চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫৬

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫৬

🍂🍂🍂

ক্লান্ত ভঙ্গিতে টেবিলে মাথা হেলিয়ে বসে আছে শুভ্রতা। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে চন্দ্র। গোল টেবিল ঘিরে বসে কথা বলছে সকলে। সকলের মধ্যমণি আজ তরী। মেয়েটা বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। সারাক্ষণ এটা সেটা নিয়ে কথা বলতেই থাকে। মানুষকে হাসাতে তার বেশ ভালোই লাগে। শুভ্রতার বেশি কথা বলা মানুষ ভালো লাগে না। সে নিজেও বেশি কথা বলে না। তবে তরীর কথা বার্তা তার কাছে বেশ লাগে। সে আশেপাশে থাকলেই যেনো এক পজেটিভ ভাইব থাকে চারপাশে।

~বেশি খারাপ লাগছে? বাড়ি যাবে?

চন্দ্রের প্রশ্নে শুভ্রতা মাথা দোলালো। সে এখন যেতে চায় না। খুব বেশিই খারাপ লাগছে। তবে উপমার জন্য স্পেশাল একটা দিন আজ। তার মন খারাপ করতে চায় না সে। এখন পর্যন্ত নুরের সাথেও কথা হয়নি তার। অরণ্যের সাথে কথা হয়েছে কিনা তাও জানে না। শুভ্রতা মাথা তুলে সটান হয়ে বসলো। তার এক পাশে চন্দ্র, অন্য পাশে রিদিতা বসে। শুভ্রতা কপাল কুঁচকালো। রিদিতার পাশের চেয়ারটা খালি।

~রুপ কথায়?

শুভ্রতার প্রশ্নে যেনো টনক নড়লো রিদিতার। পাশের চেয়ারের দিকে চেয়ে বলল,
~এখানেই তো ছিলো।

দূরের আরেক টেবিলের দিকে তাকালো অনুসন্ধানী চোখে শুভ্রতা। ঐখানটায় নুর বসে ছিল। সে মাথা নুয়ে রাখার আগেও দেখেছে নুরকে। এখন কোথায়? শুভ্রতা সন্দিহান চোখে তিলোত্তমার দিকে তাকালো। এখানে রূপার সাথে সাথে শ্রেয়াও নেই। শুভ্রতা উঠে দাড়ালো তৎক্ষণাৎ। মন বলছে কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে এখানে। এখনি তিলোত্তমার থেকে জানা প্রয়োজন। সে উঠে দাঁড়াতেই চন্দ্র জানতে চাইলো,
~কোথায় যাও?
~এই তো এখানেই। বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
~চলো আমিও আসছি তবে।
~না, না আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তিলো আর রিদিকে নিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন পর দেখা হলো। একটু কথা বলবো আর কি। আপনারা গল্প করুন। আমরা একটু ঘুরে আসি।

চন্দ্র মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। যাওয়ার আগে তিলোত্তমাদের বললো শুভ্রতার খেয়াল রাখতে। শুভ্রতা সবার থেকে দূরে এক কর্ণারে এসে দাড়ালো। এই দিকটায় মানুষ নেই। সকলেই এখন চেয়ারে পেতে বসে আরাম করছে।

~নুর কোথায়?

শুভ্রতা সোজা প্রশ্ন করলো তিলোত্তমাকে। তিলোত্তমা থতমত খেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। শুভ্রতা তিলোত্তমাকে চাপা ধমক দিলো। জানতে চাইলো নুর, রুপা আর শ্রেয়া কোথায়। তবে তিলোত্তমা নিজের কথায় অটল। সে কিছুতেই বলবে না নুর আর রুপা কোথায়। বিরক্ত হয়ে রিদিতা আর উপমাকে প্রশ্ন করলো,
~তোরা কি এই ব্যাপারে কিছু জানতি?

