#তোকে_দিয়েছি_মন❤
৭.৮
পর্ব – ৭
Writer: Sidratul muntaz
বুড়ির কথা শুনে মহা টেনশনে পড়ে গেলাম আমি। ইচ্ছে করছিল সাদা চুলগুলো টেনে ছিড়ে দেই। তাও যদি একটু শান্তি লাগে। কিন্তু পরমুহুর্তেই মায়ের উত্তর শুনে একটু স্বস্তি আসল মনে। মা বললেন–
না না। এতো অল্প বয়সে আমি তারু কে বিয়ে দিব না মা। এখন তো সবে এইচ এস সি পরীক্ষা দিল মেয়েটা। ভার্সিটির চৌকাঠ মারানোর আগেই বিয়ে হয়ে যাবে??
দাদী মায়ের কথায় ভ্রু কুচকে তাকাল মায়ের দিকে। মায়ের এইরকম উত্তর আশা করেনি বুড়িটা। আমার দিকে একবার তাকিয়ে পান চাবাতে চাবাতে বলে উঠল–
মাইয়া মাইনসের এতো কিয়ের লেখাপড়া আবার?? আর লেখাপড়া তো বিয়ার পরেও করোন যা। মাইনসে করে না?? এতো শিক্ষিত পোলাডার কাছে বিয়া দিলে হেয় কি তোমার মাইয়ারে লেখাপড়া করাইবো না?
মা মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। বুড়ি মায়ের মুখের কাছে এসে আরও উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করে বলল–
পোলার কিন্তু ফ্যামিলি খুব ভালা। নাম ডাক আছে। আমি কই কি…… তারিফের বিয়াত হেগোরে দাওয়াত দেই। তাইলে আমাগো তারু রে দেইক্কা যাওন হইবো। আবার পোলার ফ্যামিলির লগেও পরিচিত হইবো। পছন্দ হইলে তো ভালোই। এমন পোলা কিন্তু হাত ছাড়া করা ঠিক হইবো না। মাইয়ার বাপেরা তো লাইন ধইরা খাড়ায় আছে। তবুও পোলা যদি তোমার এতিম মাইয়া বিয়া করতে রাজি হয়….. হের থেকা ভালা আর কি হইতে পারে?
কথাটা শুনে মা একবার আমার দিকে তাকালেন। আমি চরম বিরক্তিভরা মুখ করে মা কে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি এই বিয়েতে মোটেও আগ্রহী না। মা আমার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করলেন। আচল দিয়ে চোখের কোন টা মুছে নিলেন। আমি জানি মা দাদীর কথায় আঘাত পেয়েছে খুব। ছোটবেলা থেকেই আমাদের কেউ এতিম বললে মায়ের সহ্য হয়না। অনেক ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি……. অথচ বাবার অভাব টা টের পেতে হয়নি কখনো। মা একা হাতেই সংসার সামলেছে। ভাইয়ার অবদানও কম নয়। খুব অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল ভাইয়াকে। ক্লাস এইট থেকে টিউশনি করাতো ভাইয়া। পার্ট টাইম জব শুরু করেছিল ক্লাস টেন থেকে। অনেক টানাপোড়েনের সংসার ছিল আমাদের। এতো অভাবের মধ্যে থেকেও কখনো আমার কোনো চাওয়া অপুর্ণ থাকেনি। ভাইয়া তার রোজগারের বেশিরভাগটাই ঢেলে দিতেন আমার পেছনে। দিনগুলো খুব কষ্টের ছিল….. আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ভাইয়া পাবলিক কলেজে চান্স পাওয়ার পর থেকেই আমাদের সংসারে স্বচ্ছলতার আগমন ঘটে। এখন অনেকটাই স্বচ্ছল আমাদের সংসার টা। ভাইয়া…. মা…. আমি……ছোট্ট এই পরিবারে সুখের কমতি ছিল না কখনোই। এখনো নেই। আশা করি কখনো হবেও না। এক চিলতে হাসি ঠোটে জমিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম আমি। মা খালি শরবতের গ্লাসটা নিতে নিতে দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন–
দেখেন মা। আপনি যদি চেনা পরিচিত হিসেবে তারিফের বিয়েতে তাদের ডাকতে চান তাহলে ডাকেন। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমার তারুর বিয়ে আমি এখন দিব না। মেয়েটা তো নিজেকেই সামলাতে পারে না এখনো। রান্নাঘরে ঢুকলে লবণ চিনি আলাদা করতেও যে মেয়ের তিন মিনিট লাগে…… তাকে কোন ভরসায় আমি বিয়ে দিই বলেন তো?? যে নিজের ওরনাটাও ঠিক করে সামলাতে পারেনা……সে আবার সংসার কি করে সামলাবে ??( একটু থেমে) এসব কথা এখন থাক মা। আমি নিচে খাবার দিচ্ছি। খেতে আসেন। এই তারু! দাদিকে নিয়ে নিচে আয়।
বলেই চলে গেলেন মা। মায়ের উত্তর শুনে আমার তো ইচ্ছে করছে লুঙ্গি ডান্স দিতে। মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। এই না হলে আমার মা!! বেশ হয়েছে বুড়িটার মুখের উপর না করে দিয়েছে। কত্ত বড় সাহস আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর প্ল্যান তাইনা?? এতো সোজা?? ভাইয়া আর মাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো নাকি কোনোদিন??? দম বন্ধ হয়ে আসবে যে আমার!
