর বাপ নির্ঘাত পটল তুলবে। তাই সব বাদ।
~শ্রেয়ান ভাই? সে যেতে দিলো তোকে?

শুভ্রতার চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া। রিদিতা হেসে বললো,
~সে তো আমাকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসলে তো এসব ভাবতাম। আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসিনি। শুধু পছন্দ করেছিলাম। ওই পর্যন্তই।

~যদি তাকে ভালোই না বাসিস তবে কার জন্য মাহাদ ভাইকে ইগনোর করছিস? গত তিনটা মাস ধরে বেচারা নাছোড়বান্দা হয়ে তোর পেছনে পড়ে আছে। দুদিন পর পর গ্রাম থেকে ঢাকা আসে শুধু তোকে এক নজর দেখার জন্য। কখনো কখনো এতো দুর এসে তোকে চোখের দেখাটাও দেখতে পারে না। শ্রেয়ানকে না ভালোবাসলে তাকে এত অবহেলা কেনো? যদি শ্রেয়ান ভাইকে ভালোবেসে থাকিস তবে বল। বেটাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে তোর সাথে বিয়ে দিবো।

রিদিতা চোখ পিটপিট করে বান্ধবীর দিকে চাইলো। যার চোখে মুখে স্পষ্ট লেখা সে একবার হ্যা বললে সত্যিই তাকে উঠিয়ে আনবে শুভ্রতা। রিদিতা হেঁসে মেঝে থেকে পপকর্ণ উঠাতে উঠাতে বললো,
~মাহাদ ভাইয়ের সামনে যেতে আমার লজ্জা লাগে। তাই যাই না। মানুষটার চাহনীতে অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এমন ভাবে চেয়ে থাকে যেনো চোখের পলক পড়লেই দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে।
~একবার সাহস করে সেই চোখের দিকে চেয়ে দেখিস। নিজের জন্য ভালোবাসা আর সম্মান দুটোই দেখতে পাবি।

অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র আওয়াজে চমকে উঠলো দুজনেই। জানালার কাছে ছুটে গিয়ে বাহিরে উকি দিতেই দেখলো বাড়ির নিচে অ্যাম্বুলেন্স দাড় করানো। তখনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো রিদিতার মা, তিলোত্তমা, উপমা আর রুপা। উপমা অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
~তুই মরস নাই?

~আশ্চর্য! আমি কেনো মরবো?

~তোর ক্রাশ যে অন্য বেডির লগে বিয়া করতাছে। ভাবলাম দুঃখের ঠেলায় হারপিক খাইছস। তাই অ্যাম্বুলেন্স নিয়া আসলাম। (তিলোত্তমা)

রিদিতার মা ধুপধাপ করে চলে গেলো নিজের কাজে। যেতে যেতে বললেন,
~নিজেও পাগল। বান্ধবী রূপে জুটাইছে আরো কয়টা পাগল। সব পাগলের এক বাড়ি।

রিদিতার মা যেতেই রুপা শান্তনা দিয়ে বললো,
~শোন রিদি, কান্দিস না। বন্ধুমহলে তোর মতো আমিও সিঙ্গেল আছি। তোরে আমি ছেলে খুঁজে দিবো, আর তুই আমাকে খুঁজে দিবি।

~তোর খুঁজে দেওয়া লাগবে না। ওর হবু বর নিজেই ওরে খুঁজে বসে আছে। ও হ্যা বললেই হলো। (তিলোত্তমা)
~মাহাদ ভাই? ওনাকে বিয়ে করবে ও? ওনারে দেখলেই ও যেমন ঠুসঠাস বেহুশ হয়! দেখা যাইবো বাসর ঘরে ভয়ের ঠেলায় মিরকি ব্যারাম উঠে গেছে।

