তুমি আমার প্রাণ পর্ব -০১

বলো তো রিশা মামুনি তুমি কার কাছে থাকতে চাও….বাবা নাকি মা…?

চারিদিকে সবুজ মাটে ঘেরা একটা সুন্দর গ্রাম নাম আনন্দপুর।ফসলি জমির মাঝ দিয়ে একটা পথ চলে গেছে সোজা শহরে। পথের চারপাশে বসতি ঘরবাড়ি। সেই বাড়ি গুলোর মধ্যে একটা বাড়ির মধ্যে আজকে সন্ধ্যায় বিচার সভা বসেছে। উপরের প্রশ্নটি করা হয়েছে একটা চার বছরের ছোট মেয়েকে।যার এই দুনিয়া সম্পর্কে এখনো কোনো ধারণা নেই। মেয়েটির নাম রিশা। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। অনেক আদরের তবে সেই আদর ভালোবাসা বেশিদিন ঠিকলো না। এই বয়সেই বাবা মায়ের বিচ্ছেদ দেখতে হচ্ছে। বাবার নাম মজিদ মিঞা। মা সাহেরা বানু। মজিদ মিঞা আর সাহেরা বানুর সংসার জীবন ৬ বছর পার হয়েছে তাও তাদের মধ্যে নেই কোনো মনের ভাব। সংসার প্রিয় সাহেরা বানু অনেক চেষ্টা করেছেন সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু মজিদ মিঞা ছিলেন পরনারীতে আসক্ত। তবে মজিদ তার মেয়ে বলতে পাগল। মজিদ দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছেন সেলিনা নামের এক মহিলাকে। ১ বছর বিয়ের কথা লুকিয়ে থাকলেও সেলিনা বেগমের কুটিলতার ফলে বেশিদিন আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সাহেরা বানু এটা মানতে পারেনি তাইতো আজ তাদের বিচ্ছেদ। এটা নিয়ে মজিদ মিঞার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

আমি বাবা-মা দুজনের সাথেই থাকবো

রিশার উত্তরে গ্রামের মাতব্বর আকবর বিচার সভার অন্যদিকে দিকে তাকান।

মজিদ মিঞা দাঁড়িয়ে ছিলেন।এবার তিনি বললেন

মেয়ে আমার সাথেই থাকুক।

মানতে পারলেন না সাহেরা বানু। তিনি মেয়েকে তার সাথে নিয়ে যাবেন বাবার বাড়ি। এতে সেলিনা বেগম ভেংচি কাটেন। মজিদ মিঞা এবং সাহেরা বানু কেউ ই তাদের সন্তান কে ছাড়বেন না। সব শেষে মাতব্বর আকবর জানালেন

মেয়ে তোমাদের দুজনের সাথেই থাকুক। কিছুদিন মজিদ মিঞার কাছে আবার কিছুদিন তার মায়ের সাথে।

সন্তান নিয়ে ভাগাভাগি হয়ে গেলো। বিচার সভায় সাহেরা বানুর বড়ভাই রসুলপুর গ্রামের চেয়ারম্যান মতিন সাহেব ছিলেন। বোনের সংসার টা গুছিয়ে দিতে তিনি চেষ্টা করেছিলেন তবে মজিদ মিঞাকে বেশি পছন্দ না হওয়ায় আর বোনের কথায় তিনি বেশিকিছু না করে বোনকে নিতে এসেছেন। সাহেরা বানু মেয়ে হওয়ার পর থেকে কখনো কোল ছাড়াও করেননি তাই তো রিশাকে ছেড়ে থাকার কথা তিনি মানতে পারলেন না….সংসার বিচ্ছেদের শোকের সাথে মেয়ে ছাড়া থাকার শোক একত্রিত হওয়ায় তিনি ঘরের চৌকাঠে জ্ঞান হারালেন। মতিন সাহেব ছোট বোনকে ভ্যান গাড়িতে তুলে নিয়ে আর বেশিক্ষণ মজিদ মিঞার বাড়িতে থাকলেন না।বিচার সভা শেষ। মাকে মামার সাথে যেতে দেখে রিশা বাধ ভাঙ্গা কান্না শুরু করেছে।মজিদ মিঞা রিশার কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। গ্রামের একটা দোকানে নিয়ে জিনিস কিনে দেওয়ায় রিশা কান্না থেমে গেলো। মজিদ মিঞা মেয়েকে নিয়ে একটু হাটাহাটি করে বাড়ি এসে রাতের খাবারের জন্য রান্না ঘরে গেলেন…মজিদ মিঞার অনেক টাকাপয়সা,, জমিজমা না থাকলেও সংসারে সচ্ছলতা ছিলো। পিতৃ সূত্রে পাওয়া আড়াই বিঘা জমি আর চার কাঠার ওপর বসত ভিটা। দুইটা চৌচালা টিনের শোয়ার ঘর,,একটা গোয়াল ঘর,, রান্নাঘরের একপাশে খাওয়া দাওয়ার ভালো ব্যবস্থা করা আছে,,গোসলখানা এই নিয়ে বাড়িটা।

