তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব -২০-২২

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২০

আগরবাতির গন্ধ মম করছে সারা বাড়ি, উঠানে গিজগিজ করছে গ্রামের মানুষ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের আয়োজন চলছে প্রকৃতিতে, পাখিটা নীড়ে ফেরার উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে এদিক ওদিক, সাথে করছে কিচিরমিচির শব্দ। তবে সেই সাথে কানে আসছে বাড়ির দক্ষিণ দিকের শিমুল গাছের উপর বসা কাকের কা কা ডাক। অবেলায় কাকের ডাক বড্ড বেমানান, তবে তাতে কী বা করার আছে ? অনেক কিছুই আমাদের কাছে বেমানান লাগে কিন্তু তাও সহ্য করতে হয়। বাড়ির উঠানে কাফনে মুড়ানো তাহেরার লাশটাও বেমানান লাগছে তবে করার কিছুই নেই। তৌহিদুর গ্রামের বাড়ি নিয়ে এসেছে তাহেরার লাশ। একপাশে এলোমেলো হয়ে বসে আছে ইমা আর তার পাশেই ইয়ানা বসেছে ইমাকে সামলাতে। ইমার চোখে পানি নেই দৃষ্টি সামনে রাখা লাশের খাটিয়ার দিকে, শুধু বিড়বিড় করে একটা কথাই বলছে তার জন্য মরে গেছে মা। সে দায়ী তার মায়ের মৃত্যুর জন্য। তার মা সত্যি তাকে ছেড়ে চলে গেলো এটা যেনো সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাহেরার মাথার কাছে বসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তাহের তার একটু দূরেই তৌহিদুর। এই গ্রামেই তাহেরা, ইমরুল আর তৌহিদুর সবার বাড়ি। এই গ্রামেই তাহেরার বেড়ে উঠা, ইমরুলের সাথে প্রেম তারপর বিয়ের আগের দিন পালিয়ে যাওয়া আবার এই গ্রাম থেকেই তৌহিদুরকে বিয়ে করে শহরে পাড়ি দিয়েছিলো সে। আজ আবার ফিরে এলো এই গ্রামেই তবে পার্থক্য একটাই। তিন বছরের ইমাকে কোলে নিয়ে বধূ সেজে গিয়েছিলো সেদিন আর আজ সাদা কাফনে মুড়ে ফিরে এলো। ডক্টর অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে মুখ মলিন করে যখন বলেছিলো সি ইজ নো মোর, সাথে সাথে ইমা সেন্সলেস হয়ে পরে গিয়েছিলো, তাহের থম মেরে তাকিয়ে ছিলো ডক্টরের দিকে আর তৌহিদুর ফ্লোরে বসে পরে মাথায় হাত দিয়ে। ইয়াদ ইমাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বাড়িতে কল দিয়ে ইয়ানাকে আসতে বললে কিছুক্ষণের মধ্যে ইয়ানা আর ইশান দুজনেই চলে আসে। কারো মনের অবস্থা স্বাভাবিক নেই তাই সব ফর্মালিটি ইয়াদ নিজেই সামলায়। তৌহিদুরের কথায় তাহেরাকে গ্রামের বাড়ি আনার ব্যবস্থা করা হয়। এখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দাফন কাজ সম্পন্ন করা হবে। ইয়াদ এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সাথেই ইশান। ইমার নানু ছাহেরার বুকে পরে চুপটি করে মেয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রথম থেকে একটুও কাঁদেনি সে, অনেকসময় হলো তার কোনো সাড়াশব্দও নেই।

ছাহেরা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ও মা তোমার তাহেরা চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে, একটু কাঁদো।

ছাহেরা সাড়া না পেয়ে মায়ের মাথাটা বুক থেকে সরাতেই মা বলে চিৎকার করে উঠলো। তার চিৎকারে সবাই দৌড়ে কাছে গেলো। আরমান দ্রুত পালস চেক করে পাশে বসে পড়লো থপ করে। নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝালো নানু আর বেঁচে নেই। ছাহেরার চিৎকারে পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো। ইমার নানুর বয়স হয়েছে এই বয়সে এসে এতোবড় ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি, সহ্য করতে পারেনি আদরের মেয়ের নিথর দেহ। সেও মেয়ের সাথে বিদায় নিয়েছে এই স্বার্থপর পৃথিবী থেকে। তাকেও সোজা করে শুইয়ে দেওয়া হলো। কী নির্মম সেই দৃশ্য, পাশাপাশি পরে আছে মা মেয়ের লাশ।

ইমা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নানুর মাথার কাছে বসে মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, এই নানু তুমি কথা বলছো না কেনো ? তুমি তো তোমার মেয়ের মতো স্বার্থপর নও যে আমাকে একা ছেড়ে যাবে ? তুমি তো সবসময় আমার পাশে ছিলে ছায়ার মতো, তাহলে আজ কেনো নিজের মেয়ের জন্য আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছো। এই নানু উঠো না তোমার মেয়েকে একটু বকে দাও। সে আমাদের রেখে চলে যাচ্ছে তুমি তাকে বকে দাও।

ইয়াদ ইমার কাছে গিয়ে জোর করে টেনে উঠিয়ে দাঁড় করালো। ইয়াদ বুঝতে পারছে ইমার মেন্টাল কন্ডিশন একবারে ঠিক নেই। খারাপ কিছু হয়ে যাওয়ার আগে দূরে নিতে হবে, ওকে বুঝাতে হবে।

ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, এই দেখেন না নানুও কথা বলছে না কিছু বলুন নানুকে। আমি কীভাবে বাঁচাবো সবাই আমাকে রেখে চলে গেলে। কেউ তো ভালোবাসে না ইমাকে, শুধু মা আর নানু ছাড়া। তারাও চলে গেলে ইমা কীভাবে বাঁচবে তাদের একটু বুঝান না।

ইয়াদ কী বলে ইমাকে শান্তনা দিবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। একসাথে দুজন আপন মানুষকে হারানোর যন্ত্রণা হয়তো ইয়াদও কোনো একদিন পেয়েছিলো। তবে কষ্টটা হয়তো ইমার থেকে কম হয়েছিলো। ইয়াদ ইমাকে কিছু বলছে না।

ইমা ইয়াদকে চুপ থাকতে দেখে রেগে বললো, আপনি কাউকে কিছু বলছেন না কেনো ? ওদের বলুন আমাকে একা ফেলে না যেতে। আমি আর কখনো আপনাকে জ্বালাবো না কথা দিচ্ছি তবু ওদের যেতে মানা করেন।

ইমা চিৎকার করে কথা বলতে বলতেই আবার চুপ হয়ে গেলো। ইয়াদ তাকিয়ে দেখে সেন্সলেস হয়ে গেছে আবারও। ইয়াদ কোলে করে ইমাকে একটা রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো। ইয়াদের পিছনে পিছনে ইয়ানাও গেলো।

ইয়াদ ইয়ানাকে বললো, তুই ওর পাশে থেকে কোথাও যাবি না এখানেই বসে থাকবি। সেন্স ফিরলেও আর বাইরে যেতে দিবি না।

ইয়ানা ভেজা গলায় বললো, একসাথে দুটো ধাক্কা কীভাবে সামলাবে রে ভাইয়া ?

