তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৫৪+৫৫

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৪

আশালতা কবীরের স্টাডি রুমে টেবিলে ছড়িয়ে থাকা ফাইল গুলো গুছিয়ে রাখছিলো। একটা ফাইল হাত থেকে পড়ে যেতেই কোন একটা ছবির একাংশ বের হয়ে এলো। কৌতুহলবশত আশালতা ছবিটা হাতে নিল। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। এতদিন পর শান্ত কে দেখতে পেয়ে যেখানে খুশিতে দুচোখ জুড়িয়ে যাবার কথা সেখানেই তার দৃষ্টিতে অবাক, শান্ত’র সাথে থাকা মেয়েটিকে দেখে। কে এই মেয়ে, কি’ই বা তার সম্পর্ক শান্ত’র সাথে। এই ফাইলেই বা তাদের ছবি কি করছে। আশালতা ফাইলটা খুলে পড়তে লাগল। অনেকক্ষণ ধরেই পুরো ফাইলটা পড়ল সে। শান্ত’র এক্সি’ডেন্টের কথা শোনার পর অস্থির হয়ে পড়ল। অতঃপর শেষে যখন জানতে পারল সে ঠিক আছে তখন তার প্রাণ জুড়াল। কিন্তু এই শান্ত’র পাশে এই মেয়েটাকে মোটেও ভালো লাগছিল না আশালতা! খুব কি ঘনিষ্ট সম্পর্ক শান্ত’র সাথে তার। আশালতা ফোন বের করে নিঝুমের ছবিটা তুলে নিল। শান্ত’র খোঁজ নাই বা নিতে পারল, কিন্তু এই মেয়েটার তো নিতে পারবে। জানতেই হবে কে এই মেয়ে? শান্ত’র জীবনে এর গুরুত্ব’ই বা কতোখানি!

কলিং বেল বাজতেই শান্ত’র এসে দরজা খুলে দেখল সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে। সবাই আছে শুধু একজন বাদে। শান্ত কে ঠেলেঠুলে সবাই ভেতরে ঢুকে পড়ল। ট্রিট নেবার জন্য শান্ত’র বাসার থেকে ভালো জায়গা আর কারো জানা ছিল না। পির্জা, চিকেন ফ্রাই অর্ডার করাই ছিল। খানিকক্ষণ পর এসে পড়বে। সবাই ডয়িংরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল। শান্ত একটু বিচলিত! নিঝুমের আসার কথা ছিল ঘন্টা খানিক আগে। অথচ তার দেখা এখনো নেই। শান্ত রুমে ঢুকেই নিঝুম কে কল করল, ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ করে নিঝুম বলল, “বলুন বলুন!”

“সবাই তো এসে পড়ল, তুমি কোথায়?”

“আমি জ্যামে বসে আছি।”

“তোমার না একঘন্টা আগে আসার কথা ছিল।”

“একঘন্টা আগে এসে কি করতাম!”

“ঢং করতে আমি বসে বসে দেখতাম।”

“রসিকতা করছেন নাকি রেগে বলছেন?”

“তোমার কি মনে হয়?”

“কিছুই না, যাই হোক। মুভি দেখছিলাম, মুভি একটু আগে শেষ হলো আর রওনা দিলাম।”

“বাহ, খুব ভালো করেছো?”

বলেই ধপ করে ফোনটা কেটে দিল শান্ত। দরজার আড়াল থেকে আহিম বলে উঠল, “উহুম উহুম!”

তিথি মুখ টিপে বলল, “বাহ এক ঘন্টা আগে!”

বললাম দুজনেই গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগল। শান্ত হা হয়ে শুধু তাকিয়েই রইল। কিছু শোনার জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে দৌড়ে ভেতরে গিয়ে উপস্থিত সবার মাঝেই কথাটা বলে দিল তিথি। শান্ত দৌড়ে এসে দেখল সবার মুখ থমথমে। শান্ত’র মুখও থমথমে। ঠোঁট কামড়াচ্ছে বারবার। সবাই একসাথে হাসতে লাগলো। আহনাফ হাসতে হাসতে লাল হয়ে গেছে। শান্ত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আফিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এক ঘন্টা আগে কেন?”

শান্ত মিনমিনিয়ে বলল, “কিছু না!”

“কিছু না, কিছু তো আছেই। কিন্তু তোদের না রিলেশন’র সবে দশদিন গেল।”

“আরে ধুর, তোরা দেখছি তিল কে তাল বানিয়ে ছাড়বি।”

নীলাভ্র হেসে বলল, “কোন সারপ্রাইজ প্ল্যান ছিল?”

আহনাফ মুখ টিপে হেসে বলল, “রুমটা চেক করলো বোঝা যেত!”

“আহনাফ না!”

কে শুনে কার কথা, তিথি, আহিম সবাই দল বেঁধে চলে গেল শান্ত’র রুমে। চিরুনি তল্লাশি চালানোর পর দুটো প্যাকেট পাওয়া গেল। শান্ত’র মুখটা এখন আরো থমথমে। তানিশা হালকা কেশে উঠল। শান্ত কঠিন গলায় বলল, “তানিশা তুই না প্লিজ!”