দাদি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বিড়বিড় করে বলে উঠলেন–
তোর মায় মনে অয় তোরে হারাজীবন শোকেজে সাজায় রাখবার চায়। ভালার লাইগা কইলাম। কতাডা উড়ায় দিল। নবাবজাদী বানায় রাখব মাইয়ারে।
মাজায় হাত রেখে হাটতে হাটতে কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেল দাদি। বিড়বিড় করে বললেও উনার আসল উদ্দেশ্য যে আমাকে খোচা মারা….. সেটা বেশ ভালো করে বুঝতে পারলাম আমি।
.
.
বিছানায় শুয়ে এপাশ অপাশ করছি। বুড়ির নাক ডাকার শব্দে অতিষ্ট হয়ে উঠেছি প্রায়। কান দুটো যেন একটু পরেই খসে পড়বে। সত্যিই কি এইভাবে কেউ নাক ডাকে?? নাকি সবই আমাকে জ্বালানোর ফন্দি?? বুড়ির বিশ্বাস নেই। আমাকে জ্বালানোর যা কিছু করতে পারে বুড়িটা। বালিশ দিয়ে কোনোমতে দুই কান ঢেকে রাখার বৃথা চেষ্টা চালাতে লাগলাম আমি। ঠিক এমন সময় ফোনের ম্যাসেজ টোন টা বেজে উঠল। বিদঘুটে নাক ডাকার শব্দের কাছে ম্যাসেজ টিউন টা খুব সুমধুর মনে হল আমার কাছে। হতে পারে কোনো সিম কোম্পানির কোনো ফালতু ম্যাসেজ। অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা হাতে নিলাম আমি। আমার ধারণা সঠিক হল না। ম্যাসেজ টা এসেছে অচেনা নম্বর থেকে। কিন্তু এই অচেনা নম্বরের মালিকটা কে চিনে উঠতে বেশি সময় লাগল না আমার। ম্যাসেজের প্রথম ওয়ার্ডটা পড়েই বুঝে গেলাম এইটা ইশান ভাইয়া।
উনি লিখেছেন—
তারা,,,
ঘুম আসছিল না তাই ছাদে হাটতে এসেছি। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। যদি জেগে থাকো তাহলে একবার ছাদে আসবে প্লিজ??