ইয়াদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, জানি না রে কী থেকে কী হয়ে গেলো। তবে এর প্রভাব ইমার উপর খুব খারাপভাবে পড়বে সেটা ভালোই বুঝতে পারছি।

২৩.
রাত দশটার বেশী বাজে তাহেরা আর তার মায়ের দাফন শেষ হয়েছে এশার নামাজের পর পরই। ইমা এখনো ঘুমাচ্ছে হসপিটালের ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাব এখানো কাটেনি। ইয়াদ চিন্তায় আছে ঘুম ভাঙলে ইমা কী রিয়াকশন দিবে সেটা ভেবে। ইয়ানা আর ইশানকে চলে যেতে বলেছিলো কিন্তু ওরা বলেছে ইমার ঘুম ভাঙলে এক সাথেই যাবে।ছাহেরা বেগম থম মেরে বসে আছে আর তার পাশে বসে আছে কথা। ছাহেরা বেগম মা-বোন হারিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আজ বুঝতে পেরেছে সে অনেক অন্যায় করেছে তাহেরার সাথে। ছাহেরা তাহেরার পাঁচ বছরের বড় ছিলো। বেশির ভাগ দেখা যায় ছোট বোনের জন্য বড় বোন সেক্রিফাইস করে কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে ছাহেরা ছিলো অতিরিক্ত জেদি। সবসময় তাহেরাকে হিংসা করতো সে। ছাহেরা ছিলো বাবার চোখের মণি আর তাহেরা মায়ের। তবে ছাহেরা সেটা নিয়েও হিংসা করতো তার বাবা-মা দুজনের কাছেই বেশি ভালোবাসা চাই। ছোটবেলা থেকে তাহেরার জিনিস কেড়ে নেওয়া ছিলো স্বভাব। কোনো কারণে নিতে না পারলে নষ্ট করে দিতো যাতে সেটা তাহেরাও না পায়৷ সময়ের সাথে সাথে বড় হলেও মনের পরিবর্তন হয়নি ছাহেরার। ইমরুলকে না পেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছিলো তাহেরার প্রতি। তাই সে ইমরুলের মৃত্যুর পর বাবাকে বুঝায় তাহেরার বিয়ে দেওয়া উচিত। তার বুদ্ধিতে তাহেরার বাবা তাকে নানাভাবে চাপ দেয় বিয়ে করার জন্য। শেষ পর্যন্ত ইমাকে সরিয়ে ফেলার হুমকি দেয়। তাহেরা বাধ্য হয় বিয়ে করতে, তাহেরের জন্মের পর ইমাকে রেখে যাওয়ায় সবসময় বুঝাতো তার মা তাকে ভালোবাসে না তাই এখানে রেখে গেছে নিজের কাছে রাখেনি। আরো বড় হওয়ার পর বুঝায় ইমার বাবাকে ইমার মা ভালোবাসে না তাই অন্য এক লোককে বিয়ে করে নিয়েছে। ছোট থেকে এসব শুনতে শুনতে ইমার মনে অভিমান জন্মে মায়ের জন্য। আজ নিজের কাছে নিজেকে ঘেন্না লাগছে ছাহেরার। তার বোনের মৃত্যুর জন্য অনেকটাই দায়ী সে। ইমা ছিলো ইমরুলের শেষ স্মৃতি তাহেরার কাছে, ভালোবাসার মানুষের শেষ স্মৃতি ভালো রাখতে না পেরে প্রতিনিয়ত অপরাধ বোধে ভুগেছে তাহেরা। মেয়ের থেকে দুরত্ব তার জীবনের মায়া কমিয়ে দিয়েছে। তাই এতোবড় অসুখ নিজের মধ্যে চেপে রেখেছিলো কাউকে বুঝতে দেয়নি কখনো।

আরমান বাড়ির দক্ষিণ দিকে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা খা খা করছে। কষ্ট হচ্ছে ইমার জন্য মেয়েটার জীবনে সুখের দেখা কখনো পায়নি। সে নিজেও কী কম কষ্ট দিয়েছে ভাবতেই বুকের ব্যাথাটা আরো তীব্র হচ্ছে আরমানের। অনেক সময় ধরে ইয়ানা দূর থেকে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে গেলো।

স্যার,,,,

কারো ডাকে আরমানের চিন্তার অবসান ঘটে, ঘুরে তাকায় ইয়ানার দিকে।

ইয়ানাকে দেখে বলে, কিছু বলবে ?

ইয়ানা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, ভালোবাসেন ইমা ভাবিকে ?

ইয়ানার কথা শুনে আরমান বিস্ফুরিত চোখে তাকায়, আরমানের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। তার জন্য যদি ইমার সংসারে আবার অশান্তি হয় তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না কখনোই। আসলে আজ সারাদিন আরমানের দৃষ্টি ছিলো ইমার দিকে। আরমানের মুখ দেখে মনে হতো ইমার কষ্ট সে উপলব্ধি করতে পারছে। ইয়ানা সবটা সময় সেটা খেয়াল করেছে।

আরমান নিজেকে স্বাভাবিক করে গম্ভীর গলায় বললো, কী সব বাজে কথা বলছো ? এই পরিস্থিতিতে তোমার এসব কথা মাথায় এতো কীভাবে ?

ইয়ানা ইয়াদের পাশে বসে বললো, তিক্ত হলেও কথাটা সত্যি সেটা আমি জানি স্যার। আন্টি বা নানুর মৃত্যু নিয়ে আপনি যতটা না ভাবছেন তার থেকেও বেশি ভাবছেন ভাবির কষ্ট নিয়ে।

ইয়ানার কথার উত্তরে আরমান আর কিছু বললো না কারণ কথাটা সত্যি। মৃত্যু সবসময়ই কষ্টের তবে সেটা যদি আপন কারো হয় তাহলে কষ্টের তীব্রতা বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক গুণ বেশি। আরমানের সাথে মণি বা নানুর কখনোই খুব বেশি বন্ডিং ছিলো না। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাও হতো না তাই তাদের মৃত্যুর থেকে আরমানের বেশি কষ্ট হচ্ছে ইমার কষ্ট দেখে। ইমার কান্না আরমানের বুকে রক্তক্ষরণ করছে। আজ আরমান নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে, নিজেকে প্রশ্ন করছে কোথায় ছিলো তার এতো কষ্ট যখন সে নিজে ইমাকে কষ্ট দিতো। কিছু হারিয়ে গেলে তার মায়া কাটাতে শিখতে হয় কিন্তু সেখানে আরমানের সাথে হচ্ছে উল্টো। ইমা হারিয়ে যাওয়ার পর তার প্রতি মায়া দিনদিন বেড়ে চলেছে আরমানের। যার লাভ কিছু না হলেও হয়তো ক্ষতি হবে অনেক। ইমা যদি আরমানের মনের কথা কোনোদিন জানতে পারে তাহলে হয়তো দম ফাঁটা তাচ্ছিল্যের হাসিতে ফেটে পরবে। আরমান তো চাইতেই ইমার কষ্টে ডুবে থাকা জীবনে এক পশলা সুখের বৃষ্টি হতে পারতো। তা না হয়ে কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে সে। ইয়ানা চুপচাপ বসে রইলো আরমানের পাশে কেউ কিছু বলছে না।

—–

ইয়াদ ইমার পাশে বসে আছে কখন ইমার ঘুম ভাঙবে সেই আশায়। হঠাৎ রনিতের কল এলে নেটওয়ার্কের প্রবলেমে কথা বলতে পারে না তাই বাইরে বের হয়ে আসে।

মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে ইমা চোখ মেলে তাকায়। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখতে পায় তৌহিদুরকে। ইমা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে গিয়েও পারলো না।

তৌহিদুর ভাঙা গলায় বললো, থাক মা তোকে উঠতে হবে না।

ইমা বললো, আপনি ?