একপ্রকার টন্ট করেই বললো উপমা। রিদিতা ঠোঁট বাকিয়ে বললো,
~মাহাদ ভাইয়ের চামচা গুলা। যা বের হ!
~যাবো না, যাচ্ছি না। আগে ট্রিট দে। শ্রেয়ান ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে। (তিলোত্তমা)
~শ্রেয়ান ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে আমি ট্রিট কেনো দিবো? (রিদিতা)
~তোর ক্রাশ ছিল না! তাই দিবি।(রুপা)
~ট্রিট এর চিন্তা পরে। আগে বাড়ির সামনে থেকে অ্যাম্বুলেন্স বিদায় কর। আওয়াজ এ কানের পোকা শহীদ হচ্ছে।

সোফায় গা এলিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল শুভ্রতা। তৎক্ষণাৎ বাইরে দৌড় লাগলো রুপা। তিলোত্তমা কোমরে হাত রেখে শুভ্রতার সামনে দাঁড়ালো।

~তুই হারামী, আমাকে ফেলেই চলে এসেছিস কেন? জুতা পড়ে বাইরে এসে দেখি তুই আর গাড়ি দুইটাই গায়েব।

শুভ্রতা বোকাসুলোভ এক হাসি দিয়ে বললো,
~রাগের মাথায় ভুলে গিয়েছিলাম। সরি।

শুভ্রতার হাসি দেখে তিলোত্তমার রাগ কমলেও সে কপট নাক ফুলালো। শুভ্রতা আড়মোড়া দিয়ে বললো,
~নাক না ফুলিয়ে আগে রিদির থেকে ট্রিট কি নিবি সেটা ঠিক কর।
~ওহ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এই রিদি ট্রিট দে!
____________________________

সোফায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে শুভ্রতা। তার গা ঘেঁষে ক্ষুদায় পেট চেপে বসে আছে রাত্রি। চিত্রা এসে বুঝিয়ে গেলেন,
~চন্দ্রের আসতে হয়তো দেরি হবে। তুই আয়, আমরা আগে খেয়ে নেই।

শুভ্রতা আর রাত্রি আবারো একই সঙ্গে জবাব দিল,
~ চন্দ্র এলে সবাই এক সাথে খাবো। তত পর্যন্ত বসে থাকো।

চন্দ্র বাড়ি ফিরলো সাড়ে তিনটার নাগাত। বাড়ি ফিরে দেখলো শুভ্রতা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। চন্দ্র মুচকি হেঁসে শুভ্রতার ছোট চুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বললো,
~এখানে বসে আমার জন্য ওয়েট করছিলে?
~কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছিলাম। এই আসার সময় হলো?

অভিমানী কন্ঠে বললো শুভ্রতা। চন্দ্র কান ধরে বললো,
~সরি বউ, রাস্তায় একজনের সাথে দেখা হয়ে ছিল। তার সাথে কথা বলতে বলতেই সময় লেগেছে। সবার খাওয়া হয়েছে?

~তোর বউ আমাদের খাবার খেতে দিলে তো? সবাই এক সাথে খাবে বলে বসিয়ে রেখেছে। জলদি আয়!

আশহাবের কন্ঠে শুভ্রতার থেকে দু কদম দূরে সরে দাঁড়ালো চন্দ্র। সে খেয়ালই করেনি সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে আছে তার জন্য অপেক্ষা করছে। চন্দ্র দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে খেতে বসলো। খাওয়ার মাঝেই আশহাব উৎকণ্ঠা হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
~আসতে এতো দেরি হলো কেনো?

সকলের আগ্রহী চাহনি তার দিকে স্থির হতেই সে খাবারে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বললো,
~তেমন কেউ না। তোমাকে পরে বলবো। আগে খাও।

খাবার খেয়ে ঘরে ফিরতেই শুভ্রতা বললো,
~বাবার সাথে দেখা হয়েছিল। তাই না?

শুভ্রতার কথায় তপ্ত শ্বাস ফেলল চন্দ্র। মাথায় হাত বুলিয়ে শুভ্রতার দিকে ফিরে বললো,
~কি করে বুঝে গেলে?

শুভ্রতা প্রশ্ন করলো,
~বাবা জড়িয়ে ধরে ছিলো আপনাকে?

