#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫২
শান্ত ভাবছে, এখনো ভাবছে। কি করবে এটা ভেবেই তার ঘুম কাবার। কাউকে গিয়ে বলতেও পারছে না, লজ্জা লাগছে। কেন লাগছে সেটা সে জানে না। আহনাফ কে কি করে বলবে এই কথা সেটাও বুঝতে পারছে না। একমাত্র অমি, যাকে শান্ত তার মনের কথাগুলো বলে ফেলছে। কিন্তু এতে কি? অমি তো আর বলতে পারে না, বলতে পারলে বোধহয় ভালো হতো!
অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে ভার্সিটিতে পা রাখল সে। এতোটাই অন্যমনস্ক, যে তার পাশে দাঁড়ানো স্বয়ং নিঝুম কেই সে উপেক্ষা করে চলে গেল। গতকাল এতো ধমকাধমকির পর অশান্ত’র কাছে এমনটা মোটেও আশা করেনি নিঝুম। সে ছুটে এসে এমন ভাবে দাঁড়াল শান্ত’র সামনে যে সে হতচকিয়ে গেল। নিঝুম নাক ফুলিয়ে বলল, “আপনি আবারো আমায় ইগনোর করছেন অশান্ত!”
“কি বলছো, কখন করলাম?
“আবার মিথ্যেও বলছেন?
“আরে না, আমি সত্যি..
“থামুন! দেখুন এবার আমি কি করি!
অতঃপর হন হন করে নিঝুম চলে গেল। শান্ত পুরোই বেকুব বনে গেল। কি করে কি হলো, হঠাৎ চেঁচামেচি’র খুব শব্দ পেলো। মুখ ফিরিয়ে পাশ ফিরতেই দেখল দুটো মেয়ে চেঁচিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে এদিকেই আসছে। ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটল সে পিছনের মেয়েটা এসে ধাক্কা খেলো তার’ই সাথে। শান্ত হুট করেই হাতটা ধরে তাকে নিচে প*ড়া থেকে বাঁচালো। বিপদ ঘটল তখন, যখন দেখল নিঝুম অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিঝুম ভেবেছিল, শান্ত বোধহয় তার রাগ কমাতে তার পিছন পিছন আসবে। কিন্তু এদিকে দেখছে সে তার রাস্তা বদলে নিয়েছে। মনে মনে শান্ত কে পল্টিবাজ বলে গালিগালাজ করছে। অথচ শান্ত’র চোখ তার দিকে পড়তেই ফট করে হেসে দিল সে। নিঝুমের হাসি দেখা মাত্র মেয়েটার হাত ছেড়ে দিল সে। মেয়েটা ধপাস করে পড়ে গেল। মেয়েটাও বোধহয় স্বপ্নতেই ছিল, শান্ত তার হাত ধরেছে এটা ভাবতেই পেরেই ঘোরে চলে গেছে সে। আটকে গেছে শান্ত’র মাঝে। এজন্য বোধহয় নিচে পড়ে যাওয়াটা ওভাবে মানতে পারে নি। হতবুদ্ধি’র মতো চেয়ে রইল শান্ত’র মাঝে। শান্তও হতচকিয়ে বলে উঠল, “সরি, সরি!
আহনাফ, নীলাভ্র, আহিম দূর থেকে দৌড়ে এলো। নীলাভ্র মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আহনাফ শান্ত’র ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “যখন ফেলেই দিবি তাহলে ধরতে গেলি কেন?
শান্ত আমতা আমতা করতে করতে এদিক ওদিক তাকাল। নিঝুম নেই, চলে গেছে। কোন একটা অজুহাতে সেখান থেকে চলে গেলে সেও।
ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। আশ্চর্য ভাবে ইফাও দেখা গেল সেখানে। তিথি একটা জোকস বলল, আহিম সেই জোকসটা’কেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এভাবে বলল সবাই হাসতে লাগল। তিথি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে আহিমের দিকে। শান্ত শুধু একবার এদিক আরেকবার ওদিক তাকাচ্ছে। আশেপাশে নিঝুম নেই, এটাই একমাত্র শান্তির ব্যাপার। না জানি, কখন এসে আবার কি করে বসে। বলতে বলতে নিঝুম এসে হাজির। নাচতে নাচতে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ” টাডা আমি চলে এসেছি!
নীলাভ্র আর আহনাফ একসাথে হেসে ফেলল। রিয়া মুখ ভেংচি কেটে বলল, “মহারানী ভিক্টোরিয়া এসেছেন, পায়ের ধুলো দিতে।
“আ আ রিয়া ভুল বললে, ওটা হবে দ্বিতীয় রানী ভিক্টোরিয়া! মহারানী তো একজনই তো তাই না।
সবাই মুখ টিপে হাসল, আফিন হাসতেই যাচ্ছিল। রিয়া এমন ভাবে তাকাল সেও চুপসে গেল। রিয়া তার হবু বউ, এখনি তার বিপক্ষে চলে গেলে অনর্ধক হয়ে যাবে এটা তার মাথায় আছে। তানিশা আর দিয়া পাত্তা দিল না অন্যদিকে ইফা ভ্রু কুঁচকে নিল। নীলাভ্র বলল, “সিঙ্গাড়া খাবে নিঝুম!
নিঝুম মাথা নেড়ে বলল, “না ডাইট’এ আছি!
দিয়া একটু উচ্চস্বরে বলল, “ওসব মুখের কথা, রাত হলে ঠিক’ই আইসক্রিম চকলেট খাওয়া শুরু!
নিঝুম চকলেটে কামড় বসিয়ে বলল, “রাত হলে না দিয়া, দিনেও খাই। শুধু তেল চর্বি খাবার বাদ দিলাম। কিন্তু মিষ্টি খাবার ছাড়া যাবে। ওটা আমার প্রাণ!
তানিশা হেসে বলল, “ডাইট’এর কি নমুনা।
“এভাবে হিংসে করা ঠিক না তানিশা!
“আমি আর তোমায় হিংসে, ইউ নো তোমার চেয়ে কতো ফিট আমি। কি আছে তোমার, যে আমি হিংসে করবো।
নিঝুম চট করে বলে উঠল, “যা তোমার নেই!