এইরকম কিউট একটা ম্যাসেজ ইগনোর করা যায়না। কিন্তু পাশেই যে শুয়ে আছে কুচুটে বুড়িটা। একবার যদি কিছু টের পেয়ে যায়….. আমার ঘুম তো হারাম হবেই….. সাথে বাড়ি শুদ্ধো সবার ঘুম হারাম করে ছাড়বে চেচিয়ে। তিল কে তাল বানাতে তো বুড়ির এক মিনিটও সময় লাগবেনা। তারপর দেখা যাবে পরিবারের সবাই একসাথে ছাদে গিয়ে জোৎস্না বিলাস করছি। কেমন হবে দৃশ্যটা?? বিরক্ত হয়ে মাথার উপর থেকে বালিশটা নামিয়ে রাখলাম আমি। ঘুম তো এমনিতেও আসছিল না….. তার উপর ইশান ভাইয়ার এমন একটা ম্যাসেজ। ঘুমের যে তেরোটা বেজে গেছে সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এখন বুড়িটা আসলেই ঘুমাচ্ছে নাকি সেই বিষয়েও নিশ্চিত হয়ে নেওয়া জরুরি। বেঘোরে নাক ডাকছে বলেই যে বুড়ি ঘুমে বিভোর….. এই কথা চিন্তা করাও বোকামি। আমাকে বিব্রত করার জন্যেও নাক ডাকার নাটক করতে পারে বুড়িটা। আমার এই ধারণা কতটা সঠিক সেইটা বোঝার জন্য বুড়ির মাথার কাছে গিয়ে হালকা শব্দ করলাম আমি–
এই বুড়ি!
……. (নো রেসপন্স)
আমি আবার ডাকলাম– বুড়ি! বু—ড়ি! ( ব্যঙ্গ করে)
কিন্তু এবারও কোনো সাড়া পেলাম না। তাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে বুকে হাত দিয়ে ধপ করে বসে পরলাম। মনে হচ্ছে খুব বড় একটা বিপদ থেকে বেচে ফিরেছি। আমি বুড়িকে বুড়ি বলে ডাকব….. আর সেটা বুড়ি চুপচাপ হজম করে নেবে…. কোনো উত্তর দিবে না, এমন টা তো স্বপ্নেও হতে পারে না। ইম্পসিবল। বরং এতোক্ষনে তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম কিছু যেহেতু হয়নি….. তার মানে বুড়ি আসলেই ঘুমাচ্ছে। মুখ টিপে এক গাল হেসে নিয়েই বিছানা ছেড়ে নেমে গেলাম আমি। পা টিপিয়ে টিপিয়ে খুব সাবধানে রওনা হলাম ছাদের উদ্দেশ্যে।
.
.
ইশান ভাইয়া ছাদের কার্নিশ ধরে দাড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঘুরে আমাকে দেখতে পেয়েই অনেকটা চমকে উঠলেন উনি। সেই সাথে উনার চোখমুখ টাও উজ্জ্বল হয়ে উঠল কয়েক মুহুর্তে। আমি যে সত্যিই চলে আসবো এটা হয়তো আশা করেনি সে। ইশান ভাইয়া নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন চোখ দিয়েই গিলে খেয়ে ফেলবে। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। লজ্জা লাগছে প্রচুর। আগে উনাকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখলে রাগ লাগতো….. কিন্তু এখন কেনো জানি লজ্জা লাগে। শুধু লজ্জা না….. মারাত্মক রকমের লজ্জা। লজ্জায় রীতিমতো মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা এখন যদি আমি উনাকে জড়িয়ে ধরে উনার বুকে মুখ লুকাই?? তাহলে কেমন হয়?? শকের উপর ডাবল শক খেয়ে যাবেন উনি। কিন্তু লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সেই কাজটা আমি কিছুতেই করে উঠতে পারবো না। আমার ভাবনার জগৎ ছিন্ন করে হঠাৎ ইশান ভাইয়া আমাকে পাজাকোলা করে নিয়ে হাটতে লাগলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় মুখ টা হা হয়ে গেল আমার। ছটফট করে কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই আমাকে দেয়ালের উপর বসিয়ে দিলেন উনি। আমি উনার কান্ড কারখানা কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি আবার আমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিবে না তো?? অবশ্য এই দুই তলা থেকে পড়ে গেলে তেমন কিছুই হবে না আমার। তবুও ভয় লাগছে।
#তোকে_দিয়েছি_মন❤
পর্ব – ৮
Writer: Sidratul muntaz
ইশান ভাইয়া আমার পা গুলি একটু উচু করে ধরলেন। এতে যেন আমার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। ছোটবেলা থেকেই হাতে পায়ে খুব সুড়সুড়ি আমার। কেউ পায়ে হাত দিলেই ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠি। কিন্তু এখন তো লাফানো যাবেও না…… সেইসাথে নড়াচড়া করাও আমার জন্য নিষিদ্ধ। যেখানে দেয়াল খামচে ধরে ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে আমাকে….. সেখানে নড়াচড়ার তো প্রশ্নই আসেনা। তবুও আমার পুরো শরীর অটোমেটিক নড়ছে….. মানে কাপছি আমি। আর আমার পা গুলোও যেন পাল্লা দিয়ে দিগুন গতিতে কাপছে। ইশান ভাইয়া পা দুটো এমনভাবে ধরে রেখেছেন যে আমি না পারছি সহ্য করতে আর না পারছি কিছু বলে উঠতে। পায়ে খুব সুড়সুড়ি লাগছে সেই সাথে উনার উষ্ণ হাতের স্পর্শে অন্যরকম একটা শীহরণ অনূভুত হচ্ছে। চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর হঠাৎ ইশান ভাইয়ার মুখে কথা ফুটল। সেইসাথে আমার মনে জমে থাকা অস্বস্তির পাহাড়টাও যেন নেমে গেল। ইশান ভাইয়া বললেন–
তোমার পা গুলো আমাকে দিবে প্লিজ??