রিদিতা নিঃসংকোচে মাথা নাড়ালো। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

~আমি ওদের খুঁজতে যাচ্ছি।

তিলোত্তমা বাঁধা দিতে চাইলে শুভ্রতা চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। মাথা বেশ গরম তার। এখন যদি রুপা ফের কোনো ভুল করে বসে তবে নুর আর অরণ্যকে কখনোই এক করতে পারবে না সে। শেষ একটা সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না। শুভ্রতার অগ্নিশর্মা চোখ দেখে হাল ছাড়লো তিলোত্তমা। যেতে দিলো তাকে। শুভ্রতা সব ঘরে একে একে খুঁজতে লাগলো ওদের। রিদিতা আর উপমা গেলো বাগানের দিকে। ফিরে এসে জানালো ওদের কোথাও খুঁজে পায়নি। খোঁজার জন্য আর একটা জায়গাই বাকি আছে তা হলো ছাদে। শুভ্রতা ছুট লাগালো ছাদের দিকে। দরজার কাছাকাছি পৌঁছাতেই হাত টেনে ধরলো তিলোত্তমা। বাঁধা পেয়ে প্রচন্ড রেগে গেলো শুভ্রতা। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই তিলোত্তমা চাপা স্বরে বললো,
~তুই রুপাকে আটকাবি না শুভ্রতা। আমি যা করছি তোর ভালোর জন্য করছি।
~হাত ছাড় তিলো।
~না ছাড়বো না। এখন ভেতরে গিয়েও লাভ নেই। রুপা হয়তো নিজের কাজ করা শুরুও করে দিয়েছে। অর্ধেক কথা শুনে অবশ্যই নুর বসে থাকবে না। সম্পূর্ণ কথা শুনেই ছাড়বে।

বলেই কিটকিটিয়ে হেঁসে উঠলো তিলোত্তমা। সে আদৌ কি করতে চাইছে তা বুঝতে পারছে না শুভ্রতা। শুধু বুঝতে পারলো এই মুহূর্তে দুনিয়া উল্টে গেলেও তিলোত্তমা তাকে ছাড়বে না। সে এক হাতে তিলোত্তমার হাত চেপে ধরলো। উদ্দেশ্য একই। তিলোত্তমা তাকে যেতে দেয়নি তাই এখন সেও তিলোত্তমাকে যেতে দিবে না। শুভ্রতা রিদিতার দিকে তাকাতেই রিদিতা মাথা ঝাকিয়ে দরজা পেরিয়ে ছাদে ঢুকে গেলো। এবার তিলোত্তমা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। শুভ্রতা হাতের বাঁধন শক্ত করে চাপা স্বরে বলল,
~তুই গিয়ে রিদিতাকে সাহায্য কর। আমি তোর ঘরে যাচ্ছি।

শুভ্রতার কথা মতো উপমাও ছাদে প্রবেশ করলো। শুভ্রতা তিলোত্তমাকে নিয়ে উপমার ঘরে চলে এলো। মেজাজ তার ভীষণ খারাপ। এত ছোটাছুটি করে এতক্ষণে আটকে রাখা অসুস্থভাবটা এবার যেনো মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। সে চুপ করে সারা ঘরে পায়চারি করতে শুরু করলো। হাজারো চিন্তায় মগ্ন সে। অনেকক্ষণ হয়ে গেলো এখনও উপমা ওরা রুপাকে নিয়ে আসেনি। শুভ্রতা ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে থেমে গেলো তিলোত্তমার কথায়।

~তোর এখানে চিন্তার কোনো কারণ নেই শুভি। নুর দেখবি আবার তোর কাছে ফিরে এসেছে। আমি সব বন্দোবস্ত করেছি। আমার প্ল্যান সাকসেসফুল হলেই হলো। আই হোপ রিদি, উপ যাওয়ার আগেই ও ওর কাজ কমপ্লিট করেছে।

শুভ্রতার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। জানতে চাইলো,
~কিসের প্ল্যান? কি করতে বলেছিস তুই ওদের?

তিলোত্তমার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। বড় বড় কদম ফেলে সে শুভ্রতার কাছে এলো। সে শুভ্রতার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল,
~রুপা আজ নিজের সব ভুল স্বীকার করবে। সে সব ভুল স্বীকার করলেই নুর আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে। তুই, নুর, আমি, উপমা, রিদিতা সবাই এক সাথে আগের মত আড্ডা দিবো, গল্প করবো। এটাই তো তোর ইচ্ছা, তাই না? নুর ফিরে এলে আমরা আবার অরণ্য ভাইয়ের সাথে ওর মিল করিয়ে দিবো।
~আর রুপা? সে? তার কি হবে?
~সেসব মোটেও আমার দেখার বিষয় না। সে তো ভাবেনি আমাদের বন্ধুমহল ভাঙার আগে।
~তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি বলছিস তুই?
~আমার মাথা ঠিকই আছে। আর একদম ঠিক বলছি আমি। কেনো? তুই চাস না তোর বান্ধবী তোর কাছে ফিরে আসুক? আমি জানি তুই চাস।

