চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৫৯

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৫৯

🍂🍂🍂

রাতের মধ্য প্রহর। কফি মগে শেষ চুমুক দিয়ে পাশে থাকা রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো শুভ্রতা। ঠান্ডায় তার নাক, গাল লাল হয়ে আছে। মাথার সেই ঘন কালো চুল গুলো ঝড়ে পড়তে পড়তে খুব পাতলা হয়ে গেছে। পাতলা চুলের বেনিটা কাঁধ থেকে ঝাড়া মেরে পিঠের দিকে সরিয়ে দিলো। জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়। শীতের প্রকোপ বেশ। গায়ের শালটা আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো শুভ্রতা। চাঁদটা একদম আকাশের মাঝামাঝি স্থানে ঝুলছে। কুয়াশায় চারদিক অস্পষ্ট। অন্ধকারে গা ছিম ছিম অবস্থা। ভয় লাগার কথা হলেও তার ভয় লাগছে না। কিসে ভয় পাবে সে? মৃত্যু তার এমনিও সন্নিকটে। শুভ্রতা আকাশের চাঁদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে থাকা টি টেবিলটির দিকে তাকালো।

রাঙামাটি এসেছে আজ পাঁচদিন। এর মধ্যে একবারও তার খোঁজ নেননি চন্দ্র। অবশ্য খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় ছাড়েনি শুভ্রতা। কেউ জানেনা সে কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা। রাঙামাটি এসে সে দিপার বাসায়ও উঠেনি। দিপাকে দিয়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে। দিপার সাথে সেই ছোট বেলা থেকেই পরিচয় তার। ছোটবেলায় খুব ভালো বন্ধু ছিল ওরা। বাবার ট্রান্সফার হওয়ায় ঢাকা থেকে তারা এখানে এসেছে বছর পাঁচেক আগে। সে একবার বলাতেই দিপার মা নিজে ভালো ঘর নিয়ে দিয়েছে তাকে। তিনি চেয়েছিলেন শুভ্রতা তাদের সাথেই থাকুক। শুভ্রতা দ্বিমত পোষণ করায় আর জোর করার সাহস হয়ে উঠে তার। শুভতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। টেবিলে থাকা অ্যালবামটা নিয়ে নিজের কোলে রাখলো। কভার পেজটা উল্টাতেই প্রথমে নজরে এলো গুটি অক্ষরে লেখা,

শুভ জন্মদিন মাই ডিয়ার বেস্টি,
দোয়া করি তোর জীবন দীর্ঘায়ু হোক।
তার সাথেই দীর্ঘায়ু হোক আমাদের বন্ধুত্ব।
লাভ ইউ…💋