কথাটা আহনাফ কে উদ্দেশ্যে করেই বলল, তানিশা’সহ আরো অনেকেই তা বেশ বুঝতে পারল। তানিশা চুপ হয়ে গেল। এদিকে শান্ত বুঝতে পারছে না, নিঝুম সেচে কেন সবার সাথে ঝগড়া করছে। তিথি এসে নিঝুম কে চিমটি মেরে বলল, “কি করছিস কি? এভাবে কেন ঝগড়া করছিস?
“ইচ্ছে হচ্ছে তাই করছি। কি আহনাফ, যা আমাদের করতে ইচ্ছে করে সেটা কি আমরা করবো না।
আহনাফ কিঞ্চিত হেসে মাথা দুলাল। নিঝুম হাসল। আহনাফের ঠিক পিছনেই চেয়ার পেতে বসা তানিশা। রাগে এবার কাঁপছে সে। শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিঝুম সবার দিকে একবার চোখ বুলাল। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। হুট করেই চেয়ার পেতে বসে পড়ল আহনাফ আর শান্ত’র মাঝে। খুব গম্ভীর গলায় বলল, “আহনাফ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি!
সবাই খানিকটা হতচকিয়ে গেল। শান্ত টেনশনে অস্থির, নিঝুম এখন কি বলতে চলেছে আবার। নিঝুম বলল, “আমি খুব সিরিয়াসলি বলছি বিষয়টা।
“বলো!
“আহনাফ আমি আপনার সাথে আরেকবার ডেটে যেতে চাই, আপনি যাবেন!
আহনাফ খানিকটা অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে নিল। শান্ত কাশতে শুরু করল। নীলাভ্র চুপসে গেছে। রিয়া খপ করে আফিনের হাতটা ধরে ফেলল। আহিমের চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে। এ কি হচ্ছে! সে তো ভেবেছিল এক আর হচ্ছে আরেক! ইফা ভ্রু কুঁচকে নিল। দিয়া হতভম্ব হয়ে তাকাল তানিশার দিকে। তানিশা নিশ্চুপ, নিরব হয়ে এখনো বাকিটা শোনার আশায় আছে। তিথি দৌড়ে এসে নিঝুমের মাথায় বারি মেরে বলল, “কি বলছিস কি এসব? পাগল হয়ে গেলি নাকি?
একটা হইচই মুখর পরিবেশ নিমিষেই নিরব হয়ে গেল। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে বলল, “যাওয়াই যায়, যাবে না কেন?
নিঝুম অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বলল, “তাহলে চলুন!
“কবে যাবে?
“কাল!
দিয়া বলে উঠল, “ওয়েট ওয়েট! কিসব কথাবার্তা বলছিস তোরা। মানে এসব কি? তোরা এর আগে আবার কবে ডেটে গেলি।
নিঝুম হেসে বলল, “তানিশা কে জিজ্ঞেস করো, সে সব জানে!
দিয়া অবাক চাহনিতে তানিশার দিকে ফিরল। তানিশা হন হন করে বেরিয়ে গেল। নিঝুম হেসে উঠল। আহনাফও তার হাসির সাথে হাসি মিলাল। এদিকে শান্ত বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। তার পুরো শরীর হিমশীতল হয়ে গেছে নিঝুমের কথা শুনে। চশমিশ এভাবে তাকে বেকায়দায় ফেলবে এটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
——
ডেটে যেতে এখনো দু ঘন্টা বাকি। ক্ষিদের বশে রান্না ঘরে হাজির নিঝুম। পাস্তা তৈরি করে খাওয়ায় যেতে পারে, এরপর নিজে তৈরি হবে। যদিও সে জানে, আজ তার ডেটে যাওয়া হবে না। কোন না কোনভাবে ভাবে অশান্ত সেটা ভুন্ডুল করবে। তখন সবাইকে সে সত্যি টা জানিয়ে দেবে। আপাতত প্ল্যান এইটাই। অশান্ত কে এবার এমন জব্দ করবে যেন সারাজীবন মনে রাখে। কি ভেবেছে কি সে।
গতদিন পেরিয়ে আজ হলো, কিন্তু শান্ত একবারও তাকে কল করল না। অশান্ত করবে এই ভেবে নিঝুমও করল না। কিন্তু এবার বোধহয় তাকেই কলটা করতে হবে। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে কল করল শান্ত কে। অনেকবার রিং হলো, কিন্তু কেউই ধরল না। বিরক্ত আর রাগে লাল হয়ে যাচ্ছিল নিঝুম। এভাবেই চুলোর আঁচ, তার উপর অশান্ত’র রাগ , দুটো মিলে যেন নিঝুম এখন মরুভূমিতে বাস করছিল বলে মনে হতে লাগল। পাস্তা গুলো গরম পানিতে ফেলতে ফেলতে ফোনের দিকে তাকাল। রিং বাজছে, এটা ২৫ নাম্বার মিসকল! যদি অশান্ত এটা না তুলে তাহলে তার বাসায় যাবার পথে একটা ডাব কিনে নিয়ে যাবে, সেটা অশান্ত’র মাথায় গিয়ে ফাটা*বে। কিন্তু তেমন কিছু হয়তো অশান্ত’র ভাগ্যে ছিল না। দেখা গেল এই কলটা সে রিসিভ করল। নিঝুম দ্রুত ফোন কানের কাছে নিয়ে বলতে শুরু করল, “কোথায় ছিলেন আপনি, এতো গুলো কল করলাম! একটাও ধরলেন না কেন? কি করছিলেন কি? রাতেও একটা ফোন করেন নি। আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না অশান্ত। আপনি আমায় রাগাচ্ছেন কেন? হ্যালো, এখন কথা বলছেন না কেন?
শান্ত শীতল স্বরে বলল, “তুমি থামলে তো বলবো।
নিঝুম এবার নরম গলায়,
“ওহ, বলুন কি হয়েছে? আপনার গলা কেন এমন শুনাচ্ছে?
“জ্বর এসেছে তাই!
“জ্বর এসেছে মানে, কখন জ্বর এল?
“রাতে!
“রাতে! আর আপনি আমায় এখন বলছেন? ঔষধ খেয়েছেন?
“না।
“কেন?
“খেতে ইচ্ছে করছে না।
“মানে?
“মানে কিছুই না, আমি এখন ফোন রাখছি।
“কেন?
“কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই!
“এটার মা..
কথা শেষ করবার আগেই অশান্ত কল কেটে দিল। নিঝুম রেগে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। আবারো কল করলো সে। অশান্ত ফোন তুলছে না। নিঝুম মাথা ঝাকালো। না এবার রাগ না, চিন্তা হচ্ছে। গতকাল কি একটু বেশিই করে ফেলল। নাহলে এমন হুট করে কেন জ্বর আসবে অশান্ত। খুব বেশি কি জ্বর! উনার বাসায় তো কেউই নেই, কি জানে কি করছে? না আর এভাবে বসে থাকলে হবে না। নিঝুম ছুটে বেরিয়ে গেল। যেভাবে ছিল সেই ভাবেই গেল। রাস্তায় যেতে যেতে কোনভাবে চুল গুলো খোঁপা বেঁধে নিল। কিছু না পেয়ে শেষমেষ রিক্সায় চড়ে বসল। বার বার কল করছে অশান্ত কে? কিন্তু অশান্ত ফোন’ই তুলছে না। রেগে এবার নিজের চুল নিজের’ই ছিঁ*ড়তে ইচ্ছে করছে।
ক্রমশ দরজায় বেল বাজাচ্ছে নিঝুম। কেউ খুলছে না কেন? রেগে দরজায় বারি মারতেই সুর সুর করে দরজা খুলে গেল। নিঝুম খানিকটা হতচকিয়ে গেল। দরজা অমন ভাবে খোলা কেন? উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা আঁকড়ে ধরল তাকে। নিঝুম দৌড়ে অশান্ত’র রুমে ঢুকল।
হা হয়ে তাকিয়ে আছে সে। অশান্ত দিব্যি বসে চিপস খাচ্ছে। তার পাশে আমি ঘুমাচ্ছে। নিঝুম কে দেখতে পেয়েই একগাল হেসে বলল, “হাই!
নিঝুম ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। তার অবাকের রেশ এখনো কাটেনি। বিছানার ধারে এসে বসল সে। অশান্ত চিপসের প্যাকেট এগিয়ে দিল তাকে। নিঝুম তার বদলে তার কপালে হাত দিয়ে বলল, “জ্বর চলে গেছে আপনার?
“যখন আসেই নি তো যাবে কি?
“আপনি আমায় মিথ্যে বলেছেন অশান্ত!
“সরি! রাগ করো না। কাল তুমি আমায় যেই শক দিলে তা ভুলতে নিজের মাথা ঠান্ডা আইমিন কুল রেখে একটু মিথ্যে বললাম!
নিঝুম শব্দ করে শ্বাস ফেলল। ঢোক গিলল, পরিস্থিতি বেগতিক থেকে শান্ত বিছানায় ছেড়ে নামতেই যাচ্ছিল অমনি খপ করে নিঝুম তার হাতটা ধরে ফেলল। তার হাসি হাসি মুখ থেকে শান্ত’র অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। শান্ত বলতে নিল, “চশমিশ আমি তোমার জন্য আইস… আআআআআআ!
নিঝুম খুব জোরে কামড় বসাল তার হাতে। উঠে দাঁড়িয়ে এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “নিন, দেখবেন আমার কামড়েই আজ রাতে আপনার জ্বর আসবে।
“এভাবে কামড় দিলে তুমি! চশমিশ দাগ বসে গেছে।
“বেশ হয়েছে, গেলাম আমি। আর এক ঘন্টা পর ডেটেও যেতে হবে আমার
“ডেট মানে, তুমি আমার সাথে আছো, চশমিশ!
কে শুনে কার কথা, চশমিশ হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেলো। শান্ত উঠে তার পিছন ছুটল। ড্রয়িং রুমে আসামাত্র শান্ত পেছন থেকে জাপ্টে ধরল নিঝুম কে। নিঝুমের খোঁপা খুলে গিয়ে চুল গুলো বারি খেলো তার মুখে। শান্ত মাথা ঝাঁকিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিল। নিঝুমের হাত শান্ত’র হাতের উপর। কিছুক্ষণ কেটে গেল। শান্ত’র গরম নিঃশ্বাস গুলো পড়ছে নিঝুমের ঘাড়ে। নিঝুম মোচরামুচরি করে বলল, “অশান্ত ছাড়ুন!
শান্ত অভিমানি গলায় বলল, “না আমি ছাড়বো না, আমি ছাড়লেই তুমি পালিয়ে যাবে আমার ছেড়ে।
নিঝুম শুকনো ঢোক গিলল। তার অস্বস্তি হচ্ছে, খুব অস্বস্তি হচ্ছে। না পারছে নড়তে, না পারছে কিছু করতে। অশান্ত হাত দুটো আলগা করে তাকে সামনে ঘুরাল। অবাধ্য চুল গুলো এবার নিঝুমের মুখের সামনে। তার হৃৎস্পন্দন ধক ধক করছে ক্রমশ। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, “অশান্ত’রও কি এমন অনুভূতি হচ্ছে কি না।” কিন্তু লজ্জা লাগছে। লজ্জায় গাল টুকু লাল হয়ে যাচ্ছে। শীতল হাতের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠলো নিঝুম। শান্ত খুব যত্ন করে তার চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। চোখের চশমা টা কি করে থিতুনি তে হাত রেখে মুখটা উঁচু করল। নিঝুমের বেশ লজ্জা লাগছে এভাবে শান্ত’র চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে তবুও দৃষ্টি সরিয়ে ফেলছে না সে।
শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল, নিঝুমের ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। শান্ত থিতুনি থেকে হাতটা সরিয়ে এবার গালে রাখল। অন্যহাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি আমার চশমিশ, শুধু আমার। তোমাকে অন্যকারো হতে দিতে পারি না আমি। কিভাবে ভাবো এসব? তুমি বুঝ না আমার কেমন লাগে, কেন করো এসব সবসময়। কেন করছো এমন? কম ভালোবাসি না আমি তোমায়, একটু সময় তো দাও। নিজের সবটুকু ভালোবাসা প্রকাশ করবো তোমার মাঝে। নিজের মাঝে তোমায় আগলে রাখবো। কেউ নিতে পারবে না তোমায়, তুমি নিজে চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারবে না। তুমি যে আমার, শুধুই আমার!