শুভ্রতা বিস্ময়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো। এই মুহূর্তে এই তিলোত্তমাকে তার অচেনা লাগছে। সে ঠাহর করতে পারছে না এটাই কি তার সেই শান্ত, সকলের ভালো কামনা করা মেয়েটা কিনা। নাহ! মনে হচ্ছে না। সে তো কখনোই একজনের খারাপ করে আরেকজনের ভালো চায়নি। তিলোত্তমা আবারো আপন মনে বলে উঠলো,

~দেখিস এখনি নুর তোর কাছে ছুটে আসবে। তোর কাছে ক্ষমা চাইবে।
~এই, তোর মাথা ঠিক আছে? তুই রূপকে পাঠিয়েছিস সব সত্যি স্বীকার করতে। বুঝতে পারছিস কিছু তুই? রুপ এসব করেছে জানলে নুর আরো দ্বিগুণ ভেঙে পড়বে, রুপকে ঘৃনা করবে।
~করুক ঘৃনা। ও প্রাপ্য এটার।

শুভ্রতা এবার আরো বেশি অবাক হলো। রাগ তার তিরতির করে বেড়েই চলেছে। সে চেঁচিয়ে উঠলো,

~প্রাপ্য? কিভাবে ও এটার প্রাপ্য? বন্ধুমহল ভাঙার পেছনে একা ওর হাত আছে? অবশ্যই না। আমারও তো হাত আছে। আমিও তো রাগ কন্ট্রোল না করে নুরের সাথে কথা কাটাকাটি করেছি। এদিক থেকে তো আমিও ঘৃণার প্রাপ্য। আমাকে ঘৃনা কেনো করিস না তুই?

তিলোত্তমা কপাল কুঁচকালো। কন্ঠে রাগী ভাব এনে বললো,
~তুই মোটেও দোষী না। আমার মনে হয় না তুই দোষী। তোর নিজের মানসিক অবস্থা তখন ঠিক ছিল না। ওই সময়ে ও এভাবে কথা বলছিল তোর সাথে। এই জন্য তুই জাস্ট রিয়েক্ট করছিস।
~ওই সময় রুপও চন্দ্রকে ভালোবাসতো। ওর মাথায় কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল এটা ভাবার মানসিকতা তখন ছিল না। তার ওপর সকাল ওকে ব্রেইন ওয়াশ করেছিল।
~আমি জানি না, এসবের কিচ্ছু জানি না। আমি শুনতে চাই না এসব। আমি শুধু চাই তুই ভালো থাক। তোকে এভাবে কষ্ট নিয়ে মরতে দেখতে পারবো না আমি। আমার সব থেকে প্রিয় বান্ধবী তুই। তোকে আর অরণ্য ভাইয়াকে এভাবে কষ্টে দেখলে আমারও কষ্ট হয়।

বলতে বলতেই খাটে বসে পড়লো তিলোত্তমা। মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। শুভ্রতার রাগ এবার কমে এলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে তিলোত্তমাকে বুঝাতে চাইলো। তিলোত্তমা ইতিমধ্যেই কান্না করে দিয়েছে। সে সত্যিই চাইছে শুভ্রতাকে ভালো রাখতে। শুভ্রতা নিজেকে ধাতস্থ করলো। ধীর পায়ে তিলোত্তমার সামনে গিয়ে বসলো। মাটিতে বসে হালকা কাশলো। ঠান্ডা গলায় বললো,

~দেখ তিলো, আমিও চাই নুরের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আগের মত ঠিক হয়ে যাক। নুর অরণ্য ভাইয়ের কাছে ফিরে আসুক আমিও চাই। আমিও চাই নুর আগের মতোই আমার সাথে, তোর সাথে কথা বলুক, আড্ডা দিক। কিন্তু তার জন্য রূপকে নুরের সামনে ছোট হতে দিতে চাই না আমি।