উনার কথার কি উত্তর দিব বুঝতে পারলাম না। সেইসাথে এইটাও বুঝতে পারলাম না যে আমি ঠিক শুনেছি কিনা। উনি কি সত্যিই আমার কাছে পা চাইছেন?? কথার মাথামুণ্ডু খুজে বের করতে না পেরে যখন আমি হাবার মতো তাকিয়ে রইলাম ঠিক তখনি উনি বলে উঠলেন–
কারো পায়েও এতো সৌন্দর্য্য থাকতে পারে?? কিভাবে তারা?? মনে হচ্ছে এ যেন কোনো জীবন্ত চিত্রকর্ম। চিত্রশিল্পী তার মনের মাধুরি মিশিয়ে খুব যত্ন করে একে রেখেছেন। যার প্রতিটা ভাজে ভাজে আছে শুধু মুগ্ধতা।
নিষ্পলক ভাবে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো বলছেন উনি। কেউ আমার পায়ের প্রসংশা এইভাবে করছে ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগছে আমার। উনার কথার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে কখন যে দেয়াল ছেড়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছি সেটাও টের পাইনি আমি। কিন্তু যেই মুহুর্তে বিষয়টা উপলব্ধি হল ওমনি দেয়াল খামচে ধরে নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ইশান ভাইয়া হয়তো বিষয়টা কিছু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন। তাই টুক করে আমার পা গুলো টেনে উনার কোলে নিয়ে বসলেন। এতে যেন আমি আরও অনেকটা অবাক হলাম। যদিও প্রথম দিন থেকেই নতুন নতুন উপায়ে আমাকে অবাক করে চলেছেন তিনি। উনার সেই অবাক করার উপায় দিনকে দিন যেমন আপগ্রেড হচ্ছে আমার অবাক হওয়ার মাত্রটাও যেন পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছে না…… উনার পাগলামি তে আমি হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি বারবার। এতোটা পাগলামি কি করে করে মানুষ?? আমার পা গুলো উনি এমন ভাবে উনার কোলে রেখেছেন যেন মনে হচ্ছে আমি উনাকে লাথি দিচ্ছি। ব্যপারটায় উনার কেমন ফিল লাগছে জানিনা কিন্তু আমি যে চরম অস্বস্তিতে ভুগছি। আমি যত পা টেনে সরিয়ে নিতে চাইছি ততই উনার স্পর্শ শক্ত হয়ে আসছে। আবার বেশি জোরে টানতেও পারছি না কারণ পড়ে যাওয়ার ভয় আছে আমার। মনে হচ্ছে মহা মুশকিলে ফেসে গেছি। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই উনার শান্ত দৃষ্টিতে ঘায়েল হয়ে চুপ করে যেতে হল আমায়। ইশান ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আমাকে এখন খুব জরুরি কিছু বলবেন। আমার ধারণাকে সঠিক করে দিয়ে এবার মুখ খুললেন ইশান–
তুমি কি জানো তারা?? আমি তোমাদের শহরে এই নিয়ে কয়বার এসেছি??