কপালে ঠোঁট দুটো ছুঁইয়ে দিল সে। নিঝুম লজ্জায় শান্ত’র বুকে মুখ লুকালো। কিছু একটা শব্দ হলো, নিঝুম এবার লজ্জায় চোখ বুঝে আছে। শান্ত বলে উঠল, “তোমার ক্ষিধে পেয়েছ চশমিশ!
নিঝুম মুখ তুলে মাথা নাড়ল। শান্ত বলে উঠল, “কি খাবে!
“পাস্তা!
বলতেই হতচকিয়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আমার পাস্তা!
পাস্তা সিদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে পাতিলের সাথে লেগে গেছে। তাহমিনা বেগম রেগে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। এটা নিঝুমের কাজ, মেয়েটা সবসময় এমন করে। তিনি রেগে চুলো নিভিয়ে নিঝুম নিঝুম বলে চেচালেন। আজ’ই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। এতোটা অন্যমনস্ক মেয়েটা হয় কি করে। হিনা এসে জানাল নিঝুম বাসায় নেই। এটা শুনেই রাগটা যেন আরো বেড়ে গেল। আ*গুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা। তাহমিনা বেগম ককর্শ গলায় বলে উঠলেন, “আসুক আজ নবাবের ঝি। কি পেয়েছে টা কি? এভাবে আমায় জ্বালিয়ে মারবে। কি মনে করে কি নিজেকে। এভাবে রান্না বসিয়ে হুটহাট করে বাইরে চলে যাবে। কে বলেছে তাকে রান্না ঘরে আসতে, কাজ করতে এসেছে না ম*রতে এসেছে।”
হিনা শুকনো ঢোক গিলে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। এখানে থাকা বিপজ্জনক। মা না এবার নিঝুমের আপার রাগ এসে তার উপর ঝাড়ে।
নিঝুম সোফায় শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে চিপস খেতে খেতে বলল, “আম্মু আর আমায় বাসায় ঢুকতে দেবে না অশান্ত!
“চিন্তা কি? আমার বাসায় থাকো!
নিঝুম মুখ তুলে তাকাল শান্ত’র দিকে। আবারো মুখে চিপস পুড়ল। শান্ত মিটিমিটি হাসছে। নিঝুমের কার্যকলাপ ইতিমধ্যে শোনা হয়ে গেছে। নিঝুম রেগে বলে উঠল, “এই অশান্ত হাসবেন না।
“হাসলাম কই?
“শুনুন, যা হয়েছে আপনার জন্য। আমি যখন বাসায় যাবো তখন আপনার ঘাড় ধরে নিয়ে যাবো। আপনাকে দেখিয়ে বলল, সব দোষ আপনার। ভুলভাল বলিয়ে বাসা থেকে বের করে আনিয়েছেন আমায়।
“আচ্ছা বেশ করো।
ফ্রিজ থেকে ডিপ করা খাবার বের করে গরম করল শান্ত। নিঝুমের সামনে এনে খাবার রাখল। নিঝুম খেতে খেতে গল্প করছে তার সাথে। শান্ত মুগ্ধ হয়ে তা শুনছে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। শান্ত’র ঘোর কেটে গেল। এখন আবার কে এলো? বলতে বলতে দরজা খুলল সে। আহনাফ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। আহনাফ হেসে বলল, “তুই না বাসায় নেই!
শান্ত আমতা আমতা করতে লাগল। কিছুক্ষণ আগেই আহনাফ কল করে বলেছিল, “নিঝুম আসছে না। সে একা দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি তার কলও ধরছে না।
শান্ত বিছানার পাশে চোখ বুলাল। নিঝুমের ফোন এখানেই। সাইলেন্ট এ ছিল বলে আওয়াজ পাওয়া যায় নি। হঠাৎ আহনাফ বলে উঠল, “আমি আসছি তোর বাসায়!
শান্ত তড়িখড়ি করে বলে উঠল, “না না আমি তো বাসায় নেই?
“কোথায় তাহলে তুই ?
“বাহিরে এসেছি!
“কি করছিস?
চোখের সামনে তখন অমি দৌড়াচ্ছিল। শান্ত চট করে বলে উঠল, “অমির সাথে খেলছি!
আহনাফ “ওহ আচ্ছা ” বলে কল কেটে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও মনে ভয় রয়েই গেল। আহনাফ কি তার মিথ্যে কথাটা বুঝতে পারে নি। নাকি বুঝে ফেলল। শান্ত’র সমস্যা হচ্ছে , “যখন মিথ্যে গুছিয়ে বলার দরকার তখন সে বলতে পারে না। আর অকারণে কি সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যে বলে ফেলে!”
নিঝুম জোরে বলে উঠল, “কে এসেছে অশান্ত!”
শান্ত’র মুখ থমথমে। আহনাফ শান্ত কে সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “নিঝুম তুমি এখানে, তোমার না আমার সাথে যাবার কথা!
নিঝুম থমকে গেল। সে হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। শান্ত মাথা চুলকাচ্ছে। নিঝুম দ্রুত মুখের খাবার শেষ করে বলল, “আহনাফ আমি সত্যি বলছি, আমি এখানে আসি নি। নিজের ইচ্ছে তো মোটেই না। অশান্ত আমায় মিথ্যে বলে আনিয়েছে।
আহনাফ অশান্ত’র দিকে ফিরে বলল, “তাই!
শান্ত কি করবে না বুঝতে পেরে আহনাফ কে বাইরে নিয়ে এলো। বলতে শুরু করল, “আহনাফ আমি বলছি কি?
“আমি শুনছি!
শান্ত অস্থির হয়ে উঠল। উত্তেজনায় বলে উঠল, “শুন, আমি তোকে সব গুছিয়ে বলছি। তুই আপাতত এখান থেকে চলে যা প্লিজ
“আমি চলে যাবো!
শান্ত করুণ স্বরে বলল,
“আহনাফ!
“হুম!
দরজার আড়াল থেকে উঁকি মারল নিঝুম। শান্ত বলে উঠল, “দেখ আমার প্রথম ডেট, এমন করিস না।
“তোর ডেট তাও নিঝুমের সাথে!
শান্ত মাথা দুলাল। নিঝুম দরজার ওপাশ থেকে কেশে উঠল। আহনাফ নিঝুমের দিকে ফিরে বলল, “সত্যি নিঝুম!