বিচার শেষ থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সেলিনা বেগম বেশিকিছু না বললেও খাওয়ার সময় মজিদ মিঞাকে বললেন

মেয়েকে তার মায়ের সাথে দিয়ে দিলেই ভালো হতো

মজিদ মিঞা রিশাকে ভাত খাওয়ায় দিচ্ছিলেন। সেলিনা বেগমের এমন কথা শোনায় তিনি রাগান্বিত চোখে সেলিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন

খবরদার আর কখনো এই কথা বলবে না।মেয়ে আমার সাথেই থাকবে। আমার মেয়েকে আমি আলাদা রাখবো না

সেলিনা বেগম একটু ভয় পেলেও মনে মনে ভেবে রাখলেন অন্যের মেয়েকে বেশিদিন তিনি তার সংসারে রাখবেন না।

খাওয়া শেষে মেয়েকে নিয়ে মজিদ মিঞা শোয়ার ঘরে গেলেন। রিশা এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও ঘুমানোর জন্য এখন মাকে খুঁজছে। মা কাছে না থাকলে তার ঘুমই হবেনা…রিশা আবার কান্না শুরু করলে মজিদ মিঞা বললেন

রিশা মা এখন তুমি আমার সাথে ঘুমাও তোমার মা তো এখন নাই। যখন তোমার মা থাকবি তখন মায়ের সাথে ঘুমাইও।

মজিদ মিঞা মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকলেন।অনেকক্ষণ কান্নার পরে রিশা ঘুমিয়ে গেলে মজিদ মিঞাও চোখ বন্ধ করলেন।সেলিনা বেগম থালাবাসন গুছিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে আসলেন।বিছানায় রিশাকে দেখে মনে মনে বেশ রেগে গেলও প্রকাশ করলেন না।মজিদ মিঞাকে একটু ভয় পাওয়ার কারনে একটু চুপচাপ থেকে নিজেও মজিদ মিঞার পাশে শুয়ে পরলেন।

অন্যদিকে,,মতিন সাহেব বোনকে বাড়িতে নিয়ে ডাক্তার ডেকে আনলেন।ডাক্তার কিছু ওষুধ আর ঘুমের একটা ইনজেকশন দিয়ে চলে গেলেন। মতিন সাহেব একমাত্র বোন হওয়ায় সাহেরা বানুকে খুব স্নেহ করেন।মতিন সাহেবের বউ মুর্শিদা শান্ত প্রকৃতির একজন মানুষ। বড় এক ছেলে বয়স ১৪ বছর আর ১০ বছরের এক মেয়েকে নিয়ে তিনি সুখেই সংসার করছেন। স্বামী মতিন সাহেবের মতো তিনিও বোন সমতুল্য ননদকে ভালোবাসেন। কেননা সাহেরা বানু একমাত্র ভাইয়ের বউকে কখনো কোনো কিছু নিয়ে জ্বালাতন করেননি যতদিন ভাইয়ের সংসারে থাকছেন। মতিন সাহেব এবং মুর্শিদা চিন্তিত রিশাকে নিয়ে। ছোট একটা বাচ্চা কতক্ষণ মাকে ছাড়া একা থাকবি আর সাহেরা বানুই বা কতক্ষণ চুপ থাকবেননি। তারা শঙ্খায় আছে সকালে সাহেরা বানু মেয়েকে কাছে না পেলে কি করবে। দুজনেই বোনকে ঘরে রেখে নিজেদের ঘরে গেলেন ঘুমানোর জন্য। রাত তো অনেক হয়েছে। ছেলে তাশরিফ আর মেয়ে তানিয়া অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।