তৌহিদুর মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইমার দিকে, ছোট্ট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। ইমা তাকে সেদিন অপমান করে ফিরিয়ে দেওয়ার পর তৌহিদুর আর কখনো ইমার সামনে যায়নি।

তৌহিদুর মায়াভরা কণ্ঠে বললো, তোর মা আমাকে কখনো মেনে নেয়নি। তাই এমন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। আমি কী এতোটাই খারাপ তুইও একবার বাবা ডাকতে পারবি না ? বিশ্বাস কর মা, দ্বিতীয় বার তোর মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম তোর মতো একটা মিষ্টি মেয়ের বাবা হতে পারবো বলে। ছোটবেলায় তুই আমার আঙ্গুল ধরে হাঁটতি আর মিষ্টি করে বাবা ডাকতি। বিশ্বাস কর মা সেই ডাক আজও আমার কানে বাজে।

ইমা টলমল চোখে তাকিয়ে আছে তৌহিদুরের দিকে। এতো ভালোবাসা পায়ে ঢেলে সে কীভাবে বেছে নিয়েছিলো #তিক্ততার_সম্পর্ক ? এই মানুষটা একবার তার মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য কত ছটফট করেছে আর সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বারবার। সবসময় রক্তের সম্পর্কই কী সব হয় মনের সম্পর্ক কী কিছুই না ? ইমার মন আজ তীব্র ভাবে চাইছে সামনে বসা মানুষটাকে একবার বাবা বলে ডাকতে। মাকে হারিয়ে মায়ের কদর বুঝেছে সে এবার উনাকে ফিরিয়ে দিলে হয়তো একদিন আবার আফসোস করতে হবে আজকের মতো।

হঠাৎই ইমার মায়ের কথা মনে পরে গেলো এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলো মা আর নানুর কথা। ইমা পাগলের মতো কান্না করে বললো, আ,,,আমার মা কোথায়,,,, মা,,, আমার নানু ?

ইমার কান্নার শব্দে ইয়াদও বারান্দায় থেকে রুমে চলে এলো। রুমে এসে দেখতে পেলো তৌহিদুরকে।

ইয়াদ ব্যস্ত হয়ে বললো, কী হয়েছে ইমা এমন করছো কেনো ?

ইমা শক্ত করে ইয়াদের হাত আঁকড়ে ধরে বললো, আমার মা কোথায় ইয়াদ ?

ইয়াদ নরম গলায় বললো, ইমা শান্ত হও এমন পাগলামি করলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে।

ইমা কথা না শুনে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো আবার। ইমার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে তৌহিদুর বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ইমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইয়াদ তবু ইমা থামছে না। এভাবে চলতে থাকলে ইমা অসুস্থ হয়ে যাবে। ইয়াদ কী করবে বুঝতে পারছে না ?

ইয়াদ জোরে ধমক দিয়ে বললো, চুপ করবে তুমি ?

ইয়াদের ধমকে ইমা কেঁপে উঠে চুপ করে যায় ইমা। ইমাকে চুপ করতে দেখে ইয়াদ আবার বলে, চলো বাসায় যাবে ?

ইমা নিজেকে ইয়াদের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভেঙে ভেঙে বলে, আ,,,আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।

চলবে,,,,,
(কেমন হয়েছে জানি না আজ কেনো জানি গল্পটা গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না তাই অনেক লেইট হয়ে গেলো দিতে।)#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২১

ইমা নিজেকে ইয়াদের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভেঙে ভেঙে বলে, আ,,,আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।

ইয়াদ উত্তেজিত হয়ে বললো, মানে ?

ইমা ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো, মা এখানে আছে, মাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না, আপনি চলে যান।

ইয়াদ বুঝিয়ে বললো, আবার আসবে মায়ের কাছে এখন অনেক রাত হয়ে গেছে আমাদের ঢাকা পৌঁছাতে হবে।

ইমাকে অনেক বুঝিয়ে ইয়াদ সাথে নিয়ে গেলো। ইয়াদ, ইমা, ইয়ানা আর ইশান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলো। বাকি সবাই আগামীকাল যাবে।

২৪.
গতকাল রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অবিরাম। প্রকৃতি সবুজ হয়ে উঠেছে চারদিকে। বৃষ্টির পর প্রকৃতি হয়ে উঠে সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। আজ পনেরো দিন হলো ইমার মা আর নানুর মৃত্যুর। বাড়ি ফেরার পর এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি সে। একদম চুপ হয়ে গেছে সারাদিন উদাস হয়ে বসে থাকে। কারো সাথে কথাও বলে না আর ভার্সিটিও যায় না। ইয়াদের ভালো লাগছে না ইমার এই গম্ভীরতা। মিস করছে ইমার বিরক্ত করা তবে ইয়াদ মুখ ফোটে কিছু বলেও না ইমাকে। নিজের মতো অফিস, জিম আর বাকি দুজন মানুষের সন্ধান করে চলেছে প্রতিনিয়ত। ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে একবার বাইরের দিকে তাকালো। বৃষ্টি ইয়াদের একদমই পছন্দ না। ঢাকা শহরে বৃষ্টি মানেই রাস্তায় হাটু সমান নোংরা পানি জমা, বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পরে ভিজে গেলে কেমন খুঁতখুঁত করে ইয়াদ। পছন্দ না করার আরো বড় একটা কারণ হলো পাঁচ মিনিট বৃষ্টিতে ভিজলে ইয়াদের জ্বর আসে শরীর কাপিয়ে। তাই অপছন্দের তালিকায় রেখেছে সে বৃষ্টিকে তবে সেটা শুধু ঢাকা শহরের জন্য আর ভেজার জন্য। অন্য কোথাও অবস্থান কালে বৃষ্টির দিন তার খুব একটা মন্দ লাগে না, যদি কাঁচের জানালার এপার থেকে দেখে বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতি। তবে আজ বৃষ্টি দেখার সময় নেই তার আর তাই ইয়াদ বিরক্তি নিয়ে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। কে জানে আজ রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে নাকি শিপের ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে ইমা জানালা দিয়ে মিনি ছাঁদটার এরিকা পাম গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির ফোটা পরতেই গাছের সরু পাতাগুলো কেমন নেচে নেচে উঠছে। সকাল আটটার বেশি বাজে হয়তো কিন্তু বাইরের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে আসছে এমন অন্ধকার চারদিকে।