“যাহ বাবা আমি কি করলাম, এই রাখ রাখ। ওটা ওর গার্লফ্রেন্ড’র জন্য গিফট। তোরা ধরে পুরান করে করে দিচ্ছিস‌। শান্ত সাহেব যে রাগ করছে।”

“তানিশা!

তানিশা হেসে উঠল। সবার মুখ হাসিহাসি। এর মাঝেই আহিম দুটো এক ডিজাইনের সু বের করে বলল, “বাহ দারুন!‌ আমি গতকাল’ই এগুলো অনলাইনে দেখেছিলাম। তুই কি সেখান থেকে অর্ডার করেছিস।”

শান্ত হন হন করে এসে প্যাকেট খুলে হাতে নিল। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। আহনাফ সিচুয়েশন বুঝতে পেরে বলে উঠল, “আচ্ছা থাক থাক। রাখ এবার তোর।”

দিয়া বলে উঠল, “তাই রেখে দে, বেচারা এতো শখ করে এনেছে তোরা কেন এসব করছিস?”

শান্ত রেগে ধপাস করে প্যাকেট গুলো আলমারিতে তুলে রাখল। হন হন করে বেরিয়ে গেল সবার মাঝে থেকে। সবাই এবার খানিকটা চুপচাপ। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেল শান্ত। “আসুক আজ চশমিশ! সব হয়েছে ওর জন্য, কখনো কোন কাজটা ঠিক করে করে না মেয়েটা। আজ ওর জন্য’ই সবার কাছে সে হাসির পাত্র!”

কলিং বেল বেজে উঠল। শান্ত ভাবল হয়তো চশমিশ এসে পড়েছে। কিন্তু না, খাবার ডেলিভারির ছেলেটা এসে খাবার দিয়ে গেল। শান্ত ছোট ছোট চোখ করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
অবশেষে নিঝুম এলো‌,অনেক দেরি করেই এলো। শান্ত তাকে দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইল। নিঝুম ধপাস করে বসে পড়ল তিথির পাশে। শান্ত আড়চোখে তার দিকে তাকাল। কিন্তু সেদিকে নিঝুমের নজর নেই। তার মনেই নেই, এতো সবার মাঝে কেউ একজন তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আহনাফ হালকা কেশে বলে উঠল, “নিঝুম এতো দেরি হলো যে!”

“মুভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই!”

শান্ত ভ্যাবাছেকা খেল। তাকে বলল মুভি দেখছিল আর এখানে এসে বলছে ঘুমিয়ে ছিল। মিথ্যে কোনটা বলেছে আর কাকে বলেছে, সেটাই ধরতে পারছে না সে। আহিম আগুনে আরেকটু ঘি ঢেলে বলল, “অনেকক্ষণ ধরে আমরা অপেক্ষা করছি, আরেকজন তো সেই কখন থেকেই!”

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বলল, “কে?”

সবাই একসাথে হেসে উঠল। শান্ত এবার রেগে উল্টো করে বসে রইল। বাকি সবাই শান্ত’র রাগের মাত্রা বুঝতে পারলেও নিঝুম বোধহয় বুঝতে পারছিল না। সে আহনাফ কে জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা ইফা এলো না কেন?”

“ওর নাকি মাথা ধরেছে, দরজা বন্ধ করে বসে আছে তাই আসেনি!”

“আচ্ছা,আমরা কি এখানে শুধু এভাবেই বসে থাকবো।

আহিম বলে উঠল, “তুমি বললে নাচতেও রাজি!”

“না নাচানাচি থাক, চলুন সবাই বসে লুডু খেলি!”

শান্ত এবার রেগে’টেগে অস্থির। আসা থেকে এই অবদি নিঝুম একবারও তার কথা জিজ্ঞেস করল না। আসর বেঁধে সবাই বসেছে লুডু খেলতে। চারজন খেলছে একসাথে। প্রতি একজনের সাথে বসে একজন সার্পোট করে করে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে নিঝুমের সব গুটি উঠে গেল। খেলা এবার জমজমাট! আবার দেখতে দেখতে শান্ত’ই তার সব গুটি খেয়ে বসে রইল। নিঝুম চার কাঁচা গুটি হাতে নিয়ে শান্ত’র দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। শান্ত বাঁকা হাসল! তাকে ইগনোর করার প্রতিশোধ সে নিয়ে নিয়েছে। নিঝুম নাক ফুলিয়ে আবারো খেলায় মনোযোগ দিল। অমি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে আহনাফের কোলেতে। সেও খুব মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছে। খেলা শেষ হলো, দেখা গেল নিঝুম’ই হেরে গেছে। তবে শান্তও জিততে পারে নি। জিতে গেল আহনাফ! তবুও শান্ত’র মুখ হাসাহাসি। এদিকে নিঝুম দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। আজ শুধু সে শান্ত’র জন্য’ই হেরে গেল। আড্ডা আরো খানিকক্ষণ চলল। গান হলো, নাচ হলো! হইহুল্লোড় কান্ডকারাখানা! এর মাঝে তিথি আর আহিমের ঝগড়াও লেগে গেল। আহিম তার ঝগড়া কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিল। রাতে এখানেই সবাই খেয়ে যাবে। খাবারের যোগাড় যন্ত্র করছে শান্ত আর আহনাফ! নিঝুমও একটু একটু এগিয়ে দিচ্ছে। শান্ত সামনে একবার তাকাল। সবার মনোযোগ টিভিতে। এতোবার দেখা সত্বেও এমনভাবে দেবদাস মুভি দেখছে যেন এই প্রথমবার’ই দেখছে। এবার একটু পেছন ফিরে উঁকি দিয়ে দেখছে নিঝুম কে! নিঝুম তরকারির লবণ চাখছে। আহনাফ মিটিমিটি হাসছে। সুযোগ পেয়েই শান্ত’র চশমিশের চুল টেনে দিল। এদিকে চশমিশ অবাক হয়ে আশপাশ তাকাচ্ছে। আহনাফের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাতেই আহনাফ শান্ত’র ঘরের দিকে ইশারা করল। নিঝুম গুটিগুটি পায়ে সেদিকেই রওনা দিল। আহনাফের হাসি থামছে না, বরং বাড়ছে। সেই সাথে কাজের চাপও। খাবার বাইরে থেকে আনালেই বোধহয় ভালো হতো। তানিশা মুখ ফিরে তাকাল রান্না ঘরের দিকে। কেউ নেই, আহনাফ কে একাই সব সামলাতে হচ্ছে!
চশমিশ মুখ ফুলিয়ে বলল, “আপনি আমার চুল টানলেন কেন?”