উনার কথায় কনফিউজড হলাম আমি। এইরকম প্রশ্ন কেনো করছে ইশান?? সে তো এই প্রথমবারই আমাদের শহরে আসল। মনের কথাটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলাম আমি–
আপনি তো এই প্রথম বার আমাদের শহরে আসলেন। তাহলে একবার!( ভ্রু কুচকে)
উনি না সুচক মাথা নাড়লেন।
ভুল। আমি আগেও একবার এসেছিলাম। প্রায় দুই বছর আগে। কিন্তু তোমার সাথে দেখা হয়নি।
কথাটা শুনে অটোমেটিক আমার হাত মাথায় চলে গেল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে উঠলাম–
আরও একবার এসেছিলেন??
হুম
তাহলে আমার সাথে দেখা হল না কেনো?? আর আমি আপনাকে চিনি না কেনো?? মা ভাইয়া একবার হলেও তো বলতেন আমাকে আপনার কথা। কই কখনো তে বলেনি। আর আমার কাছে বিষয় টা গোপন করারও কোনো কারণ নেই….. আপনাকে দেখার তো সবথেকে বেশি ইচ্ছা আমারই ছিল। ভাইয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মায়ের কাছে শুধু আপনার গুণগানই করে। সেই গল্প শুনতে শুনতে আপনি হয়ে গিয়েছিলেন আমার কাল্পনিক চরিত্র। মনে মনে আপনাকে কল্পনা করতাম আমি। কত বলেছি আপনার একটা ছবি তুলে আনার জন্য……. কিন্তু ভাইয়া কথা কানেও নেয়নি। যেখানে চার বছর ধরে আপনার গল্প শুনে কল্পনার জগৎ সাজিয়ে আপনাকে দেখার আশায় হাপিত্যেশ করে মরছি আমি….. সেখানে আপনি দুই বছর আগে আমাদের বাসায় এসেছিলেন এইটা মা বুঝি আমায় বলবে না……
কথাগুলো বলতে বলতে এক পর্যায় থেমে গিয়ে জিহ্বা কাটলাম আমি। উফফ আমার মুখটা রেলগাড়ির থেকেও ফাস্ট । একবার ছুটতে শুরু করলে আর থামার নাম নেই। কি বলতে কি বলে ফেললাম……. একদম পেটের ভেতর যা ছিল সবই যেন বদহজমের মতো বেরিয়ে আসল এক নিমেষে। ইশান ভাইয়ার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। উনি কোন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা আন্দাজ করতেও লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসছে আমার। চার বছর ধরে ভাইয়ার মুখে গল্প শুনেই যে উনার উপর আমি ক্রাশড…… এই বিষয়টা কি অনায়াসে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল আমার। জীবনের প্রথম ক্রাশটাই তো ছিলেন উনি। তাও আবার কাল্পনিক ক্রাশ। যার মুখটা মনে মনে কল্পনা করেই কারণে অকারণে ক্রাশ খেতাম আমি। চার বছর ধরে কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখার পর সেই স্বপ্ন বাস্তব রুপ ধারণ করল ঠিক ভাইয়ার গায়ে হলুদের দিন। আমার অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আমার কল্পনা কে বাস্তবের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ হল। কিন্তু কল্পনার থেকেও বাস্তব টাও যে হাজার হাজার গুন সুন্দর হতে পারে সেটা সত্যিই আমার কল্পনাতীত ছিল। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। জীবনের সব থেকে বড় সারপ্রাইজ হয়তো সেদিনই পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু পরবর্তীতে উনার অদ্ভুত আচরণে একটু বিব্রত হয়েছিলাম তা ঠিক!! আসলে আমি এক্সপেক্টই করতে পারিনি যে উনিও আমাকে পছন্দ করবেন। প্রথম প্রথম উনার আচরণ গুলো আমার খারাপ ইঙিত মনে হতো। ভাবতাম ভাইয়া হয়তো এতোদিন উনার সম্পর্কে বেশিই বাড়িয়ে বলেছেন। উনি আসলে এতোটাও ভদ্র না যতটা ভাইয়া মনে করেন। বরং আমার চোখে উনি একটা চরম অভদ্র হিসেবে প্রকাশ পেতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই ধারণাটাও মিথ্যে হল আমার। আমার কল্পনার চরিত্রের থেকেও উনার বাস্তব চরিত্র টা আরো অনেক বেশি সুন্দর। ঠিক যেমন কাল্পনিক চেহারা হার মেনেছে বাস্তব চেহারার কাছে! ঠিক তেমনি। লাজুক হাসিতে মত্ত হয়ে এক হাত দিয়ে মুখ ঢাকলাম আমি। ইশান ভাইয়া হয়তো এতোক্ষন আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো না….. উনি নিশ্চিত আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার লাজুক হাসির উত্তরে মুচকি করে হাসলেন উনিও