ইমা আগের মতো ইয়াদকে বিরক্ত করলে হয়তো এখন বলতো আজ অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দেখুন বাইরে কী সুন্দর বৃষ্টি, চলুন দুজনে একসাথে ভিজি এই বৃষ্টিতে।

ইয়াদ ইমার উদ্দেশ্যে বললো, নিচে চলো ব্রেকফাস্ট করে তারপর আবার এভাবে বসে থেকো সারাদিন।

ইয়াদ বের হয়ে গেলো রুম থেকে আর ইমা সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো তবে নিচের যাওয়ার দিকে না গিয়ে মিনি ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। বৃষ্টি স্নান করার ইচ্ছে করছে ইমার। বৃষ্টির ফোঁটার সাথে নিজের ভেতরের কষ্টগুলোকে ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে খুব। ইমা ধীর পায়ে ছাঁদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে দু’হাত দু’দিকে মেলে দিলো। আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিলো। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ইমার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। গায়ের সাদা সুতি শাড়ীটা একটু একটু করে ভিজে ইমার গায়ের সাথে মিশে যাচ্ছে। বৃষ্টির বেগ বেশি থাকায় মাত্র কয়েক মুহূর্তে ইমার সারা শরীর ভিজে এককার হয়ে গেলো। সাদা শাড়ীটা দেহের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে, প্রত্যেকটা ভাজ ফুটে উঠছে। ইয়াদের বাড়ির পাশের বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে মাঝে ইয়াদদের ফলের বাগান, ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়ানোর জন্য নিচ থেকেও দেখা যাচ্ছে না আর ইয়াদ চলে গেছে আর আসবে না। তাই ইমা নিশ্চিন্তে ভিজচ্ছে বৃষ্টিতে। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনা পানিগুলো বৃষ্টির পানি গ্রাস করে নিচ্ছে। ইমার মনে হচ্ছে চোখের পানির সাথে মনের কোণে জমা কষ্টগুলো এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা শুষে নিচ্ছে।

ইয়াদ ফাইল রেখে চলে গিয়েছিলো। ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমে এলো ফাইল নিতে। ইমাকে রুমে না পেয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো কারণ ইমা নীচে যায়নি। সাইড টেবিল থেকে ফাইলটা হাতে নিয়ে আবার ইমাকে খুজার জন্য ওয়াশরুমের দিকে তাকালো না পেয়ে ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই ইয়াদের হাত থেকে ফাইলটা নিচে পরে গেলো। ইয়াদ একবার ফাইলের দিকে তাকিয়ে আবার ইমার দিকে তাকালো। দুহাত দু’দিকে মেলে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে আছে। বৃষ্টির ফোঁটায় ইমার চোখের ঘন কালো পাপড়িগুলো নড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত, সারা মুখে পানির বড় বড় ফোটা, গোলাপি ঠোঁটের কোণে পানি। বৃষ্টির ফোঁটা কপালে পরে গাল, চিবুক তারপর গলা বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। ইয়াদ আজ নিজের মধ্যে নেই সে হারিয়ে গেছে ইমার মাঝে। কখন রুম থেকে ধীর পায়ে ছাদে পা রেখেছে ইয়াদ নিজেই জানে না। মুহুর্তে ইয়াদের সাদা শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো, মাথার চুল বেয়ে পানিগুলো গড়িয়ে নিচে নামতে লাগলো। ইয়াদ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে একদম ইমার সামনে দাঁড়ালো। ইয়াদ ইমার থেকে অনেক লম্বা তাই সামনে দাঁড়িয়ে ইয়াদ নিচের দিকে তাকিয়ে ইমার মুখ দেখছে। ইয়াদের চুল বেয়ে পরা পানিগুলো ইমার চোখে মুখে পরছে। ইমা বৃষ্টিতে ভেজায় এতোটাই ব্যস্ত তার এতো কাছে এসে কেউ দাড়িয়েছে ইমার হুঁশ নেই। বৃষ্টির ঠান্ডা পানিতে ইমার সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। হঠাৎ মুখে গরম নিশ্বাস পড়তেই ইমা চোখ পিটপিট করে তাকায়। ইমা আর ইয়াদের মাঝে হয়তো এক ইঞ্চিরও কম দূরত্ব আছে৷ ইমা চোখ খুলে ইয়াদকে দেখে চমকে গেলো, এক পা পিছিয়ে যেতেই ইয়াদ ইমার কোমর জড়িয়ে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ভেজা গায়ে ইয়াদের ভেজা হাতের স্পর্শ যেনো ইমার গায়ের প্রতিটি লোমকূপে পৌঁছে গেলো। একে অপরের মাঝে আর সুতো পরিমাণ জায়গাও ফাকা নেই। এবার ইমাও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইয়াদের ভেজা মুখের দিকে। ইমা চোখ দুটো মিটমিট করছে কারণ একটু পরপরই ইয়াদের চুল বেয়ে পানিগুলো ইমার চোখে মুখে গড়িয়ে পড়ছে। এভাবে কতটা সময় পার হয়ে গেলো কারো জানা নেই। একে অপরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি বিলাস করছে। হারিয়ে গেছে অন্য এক জগতে, বৃষ্টির বেগ যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো, চারপাশটা আরো ঘন কালো অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। ইমার শীত লাগতে শুরু করেছে, ভেজা গোলাপি ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে। ইয়াদের দৃষ্টি আটকে গেছে সেই ভেজা ঠোঁটে। নিজের অজান্তেই ইয়াদ একটু একটু করে আগাতে লাগলো ইমার ঠোঁটের দিকে। ইয়াদের দু’হাত ইমার কোমরে আর ইমা নিজের দু’হাতে ইয়াদের কাঁধের শার্ট খামচে ধরে আছে। বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে দুজনের হুঁশ ফিরে। ইয়াদ তৎক্ষনাৎ ইমাকে ছেড়ে দেয় ইমা ছিটকে দূরে সরে যায়। ইমা কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে রুমে চলে যায়। ইয়াদ পাশের চেয়ারে বসে পরে, কাঁচের টেবিলটাতে টপটপ বৃষ্টির ফোঁটা পরছে সেগুলো দেখতে লাগলো। কী হয়েছিলো তার এসব কী করছিলো ? এটা কী কেবলই আকর্ষণ ছিলো নাকি অন্যকিছু ? ইয়াদ কিছু ভাবতে পারছে না এখনো চোখে লেগে আছে ইমার ভেজা মুখটা যা খুব করে কাছে টানছিলো ইয়াদকে। গলার বিন্দু বিন্দু পানিগুলো শুষে নিতে ইচ্ছে করছিলো। ইয়াদ দু’হাতে নিজের ভেজা চুলগুলো পেছনের দিকে দিলো। তবে কী সেটাই ঠিক যেটা ইয়াদের মন বলছে কিন্তু ইয়াদ তো তার মনের কথা মানতে নারাজ। ইয়াদ চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিলো, উপভোগ করতে লাগলো বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা। খুঁতখুঁতে লাগা বৃষ্টির স্বাদটা আজ ইয়াদের কাছে অন্যরকম লাগছে, এক নাম না জানা অনুভূতি নাড়া দিচ্ছে মনে। ইমা ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইয়াদকে এতো কাছে দেখে ইমার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গিয়েছিলো। যখন কাছে টেনে নিলো তখন মনে হয়েছে হার্টবিট থেমে গিয়েছিলো আর যখন ঠোঁটের দিকে,,,,, ইমা আর ভাবতে পারলো না দু’হাতে মুখ ঢেকে নিলো লজ্জায়। তখন হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো বলে ইমা লজ্জা পেতেও ভুলে গিয়েছিলো। এখন ইমার মনে হচ্ছে ইয়াদের সামনে গেলেও লজ্জায় মরে যাবে সে। ইমার শীত বাড়তে লাগলো তাই তাড়াতাড়ি শাওয়ার শেষ করে ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখে সে কোনো কাপড় আনেনি। এখন বাইরে যাবে কী করে সেটা ভেবে ইমার মাথায় হাত। ওয়াশরুমের দরজা একটু ফাঁকা করে দেখে ইয়াদ রুমে আসেনি এখনো। ভেজা কাপড়ে দৌড়ে কাবার্ডের সামনে চলে গেলো একটা ধূসর রঙের শাড়ী নিয়ে ঘুরতেই ইয়াদকে দেখতে পেলো রুমে আসছে। দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলে ইমা চোখ নামিয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায় আর ইয়াদ রুমেই ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়। এই প্রথম হয়তো ইয়াদের অফিসের জন্য লেট হলো। দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ইমা শাড়ী পরে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদের সামনে পরতে হবে ভেবে লজ্জা লাগছে, বের হতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ মনে হলো ইয়াদ ভেজা কাপড়ে আছে তাই তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো ওয়াশরুম থেকে। কিন্তু ইয়াদকে দেখতে পেলো না রুমে। কাপড় রাখার ঝুঁড়িতে ইয়াদের ভেজা কাপড় দেখে বুঝতে পারলো ইয়াদ চেঞ্জ করে চলে গেছে অফিসে। এক মুহুর্তের জন্য ইমার উদাসীনতা কেটে চঞ্চলতা ভড় করেছিলো আবার একা হয়ে যেতেই উদাসীনতা তাকে গ্রাস করতে লাগলো।