মতিন সাহেবের বাড়ি আনন্দপুরের পাশের গ্রাম রসুলপুরে।মতিন সাহেব একজন উচ্চ বংশের ছেলে সাথে রসুলপুর গ্রামের চেয়ারম্যান। বাবার কথায় বোনের বিয়েতে কোনোকিছু না ভেবে বোনকে বিয়ে দিয়েছিলো তাদের থেকেও নিম্ন এক ছেলের সাথে। বিয়ের আগে মজিদ মিঞা সুপাত্র রুপে থাকায় সাহেরা বাবুর সুখ নিয়ে কোনো সন্দেহ কারোই ছিলো না। তবুও ভাগ্যগুনে সাহেরা বানু আজ একা হয়ে গেলেন।

সকালবেলা রিশা ঘুম থেকে উঠে মাকে পাশে না পেয়ে কান্না শুরু করে আবার। মজিদ মিঞা অনেক কৌশলে কান্না থামিয়ে সেলিনা বেগমের কাছে রিশাকে রেখে মাঠে গেছেন গরু নিয়ে। বাবা চলে যাওয়ার পর রিশা মা মা বলে আবার কান্না শুরু করে।

তোর মা আমার সংসার থেকে চলে গেলেও আরেক আপদ আমার রেখে গেলো কোন দরকারে। এখন একদম মা মা করবি না। চুপ কর।

সেলিনা বেগমের ধমকে রিশা ভয় পেয়ে আরো জোরে কান্না শুরু করে। এতে সেলিনা রেগে রিশার পিঠে চিকন কঞ্চির দুইটা বাড়ি দেয়।মজিদ মিঞা কাছে নেই বলে কালকের রাগ আজ রিশার ওপর উশুল করলেন।ছোট রিশা ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মা বলে চিৎকার করে উঠলেন।মজিদ গরু মাঠে রেখে বাড়ির দিকেই আসছিলেন। মেয়ের আর্তনাদ শুনে দৌড়ে বাড়ি এসে দেখেন রিশা উঠানে উপুড় হয়ে পরে থেকে কাঁদছে। এটা দেখে মজিদ মিঞা সহ্য করতে পারলেন না। ছোট মেয়েকে মজিদ আর সাহেরা অনেক আদর দিয়েছেন। মজিদ মিঞাকে দেখে সেলিনা বেগম ভয় পেয়ে গেলেন।

আমার মেয়ের কি হয়েছে…?

ওর মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাহিরে যাওয়ার সময় পরে গেছে।

মজিদ মিঞা আর কিছু না জিজ্ঞেস করে রিশাকে নিয়ে বসলেন ঘরের চৌকাঠে। অনেক চেষ্টার পর কান্না থামলে রিশা মজিদ মিঞার গলা জরিয়ে ধরে বাবার ঘাড়ে মাথা দিয়ে চুপ করে থাকে।

রসুলপুর চেয়ারম্যান বাড়িতে সকালবেলা আবারও ডাক্তারের আগমন। সাহেরা মেয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। না খেয়ে থাকার ফলে শরীর অতিরিক্ত দূর্বল হয়ে পরেছে।

দুপুরে মজিদ রিশাকে গোসল করানোর সময় পিঠে যখন দুইটা লাল ফুলে উঠা দাগ দেখতে পেলেন তখন তিনি পাগলপ্রায়। রিশাকে জিজ্ঞেস করলে রিশা বলে

ছোট মা মেরেছে লাঠি দিয়ে।

সেলিনা ঐ সেলিনা এখানে আয়।

মজিদ মিঞার ডাকে সেলিনা গোসলখানায় গেলে মজিদ মিঞার হাতে একটা চিকন কঞ্চি দেখতে পায় যেটা দিয়ে সে রিশাকে মেরেছে। মজিদ মিঞা সেলিনাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে সপাৎসপাৎ করে কয়েকটা বাড়ি দেন।

বল আর কখনো আমার মেয়েকে মারবি বল।তুই কিভাবে পারলি মারতে আমার ফুলের মতো মেয়েকে। আজকে তোকে আমি মেরে ফেলবো।

সেলিনা বেগমের চিৎকার আর বাবার রাগ দেখে ছোট রিশা ভয় পেয়ে যায় অনেক। গোসলখানার এককোণে বসে পরে। অতিরিক্ত ভয়ে একসময় রিশাও জ্ঞান হারায়।

মজিদ মিঞা যখন রিশার দিকে তাকায় তখন মেয়েকে নেতিয়ে যেতে দেখে মেয়েকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের দোকানে যায়। এমনভাবে মার খাওয়ার পর সেলিনা বেগম রিশার প্রতি আক্রোশে ফেটে পড়েন।

#তুমি আমার প্রাণ
#পর্বঃ০১
#Mitu- মিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here