নিঝুম মাথা নাড়িয়ে না না করল। শান্ত চোখ বড় বড় করে বলল, “একি বলছো!
নিঝুম দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করলো। আহনাফের বেশ হাসি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে দু’টো পুতুল চোর ধরেছে।চোর দু’টো কে সে নিজেই নাচাচ্ছে আর তারা বেশ নাচছে। ইচ্ছে করছে হাসতে, তবুও হাসছে না। নিঝুম দরজায় আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। শান্ত অনেক অনুনয় বিনয় করে আহনাফ কে চলে যেতে বলল। আহনাফ শেষমেষ চলেই গেল। শান্ত লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা টুকু পেল না। সে রুমে এসে দেখল নিঝুম নির্বিকারে এখনো খেয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখেই বলে উঠল, “আহনাফ চলে গেছে!
শান্ত কিছু না বলে ঘরের ভেতর চলে গেল। নিঝুম অবাক হয়ে তার পিছন পিছন গেল। শান্ত লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথার উপর বালিশ! নিঝুম ডাকল, “অশান্ত এই অশান্ত! কি হয়েছে আপনার!
শান্ত বালিশের থেকে মুখ বের করে বলল, “আহনাফ সব জেনে গেছে।
“তা তো জানি! কিন্তু এখন?
শান্ত উঠে বসল। বালিশ কোলের মাঝে নিয়ে বলল, “এখন কি হবে?
“কি আর হবে, দলবেঁধে সবাই এসে আপনার কাছে ট্রিট চাইবে।
“মজা করছো!
“আরে না না। এই অশান্ত, আপনি আমায় ট্রিট দেবেন না।
“তোমায় কিসের ট্রিট!
“আপনি প্রেম করছেন তাই!
শান্ত হেসে উঠল। নিঝুম দাঁড়িয়ে হাসছে। দুজনেই জোরে জোরে হাসছে, এতোক্ষণ কি হলো না হলো কিছুই মনে নেই কারো। মনের মধ্যে যেই অস্থিরতা ছিল সেটাও চলে গেল মুহুর্তেই! ভালোবাসার মানুষের মাঝে এমন এক অলৌকিক শক্তি থাকে যা অস্থিরতা বাড়াতে আর কমিয়ে দিতে সক্ষম!
দুজনেই ঘুরতে বের হয়েছে, নিঝুমের হাতে এক হাওয়ায় মিঠাই! সে একটু একটু কামড় বসাচ্ছে তাতে। হাওয়ায় মিঠাইয়ের পড়ের লিষ্ট বলছে শান্ত কে, “এরপর ঝালমুড়ি, তারপর আইসক্রিম, তারপর ফুচকা তারপর আবার..
“আইসক্রিম!
নিঝুম এসে শান্ত’র সামনে দাঁড়িয়ে উল্টো করে হাঁটতে লাগল। শান্ত তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। নিঝুম হাতটা ধরে ফেলল। হঠাৎ করে শান্ত বলে উঠল, “আমার ভালোবাসা তুমি নিঝুম, একমাত্র তুমি!
“আমি জানি।
“কাল থেকে কোন পাগলামি আর করবে না।
“বেশি করে করবো।
“ঝগড়া করবে না।
“আগুনে ঘি ঢালবো।
“উল্টো পাল্টা কিছুই করবে না।
“পুরো উল্টোটাই করবো।
“কথাগুলো শুনবে।
“শুনবো না।
“কতো অবাধ্য তুমি!
“তো কি আপনি তো বাধ্য!
দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো। একটা বাচ্চার আওয়াজ শুনে শান্ত ওদিক তাকালো। নিঝুমের মনে হলো অশান্ত কোন মেয়েকে দেখছে। সে হঠাৎ বলে উঠল, “অশান্ত শুনে রাখুন, আপনার যদি কোন মেয়ের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে আপনি তাকাবেন। কোন অসুবিধা নেই, শুধু এতোটুকু মনে রাখবেন। আপনি যা করবেন আমিও হুবহু তাই করবো।
শান্ত হেসে উঠলো, নিঝুমের মুখটা গম্ভীর! শান্ত তার হাত ধরে হিচকে তার কাছে টেনে বলল, “এর অর্থ আমি তোমাকে যতোটা ভালোবাসি তুমিও আমায় ততোটা ভালোবাসতে বাধ্য, কি তাই তো!
নিঝুম মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল। শান্ত হেসে তার গাল টেনে ধরল!
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৩
শান্ত ঠোঁট কামড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার তাকানোর দৃষ্টিতে অস্থিরতা। আহনাফ ধপাস করে পানির গ্লাসটা রাখার সাথে সাথে শান্ত কেঁপে উঠলো। শব্দ করে শ্বাস ফেলে আহনাফ বলে উঠল, “কবে থেকে এসব?
“এই তো পাঁচদিন!”
“পাঁচ দিন! ১২০ ঘন্টা, ৬০০০ সেকেন্ড, ১৮০০ মিনিট বেজে এখন ৩০ সেকেন্ড ( ঘড়ি দেখে ) অথচ তোর বলার সময় হলো না!”