শুভ্রতা হাসলো। তার বয়সের মতোই তার বন্ধুত্ব হলো তবে স্বল্প আয়ু। শুভ্রতা ফের পাতা পাল্টালো। প্রথম পাতায় তার আর শুভ্রতার কিছু ছবি। সবটাই ক্যান্ডিড। শুভ্রতা হাসি ঠাট্টায় মত্ত আর নুর দূর থেকে ওর সাথে সেলফি তুলছে। পাতা উল্টালো। অ্যালবাম জুড়ে সব শুভ্রতার ছবি। সব তার অজান্তে তোলা। কোথাও সে প্রাণখুলে হাসছে, কোথাও সে গম্ভীর হয়ে বসে আছে, কোথাও তার রাগী চাহনি আবার কোথাও তার মায়া ভরা চাহনি, কোনো ছবিতে সে প্রকৃতিতে বিভোর, কোনটায় আবার বান্ধবীদের সাথে হয়ে উঠা হাস্যোজ্জ্বল চঞ্চল রমণী। শুভ্রতার প্রতিটা অভিব্যক্তিই যেনো ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করেছে নুর। শুধু ক্যামেরা বন্দী হয়নি তার ভেঙে পড়ার চিত্র। তার কান্নামাখা নেত্র। পুরো অ্যালবাম তার ভালো লাগলেও কিছু ছবি তার মনে ধরেছে। কিছু ছবি দেখে সে খুব হেসেছে। একটা ছবিতে সে ভীষণ রেগে ছিলো, রাগে তার কপাল কুঁচকে ছিলো। সামনে কাঁচুমাচু হয়ে রিদিতা দাড়িয়ে। তার পাশে উপমা, রুপা আর তিলোত্তমা খিলখিল করে হাসছে। সেদিনের কথা মনে পড়তেই হেসে উঠলো শুভ্রতা। ভার্সিটির কোনো এক সিনিয়র সেদিন রিদিতাকে বলেছিল সে যদি শুভ্রতাকে পটাতে সাহায্য করে তবে রিদিতাকে ট্রিট দিবে সে। রিদিতা ওই লোককে বোকা বানিয়ে এক গাদা চিপস চকলেট নিয়ে এসেছিল। সাথে নিয়ে এসেছিল গোলাপ হাতে সেই ছেলেকে। সে এসেই শুভ্রতার পাশে বসে বলছিল, “দোস্ত! এইযে উনি, তোকে পছন্দ করে। তোকে প্রপোজ করতে এসেছে। ভীষণ ভালো লোক। দেখ আমাকে কতোগুলো চিপস, চকলেট আর জুস কিনে দিয়েছে। আমার এই লোককে খুব মনে ধরেছে। তুই প্রপোজালটা একসেপ্ট করে ফেল তাহলে আমি রোজ এমন চিপস আর চকলেট পাবো। তুই একসেপ্ট করলেই আমি ওনাকে দুলাভাই ডাকতে শুরু করবো।”। সেদিন শুভ্রতার এক ধমকে দৌড়ে পালিয়েছিল সেই ছেলে। যাওয়ার আগে চিপস আর চকলেটও ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। তা নিয়ে সে কি হাসাহাসি ওদের। চিপস আর চকলেটের লোভে বান্ধবীর প্রেম করিয়ে দিতে এসেছিল এই মেয়ে। সেদিন রাগ হলেও এখন মনে পড়তেই হাসি আসে শুভ্রতার। অ্যালবামের শেষের দিকে শুভ্রতা আর চন্দ্রের কিছু ছবি দেখতে পায় সে। একটা ছবিতে চন্দ্র বিস্তর হেসে শুভ্রতার শাড়ির আঁচলের এক কোণ নিজের হাত ঘড়িতে বেঁধে দাড়িয়ে, তা দেখে শুভ্রতা কোমরে হাত রেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে তার দিকেই চেয়ে আছে। শুভ্রতার কাছে সব থেকে সুন্দর ছবি ছিলো এই ছবিটাই। সব শেষে আরো একটা ছবি তার প্রিয়। একই ফ্রেমে চন্দ্র, অরণ্য, মাহতাব, শুভ্রতা আর তার বন্ধুমহল দাড়িয়ে। ছবিটা যেদিন কার্জন হল গিয়েছিল সেদিন তুলেছিল ওরা। শুভ্রতা ঠোঁটের হাসিটা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। সে ছলছল চোখে ছবিটায় হাত বুলালো। এত সুন্দর বন্ধুমহলটা কেমন ভেঙে গেলো। ছবিতে থাকা প্রতিটা মানুষ সেদিনের পর পাল্টে গেলো। সময় তাদের হাতের মুঠোয় রইলো না। শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অ্যালবামটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে সে পুনরায় চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। দৃষ্টি স্থির করলো দূর আকাশে। বিড়বিড় করে ধরা গলায় বললো,
~জীবনটা যদি আবার আগের মত হতো!

