তুমি বললে আজ ২ পর্ব -৩০(প্রথমাংশ)

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ৩০ ( প্রথমাংশ)

.
অনুভূতি গুলো ঠুনকো নয়, ভালোবাসাটাও তো মিথ্যে নয়। তাহলে? তাহলে কি কোন খামতি ছিলো? তাসফি ভাইকে ভালোবাসার গভীরতা কি কম ছিলো আমার? চার বছর আগের মতো কিশোরী বয়সের সেই সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতির মতোই কি ভালোবাসাটাও সদ্য জন্ম নেওয়া ছিলো?হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। শব্দ হবার ফলে দু’হাতে মুখ চেপে ধরলাম।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো চার বছর আগের সেই স্মৃতি। ইস্! কিভাবে ভুলে গেলাম আমি সেই দিনের কথা, নিজ কানে শোনা ওনার ও কিয়ানা আপুর কিছু কথা। জানি না, সেদিনের ঘটনা ঠিক কতটা সত্যি ছিলো। এতদিন দূরত্বের ব্যাবধানে সেই দিনটাকে কেন্দ্র করে অভিমান করেছি, ইগনোর করে গেছি। দূরত্বের ব্যাবধান ঘুচিয়ে গেলে সবকিছুই ভুলে গেছি, আপন করে নিয়েছি সেই মানুষটাকে।

.
সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর যখন জানতে পারি, তাসফি ভাইয়া আমেরিকা চলে যাবেন, তখন স্তম্ভিত হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের। ছুটে গিয়েছিলাম ওনার রুমে। কিন্তু ওনাকে রুমে না পেয়ে নিরাশ হয়ে যাই, হতাশ হয়ে ফিরে আসি রুমে। জানতে পারি বাসায় চলে গিয়েছেন। কয়েকদিনের শত চেষ্টা করেও দেখা করতে পারি নি ওনার সাথে, জানতে পারি নি ওনার হঠাৎ চলে যাবার কারণ।
মনের সাথে হাজারো বোঝাপড়া করে, ওনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে করতে কেটে যায় প্রায় দু’সপ্তাহের মতো। এতদিন ওনার সাথে কথা বলার সুযোগ না হলেও ওনার ফ্লাইটের আগের দিন সেই সুযোগটা আসে। সবার চোখের আড়ালে চলে আসি ওনার রুমে। রুমে ঢুকে ওনাকে ব্যাগ গোছাতে দেখে আলগোছে দরজাটা ভিরিয়ে দিয়ে ওনাকে ডেকে উঠি। জবাব দেন না উনি, একমনে জামা কাপড় লাগেজে গুছিয়েই যান। সামনে গিয়ে ওনার হাত টেনে আবারও ডেকে উঠি। উনি মাথা উঠিয়ে হাতটা ছেড়ে নিলেন। নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,

“কি চাই?”

“আপনাকে চাই, আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”

“বলে ফেল, শুনছি।”

“কেন চলে যাচ্ছেন তাসফি ভাইয়া? আপনার তো যাবার কথা ছিলো না?”

“সবসময় যে একটা কথাতেই আটকে থাকতে হবে এমনটাও তো না।”

“কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন যাবেন না, এখানেই পড়াশোনা করবে। তাহলে এখন কেন যাচ্ছেন।”

“বললাম না, সবসময় এক কথাতেই থাকতে হবে নাকি? আমার হচ্ছে হয়েছে তাই যাচ্ছি।”

ওনার খাপছাড়া কথায় মনটা ভার হয়ে উঠলো। তবুও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ওনার কাছে এগিয়ে গেলাম। হাত টেনে আবারও বললাম,
“যাবেন না আপনি। আপনি চলে গেছে আমি কার সাথে সময় কাটাবো তাসফি ভাইয়া?”

“এভাবে ডিস্টার্ব করছিস কেন? বেয়াদব! যা এখান থেকে, কাজ করতে দে আমাকে।”

“প্লিজ তাসফি ভাইয়া আপনি যাবেন না, আপনি চলে গেলে কিছুতেই ভালো থাকতে পারবো না আমি। আপনাকে ছাড়া….”

“তাসফি তোমার প্যাকিং করা হয়েছে? লেট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমাদের।”

অচেনা মেয়েলী কণ্ঠস্বরে কিছুটা চমকে উঠলাম। দরজার দিকে তাকাতেই একটা অপরিচিত মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজা খুলে। কিছুটা এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
“এই মেয়েটা কে তাসফি?”

“আ..আমি ওনার…. ”

“ও আমার মামাতো বোন, রূপা।”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে চট করে বলে উঠলেন তাসফি ভাই। এবার কিছুটা অভিমান এসে ভীর জমালো মনে। আমাদের তো বিয়েও হয়েছে, তাহলে বিয়ের কথাটা বললেন না কেন? ওনার দিকে তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মেয়েটা এগিয়ে এসে বলে উঠলো,
“অনেক মিষ্টি তো দেখতে। আমি কিয়ানা, তাসফির খুব কাছের ফ্রেন্ড।”

তিন অক্ষরের নামটা মনে মনে আওড়াতে লাগলাম। সাথে ভাবতে লাগলাম খুব কাছের ফ্রেন্ড, কিন্তু উনি তো আগে কখনো বলেন নি। আমার চুপ করে থাকার মাঝেই আবারও বলে উঠলো,
“আমরা একসাথেই আমেরিকা যাচ্ছি। ও তো যেতেই চাচ্ছিলো না, তার নাকি নিজের দেশ ছাড়া মন টিকবে না। কিন্তু হঠাৎ কেন যে রাজি হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছি না। তবে অনেক ভালো হয়েছে, বুঝছো রূপা। ওখানে একসাথে সময় তো কাটাতে পারবো।”