আসবো ম্যাম ?

সার্ভেন্টের ডাকে ইমা দরজার দিকে তাকায়। দরজা খোলা তাই বাইরে সার্ভেন্টকে খাবার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে আসতে বললো।

সার্ভেন্ট ভেতরে এসে সাইড টেবিলে খাবারের ট্রে রেখে বললো, ম্যাম আপনার খাবার।

ইমা অবাক হয়ে বললো, আমি তো খাবার রুমে দিতে বলিনি।

সার্ভেন্ট ফ্লোরে দৃষ্টি রেখে বললো, স্যার যাওয়ার সময় আপনার খাবার রুমে দিয়ে যেতে বলেছে।

ইমা বেশ অবাক হলো আজ ইয়াদের আচরণে। বিয়ের অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে ইয়াদ এখনো কোনোদিন ইমাকে জিজ্ঞেস করেনি সে খেয়েছে কিনা, বা কখনো বলেনি খেয়ে নাও। আজ ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার সময়েও সাথে যেতে বললো আর এখন আবার নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশ্য ইমার মা চলে যাওয়ার পর এই পনেরো দিন ইয়ানা সবসময় ইমার খেয়াল রেখেছে, হয়তো ইয়াদের কথাতেই করেছে হবে। ইমা ভেবে দেখলো ইয়ানা ভার্সিটি চলে গেছে তাই হয়তো বাধ্য হয়ে ইয়াদ নিজেই বলে গেছে।

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, ঠিক আছে তুমি যাও আমি খেয়ে নিচ্ছি।

সার্ভেন্ট ওকে ম্যাম বলে চলে গেলো। ইয়াদের এই আড়ালে থেকে খেয়াল রাখার কথা চিন্তা করে ইমা মুচকি হাঁসলো।

বিড়বিড় করে বললো, আপনি উপরে নিজেকে যেমন দেখান আসলে আপনি তেমন নন। আপনার কঠিন আবরণের আড়ালে একটা নরম মন আছে। যেটা আপনি সবসময় লুকিয়ে রাখতে চান। তবে মিস্টার আবরার হামিদ ইয়াদ ধরা পরে গেছে নিজের মিসেস এর কাছে।

ইমা মুচকি হেঁসে খাবার খেতে লাগলো। এদিকে ইয়াদের অফিসে আসতে অনুমানের থেকেও বেশি লেট হয়ে গেলো। মাথা ভারী হয়ে আসছে ইয়াদের, একের পর এক হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজার ফল ভোগ করতে হবে হয়তো।

২৫.
ক্লাসের সামনে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ানা, বাইরের বৃষ্টি দেখছে। আজ বৃষ্টির জন্য অনেকেই আসেনি তবে ইয়ানার ক্লাস মিস করা একদমই পছন্দ নয় তাই চলে এসেছে। আজ ইয়ানার একমাত্র ফ্রেন্ড রিকু (রোকেয়া) সেও আসনি। ইয়ানার এখন মনে হচ্ছে সে এসে ভুল করেছে। হাতে গোনা কিছু ছেলেমেয়ে এসেছে সবাই নিজেরদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে। আজ স্যাররাও ক্লাস নিচ্ছে না খুব একটা। দুই এক ক্লাসে গুটি কয়েক স্টুডেন্টদের সাথে স্যার দেখা যাচ্ছে। তবে পড়াচ্ছে নাকি গল্প করছে বুঝা দায়। ইয়ানা বিরক্ত হয়ে ভাবলো বাসায় চলে যাবে, সেখানে অন্তত নিজের ভাবির সাথে গল্প করতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ, ক্লাস থেকে নিজের বইপত্র নিয়ে চলে আসলো। হলরুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো।

ইয়ানা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো, কে ?

সাথে সাথে হলরুমের সব লাইট জ্বলে উঠলো একে একে। সামনে তাকিয়ে ইয়ানার ভয় বেড়ে গেলো। তার সামনে পাঁচজন অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের আগে দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না।

ইয়ানা ভয়ে ঢোক গিলে বললো, আপনারা কারা, ভার্সিটিতে ঢুকলেন কী করে ? আর আমাকে এখানে কেনো এনেছেন ?

একটা ছেলে প্রচন্ড আক্রোশে বললো, আমার ভাই সামান্য তোর হাত ধরেছিলো বলে তোর ভাই তার হাতের হাড় এতোগুলা টুকরো করেছে যে কোনো দেশের ডক্টর সেটা জোড়া লাগাতে পারেনি। চোখ তুলে তাকিয়েছে বলে এসিড দিয়ে চোখদুটো ঝলছে দিয়েছে, তোকে কিছু কথা বলেছে বলে জিহ্বা কেটে দিয়েছে। আজ আমি তোর এমন হাল করবো তোর ভাই তোর দিকে তাকালে, তার রুহ কেঁপে উঠবে তোকে দেখে।

সামনের ছেলের বলা কথার কিছুই বুঝতে পারছে না ইয়ানা। কার কথা বলছে আর তার ভাইয়া এতো নির্মম হতে পারে না।

ইয়ানা রেগে বললো, কী সব আবোল তাবোল কথা বলছেন আপনি ? আর কে আপনার ভাই ?