শান্ত চট করে আবার চুল টেনে বলল, “বেশ করেছি! তুমি জানো, তোমার জন্য আজ সবাই আমাকে নিয়ে কতো হাসাহাসি করেছে।”

“আজব আমার জন্য কেন হাসাহাসি করবে। বলুন আপনি পাগলামি করেছেন বলে হেসেছে। আর আপনি আবার আমার চুল কেনো টানলেন?”

শান্ত এক পা এগিয়ে এলো। নিঝুম চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। শান্ত বলে উঠল, “একে তো তুমি দেরি করে এসেছো, তার উপর এসেও আমায় ইগনোর কেন করছিলে?”.

নিঝুম চোখের চশমা ঠিক করে বলল, “যা করেছি বেশ করেছি।”

“চশমিশ!

“অশান্ত!

“এই ঝুম ঝুমাঝুম ঝুম!

“এই দেখুন দেখুন, আপনাকে আমার আসল নামে ডাকতে বারণ করেছি বলে একদম উল্টোপাল্টা নামে ডাকবেন না বুঝলেন।”

“একশ বার ডাকবো আর একমাত্র আমিই ডাকবো।”

নিঝুমের চোখে চোখ রেখে কথাটা বলল শান্ত। নিঝুম শীতল গলায় বলল, “ডাকলে একদম ভালো হবে না।

“কি করবে তুমি ডাকলে?

“দেখবেন কি করবো?

“কি’বা করতে পারো, ওই তো তোমার রাক্ষসী দাঁত গুলো দিয়ে কামড় বসাবে এই তো!

নিঝুম কিছু একটা বলতে নিল, এর আগেই অমি ডেকে উঠলো “মিয়াও”। দুজনেই ফিরে দেখল অমি বেশ মনোযোগ দিয়ে তাদের ঝগড়া শুনেছ। নিঝুম চোখ ফিরিয়ে শ্বাস ফেলে বলল, “অশান্ত সরি বলুন।

“কেন বলবো?

“ভুল করেছেন তাই।

“কখনো না।

“কেমন বয়ফ্রেন্ড আপনি, গার্লফ্রেন্ড সরি বলতে বলছে তবুও বলবেন না।

“গার্লফ্রেন্ড অর্ধেক পাগল হলে তার সবকথা শুনতে নেই।

“অশান্ত আপনি আমায় পাগল বলেছেন?

“হ্যাঁ বলছি?

“আচ্ছা আপনি জানেন পাগল কি করে?

“মানে?

“এখন দেখুন পাগলের পাগলামি!

বলামাত্র শান্ত’র চুল দুই হাতে টেনে ধরল নিঝুম। শান্ত খুব চেঁচামেচি করে কোনমতে নিঝুমের হাত সরাল। তবুও শান্ত হলো না নিঝুম। শান্ত’র হাতে খুব জোড়ে কামড় দিয়ে বসল নিঝুম। আবারো কোনোমতে তাকে সরাল শান্ত। ধপাস করে খাটে বসে পড়ল। নিঝুম দূরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। শান্ত হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আরেকটু হলে গোশত উঠে আসত। কি পাগলামি করছো!”

নিঝুম হঠাৎ হেসে উঠলো। হেসে বলল, “অশান্ত শুনুন!

“কি?

নিঝুম একটু কাছে এগিয়ে এসে শান্ত কে শুড়শুড়ি দিতে লাগল। শান্ত লাফিয়ে উঠে বলল, “একি করছো!

“দাঁড়ান দাঁড়ান, আমায় পাগল বলেছেন তো পাগলামি কাকে বলে দেখুন।

“নিঝুম না, নিঝুম!