চোখ জ্বালা করতেই শুভ্রতা তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। তার মনে হলো দূর থেকে কেউ তাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। শুভ্রতা চোখ মেলে তাকালো। এই কুয়াশায় বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুভ্রতা ঘরে চলে এলো। কান খাড়া করতেই মনে হলো সে কিছুর আওয়াজ শুনেছে। শুভ্রতা তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সারা বাড়ি খুঁজেও সে কাউকে পেলো না। আর একটা মাত্র ঘর খোঁজা বাকি। এই ঘরটায় সে আজ পর্যন্ত যায়নি। দিপার মা বলেছিল এই ঘরটা এই বাড়ির মালিকের। এই ঘরে তার প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা তাই সে যেনো ওই রুমে না যায়। বাড়ীওয়ালার আদেশ। সে যায়নি। তবে আজ মনে হলো একটু যাওয়া উচিত। রোজ রাতেই সে শব্দ শুনে। তবে কিসের শব্দ তা বুঝে উঠতে পারে না। শুভ্রতা সে রুমের কাছে গেলো। দরজা খুলতে গিয়েও খুললো না। মানুষের প্রাইভেট লাইফ ইন্টারফেয়ার করার অভ্যাস তার নেই। শুভ্রতা ঘরে ফিরে এলো। ইদানিং ঘুমালেই মনে হয় কেউ তার পায়ের কাছে বসে আছে। তবে চোখ খুললেই আর কাউকে খুঁজে পায় না সে। বিছানায় শুতেই চোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। আজও ঘুমের মধ্যেই মনে হলো তার পায়ের কাছে কেউ বসে আছে। ঘুম ছুটে আসতেই শুনতে পেলো কারো কান্নার আওয়াজ। শুভ্রতা হালকা করে চোখ খুললো। খুব সন্তপর্নে। পায়ের কাছে আবছা চোখে তাকাতেই দেখতে পেলো অতি পরিচিত এক অবয়ব। শুভ্রতা বিস্ফোরক চোখে চাইলো।

~চন্দ্র!

মৃদু স্বরে ডেকে উঠলো শুভ্রতা। চন্দ্র ছিটকে দূরে সরে গেলো। ভোরের আবছা আলোতে মুক্তোর ন্যায় চিকচিক করে উঠলো তার চোখের অশ্রু কণা। চন্দ্র নিঃশব্দে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে ডাকলো শুভ্রতা। কিন্তু সে থামলো না। শুভ্রতা পরপর দু বার ডাকলো। তবুও থামলো না চন্দ্র। শুভ্রতা দৌড়ে চন্দ্রের সামনে দাড়ালো। চন্দ্র পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে শুভ্রতা দু হাত ছড়িয়ে তার পথ আটকালো। চন্দ্র হাল ছেড়ে দৃষ্টি নত করে দাড়িয়ে রইলো।

শুভ্রতা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে চন্দ্রের দিকে তাকালো। মাথার চুল কপাল গড়িয়ে চোখের ওপর পড়েছে। চোখ আর নাক খানা লাল হয়ে আছে। গায়ে জড়ানো কালো পাঞ্জাবি। ঠোঁট কামড়ে প্রয়াস চালাচ্ছে কান্না আটকানোর। শুভ্রতা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লো,
~আপনি এখানে? আমার এই ঠিকানা পেয়েছেন কোথায়?

চন্দ্র প্যান্টের পকেটে দু হাত গুজে সটান হয়ে দাঁড়ালো। মুখ ফিরিয়ে অভিমানী গলায় জানালো,

~আমার বাবা আর ভাই রাজনীতিবিদ।

শুভ্রতা ভ্রুদ্বয় এবার স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে এলো। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
~ঠিকানা বের করতে পাঁচ দিন লাগলো?

চন্দ্র আগের মতই উত্তর দিলো,
~২০ মিনিট।

~তবে পাঁচ দিন পর এলেন যে?
~সেদিনই এসেছি।

শুভ্রতা অবাক হলো। উৎকণ্ঠা হয়ে প্রশ্ন করলো,
~সেদিনই? ছিলেন কোথায়?
~পাশের ঘরে, অবশ্যই।

শুভ্রতা বিশ্বাস করলো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
~আমি দেখলাম না যে?