সামনের ছেলেটা হেঁসে বললো, সামান্য অপরাধের জন্য যার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছিস এখন তাকেই ভুলে গেছিস। জাহিদের কথা মনে আছে যে তোকে প্রপোজ করেছিলো ? আমি তার বড় ভাই শাহিদ।

জাহিদের কথা বলতেই ইয়ানার সেদিনের কথা মনে পরে যায় কিন্তু তবু এই লোকের কথা বুঝতে পারছে না। ইয়াদ তো শুধু তাদের বলেছিলো ইয়ানাকে বিরক্ত না করতে তাহলে এরা এসব কী বলছে ইয়ানা বুঝতে পারছে না।

ইয়ানা ব্যস্ত হয়ে বললো, দেখুন ভাইয়া আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। হ্যাঁ জাহিদকে আমি চিনি সে আমাকে বিরক্ত করতো কিন্তু ভাইয়া তাকে শুধু বুঝিয়েছিলো আমাকে বিরক্ত না করতে। তারপর আর তাকে আমি দেখিনি।

শাহিদ রেগে বললো, দেখবি কী করে, আমার ভাই আজ কয় মাস ধরে হসপিটালে পরে আছে। তোর ভাইয়া ওর এমন অবস্থা করেছে তার দিকে তাকাতে ভয় পায় মানুষ।

ইয়ানা এসব কী শুনছে তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাই ভাইয়া রাগী কিন্তু তাই বলে এমন কিছু করতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

শাহিদ রেগে বললো, আজ তোর এমন হাল করবো তোর ভাইয়াও তোর দিকে তাকাতে ভয় পাবে।

ইয়ানা ভয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। একে তো হঠাৎ করে তার ভাইয়ার নামে এসব শুনে সে শকড তার ওপর সামনের পাঁচজনকে তার হিংস্র পশু মনে হচ্ছে। যারা তাকে এখনই টুকরো টুকরো করে ফেলবে মুহূর্তে। ইয়ানা ভয়ে পিছনে যেতে যেতে দেয়ালে পিঠ ঢেকে গেলো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি এখন যদি সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তাহলেও হয়তো কেউ শুনতে পাবে না।

ইয়ানা হাত জোর করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়া প্লিজ আমাকে কিছু করবেন না। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে আমার ভাইয়া এমন কিছু করতে পারে না।

শাহিদ অট্টহাসি দিয়ে বললো, এই দেখ তোরা, দেশের নামকরা বিজনেসম্যান মিস্টার আবরার হামিদ ইয়াদের কলিজা এখন আমাদের হাতে। আজকের দিনটার জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছি আমরা, তোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ?

শাহিদ ইয়ানার দিকে আগাতে শুরু করলে ইয়ানা দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।

চলবে,,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২২

ইয়ানা মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।

আরমানের একটা ক্লাস আছে অনার্স ৩য় বর্ষে, আজ যদিও ক্লাস নেওয়ার মুড নেই তবু মিস করতে চায় না আরমান। আরমান বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকাতে তাকাতে ক্লাসে এগিয়ে যাচ্ছে। ইমার কথা আজ খুব মনে পড়ছে আরমানের। মেয়েটার বৃষ্টি অতিরিক্ত পছন্দ, বৃষ্টি হলে হয়তো তাকে বেধে রেখেও বৃষ্টিতে ভেজা থেকে আটকানো যাবে না। এমনই এক বৃষ্টির দিনে আরমান ইমাকে অনেক অপমান করেছিলো, ভাবতেই বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো।

——
বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে আরমান রুম থেকে বের হয় বাড়ির বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই পিছলে পড়ে যেতে চায়। সামনের দেয়াল ধরে কোনো মতে নিজেকে সামলে নেয়। নিচে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করে পিছলে যাওয়ার কারণ। ফ্লোরে তাকাতেই আরমানের মাথায় রাগ চড়ে যায়। মেইন ডোর থেকে শুরু করে নিচের রুমের দিকে গেছে পানির রেখা, একেবারে জবজব করছে। টাইলসে পানি পরার কারণে পিছলে গিয়েছিলো আরমান।

আরমান রেগে চিৎকার করে বললো, মা মা।

মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে ইমা, আরমানের দিকে এগিয়ে এসে বলে, মণি বাইরে কোথায় যেনো গেছে এখনো ফিরেনি হয়তো বৃষ্টির জন্য আঁটকে গেছে। ভাইয়া আপনার কী লাগবে আমাকে বলুন আমি দিচ্ছি।

আরমান রাগে দাত কিটমিট করে বললো, এখানে পানি কোথা থেকে এলো ?

ইমা ফ্লোরে পানি দেখে ভয়ে এক ঢোক গিললো। বৃষ্টি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি দৌড়ে ছাঁদে চলে গিয়েছিলো ভিজতে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় ভেজা কাপড়ে চলে এসেছে আর তাতে ফ্লোর ভিজে একাকার অবস্থা।

ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, আসলে ভাইয়া আমি ছাঁদে গিয়েছিলাম,,,,,

আরমান বুঝতে পেরে মাথা ঠান্ডা করে বলে, বৃষ্টি দেখে আর হুঁশ ছিলো না তাই না ? ভেজা শরীর মানুষকে দেখানোর জন্য মন উতলা হয়ে গিয়েছিলো ?

আরমানের কথায় ইমার ঘৃণায় সারা গা শিউরে উঠে, ভেজার আগে সে সবসময় দেখে নেয় আশেপাশের ছাঁদে কেউ আসে কি না। কেউ না থাকলে তবেই সে বৃষ্টিতে ভেজে আর আরমান তাকে এমন বাজে কথা বলতে পারে ভেবে ইমার নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। আরমানের বরাবরই শান্ত মাথায় মানুষকে অপমান করার স্বভাব। রেগে গেলে চেঁচামেচি না করে শান্ত মাথায় অপমান করে। এই অবেলায় ইমা বৃষ্টিতে ভিজেছে শুনে অকারণে রাগ উঠে যায় আরমানের তাই এভাবে কথা শুনিয়ে দেয়।

আরমান আগের মতো রাগ চেপে রেখে বললো, কী হলো কথা বলছিস না কেনো ? নাকি ভেবেছিলি বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হলে বাড়ির কাজ করতে হবে না। শুন তুই যদি অসুস্থ হয়ে পঁচেও মরিস তাহলেও এই বাড়িতে কেউ নেই তোকে দেখার। তাই অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজা বন্ধ কর।

কথাটা শেষ করে আরমান বড় বড় কদম ফেলে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। ইমা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ফ্লোরের পানি মুছার ব্যবস্থা করে। মণি এসে দেখলে হয়তো আবার নতুন কোনো শাস্তি পেতে হবে।

—-
কারো সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলে আরমানের অতীতে বিচরণের পালা শেষ হয়। বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে পিয়ন।

আরমান বিরক্ত হয়ে বললো, আকবর তুমি এভাবে দৌড়াচ্ছো কেনো ? এটা কী দৌঁড়ানোর জায়গা ?