বলতে বলতে দেওয়ালের সাথে ঠেকলো শান্ত। নিঝুম তাকে শুড়শুড়ি দিয়েই যাচ্ছে। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবারের মতো অবস্থা! দুজনের হাসির আওয়াজে সবাই দরজার আড়াল থেকে একবার উঁকি দিলো তাদের। অতঃপর আহনাফ ইশারা করতেই আবারো চলে গেল।
হাসতে হাসতে শান্ত’র মুখ চোখ সব লাল হয়ে গেছে। নিঝুমেরও প্রায় একই অবস্থা! শান্ত কোনমতে উঠে দাঁড়াল। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গেছে তার।
নিঝুম এখনো নিচে বসে হাসছে। শান্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার পাগলামি এবার বন্ধ করো, সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছো তুমি!”

নিঝুম আবারো উঠে দাঁড়াল। কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, “আপনি আবারো আমায় পাগল বলছেন অশান্ত!”

“পাগল কে পাগলই বলতে হয়।

নিঝুম ছুটে এলো আবারো শান্ত কে জব্দ করতে। শান্ত তার আগেই নিঝুমের হাত ধরে ফেলল। নিঝুম এবার পারছে না শান্ত’র সাথে। খুব চেষ্টা করছে হাত ছাড়ানোর। শেষে হেসে বলল, “অশান্ত হাত ছাড়ুন!

“না, ছাড়া যাবে না। তুমি জানো না পাগল কে বেঁধে রাখতে হয়। নাহলে তারা সাধারণ মানুষের ক্ষতি করে বেড়ায়। তুমিও তাদের একজন।

নিঝুমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। মনে হচ্ছে শান্ত’র কথায় খুব কষ্ট পেয়েছে সে। শান্ত হেসে হাত দুটো দিয়ে নিজেকে আবদ্ধ করে নিঝুম কে কাছে টেনে ধরল। নিঝুমের মুখটা উঁচু করে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তুমি তো আমার পাগলি, তাই তোমাকে আগলে রাখার দায়িত্বও আমার। বেঁধে রাখবো শিকল দিয়ে!

নিঝুম চোয়াল শক্ত করে শান্ত’র পিঠে খামচি বসিয়ে দিল। শান্ত ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করে বলল, “বাড়িতে গিয়ে আজ প্রথম কাজ নখ কাটবে। এতো বড় বড় নখ নিয়ে থাকো কি করে?

“আমার নখ তো বড় না।

“তাহলে খামচি এতো জোরে লাগছে কেন? নিঝুম লাগছে!

নিঝুম দাঁত বের করে হেসে বলল, “পাগল কে সাথে নিয়ে থাকতে গেলে ওমন দু একটা কামড় আর আচড় খেতেই হবে অশান্ত!

“খরগোশের মতো দাঁত, আর বিড়ালের মতো নখ। না এই মেয়ের সাথে থাকা সত্যিই অসম্ভব!

“কিন্তু এডযাস্ট তো আমি করছি!

শান্ত ভ্রু কুঁচকে নিল। নিঝুম আবারো দাঁত বের করে হাসল!

——-

আশালতা নিঝুমের ব্যাপারে কিছু খোঁজ খবর যোগাড় করেছে। তবে কথাটা কবীরের কানে যেতে সময় লাগে নি। কথাটা তার কানে যাবার সাথে সাথেই সে সব কিছু বন্ধ করে দিল। আশালতা এর মাঝেই অল্প কিছু তথ্য জেনেছে। মেয়েটার নাম নিঝুম, শান্ত’র সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ে। শান্ত’র সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে জোড়ালো ভাবে তেমন কিছুই পাওয়া যায় নি। তবে ওরা দুজন বেশির ভাগ সময়ই একসাথে থাকে। নিঝুমের বাবা সাধারণ একজন স্কুলের শিক্ষক! তারা দুবোন আর মা হাউজ ওয়াইফ! এতো টুকু জানতে পেরে আশালতা আপাতত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে নিয়ে যতোটা ভেবেছিল তেমন কিছুই পেলো না। কিন্তু তার মন মানতে চাইছে না তবুও। আর কবীর’ই বা হঠাৎ এটাতে এতো ইন্টারেস্ট কেন দেখাচ্ছে। মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজখবর নেবার সব পথ বন্ধ করে রাখল’ই বা কেন?

বসার ঘর থেকে কবীরের গলার আওয়াজ আসছে। চায়ের জন্য ডাকছে সে। আশালতা হেসে চা বানানোর জন্য রান্না ঘরে ঢুকল। কবীর কিসব কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। দুজনেই শান্ত, নিরব অথচ কে বলবে তাদের মাঝেও কিছু একটা চলছে। অদৃশ্য এক যুদ্ধ! সেই যুদ্ধে একজনের বিপক্ষে আরেকজন। খুব ভালো করেই জানে একজন অন্যজনের ক্ষমতা! তবুও মুখে টু শব্দটি অবদি নেই। এমন ভাবে কথা বলছে, হাসছে যেন তারা কতো সুখি তবে সত্যিই কি তাই!