চন্দ্র এবার তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। বললো,

~যেদিন এসেছো সেদিন এই জামাটাই পড়ে ছিলে, তার পরদিন নীল থ্রী পিস, তার পরদিন, সবুজ একটা থ্রী পিস, তার পরদিন হলুদ রঙের একটা থ্রী পিস।

শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলো। মুখটা কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেছে। শুভ্রতা গলা খাকারি দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো।

~কি জন্য এসেছেন এখানে?

~নেশাগ্রস্ত মানুষ দেখেছো কখনও?

চন্দ্রের প্রশ্নে শুভ্রতা একটু অবাক হলো। মাথা নেড়ে জানালো,
~নাহ্
~নেশাগ্রস্ত মানুষদের নেশা করতে না পারলে ভালো লাগে না। প্রেমিক পুরুষদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। প্রেয়সীকে না দেখলে পারলে তাদের ভালো লাগে না। মনে অশান্তি লাগে, অস্থির লাগে, মরে যেতে ইচ্ছে করে।

সরল স্বীকারোক্তি। শুভ্রতা এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। এমন জবাব সে আশা করেনি। শুভ্রতা মনে চেপে থাকা রাগ আরো একবার মাথা ছাড়া দিয়ে উঠলো। সে রাগী প্রশ্ন ছুড়লো,

~আবারো নিজের বন্দিনী বানাতে চাইছেন?

চন্দ্রের অভিব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলো না। তার মনে হলো কেউ তার কাটা ঘায়ে লবণ, মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
~আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমাকে সুস্থ রাখতে।

চন্দ্র বললো। শুভ্রতা স্থির হয়ে বসে থাকলো। চন্দ্র হতাশ হয়ে পুনরায় ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো। শুভ্রতা আবারো আটকালো।

~ওই ঘরে নিশ্চই বিছানা নেই? এখানে এসে ঘুমান।

চন্দ্র বিছানায় এসে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। শুভ্রতা তার পাশে এসে শুয়ে পড়ে কিন্তু উল্টো দিকে মুখ করে। সে শুতেই চন্দ্র তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতা সেভাবে চুপ করে শুয়ে থাকে।

~গত পাঁচ দিন ধরে ঘুমাই না।
~কেনো?
~প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীকে দেখতে পায়নি বলে।

শুভ্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।

~দেখি, ছাড়ুন তো! এই সময় ঢং করতে এসেছেন হয়নি।

~আমি দুঃখিত বউ। আমি ভাবিনি তুমি সেখানে দম বন্ধ অনুভব করবে। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমায় এর সুষ্ঠু চিকিৎসা দিয়ে। যেনো তুমি আরো বেশি সময় আমার কাছে থাকতে পারো।

~জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর হাতে চন্দ্র। সে যদি চায় আমি এখনি মরে যাবো, সে চাইলে আরো বছরের পর বছর বাঁচবো। আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে মাসের পর মাস হাসপাতালে রাখা লাগবে না। যেটুকু সময় আমার কাছে আছে আমি প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই চন্দ্র। নিজের প্রিয়দের সাথে হেসে খেলে বাঁচতে চাই। প্লীজ এই সময় টুকু আমার থেকে কেড়ে নিবেন না।

চন্দ্র মাথা নেড়ে বলে,
~উহু! কখনো না। এই ভুল আর কখনও করবো না।
~~~
চলবে~

(ভাবছিলাম এই গল্প শেষ হলে আর গল্প লিখবো না। এই নিয়ে পেজের এডমিন অর্থাৎ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। সে চাইছে আমি লেখি। আমি নিজেও কনফিউজড আমি কি করবো। আপনাদের মতামত কি এই নিয়ে? আমার লেখা আপনাদের কেমন লাগে কমেন্টে জানাবেন। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here