তারপর বলে উঠলেন–
আমি সব জানি তারা! তারিফ যেমন তোমার আর আন্টির কাছে আমার গল্প করতো……. ঠিক তেমন আমার কাছেও কিন্তু তোমার বাচ্চামির গল্প করতো। তুমি যে পাহাড়ে উঠতে ভয় পাও,,, সাইকেল খুব ভালো চালাতে পারো,,,টায়রা তোমার প্রাণ ভোমরা,,,এসব তো তারিফের কাছ থেকেই জেনেছি আমি।
উনার কথা শুনে আমার মাথাটা যেন চক্কর দিয়ে উঠল। অন্যভাবে বলা যেতে পারে আমার মস্তিষ্কের অবস্থান যেন ৩৬০ ডিগ্রি এংগেলে ঘুরে গেল। উনি কি শোনালেন এটা আমায়?? আমি এইভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি!! ভাইয়া আমার কাছে উনার গল্প করতো তার মানে স্বাভাবিক ভাবে উনার কাছেও আমার গল্প করতেই পারে…… সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল ভাইয়া উনাকে আমার বিষয়ে কি কি বলেছে আর কতটাই বা বলেছে?? আমি যে উনার ছবি দেখার জন্য কি পাগলামি করতাম সবকিছু আবার বলে বসেনি তো??? চার বছর ধরে যত পাপ করেছি সবকিছুর স্মৃতি এবার মাথার একপাশে জমা হতে লাগল। ভাইয়া উনাকে কোনটা বলেছে আর কোনটা বলেনি?? নাকি সবকিছুই বলেছে। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে উল্টো দিকে ঘুরে সত্যি সত্যি লাফ দেই ছাদ থেকে। সেটাই বেস্ট হবে। ইশান ভাইয়া নড়াচড়া দেখে আমাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন–
শোনো তারা সুন্দরী! আমি সত্যিই দুই বছর আগে তোমাদের বাসায় এসেছিলাম। কিন্তু সেটা খুব জরুরি একটা কাজে। কাজটা অবশ্য তারিফের ছিল!! আমি তো এসেছিলাম তোমাকে এক নজর দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সারাবাড়ি চোখ বুলিয়েও যখন তোমার দেখা মিলল না…… তখন আমার চোখ দুটো কে তৃপ্ত করতে পেয়ে গেলাম তোমার এক ছবি। আর সেই ছবি দেখেই আমি জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো মেয়ের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমার চোখ দুটো আটকে গিয়েছিল তোমার প্রসারিত ঠোটের মিষ্টি হাসিতে।
আপনি আমার কোন ছবিটা দেখেছিলেন যে আপনার এতো ভালো লাগলো।
তোমার মাথায় ছিল দুই বেণি। মাঝখানে সরলরেখার মতো সিথি। হলুদ রঙের একটা জামা…….. সবুজ পাতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে অপুর্ব সুন্দর হাসি টা ঢেকে রাখার এক অব্যর্থ চেষ্টা। ঠিক ওই সময়ই ছবি টা তোলা হয়েছিল। অনেকটা ক্যানডিড বলা যেতে পারে। সেই মিষ্টি হাসিতেই তো দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। সেদিন প্রকৃতির সাথে এক অদ্ভুত মিল খুজে পেয়েছিলাম আমি তোমার। প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের সাথে তোমার মন ভুলানো হাসি এক অন্যরকম নেশার জন্ম দিল আমার মনে। আর তখন যে তুমি পাহাড়ের উপর টায়রাকে উড়তে দেখে খুশিতে হাত তালি দিচ্ছিলে…….তোমার সেই হাসিতে আমি দ্বিতীয়বারের মতো ঘায়েল হয়েছিলাম। তারপর হুট করে আমি কাছে আসতেই তুমি আমায় জড়িয়ে ধরলে…… বুকের ভেতরটা যেন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল তখন।
কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি মনে মনে লজ্জার হাসি হাসলাম। তাহলে এইজন্যই পাহাড়ে তখন ওইভাবে কথা গুলো বলেছিলেন উনি?? ইশান ভাইয়া একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–
যেদিন তোমার ছবিটা প্রথম দেখেছিলাম সেদিনের পর থেকে এক মুহুর্তের জন্যেও সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারিনি আমি। প্রত্যেকটা পলকে পলকে শুধু তোমার সেই পাগল করা মিষ্টি হাসির ছবি ভেসে উঠতো মনে। অনেকবার অনেক বাহানায় আসতে চেয়েছিলাম এখানে। কিন্তু সুযোগ হয়ে উঠেনি। অসহ্য যন্ত্রণায় কাটতো আমার দিনগুলো। তখন বেশিরভাগ আমার মনে শুধু একটাই গান বাজতো। শুনবে সেটা??