ভার্সিটিতে ক্যাম্পাসে বসে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আহনাফ, আহিম, শান্ত, নীলাভ্র আর আফিন! আহিম গালে হাত দিয়ে বলল, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, শান্ত আর নিঝুম প্রেম করছে।

শান্ত বাঁকা চোখে তাকাল। নীলাভ্রের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা। আহনাফ হেসে বলল, “বিশ্বাস না করার কি আছে?

“ওরা যা ঝগড়া করতো, যদিও এখনো করে। সেদিন দেখলি তো, নিঝুম রেগে কি করে শান্ত’র মাথায় আইসক্রিম ঠেলে দিল।
কথাটা বলামাত্র সবাই একসাথে হেসে উঠল। এমনকি শান্ত ও! আহিম হেসে বলল, “শান্ত, এখনো সময় আছে।তুই চাইলে মন বদলাতে পারিস।

“শা’লা তুই চুপ করবি।
আফিন চিমটি কেটে বলে উঠল। আহিম বলে উঠল, “আরে মিথ্যে কি বলছি। শান্ত তুই এখনো ভেবে নে, যদি ভাবিস এই মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতবি তাহলে তো হলোই!

শান্ত ভ্রু কুঁচকে নিল। ব্যাপারটা এখন কেমন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। নীলাভ্র মলিন মুখে তাকিয়ে আছে শান্ত’র দিকে। শান্ত হঠাৎ হেসে বলল, “পাগলির সাথে সংসার কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং হয় জানিস!”

শান্ত’র কথা শুনে আবারো হেসে উঠলো সবাই। আহনাফ বলে উঠল, “নিঝুম যদি জানে তুই আবারো ওকে পাগল বলেছিস তো হলো?

“উহু , কি আবার হবে?

আফিন হঠাৎ বলে উঠল, “আহিম একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিস?

“কি!

“শান্ত আর নিঝুম কিন্তু সারাক্ষণ ঝগড়া করতো, তুই আর তিথিও তেমন সারাক্ষণ ঝগড়া করিস!

“তো!

“তো দেখ নিঝুম আর শান্ত তো প্রেম করে ফেললো। দেখ তোদের ব্যাপারটাও কি না এমন হয়!

আহিম হতচকিয়ে গেল। সবাই সিরিয়েস মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আহিম উঠে দাঁড়াল। খানিকটা বিচলিত হয়ে বলল, “হুহ এমনটা কখনো হবে না।

“হবে হবে! যারা বেশি ঝগড়া করে তাদের মধ্যে’ই প্রেম পিরিতি বেশি হয় এটা জানিস!

আহিম না না করে সেখান থেকেই উঠে দাঁড়াল। আফিন মুখ টিপে হেসে সবার দিকে ফিরল। আহিম হন হন করে সামনে আসতেই দেখল তিথি তার দিকেই আসছে। দ্রুত সে পথ বদলে নিল। না না কখনো না, এই মেয়ের প্রেমে তো সে ভুলেও পড়বে না। এর চেয়ে ভালো কাঁদায় পড়ে মাখামাখি খাবে তবুও তিথির প্রেমে পড়বে না!

——

নিঝুম সেই কখন থেকে শান্ত’র ঘরের বাইরের কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শান্ত’র আসার কোন দাম’ই নেই। কি করছে কি অশান্ত! শেষে দরজায় ধপাস করে বারি মারতে লাগল সে। শান্ত ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখল তার সামনে চশমিশ দাঁড়ানো। দ্রুত চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি এখানে!

“হ্যাঁ আমি, কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি কি করছেন?

“ঘুমিয়ে ছিলাম, কিন্তু কেন? কি হয়েছে?

“সরুন সরুন বলছি!

তড়িখড়ি করে ঘরে ঢুকে পড়ল নিঝুম। শান্ত’র দৃষ্টিতে অবাক। অমি হেলেদুলে আসছে দরজার দিকেই। তারও ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে নিঝুম। সে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে মিয়াও মিয়াও করছে। হঠাৎ নিঝুম বলে উঠল, “আচ্ছা অশান্ত, অমি ছেলে নাকি মেয়ে!

“ছেলে কেন?

“আরেকটা মেয়ে বিড়াল পালবেন।

“তুমি কি ভাবো আমার বাসাটাকে!

“আরে, ভালোই তো হবে অমি একটা বোন পাবে।

শান্ত ভ্রু কুঁচকে অমি’র কি তাকিয়ে ধীর স্বরে বলে, “সত্যিই কি!

নিঝুম সোফায় উঠে বসে। তার ব্যাগ থেকে একটা বিড়াল বের করে তার পাশে রাখে। বিড়ালটা খুব ছোট আর খুব শান্ত! শান্ত মলিন মুখে বলে, “তুমি তো সাথে করে বিড়াল নিয়েই এসেছো!

“তো কি করবো বলুন, পেলাম তাই নিয়ে এলাম।

শান্ত বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিল। অমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নিঝুম চোখের চশমা ঠিক করে বলল, “আমার বাড়িতে বিড়াল পালা অসম্ভব! আমার মা আমাকে নিয়েই অস্থির, বিড়াল নিয়ে কোন ঝামেলাই তিনি করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাই আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। রেখে দিন না অশান্ত!

“না রাখবো না!