শান্ত নিশ্চুপ! রিয়া আর দিয়া হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আহিম সবটা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসছে। তিথি সবে এসে কিছুই বুঝতে না পেরে দু সেকেন্ড পর পর আহিম কে খোঁচা দিচ্ছে। আফিন পুরো ব্যাপারটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এখানে সবার মাঝে সবচেয়ে খুশি ব্যক্তিটি হচ্ছে তানিশা আর যার মন ভাঙার আওয়াজ কেউই পায় নি সে হচ্ছে নীলাভ্র! মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে সে। কিছুক্ষণ পর পরই ঠোঁট কামড়ে ধরছে। তার মনে এই সূক্ষ্ম সময়ে নিঝুমের যে প্রভাব পড়েছে তা হয়তো সে ভুলতে পারবে না, কিংবা ভুলতেও চায় না। স্মৃতি গুলো তার কাছে চমৎকার লাগে, কেন সেগুলো ভুলতে চাইবে। জ্বর জ্বর লাগছে নিজের কাছে, মনটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে এসব কি ঠিক, “তুমি যাকে ভালোবাসবে সেও যে তোমায় ভালোবাসবে এমন তো কোন কথা নেই।” হয়তো তার মনেও অন্য কেউ আছে, সেই একটা যে তার নিজেরও খুব প্রিয়জন। নিজের মনকে অনেক বোঝানোর পর শান্ত’র দিকে মুখ ফিরল নীলাভ্র। বেচারার মুখ দেখে হাসি পাচ্ছে। আহনাফ বেশ ক্লাস নিচ্ছে তার। হঠাৎ কি মনে করে যেন তানিশা দিকে দৃষ্টি ফিরল নীলাভ্র। হয়তো এখন তানিশা কে বুঝতে পারছে সে। তানিশার ঠোঁটের কোনে হাসি! আসলে ভাগ্য এটা কি খেলা খেলল, তানিশার মনে হতে নিঝুম হয়তো আফনাফের। কিন্তু না, সেটা তো হলো না, নিঝুম হলো শান্ত’র মাঝখানে আহনাফ কে সে পেয়ে গেল। কিন্তু এসবের মাঝে তার নিজেকে জড়ানো কি খুব দরকার ছিল। কেন এমন কষ্ট পাচ্ছে সে! কষ্ট তো আরেকজনও পাচ্ছে, চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে সে। ইফার ইচ্ছে করছে সবকিছু এখন ধ্বংস করে দিতে। রাগে তার চোখ লাল হয়ে গেছে। নিঝুম কে সামনে এগিয়ে আসতে দেখতেই উঠে দাঁড়াল সে। হন হন করে বেরিয়ে গেল। ইফার মনের অবস্থা নিঝুম ঠিকই আভাস পেল। খারাপ তো তারও লাগছে, কিন্তু অশান্ত যে তাকে ভালোবাসে! যদি তাকে না ভালোবাসতে তাহলে হয়তো পিছিয়ে পড়া যেত, কিন্তু এখন যে কখনোই ভাবেই সম্ভব নয়। আহনাফ নিঝুম কে আসতে দেখে হেসে বলল, “হ্যাঁ তোমারই অপেক্ষা হচ্ছে, এসো এসো!”
“কেন কেন আমায় কি দরকার?”
রিয়া মুখ ফ্যাকাশে করে বলল, “কিভাবে জাদু করলে তা শিখার জন্য!”
আফিন চোখ শক্ত করে তার দিকে তাকাতেই রিয়া চুপসে গেল। নিঝুম হেসে বলল, “বেশি কিছু না, যে জাদু তুমি আফিনের উপর খাটিয়েছো সেটাই করেছি। তবে একটু ব্যতীক্রম খাবে।”
দিয়া বলে উঠল, “এই ঝগড়া বন্ধ করো তোমরা? ( শান্ত’র দিকে ফিরে ) আজ এপ্রিল ফুল না যে তুই আমাদের ফুল বানাবি। সময় আছে এখনো সত্যি টা বল!
“আহ, এটা তো আমায় বললেই হয়। গতকাল অশান্ত আর আমার ডেটের কিছু ছবি দেখিয়ে দিচ্ছি আমি।”
শান্ত হতচকিয়ে তাকাল। নিঝুম ফোন বের করে ছবি খুঁজছে। ছিটকে টান মেরে ফোনটা নিয়ে বলল, “একি বলছো?”
নিঝুম হেসে বলল, “ফোন নিয়ে বসে থাকতেই পারেন। আমার পোস্ট করা অবশ্য হয়ে গেছে। তিথি চলে আয়, লাইব্রেরিতে যাবো।”
বলা মাত্র তিথি সুর সুর করে নিঝুমের কাছে এলো। নিঝুম শান্ত’র হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে চলে যেতেই নিল, অতঃপর আবার ফিরে শান্ত’র গাল টেনে চলে গেল। শান্ত এদিক ফিরে দেখলো সবাই নিজ নিজ ফোন খাটছে। চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে শান্ত , গতকাল খুব অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি তুলেছে চশমিশ। সব কিছুই তার পাগলামী। এসব আবার পোস্ট করতে হয় নাকি! আজব মেয়ে তো এ! হঠাৎ তানিশা হেসে উঠলো, তার সাথে হাসি মিলালো আহিম। আহনাফও হাসছে মিটিমিটি! শান্ত চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর নিজের ফোন বের করল। তানিশা হাসতে হাসতে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, “এটা বেশ। নিঝুম খুব সুন্দর করে তোর গাল টানছে?”
আহিম বলে উঠল, “দেখ দেখ, এটাই মারা’মারি করছে। দুজন দুজনের চুল টানছে? এসব ছবি তুললি কি করে?”
“এসব ছবি তোলার কোন ইচ্ছেই ছিল না। শুধু হয়ে গেল!”
আহনাফ মুচকি মুচকি হেসে বলল, “প্রেমের মতো ছবিগুলোও হুট করেই হয়ে গেল।”
একসাথে হেসে উঠলো সবাই। নীলাভ্রের চোখে আটকালো একটা ছবি। এই ছবিটা বেশ সুন্দর। শান্ত একহাতে নিঝুমের চুল গুলো গুঁজে দিচ্ছে, নিঝুম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ছবিটা কখন তুললো, কিভাবে তুললো জানা নেই। নীলাভ্র ফোনটা অফ করে দিল। এসব নিয়ে আর ভাবতে চায় না সে। হঠাৎ আহনাফ বলে উঠল, “আহ্ আমার হিংসে হচ্ছে!”
“কিসের?”
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। তানিশা’র চোখ রক্তশূন্য! আহনাফ মুখটা মলিন করে বলল, “আই উইশ নিঝুমের সেই মানুষটা আমি হতাম, ( শান্ত’র দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলল ) মাঝখান থেকে তুই এসে সবটা উলোটপালোট করে দিলি। নিঝুম নাহলে পটেই যেত!”
শান্ত চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। আহনাফ মুখ ভেংচি কেটে উঠে পড়ল। শান্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এসব কি?”
তানিশা’র হৃৎস্পন্দন বাড়ছে, আহনাফের মনে সত্যিই কি এখনো নিঝুমের জন্য কিছু আছে নাকি পুরোটাই ভান করলো সে।
——-
নিঝুম আর আহনাফ হাঁটছে পাশপাশি! নিঝুম একটু পর পর হেসে গতকালের কথা বলছে। আহনাফ চলে যেতেই অশান্ত’র কি হাল হলো সেই বর্ণনা! আহনাফ হেসে বলে উঠল, “পাগল ছেলে একটা? আমায় বললে কি হতো?”