চন্দ্র নির্বোধ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে প্রশ্ন করলো,
~কি করে বুঝলে?

শুভ্রতা কুটিল হাসলো। চন্দ্রের চুলে হাত বুলিয়ে গুছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে উত্তর দিলো,
~সে আমার বাবা। কারো প্রতি রাগ উঠলে, কোনো কিছু নিয়ে প্রচন্ড আঘাত পেলেই মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। তারা চুপ করে আমার অভিযোগ শুনতো। ২৪ বছরের জীবনে অসংখ্যবার বাবার বুকে মাথা রেখে গল্প করেছি, কেঁদেছি। বাবার গায়ের ঘ্রাণ চেনাটা কি অসম্ভব কিছু?

চন্দ্র নিশ্চুপ হয়ে না বোধকে মাথা নাড়ালো। শুভ্রতা আবারো চন্দ্রের মাথায় হাত দিলো। তবে এবার আর চুল অগোছালো করলো না। সুন্দর করে গুছিয়ে দিলো। চন্দ্রকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুভ্রতা তার বুকে মাথা রাখলো। কোমল কন্ঠে বললো,
~মা বাবার পর আমার একমাত্র শান্তির ঠিকানা আপনি। বাবা আমার মায়ের ভরসা ভেঙেছে। আপনিও তার মতো হবেন না প্লীজ। আর মাত্র কয়েকমাস। এরপর আপনি যা ইচ্ছা করবেন, যেভাবে ইচ্ছা চলবেন। আমি যতদিন বেঁচে আছি, শুধু আমার হয়েই থাকবেন প্লীজ।

~এভাবে বলো না শুভ্রতা। আমি চন্দ্র শুধুই তোমার। তুমি থাকো বা না থাকো। চন্দ্র শুধুই শুভ্রতার। পৃথিবীতে হয়তো আমি সারাজীবনের জন্য তোমাকে কাছে পাবো না। তবে আখিরাতে… আখিরাতে আমি ঠিকই খোদার কাছে তোমাকে চাইবো। অনন্তকালের জন্য চাইবো। আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে আমার আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।

চন্দ্র শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রতাকে। চোখ গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুকণা। পুরুষ মানুষের নাকি খুব সহজে কান্না করতে নেই। তবে শুভ্রতার মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই চোখ ভিজে উঠে তার। হৃদয়ে চিনচিন ব্যাথা হয়। শুধু নারীদের মত মুখ ফুটে বলতে পারে না। পুরুষ মানুষও কাঁদে। তারাও মানুষ, তাদেরও দুঃখ হয়।
_______________________________

রাতের মধ্য প্রহর। শুভ্রতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম নেই চন্দ্রের চোখে। ইদানিং তার ঘুম হয় না। চিন্তায় চিন্তায় রাত পার হয়। নির্ঘুম রাত কাটে শুভ্রতার ঘুমন্ত মুখ দেখে। চন্দ্র নিঃশব্দে উঠে বারান্দায় চলে এলো। মনে পড়লো আজকে দুপুরের ঘটনা। যেসময় আবসারের সাথে দেখা হয়েছিল তার।

🍂ফ্ল্যাশব্যাক🍂

জুম্মার নামাজ শেষেই কবরস্থান যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় চন্দ্র। একাই এসেছে। অন্য কাউকে আসতে দেয়নি। কবরের কাছাকাছি যেতেই সে দেখতে পেল খুব পরিচিত এক অবয়ব। চন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে পা বাড়ালো। চন্দ্র প্রথমেই আবসারের পাশে দাড়িয়ে কবরবাসীর জন্য দোয়া করলো। দোয়া শেষে চন্দ্রকে দেখতেই আবসার কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। চন্দ্র তখনও দোয়া করছে। চন্দ্রের দোয়া শেষ হওয়ার আগেই তার যাওয়া উচিত ভেবে সে চলে যেতে নিলো। কিন্তু সে পেছন ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্দ্বত হতেই চন্দ্র বলে উঠলো,

~আফসোস জিনিসটা বড্ড খারাপ। না দেয় শান্তিতে বাঁচতে, না দেয় শান্তিতে মরতে।

চোখের পানি মুছে আবসার ভ্রু কুঁচকে চন্দ্রের দিকে তাকালো। চন্দ্র হেসে প্রশ্ন করলো,
~তো? ইতি বেগম জানেন যে তার প্রিয় জামাই কোথায় আছেন?

~দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস!
~এটা অবশ্যই আমার বিজনেস। আমার শাশুড়ির কবর জিয়ারত করছেন। আর আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই লংকা মরিচ লাগলো?

আবসার তেড়ে এসে বললেন,
~কিসের শাশুড়ি হ্যা? আমার মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এখনও হয়নি।
~কে বললো হয়নি? ওমা! আপনাকে আপনার ইতি বেগম খবর দেয়নি? আচ্ছা ইতি বেগম না দিলো। ওই যে ওই মহিলা, ইশ! কি যেনো নাম?

একটু ভাবার ভান করে বললো,
~এইতো, হ্যা, মনে পড়েছে। জাহানারা। উনি তো আমাদের খবরাখবর আপনার ইতি বেগম আর আপনাকে জানায়। সেও জানায়নি? অবশ্য জানাবে কি করে? সে ততটুকুই খবর জানায় যতটুকু আমি জানাতে বলি। আপনার থেকে দ্বিগুণ টাকা দেই যে আমি।

আবসার ক্রোধিত চোখে তাকাতেই চন্দ্র দু হাত উচিয়ে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বললো,
~ওকে, বি কুল! আমিই বলছি হয়েছে কি। আমি আর শুভ্রতা বিয়ে করেছি। তাও গুনে গুনে ৪ মাস আগে। মিসেস উমা আফরোজকে একদম পার্মানেন্ট ভাবে নিজের শাশুড়ি বানিয়ে নিয়েছি।

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো চন্দ্র। আবসার আঙ্গুল তাক করে কিছু বলতে নিতেই চন্দ্র চিন্তিত গলায় বললো,
~ওমাহ! আপনি খুশি হননি? অবশ্য না হওয়ারই কথা। মেয়ের বিয়ের খবর জানতে পারছেন চার মাস পর, তাও আবার কবরস্থানে দাড়িয়ে। শক হওয়ারই কথা।

আবসার বলার মত কিছুই পেলেন না। রাগে, দুঃখে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে চন্দ্রও পেছন পেছন ছুটে এলো। ধরা গলায় বললো,
~বাবা, শুভ্রতার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তাও লাস্ট স্টেজ।

থমকে দাঁড়ালো আবসার। অবিশ্বাস্য চোখে চন্দ্রের দিকে ঘুরে তাকাতেই চন্দ্র অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা দুলালো। বুঝালো সে সত্যি বলছে। আবসার বোধ করলো তার পা চলছে না। মনে হচ্ছে সে তার গায়ের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিজেই তাকে ধরলো চন্দ্র। একটা বেঞ্চে বসাতেই আবসার হু হু করে কেঁদে উঠলো। শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো চন্দ্র। আবসার অস্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন করলো,
~কবে জানতে পেরেছো এই কথা?
~সাড়ে চার মাস আগে।

আবসারের কান্নার বেগ বাড়লো। আবারো প্রশ্ন করলো,
~কতদিন বাঁচবে আমার ছোট মা?

চন্দ্র শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
~জানি না। সঠিক চিকিৎসা চললে হয়তো ১/১.৫ বছর, হয়তো তারও বেশি বা কম সময়।

আবসার কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠলো। তাকে জড়িয়ে শান্তনা দিলো চন্দ্র।