“অশান্ত! এমন নি’ষ্ঠুর হতে পারেন কি করে আপনি?

“এভাবে এভাবেই!

“আপনাকে’ই রাখতে হবে, বাসায় যাচ্ছি আমি। কেউ নেই বাড়িতে!

“বাড়িতে কেউ নেই মানে?

“আব্বু আর আম্মু গ্রামের বাড়িতে গেছে, দুদিন পর আসবে। হিনা বাসায় একা, আমায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে!

বলমাত্র নিঝুম উঠে দাঁড়াল। শান্ত’র দিকে ফিরে হাত নাড়িয়ে বাই বলে দরজার দিকে আগাতেই শান্ত দ্রুত বিড়ালটাকে কোল থেকে নামিয়ে নিঝুমের হাত ধরে বলে, “শোন!

“কি?

“আরেকটু থেকে যাও না!

“কিন্তু অশান্ত…

“তুমি থেকে গেলে আমি কিন্তু ওকে রেখে দেবো, প্লিজ থাকো, বেশি না এক ঘন্টা! তারপর আমি গিয়ে তোমায় বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবো!

নিঝুম চোখের পাতা ফেলে একবার দেখছে অশান্ত আরেকবার দেখছে বিড়ালটা কে। অমি একলাফে সোফায় উঠে বসে বিড়ালের কাছে। মিয়াও মিয়াও বলে ডেকে যাচ্ছে তাকে!

#চলবে #তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৫

“হ্যালো হিনা!

“বল!

“কি করছিস?

“বই পড়ছি, বিরক্ত না করে জলদি বলো কি হয়েছে?

“আমার আসতে ঘন্টা খানিক লাগবে, তুই দেখ দরজাটা ঠিক করে বন্ধ করা কি না‌।

“ঘন্টা খানিক কেন? পারলে দু ঘন্টা দেরি করেই আসো।‌ ততোক্ষণে বইটা শান্তিতে পড়ে শেষ করতে পারবো। আর দরজা বন্ধ’ই আছে। আর কিছু!

“না!

বললাম ধপাস করে হিনা ফোনটা রেখে দিল। তার অনেকখানি মনোযোগ নষ্ট করে দিলো নিঝুম আপা। আবারো মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। এই মেয়েটা সবসময় হুট করে এসে এমনটা করে রাগিয়ে দেয়। হিনার বেশ রাগ লাগছে। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছন ফিরল। শান্ত‌ কোল থেকে ছোট্ট বিড়াল টাকে নামিয়ে রেখে বলল, “কি বলল?

“বলেছে ঘন্টা দুয়েক দেরি করে আসতে, ততোক্ষণে ওর বই পড়া শেষ হবে।

“তার মানে তুমি নির্ঘাত ওকেও জ্বালাও!

“কি বলতে চান আপনি!

“কিছু না, এসো বসো। মুভি দেখবে?

“হুম দেখবো, আচ্ছা অশান্ত ওর একটা নাম ঠিক করুন না!

“মিনি! নামটা কেমন?

“আর কোন নাম পেলেন না।

“কেন? ছোট দুই অক্ষরের নাম, সবসময় মনেও থাকবে আর ডাকাও যাবে।

নিঝুম মুখ ভেংচি কেটে মিনিকে নিজের নিল। সে এখনো গুটিসুটি মেরে বসে আছে । শান্ত চোখ ঘুরিয়ে দেখছে নিঝুম কে। সে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মিনির কোলে। হঠাৎ হঠাৎ কোন নারীকে কোন কারণ ছাড়াই অনেকটা রূপবতী লাগে, নিঝুম কেও এখন তেমনটাই লাগছে শান্ত’র কাছে। এদিকে অমিও হা হয়ে তাকিয়ে আছে মিনির দিকে। শান্ত’র কেন জানি মনে হচ্ছে অমি ওকে বোন না বানিয়ে বউ বানিয়ে ছাড়বে!
নিঝুম ফ্যাকাশে মুখে বলল, “আচ্ছা অশান্ত, ওর কি কিছু হয়েছে?

শান্ত ভ্রু কুঁচকে তাকাল মিনির দিকে। হ্যাঁ অনেকটা অন্যরকম লাগছে দেখতে, কেমন গুটিগুটি হয়েই থাকছে। আর সবচেয়ে অবাক করবার বিষয় চশমিশ দিব্যি ওকে কোলে তুলে বসে আছে। অমি কে কখনো এভাবে কোলে নিয়েছিল বলে মনে পড়ছে না। যদিও চশমিশের বিড়াল পছন্দ না, তবুও মিনির জন্য তার মায়া অনেকখানি! শান্ত হালকা কেশে একটু গা ঘেঁষে বসে বলল, “আচ্ছা, তোমার হঠাৎ কি হলো বলো তো? বিড়াল’ই তো সহ্য হয় না, সেখানে নিজেই একটা বিড়াল নিয়ে এসেছো পালবার জন্য!

নিঝুম শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “ওকে হিনা বাসায় নিয়ে এসেছে। আমাদের বাসার পিছনে পড়ে থাকতে দেখেছিল তাই তুলে নিয়ে এসেছে। তখন থেকেই ও এমন হয়ে আছে!