নিঝুম হাসতে হাসতে বলে উঠল, “হয়তো বন্ধুত্ব শেষ হবার ভয়!”
আহনাফ অবাক হয়ে নিঝুমের দিকে ফিরল। হাসতে হাসতে কি কঠিন সত্য কথাটাই না বলে ফেলল সে। এভাবে আগে কখনো সত্যি ভেবে দেখে নি সে।
“কি ভাবছেন এভাবে আহনাফ?”
“কিছু না, তবে নিঝুম এই কথাটা সত্য। তোমায় যে পাবে সে সত্যি ভাগ্যবান!
“হতেই হবে, আফটার অল নিঝুম কে পাচ্ছে।”
চোখের চশমা ঠিক করে কোমরে হাত রেখে কথাটা বলল সে। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছুদূর এলো। সামনেই একটা ফুলের গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিঝুম কে দিতে ইচ্ছে করছে। আজ তাকে বেশ লাগছে। কিন্তু তবুও সেটা করল না আহনাফ। কাক ডেকে গেল কা কা করে। হঠাৎ নিঝুমের কণ্ঠস্বর বদলে গেল। মৃদুস্বরে বলল, “আপনি আমায় একটা কথা বলেছিলেন আহনাফ, আপনার মনে আছে?”
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে তাকাল নিঝুমের দিকে। নিঝুমের হাস্যউজ্জ্বল মুখের দৃষ্টি তার দিকেই।
সেদিন খাবার খেতে খেতে হঠাৎ আহনাফ বলে উঠেছিল, “নিঝুম! প্রতিটা মানুষের জীবনে ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে ঠিক কেউ একজন আসে, সেই একজন টা তুমি হলে খুব একটা অসুবিধা হতো না…!”
নিঝুম তার কথায় হেসে উঠেছিল! কথাটা এবার মনে করতে পেরে খানিকটা লজ্জা লাগছিল আহনাফের। সে তখনো ভাবে নি নিঝুমের সেই ভালোবাসার মানুষটি শান্ত! অনেকটা অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠেই কথাটা বলেছিল সে। কিঞ্চিত হেসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার জীবনের সেই মানুষটি শান্ত! তাই তো।
“হুম, আপনি বলেছিলেন, প্রতিটা মানুষের জীবনে সে আসে!
“কি বলতে চাও!
নিঝুম এক পা এগিয়ে এলো। ধীর কন্ঠে বলল, “আপনার জীবনেও তেমন একজন কিন্তু আছে!
“তুমি তানিশার কথা বলছো?
নিঝুম হেসে উঠল। কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। আহনাফ তার চলার পানে খানিকক্ষণ দৃষ্টি রেখে প্যান্টের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে পথ বদলে দিল। উল্টো পথে হাঁটতে লাগল সে। খানিকটা আগাতেই অশান্ত’র সাথে দেখা। নিঝুম ছুটে অশান্ত’র সামনে এসে দাঁড়াল। চশমিশ কে হঠাৎ দেখতে পেয়ে খানিকটা থমকে গেল শান্ত। কিঞ্চিত হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কোথায় ছিলে?
“এই তো এখানে!
একগাল হেসে বলল চশমিশ। অশান্ত তার গাল টেনে দিল। নিঝুম দু হাত গালে দিয়ে বলল, “এটা কি হলো?
“তখন যা তুমি আমার সাথে করলে। আর এসব ছবি কেন পোস্ট করলে।
“সুন্দর লাগছে তো, দেখুন দেখুন আপনাকে আর আমাকে কতো মানিয়েছে। ( শান্ত’র পাশে দাঁড়িয়ে ) দেখলেন তো!
“তুমি আমায় চেয়ে কতো খাটো দেখছো?
“তো! ভালোই হয়েছে আমি একটু খাটো, চাইলেই হিল পড়ে লম্বা হয়ে যেতে পারবো। কিন্তু আপনি খাটো হলে তখন কি হতো বলুনতো!
“এমন আজেবাজে চিন্তা কেন তোমার মাথায় আসে বলো তো!
“রাখুন রাখুন! আচ্ছা অশান্ত ( বলেই একটু দূরে সরে এলো ) দেখুন তো!
বলেই ঘুরতে ঘুরতে লাগলো। হলুদ রঙের একটা পোশাক পড়ে এসেছিল সে। পোশাক টা অনেকটা লম্বা আর গোল ঘেরাও ছিল। নিঝুম ঘুরতেই পোশাকটাও গোল হয়ে গেল। অশান্ত হেসে বলল, “তোমার নতুন ড্রেস!
মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ! আব্বু এনে এনে দিয়েছিল, আজ প্রথমবার পড়লাম। ড্রেসটা কেমন বলুন তো!
অশান্ত হাসলো। কোন বাচ্চা নতুন ড্রেস পড়লে যেমনটা করে নিঝুমও এখন তাই করছে। সে হেসে বলল, “হ্যাঁ সুন্দর!
নিঝুম ছুটে শান্ত’র কাছে। পড়ে যেতে নিল, শান্ত তার দুটো হাত ধরে বলল, “সাধবানে!
নিঝুম হেসে তার হাত দেখিয়ে বলল, “বলুন এটা কেমন লাগছে?
শান্ত তাকিয়ে দেখল দুই হাতে মেহেদি দিয়ে রাঙানো। বলে উঠল, “সুন্দর তবে তুমি দাও নি!
“হুম হিনা দিয়ে দিয়েছে। খুব সুন্দর মেহেদী পড়াতে জানেন।
“হুম তাই তো দেখছি!
হঠাৎ নিঝুম বলে উঠল, “আমায় কেমন লাগছো অশান্ত!
শান্ত খানিকক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো নিঝুমের মুখের দিকে। চশমার আড়ালে তার দুটো কাজল কালো চোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখের কাজলটা লেপ্টে গেছে, তবুও ভালো লাগছে। কপালে চোখ একট টিপ! ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। মিষ্টি রোদের আলো এসে পড়ছে চশমিশের মুখে। অশান্ত কিঞ্চিত হেসে বলল, “বলছি!