আমি ভাবলেশহীন ভাবে মাথা নাড়লাম। মানে শুনবো। আমার প্রতি ইশান ভাইয়ার অনুভুতির গল্পগুলো শুনতে অসম্ভব ভালো লাগছে। নিজেকে সবথেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে আমার। উনি গানের কয়েক লাইন সুর দিয়ে উচ্চারণ করলেন–
জারা তাজভির সে তু…… নিকালকে সামনে আ….. মেরি মেহবুবা!! মেরি মেহবুবা!! মেরি মেহবুবা…… মে…রি মেহবুবা……. মে…রি মেহবুবা!!!!
ছবি হয়েও কম জালাও নি তুমি আমায়। তারপর হঠাৎ করেই আসল সেই প্রতিক্ষীত দিন……. যেদিন সত্যিই আমার সামনে এসেছিলে তুমি। আর আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিনও হলুদ লেহেঙ্গা পড়েছিলে তুমি। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। এতোদিনের জমানো আবেগ গুলো প্রকাশ পেতে লাগল। আর তারপর সন্ধ্যায় যখন তুমি খয়েরী শাড়িটা পড়ে লম্বা চুল গুলো দুলিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিলে……. আমি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তাই…….
কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলেন উনি। মাথার পেছনে হাত রেখে মাথা চুলকাতে লাগলেন। আমি চোখ সরু করে ইশানের দিকে তাকাতেই ইশান মৃদু হেসে বলে উঠল—
বাই দ্যা ওয়ে সেদিন লাইট অফ হয়ে যাওয়ার প্রবলেম টা কিন্তু আমিই ক্রিয়েট করেছিলাম। আয়মান আর সাফিন সব জানতো। শুধু তারিফ জানতো না।
কথাগুলো শুনে মুখ হা করে তাকালাম আমি। উনি তো আসলেই একটা ইতর!! আমার ভাইকে সহজ সরল পেয়ে এইভাবে বোকা বানিয়ে গেছে। ভাইয়া কত বিশ্বাস করে উনাকে। আর উনি?? একেই হয়তো বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। মুখ ফুলিয়ে উনাকে কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই দুনিয়া কাপানো চিৎকার কানে এলো আমার। ইশান চিৎকার শুনেই পেছনে ঘুরে তাকাল। আমি ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিতেই আমার এক হাত ধরে আমাকে নামিয়ে নিল ইশান। দুই কাধ স্পর্শ করে বলে উঠল–
ব্যথা পাওনি তো??
উনার কথার উত্তর দেওয়ার ধৈর্য্য আমার হলো না। আমি এক ঝটকায় নিজেকে উনার বাহুডোর থেকে মুক্ত করে ছুট লাগালাম ঘরের দিকে। আওয়াজটা সেখান থেকেই আসছে। বুড়িটা আমাকে পাশে না পেয়ে কোনো এলাহি কান্ড করে বসল না তো??? মনের মধ্যে অজানা আতঙ্ক নিয়ে ছুটে চলেছি আমি। ইশান ভাইয়া আমার পেছনে আসছে নাকি সেটাও বুঝতে পারলাম না।
চলবে