কিয়ানা আপুর শেষ কথাটা কানে আসতেই ধুকপুক করে উঠলো বুকে। মনের কোণে উকি দিতে লাগলো নানান কিছু। আমার ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতেই তাসফি ভাইয়া লাগেজ হাতে উঠে দাঁড়ালেন, কিয়ানা আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
“আমার হয়ে গেছে কিয়ানা, চলো এখুনি বের হবো।”

“হ্যাঁ তাসফি চলো। এই যে পিচ্চি, থাকো হ্যাঁ। আবারও দেখা হবে।”

বলেই আর দাঁড়ালো না। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। তাসফি ভাই যাবার জন্য ওনার হাত টেনে ধরলাম। করুন গলায়, ‘প্লিজ যাবেন না’ বলতেই হাত ছেড়ে নিলেন। কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন রুম ছেড়ে। হুট করেই কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হতে লাগলো, চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো বুকে। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মিনিট দশেক পর ফুপির কান্নার আওয়াজ পেলাম, তারপর যখন নিচ থেকে গাড়ির শব্দ ভেসে উঠলো, তখন আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। কান্নার আওয়াজও দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। কিছু সময় যেতেই তাসফি ভাইয়ার রুমে সবাই চলে আসলো আমার কান্নার আওয়াজে। শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো সবাই, জানতে চাইলো কান্নার কারণ। তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু কানানা করে গেলাম, অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,
“কেন চলে গেলেন উনি? ওনার তো যাবার কথা ছিলো না, তাহলে কেন চলে গেলেন উনি?”

.
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেকে শান্ত করে নিলাম কিছুটা। কিন্তু ওনাকে এক নজর দেখার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো না আমার। ওনার একটুখানি ছোঁয়া কি, কথাটাও শুনতে পেলাম। এভাবেই কেটে গেল প্রায় ছয় মাস। এত এত ফোন কল ও মেসেজের উত্তর না পেয়ে রাগে, অভিমানে তিনদিন ওনাকে ফোন কল ও মেসেজ করা বন্ধ করে দেই। কিন্তু নিজের মনের সাথে না পেরে রিফাপুর ফোন নিয়ে আবারও ফোন দেই ওনার নাম্বারে। ঠিক ফোন কল না, ভিডিও কল। রিং হবার শেষ মুহুর্তে যখন আগের মতোই আশা ছেড়ে দিলাম, ঠিক তখনই অবাক করে দিয়ে রিসিভ হলো। অপর পাশে অন্ধকার ছাড়া তেমন কিছুই নজরে এলো না।
চমকে উঠে দুরুদুরু বুক নিয়ে ‘হ্যালো’ বলার আগেই অপর পাশ থেকে ভেসে উঠলো তাসফি ভাইয়ের চিরচেনা সেই অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর।

“পারছি না আমি, কিছুতেই পারছি না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে। তোমাকে এক নজর না দেখে দিনগুলো কাটাতে। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি, এলোমেলো হয়ে হয়ে যাচ্ছে আমার ভাবনাগুলো। তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই রু….”

“তাসফি ভাইয়া…..”

“তাসফি…. এই তাসফি, এই তো আমি। এমন করছো কেন তুমি?”

নারীকণ্ঠ ভেসে আসতেই থমকে গেলাম আমি। স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম ফোনের স্ক্রিনের দিকে। তাসফি ভাইয়া ডাকটা যেন আমার গলাতেই মিলিয়ে গেল। তাসফি ভাই আবারও বললেন,
“পারলাম না আমি, তোমাকে দূরে ঠেলে তোমার শূন্যতা পূরণ করতে কিছুতেই পারলাম না আমি। তোমাকে ছাড়া যে আমি পুরোটাই ব্যার্থ। একটু স্বস্তি পেতে চাই, তোমাকে কাছে পেয়ে একটু ভালো থাকতে চাই।”

“তাসফি, এই তো আমি। তোমার কাছেই তো আছি, যাবো না তো কোথাও। সারাজীবন তোমার সাথেই থাকবো।”

একটু পর আবারও বলে উঠলো,
“ইস্! এমন করছো কেন? আমি তো তোমার কাছেই আছি। আর কতটা কাছে যাবো?”

তাসফি ভাইয়ের কোন সারা এলো না। নিস্তব্ধ রুমে শুধু কিয়ানা আপুর কথাগুলোই ভেসে উঠলো, আপন মনে বলে গেল নানান কথা। আর শুনতে পেলাম না কথাগুলো। একহাতে মুখ চেপে ধরে অপর হাতে কেটে দিলাম ফোন। বিছানায় ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। বারংবার কানে ভাসতে লাগলো তাসফি ভাই ও কিয়ানা আপুর কথোপকথন গুলো। ভালোবাসা জন্ম নেওয়া মনটা ভেঙে গেল সহসায়, সাথে ভেঙে গেল ওনাকে করা বিশ্বাসটুকুও। আম্মু, বড়মা ও রিফাপু ছুটে এলো রুমে। আমাকে সামলানোর চেষ্টা করে জানতে চাইলো হঠাৎ কি হয়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে ওনার কথাটা কিছুতেই বলতে পারলাম না। নিজ মনেই সহ্য করে নিলাম সমস্ত কিছু।

সময়ের সাথে শক্ত করে নিলাম নিজেকে, ভুলে যাবার প্রয়াস চালিয়ে যেতে লাগলাম। ওনাকে ভুলে থাকতে না পারলেও অভিনয় করে যেতে লাগলাম প্রতিনিয়ত। কয়েকদিন পর নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে, হাজারো অভিমান নিয়ে পুরো দমে ইগনোর করে গেলাম ওনাকে। সেই অভিমানের স্থায়িত্বকাল হলো পুরো চার বছর।

.
.
চলবে…..

।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here