আকবর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, স্যার মাফ কইরা দেন দেখি নাই, আমার তারা আছে যাইতে হইবো।

আকবর যেতে চাইলে আরমান বাঁধা দিয়ে বলে, তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো আর দৌড়ে কোথায় যাচ্ছো তুমি ?

আকবর ব্যস্ত গলায় বললো, স্যার সময় নাই ইশান ভাইকে খবর দিতে হইবো। নিচে হল রুমে কয়েকটা গুন্ডা মতোন ছেলে ইশান ভাইয়ের বড় আপুরে আটকাইয়া রাইখা কী সব বলতাছে। হেই অনেক কানতাছে স্যার, আমার যাইতে হইবো নাহলে দেরি করলে খারাপ কিছু হইয়া যাইতে পারে।

আরমান চমকে উঠে বললো, ইশানের বোন মানে ইয়ানার কথা বলছো তুমি ?

আকবর ইশানের নাম জানলেও ইয়ানার নাম জানে না। শুধু ইশান ভাইয়ের বড় আপু হিসাবেই চেনে ইয়ানাকে। তাই আরমানের প্রশ্নের উত্তরে বললো, জি স্যার এইটাই মনে হয় নাম।

আরমান ব্যস্ত স্বরে বললো, ওহ্ নো।

আকবর কিছু না বুঝে আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে আর আরমান কিছু না ভেবে উল্টো ঘুরে হলরুমের দিকে দৌড় দিলো।

আকবর সেদিকে অবাক হয়ে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে ইশানকে বলার জন্য দৌড় লাগালো।

ফ্লোরে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে ইয়ানা শাহিদ বিশ্রি হেঁসে ইয়ানার ওড়না ধরলো নিচু হয়ে। হিজাব পরে ওড়নাটা ভাজ করে একপাশে দিয়ে রেখেছিলো, তবু ইয়ানা ওড়না আঁকড়ে ধরলো দু’হাতে।

ইয়ানা কাঁদতে কাঁদতে বললো, প্লিজ আমার কোনো ক্ষতি করবেন না আমি আপনাদের পায়ে পড়ছি ভাইয়া।

বাইরে ঝুম বৃষ্টি ইয়ানার কান্না এই পাঁচ জানোয়ার ছাড়া আর কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না। সবগুলো কুৎসিত হাসিতে উপভোগ করছে অসহায় মেয়েটার কান্না। শাহিদ ওড়না টান দিবে তার আগেই দরজায় কেউ সজোরে লাথি মারলো। সেই শব্দে সবাই সেদিকে তাকালো। শাহিদ একহাতে ইয়ানার ওড়না ধরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আরমান আর একবার লাথি মারতেই দরজা ভেঙে গেলো। মনে হচ্ছে রাগে আরমানের শরীরে সাতজনের শক্তি ভড় করেছে। আরমান দরজা দিয়ে ভেতরে আসতেই চোখ পড়লো ইয়ানার ওড়না ধরা শাহিদের হাতে দিকে। রাগে কপালের রগ ফোটে উঠলো। ঠান্ডা মাথায় অপমান করার মতো অবস্থা এখন আর নেই, এতো পরিমাণ রেগে গেছে। শাহিদ বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। আরমান দুকদম এগিয়ে এসে এক ঝটকায় ইয়ানার ওড়না ছাড়িয়ে নিলো শাহিদরে হাত থেকে। এতে শাহিদ রেগে গিয়ে এগিয়ে এলো আরমানের দিকে।

আরমানের কলার চেপে ধরে বললো, এই কে রে তুই আমার কাজে নাক গলাচ্ছিস ?

আরমান নিজের কলারে দিকে তাকিয়ে আউট অব কন্ট্রোল হয়ে গেলো রাগে। ছেলেরা সব সহ্য করলেও কলারে হাত সহ্য করতে পারে না, এতে শান্ত ছেলেটাও রেগে যায় আর সেখানে আরমান আগে থেকেই রেগে বম হয়ে আছে। আরমান মুখে কিছু না বলে হাতটা মুচড় দিয়ে ধরে সজোরে লাথি বসিয়ে দিলো শাহিদের পেটে। শাহিদ ছিটকে দূরে সরে মাটিতে পরে গেলো আর পেট চেপে কাতরাতে লাগলো। ইয়ানা দেয়াল ধরে ধীরে ধীরে দাঁড়ালো। এখনো ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে ইয়ানার। শাহিদকে মারতেই সাথের চারজন তেড়ে আসতে লাগলো আরমানের দিকে। আরমান আশেপাশে তাকিয়ে এখানে অনুষ্ঠান হলে সাজানো জন্য যে স্টিলের কাঠামো ব্যবহার করা হয়ে সেগুলোর একটা লম্বা পাত দেখতে পেলো। দ্রুত সেটা উঠিয়ে সবকটাকে পিটাতে লাগলো, নিজের ভেতরের সব রাগ উগ্রাতে লাগলো। সবকটা ফ্লোরে পরে ছটফট করছে আর চিৎকার করছে কিন্তু আরমানের সেদিকে হুশ নেই। তখনই দৌড়ে রুমে প্রবেশ ইশান আর তার বন্ধুরা। রাগে ইশানের চোখ মুখও লাল হয়ে গেছে। ইয়ানাকে দেখে দৌড়ে তার কাছে গেলো।

ইশান ব্যস্ত হয়ে ইয়ানার হাত-পা চেক করতে করতে বললো, আপু ঠিক আছিস তুই ?

ইয়ানা কোনো মতে ইশারায় বুঝালো সে ঠিক আছে। ইশান এবার রেগে তাকালো সামনে আরমান তখনও মেরে যাচ্ছে ওদের। ইশানও দাঁড়িয়ে না থেকে মারতে শুরু করলো, ইশান ইচ্ছে মতো লাথি মেরে যাচ্ছে। অবস্থা খাবাপ বুঝতে পেরে ইশানের বন্ধুরা ইশানকে জোর করে সরিয়ে আনলো৷ ইতিমধ্যে অনেক প্রফেসর চলে এসেছে আরমানকেও কয়েকজন মিলে টেনে সরিয়ে আনলো জোর করে। দু’জনকেই আঁটকে রাখা দায় হয়ে পড়ছে।

সবাই বলছে, আর মারলে মরে যাবে তখন ঝামেলা হয়ে যাবে।

সবগুলোর অবস্থা করুন, নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছুটে গেছে। আরমান রেগে এক ঝটকায় সবার বন্ধন থেকে নিজেকে ছারিয়ে নিলো। ইশানও নিজেকে ছাড়িয়ে বোনের কাছে গিয়ে ইয়ানার মাথা নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। ইয়ানা শুধু ইয়াদের কলিজা নয় ইশানেরও প্রাণ। আর সেখানে কেউ আঘাত করতে চেয়েছে সেটা কীভাবে মেনে নিবে ?