শান্ত নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “চিন্তা করো না, কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো! কিন্তু এটা আমার প্রশ্নের উওর ছিল না।

“বলছি বলছি, মিনি আপনার অমি’র মতো আমায় কামড় দেয় না। আপনি জানেন ও একবারও আমার খামচি অবদি দেয় নি। আর অমি!

বলেই অমির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অমি মিয়াও মিয়াও বলে চেঁচাতে লাগলো। সে বেশ বুঝেছে নিঝুম তার নামে দোষ দিচ্ছে। এই দোষ নিজের ঘাড়ে নিতে কোনমতে রাজি না সে। শান্ত হেসে মিনি কে তুলে বলল, “ওকে খাবার দিয়ে আসি!

“আচ্ছা অশান্ত ওকে গোসল করিয়ে দিলে কেমন হবে?

“এই রাতে গোসল করাবে,‌ বেচারা ঠান্ডাতে মরে যাবে।

“ওহ আচ্ছা আচ্ছা, সরি বুঝতে পারি নি!

শান্ত মুখ ফিরে তাকাল। নিঝুমের মুখটা চুপসে গেছে নিমিষেই। মনে হচ্ছে কতোবড় একটা অন্যায় করে ফেলেছে সে। শান্ত হেসে অমি’র বিছানায় মিনি কে শুইয়ে দিল। অমি রেগে তাকিয়ে আছে। নিঝুম অমি’র দিকে তাকিয়ে বলল, “একদম ওকে জ্বালাবে না বুঝলে!

অমি রেগে লেজ নাড়িয়ে চলে গেল। অমি’র কেবল’ই মনে হচ্ছে এবার তার দাম কমে যাবে।‌ নতুন একজন ঘরে এসেছে, সবাই এখন তাকে নিয়েই ব্যস্ত! তাকে দেখবার সময় কারো নেই। বোধহয় তাড়িয়েই দিবে, তখন গিয়ে কোথায় উঠবে সে!

শান্ত ক্যাট ফুড দিতেই মিনি খেতে আরম্ভ করল। নিঝুম হা হয়ে তার খাওয়া দেখছে। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে আগে কখনোই সে বিড়ালকে খেতে দেখেনি। চট করে বলে উঠল, “আমিও ওকে খাবার দিয়েছিলাম কিন্তু তখন খেলো না কেন?

“কি দিয়েছিলে?

“যা আমি খাই!

শান্ত নিঝুমের মাথায় হালকা করে বারি মেরে বলল, “চশমিশ ও আইসক্রিম খায় না।

“আরে না আইসক্রিম দিই নি তো।

“আমার মনে হয় ও কোন পোষা বিড়াল। হয়তো হারিয়ে গেছে নাহলে রেখে গেছে।

“এতো কিছু কি করে জানলেন?

“কারণ যে বিড়াল গুলো এভাবে রাস্তায় থেকে অভ্যস্ত তারা কখনো মানুষের এতো কাছাকাছি চুপচাপ থাকে না। ও কতো সুন্দর করে ছিল দেখলে!
নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আবারো নিচু হয়ে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “খেয়ে এখানেই ঘুমিয়ে পড়ো!

শান্ত হেসে সোফার দিকে তাকিয়ে বলল, “অমি কোথায় শোবে তাহলে?

নিঝুম পেছন ফিরল। খুব রাগ করে সোফায় বসে আছে অমি। নিঝুম দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলল, “কেন আপনার সাথে।

“তুমি অমি’র ঘর দখল নিতে এসেছো।

“বেশ করেছি!

চোখের চশমা ঠিক করে সোফার দিকে আগালো নিঝুম। শান্ত মৃদু হাসল।
মুভি দেখবার বেশ আয়োজন। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে মুভি দেখতে বসেছে শান্ত আর নিঝুম। তাদের কাছে এক বাটি পপকর্ন আর জুসের প্যাকেট। নিঝুম জুসের প্যাকেটে চুমুক দিল। মুভি চলছে স্পাইডার ম্যান নো ওয়ে হোম! নিঝুমের পুরো মনোযোগ মুভির দিকে। এদিকে শান্ত তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। দু’চোখ ভরে তাকে কিছুক্ষণ দেখবার আশায়, সাথে থাকতে বলেছিল সে। কি ওমন আছে এই মেয়েটার মাঝে, কি তাকে এতো আকর্ষিত করে শান্ত আজ অবদি বুঝল না। অশান্ত’র দু’টি চোখ এখনো তার চশমিশের দিকে। চশমিশ বার বার চোখের পাতা ফেলছে, ঠোঁট নেড়ে পপকর্ন খাচ্ছে। তার বেনী করা চুল গুলো ইতি মধ্যেই খুলে আসছে তার চোখের সামনে। বড্ড জ্বালাচ্ছে চুল গুলো। নিঝুম মাথা নাড়িয়ে চুল গুলো সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করছে। নিঝুম হাত বাড়িয়ে পপকর্ন এর বাটিটা দিল শান্ত’র কাছে। সেদিকে তার কোন ধ্যান জ্ঞান নেই। পুরো ধ্যান জ্ঞান এখন নিঝুমের উপর। নিঝুম মুখ ফিরে এবার তার দিকেই ফিরল। ভ্রু কুঁচকিয়ে আনলো। শান্ত’র দৃষ্টি তবুও সরলো না। কোন যেন এক নেশায় আসক্ত সে! কার নেশায় আসক্ত, এই চশমিশের। সাদাসিধে একটা যার মধ্যে এক ধরণের অসাধারণ গুণ আছে। সেই গুণটা হচ্ছে সবাইকে তার প্রতি আকর্ষিত করা। তার এই প্রবল শক্তির কাছে হার মেনে যায় সব পুরুষ! মেয়েরা এই দেখে চরম ঈর্ষে করে তাকে। শান্ত’র কানে এখন আর মুভির কোন আয়োজন আসছে না, কোন যদি কথা তার কানে আসছে তা হলো নিজের বুকের ধুবপুকানির শব্দ। নিঝুমের ঠোঁটজোড়াও এবার নড়ছে। শান্ত তার কথা শোনার চেষ্টা করল, মোহিত চোখে তাকাল নিঝুমের ঠোঁটের দিকে। তার ঠোঁটের আকৃতি বলছে নিঝুম কি বলছে!