🍂এখন🍂

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ভাবতে লাগলো চন্দ্র। আবসার বারবার অনুরোধ করছিলো সে যেনো শুভ্রতাকে বুঝায়। শুভ্রতা যেনো তাকে ক্ষমা করে দেয়, একবার যেনো সে তার সাথে দেখা করে। চন্দ্র না পারতে আশ্বাস দিয়ে এসেছে তাকে। কিন্তু শুভ্রতার সামনে এসে সে আবসারের হয়ে কিছুই বলতে পারেনি। শুভ্রতা একবারের জন্যও জানতে চায়নি তার বাবা কেমন আছে, কি কথা হয়েছে তাদের। বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার চোখে দেখতে পায়নি সে। শুভ্রতার ঘুমানোর আগে একবার নিজ থেকেই সব বলতে চেয়েছিল সে। তবে থামিয়ে দিয়েছে শুভ্রতা। এতকিছুর পরও তার প্রতি ঘৃনা জন্মানো স্বাভাবিক। শুভ্রতার জায়গায় থাকলে হয়তো চন্দ্র নিজেও মন শক্ত করে থাকতো। হটাৎই কাধে কারো শীতল স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো চন্দ্র। শুভ্রতা ঘুম জড়ানো চোখে তার দিকেই চেয়ে। চন্দ্র চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
~উঠেছো কেনো? অসুস্থ লাগছে বেশি?

শুভ্রতা নির্বোধ হাসলো। চন্দ্রের এক হাত টেনে ওষ্ঠ ছুঁয়ে বললো,
~আমার যত্ন নিতে নিতে নিজের প্রতি ভারী যত্নহীন হয়ে পড়ছেন আপনি। আমি ভেবেছিলাম আমি থাকলে আপনি হয়তো ভালো থাকবেন। এখন দেখি সম্পূর্ণ উল্টো। আমি কি তবে চলে যাবো?

চন্দ্র অসহায় মুখ করে চেয়ে রইলো। শুভ্রতা চন্দ্রের বাম গালে হাত ছুঁয়ে বললো,
~আপনি এমন এক মানুষের মায়ায় পড়েছেন যে কিনা গরল হয়ে আপনার সাজানো জীবনটা বিষিয়ে দিচ্ছে। আমাকে ভালো না বাসলেও পারতেন চন্দ্র। আপনার জীবনটা আরো সুন্দর হতো।

চন্দ্র কিছু বলতে চাইলে তার ঠোঁট চেপে ধরলো শুভ্রতা। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
~মানুষ মরণশীল। আজ নয়তো কাল আপনার, আমার, সবারই মরতে হবে। মৃত্যুর কথা ভেবে মানুষ বাঁচতে ভুলে যায় না চন্দ্র। মানুষ বাঁচে। হ্যা সবার আর আমার মধ্যে পার্থক্য এইটুকুই যে আমি আমার মৃত্যু খুব সন্নিকটে তা জানি। এটার ভাগ্য কয়জনের হয় চন্দ্র? এইযে আমি জানি আমি খুব শীঘ্রই চলে যাবো, এখন আমি জীবনটাকে আরো সুন্দর করে উপভোগ করার চেষ্টা করবো। চেষ্টা করবো আরো সুন্দর কিছু স্মৃতি সাথে নিয়ে যাওয়ার। তবে আপনার জন্য আমি তা পারছি না।

চন্দ্র প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। শুভ্রতার হাত মুখ থেকে সরিয়ে বললো,
~আমার জন্য?

শুভ্রতা মাথা দোলালো।
~হ্যা আপনার জন্য। আপনার এই অসহায় চাহনি আমাকে পীড়া দেয়। এইযে আমার চিন্তায় আপনি খাওয়া, ঘুম সব ভুলে বসেছেন। এই সব বিষয় আমাকে কষ্ট দেয়। আমি থাকতেও যদি আপনি এমন হয়ে যান। তবে আমার থাকা না থাকার মধ্যে তফাৎ কি?

চন্দ্র চোখ নামিয়ে নিলো। মনে মনে স্পষ্ট অনুতপ্তবোধ জাগলো। শুভ্রতা চন্দ্রের মাথা টেনে সোজা করলো। বললো,
~আমি চলে যাচ্ছি ভেবে কষ্ট না পেয়ে যেটুকু সময় আমি আপনার কাছে আছি এই সময়টুকু অনুভব করা যায় না চন্দ্র?
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here