কথার মাঝে একটু থামলো শুভ্রতা। মাথা প্রচন্ড ঘুরাচ্ছে। কাশি আসছে অনেক অনেক। চোখেও হটাৎ ঘোলা ঘোলা দেখছে সব। সে চোখ বন্ধ করে ঢোক গিললো। খারাপ লাগাটাকে পাত্তা না দিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো,
~আমার ওপর নুর ক্ষেপে আছে। ওকে আমি কোনো না কোনো ভাবে মানিয়ে নিবো। ও অরণ্য ভাইয়ের কাছেও ফিরে আসবে। কিন্তু আমি চাই না এর জন্য রূপ কাউকে হারাক। রুপকে নুর খুব ভালো বন্ধু মানে। বন্ধুমহল ভেঙে গেলেও সে রূপের সাথে কন্ট্যাক্ট রেখেছে। তোর সাথেও রাখবে। তুই শুধু আমার পক্ষ ছেড়ে ওর সাথে কথা বল। আমি চাই না আমার জন্য কেউ কাউকে ছেড়ে দিক বা হারিয়ে ফেলুক। আমি আমার বন্ধুত্ব হারানোর দুঃখ সহ্য করতে পারলেও আমার জন্য কেউ কাউকে হারিয়ে ফেলেছে এই দুঃখ সহ্য করতে পারব না। আমি চাই না আমার কারণে রুপ কোনো ধরনের স্যাক্রিফাইস করুক। তার এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।

তিলোত্তমা মুখ থেকে হাত সরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। শুভ্রতা মুচকি হেঁসে হাত বাড়ালো তার দিকে,
~ওয়াদা কর আর এমন কোনো কাজ তুই করবি না। কর ওয়াদা।

তিলোত্তমা শুভ্রতার হাতে হাত রাখলো। মাথা দুলিয়ে হ্যা বলতেই রুপার আওয়াজ ভেসে এলো। দুজনেই উঠে দরজার দিকে তাকালো। কতক্ষন ধরে ওরা এখানে জানা নেই। হয়তো সব কথাই শুনেছে। হয়তো না। শুভ্রতা জানতে চাইলো নুরকে সব জানিয়েছে কিনা। রুপা জানালো সে জানাতে পারেনি। সাহসে কুলায়নি। তবে যেই না সাহস করে বলতে গিয়েছিল তখনই রিদিতা এসে তাকে আটকে দিয়েছে। শুভ্রতা হেসে রিদিতাকে জড়িয়ে ধরলো।
~আজ অনেক বড় উপকার করেছিস তুই।

রিদিতাও খুশি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। পর মুহূর্তেই ঠোঁটে হাত চেপে কেশে উঠলো শুভ্রতা। মুখ থেকে হাত সরিয়ে হাতের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। সে স্বজোরে এক ধাক্কা মেরে রিদিতাকে নিজ থেকে দূরে সরালো। আকস্মিক ধাক্কায় মাটিতে গিয়ে পড়লো রিদিতা। অবাক চোখে তাকালো শুভ্রতার দিকে। রক্তমাখা হাতের দিকে চেয়ে সে পিছিয়ে যেতে লাগলো। ঠোঁটের কোণ গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। তিলোত্তমা ওরা আতঙ্কিত হয়ে শুভ্রতার কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে শুভ্রতা হাত বাড়িয়ে ভীতু গলায় চেঁচিয়ে উঠলো,

~আমার কাছে আসবি না তোরা। তাহলে তোরাও…

কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো এদের। ক্যান্সার মোটেও ছোঁয়াচে রোগ না। এই মেয়ে এমন করছে কেন? পর পর আরো কয়েকবার কেশে উঠলো শুভ্রতা। আরো কতোগুলো রক্ত মুখ থেকে বের হলো। দু হাত রক্তে লাল হয়ে আছে। গায়ে কালো থ্রি পিস থাকায় রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো শুভ্রতা। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো সকলে। শ্রেয়া ছুটে গেলো চন্দ্রদের ডাকতে।
~~~
চলবে~

(রাতেই গল্প দেওয়ার কথা ছিল। কিছু সমস্যার কারণে দেওয়া হয় উঠেনি। দেরি করার জন্য দুঃখিত। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here