অতঃপর ছুটে গেল। কোখান থেকে একটা ফুল হাতে করে ছুটে নিয়ে এসে তার কানে গুঁজে দিয়ে বলল, “এবার তোমায় দেখতে মিষ্টি লাগছে!
“কোন মিষ্টি? রসমালাই নাকি রসগোল্লা!
“তার চেয়েও একটু বেশি মিষ্টি!
নিঝুম একগাল হেসে উঠলো। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, “জড়িয়ে ধরবেন আমায়!
“এখানে? সবাই আছে আশেপাশে!
“হ্যাঁ , তো ভালো হবে। সবাই জানবে আপনি আমার!
অশান্ত খানিকটা দূরে সরে গিয়ে দু হাত প্যান্টের প্যাকেটে ঢুকিয়ে বলল, “নাও!
নিঝুম হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরল অশান্ত কে। শান্ত চোখ বুলিয়ে দেখলো আশপাশ সবাই অবাক হয়ে তাদের দুজনকেই দেখছে। অশান্ত হেসে বলল, “অন্য মেয়েদের থেকে আমাকে সরিয়ে রাখার ভালো বুদ্ধি বের করেছো চশমিশ!
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো!
——
আহনাফ বসে আছে তার চিরচেনা সেই জায়গায়। বেঞ্চের এক কোনায়! শান্ত হন হন এসে সেখানে ধপাস করে বসে পড়ল। আহনাফ তাকে দেখেও দেখল না এমন ভাব। শান্ত মুখ ভার করে বলল, “সমস্যা টা কি তোর?
“অনেক কিছু?
“তুই একটাই বল আপাতত!
“প্রথম কারণ শোন! আমার মনের সব কথা আমি তোকে বলি, তুই কেন বললি না।
কথাটা বলেই আড়চোখে তাকাল আহনাফ। শান্ত চোখ ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিন চিন নিরবতা দু’জনের মাঝে। আহনাফ তার ব্যাগ থেকে নতুন ব্রেসলেট বের করে বলল, “নে!
শান্ত হেসে হাত বাড়িয়ে বলল, “পড়িয়ে দে!
আহনাফ হাতে ব্রেসলেট পড়িয়ে দিল। সামনে তাকিয়ে দেখল নিঝুম, তিথি আর আহিম দৌড়াদৌড়ি করছে। শান্ত বলে উঠল, “এই মেয়েটা সারাটা দিন ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি করে।
“সামলাতে তোকেই হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠল, “তুই আমার উপর রাগ আহনাফ!
আহনাফ কিঞ্চিত হেসে বলল, “না রাগ না। তোর ভাগ্য দেখে শুধু একটু হিংসে হচ্ছে। তুই জানিস নিঝুম কে তুই পেয়েছিস, কতো ভাগ্যবান তুই। এই মেয়েটা সারাজীবন তোকে হাসাবে। কখনো ভার মুখে থাকতে দেবে না। তুই চাইলেও বেশিক্ষণ ওর সাথে রাগ করে থাকতে পারবি না।
শান্ত’র মুখটা মলিন। আহনাফ তার এক হাত শান্ত’র ঘাড়ে রেখে বলল, “তোদের দুজনের মিল ভালো। দুজনেই পাগল। কিন্তু শান্ত, আমাদের বন্ধুত্ব এতোটাও ঠুকনো নয় যে এই কয়েকদিনের ভালোবাসার কাছে হেরে যাবে। তবে হ্যাঁ একটা কথা, আমি নিঝুমের জন্য অনেক খুশি, কারন ও তোকে পেয়েছে। জানি তুই ওকে আগলে রাখবি, ছেড়ে যাবি না। কখনো কষ্ট পেতে দিবি না।
শান্ত মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বলল, “তুই ওর বড় ভাইয়ের মতো কথা বলছিস!
আহনাফ মুখ ফ্যাকাশে করে বলল, “নিঝুম তোকে এটা বলেছে!
শান্ত হাসতে হাসতে আহনাফ গায়ের উপর পড়ে গেল। আহনাফ ফিসফিস করে বলল, “এই মেয়েটা যা ইচ্ছে তাই! তুই জানিস আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড!
“তার আগে তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড! ( কথাটা বলে গাল টেনে দিল শান্ত )
“তোকে দেখছি নিঝুমের ভূত পেয়েছে!
“নিঝুম হচ্ছে ছোঁয়াচে রোগ!
“জানলে তোর অবস্থা খারাপ করে ছাড়বে
“কে বলবে ওকে এই কথা!
আহনাফ মুচকি হাসল। শান্ত বলে উঠল, “আহনাফ না!
“আমি কিছু বলছি না।
“জানলে আমার চুল টেনে ছাড়বে।
“শান্ত ভাব, তোর মাথায় একটাও চুল না থাকলে তোকে দেখতে কেমন লাগবে।
“আহনাফ!
আহনাফ মুখ টিপে হাসছে। শান্ত মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকাল। চোখে পড়ল সামনের ভবনের জানালা থেকে তানিশা বিভোর হয়ে দেখছে আহনাফ কে। শান্ত শীতল গলায় বলল, “ভালোবাসা কি তা তুই বুঝিস আহনাফ, তবে ওর ভালোবাসা কেন বুঝিস না!”
আহনাফ মুখ তুলে উপরে তাকাল। তানিশা হতচকিয়ে গেল না, বরং সে তাকিয়েই রইল। সে আছে এখন ঘোরের মাঝে। আহনাফ তানিশার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল, “জটিল ভালোবাসা বোঝা বড় দায় শান্ত!
তানিশা এখনো তার ঘোরে বিভোর। আহনাফের দৃষ্টিও স্থির। শান্ত কিঞ্চিত হাসল! জটিল ভালোবাসা যেমনি বোঝা বড় দায় তেমনি সেই ভালোবাসার স্নিগ্ধতাও বড় মিষ্টি! সে ফিরে সামনে তাকাল। নিঝুম তার দিকে ফিরে একগাল হেসে উঠলো। শান্ত শীতল দৃষ্টিতে তার চশমিশের দিকে ফিরে আছে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগল, “আচ্ছা ভালোবাসা কি?”
#চলবে….