আরমান রেগে হুংকার ছেড়ে বললো, এই রাস্কেল গুলো ভার্সিটিতে ঢুকলো কী করে ? এটা কী কোনো ক্লাব যে রাস্তার কুকুরও ঢোকে পরবে ?

আরমানের হুংকারে শুধু স্টুডেন্ট নয় উপস্থিত প্রফেসররাও ভয়ে কেঁপে উঠলো। আরমানকে কেউ কিছু বলতেও ভয় পাচ্ছে । তখনই প্রিন্সিপাল এসে উপস্থিত হলো।

আরমানের দিকে তাকিয়ে বললো, এখানে এতো গ্যাঞ্জাম কিসের আরমান ?

আরমান রেগে শাহিদের চুলের মুঠি ধরে একটু উঁচু করে প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখিয়ে বললো, স্যার বাইরের এই কুকুরগুলো ভার্সিটির ভেতরে ঢুকে আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট ইয়ানার উপর আক্রমন করেছে। আমি জানতে চাই এরা এখানে ঢুকলো কী করে ? প্রত্যেকটা গেইটে সিকিউরিটি গার্ড আছে তারা কী করে সারাদিন ? আজ আমি ঠিক সময়ে না আসলে ইয়ানার সাথে কী হতে যাচ্ছিলো বুঝতে পারছেন স্যার ?

শেষের কথা আরমান অনেকটা রেগে বললো তাতে প্রিন্সিপাল গম্ভীর গলায় বললো, আরমান তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি তোমার স্যারের সাথে কথা বলছো ?

আরমান রাগ কিছুটা কন্ট্রোল করে বললো, স্যার আমি ভুলে গেলেও আপনি মিস ইয়ানার পরিচয়টা ভুলবেন না। মিস্টার আবরার হামিদ ইয়াদ যদি আপনার কাছে তার বোনের সিকিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে কী উত্তর দিবেন সেটা মনে রাখেন।

ইয়াদের কথা শুনেই প্রিন্সিপালের গলা শুকিয়ে গেলো। ইয়াদের কোম্পানি থেকে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা ডোনেশন পায় এই ভার্সিটি। সেটাও শুধু ইয়ানার জন্য।

আরমান আবার বললো, যেখানে মিস্টার আবরার হামিদ ইয়াদের বোনের কোনো সেফটি নেই সেখানে তাকে রাখবে তো ?

ইশান চুপ করে দাড়িয়ে আছে কারণ তার যা বলার ছিলো সব আরমান বলে দিয়েছে। সে ইয়ানাকে সামলাতে ব্যস্ত। এদিকে প্রিন্সিপালের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো আরমানের কথা শুনে। ইয়াদকে সে ভালো করে চেনে, ইয়ানাকে নিয়ে এসে প্রথম দিনই তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে ইয়ানা কোনো কমপ্লেন করলে এই ভার্সিটির বারোটা বাজাতে তার দুমিনিটও লাগবে না। ইয়াদ সেদিন জাহিদের ঘটনার পরও প্রিন্সিপালকে ভদ্র ভাষায় ভয়ংকর হুমকি দিয়েছিলো।

আরমান ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে রাগি গলায় বললো, কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করার থেকে নিজেকে নিজে রক্ষা করতে শিখো।

আরমান কথাটা বলে আবার শাহিদকে একটা লাথি মেরে বের হয়ে যায় হলরুম থেকে। ইয়ানা এখনো ইশানের বুকে লুকিয়ে আছে বলা চলে, ভয়টা এখনো কাটেনি তার। ইশান চিন্তা করছে ভাইয়া এসব জানতে পারলে কী করবে ? ইশান বেশ বুঝতে পারছে তার কপালেও খারাপ কিছু আসে। ইশান ভার্সিটিতে থাকা সত্ত্বেও ইয়ানা এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে পরে সেটাই উত্তর চাইবে।

প্রিন্সিপাল সবাইকে যার যার ক্লাসে যেতে বলে আর ইশানের দিকে এগিয়ে এসে বলে, তোমার ভাইয়াকে এসব জানানোর প্রয়োজন নেই আমি এদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করছি আর যাদের সাহায্যে ভার্সিটিতে ঢুকেছে তাদেরও কঠিন শাস্তি দেবো আমি।

ইশান কঠিন গলায় বললো, আমি না বললেও ভাইয়ার কাছে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না, এই সব ঘটনা।

ইশান ইয়ানাকে নিয়ে বের হয়ে আসে আজ আর ক্লাস করা হবে না। ইয়ানা গাড়িতে উঠে বললো, ভাইয়াকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

ইশান অবাক হয়ে বললো, কিন্তু আপু ভাইয়া পরে জানতে পারলে আমার খবর করবে।

ইয়ানা বললো, কিছু হবে না।

ইশান আর কথা বাড়ালো না গাড়ি স্টার্ট দিলো বাসায় যাওয়ার জন্য। ইশান মনে মনে কিছু ঠিক করে নিলো। এদিকে আরমান নিজের কেবিনে বসে চেয়ারে হেলানো দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাগ কামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছে না। বারবার শাহিদের হাতে ইয়ানার ওড়না চোখের সামনে ভাসছে সেই দৃশ্য। আরমান টেবিলের ঠান্ডা পানির গ্লাসটা ঢকঢক করে শেষ করে দিলো।

২৫.
টেবিলের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে ইয়াদ ৷ কিছুতেই মাথাটা সোজা রাখতে পারছে না। চোখ দুটো অসম্ভব জ্বালা করছে। রনিত নক করলে ইয়াদ মাথা তুলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে আসতে বললো। রনিত ইয়াদের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো ইয়াদের পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে তবে দেখে মনে হচ্ছে না রেগে থাকার জন্য।

রনিত ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনি ঠিক আছেন ?

ইয়াদ গম্ভীর গলায় বলার চেষ্টা করলো, আমি একদম ঠিক আছি আমার আবার কী হবে ?

রনিত বললো, স্যার আপনার চোখ মুখ অতিরিক্ত পরিমাণ লাল হয়ে গেছে। চোখ দেখে মন হচ্ছে রক্ত বের হবে এখনই।

ইয়াদ রেগে বললো, রনিত তুমি সবসময় বেশি কথা বলো কেনো ? ফাইলটা রেখে চলে যাও।

রনিত ভয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে আসে আর ইয়াদ নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগলো সঠিকভাবে কাজ করার।

——
ইমার হঠাৎ মনে পরে যায় বিয়েতে মায়ের দেওয়া সেই গিফটের বাক্সটা গ্রহণ করলেও খোলে দেখা হয়নি। সেটা খুলে একটা চিঠি পেয়েছে ইমা যেটা পরে চোখের বাঁধ ভেঙে গেছে ইমার। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ সন্তান মনে হচ্ছে ইমার কাছে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু সেটা যে এখন আর সম্ভব নয় কোনোদিন। একবার যদি অভিমান ভুলে তখন গিফটটা দেখতো হয়তো মাকে জড়িয়ে কাঁদার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারতো ইমা।

চলবে,,,,
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here