“এই অশান্ত!

“হুম!

“কি দেখছে অমন ভাবে?

“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস!

“এটা বুঝি আমি!

“আমার কাছে তুমিই একমাত্র সেই অপরূপ সৌন্দর্য, যার সৌন্দর্যের মায়ার আমি বরাবরই আটকে যাই!

নিঝুম কিছুক্ষণের জন্য বোধহয় নিশ্চুপ হয়ে গেল। শান্ত’র দৃষ্টি তাকে বাধ্য করছে চোখ সরাতে। বলছে, “এই চোখ সরাবে না একদম না, যদি সরাও তবে খবর আছে!”

শান্ত হঠাৎ মৃদু হেসে বলল, “আর জানো মজার ব্যাপার কি?

“হুঁ!

“সেই অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারীনী শুধুই আমার, একান্ত আমার!

নিঝুমের ঠোঁটের কোনেও হাসি হাসি। তবুও সে চোখ সরায় নি, না শান্ত দৃষ্টি সরালো। দুজনের মাঝেই চিন চিন নিরবতা, শুধু আয়োজন আসছে টিভি থেকে। কিন্তু এই আয়োজন তাদের মনোযোগ ভঙ্গ করতে পারছে না। শান্ত না পারছে নিজের মনকে সরিয়ে চশমিশের থেকে চোখ ফেরাতে, আর নিঝুম না পারছে অশান্ত’র দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে। কোন এক অন্য জগতেই আছে তারা।‌ শান্ত ঢোক গিলে বলে উঠল, “চশমিশ!

“হুঁ!

“তুমি বিশ্বাস করবে?

“হুঁ!

শান্ত হাসল, নিঝুম তার কিছুতেই হুঁ হুঁ করছে। তবুও দৃষ্টি সরালো না। কেন জানি সরাতে ইচ্ছে করছে না। আশ্চর্যের বিষয় এভাবে তাকিয়ে থাকতেও দুজনের একজনরেও লজ্জা লাগছে না। শান্ত স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, “সবার জীবনেই একজন বিশেষ নারীর আগমন ঘটে, আমার জীবনে সে তুমি আর তুমিই প্রথম!

নিঝুমের দৃষ্টি এবার খানিকটা নড়বড়ে। হয়তো কথাটা সে বিশ্বাস করতে চাইছে না। এই একটু পর দৃষ্টি সরিয়ে আনবে। কিন্তু শান্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার দৃষ্টিতে নিঝুম কে আটকে রাখতে। তাই সে এবার একটা ভয়ানক কাজের সিদ্ধান্ত নিল। হাত বাড়িয়ে নিঝুমের গালটা ধরল। নিঝুম কেঁপে উঠলো, এতো শীতল কেন হাতটা? তার দৃষ্টি এখনো সরিয়ে আনেনি। হঠাৎ শান্ত বলে উঠল, “আমি এটা করতে চাই!

“কি?

বলার আগ অবদি সব ঠিক থাকলেও এবার বোধহয় সব তলিয়ে যাচ্ছে। নিঝুম তার দৃষ্টি ঠিক রাখতে পারছে না। দ্রুত চোখ গুলো বন্ধ নিল সে। কোন এক শীতল ছোঁয়ার অনুভূতি তার সমস্ত শরীরকে কম্পিত করল। পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল সে। হাত দুটো মুঠো করে নিল এর মধ্যেই! খানিকক্ষণ পরেই যেন সবকিছু শান্ত হলো, না এখন আর সেই অনুভুতি নেই। গালের কাছে শান্ত’র শীতল হাতের ছোঁয়াও নেই। ঝড় যা এসেছিল চলে গেছে, ‌বাকিসব তো ঠিক আছে কিন্তু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে নিঝুম কে। সে চোখ মেলল! অমনি যেন আকাশ থেকে পড়ল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার।‌ শান্ত’র দৃষ্টি এবার টিভিতে। খুব মনোযোগ দিয়ে মুভি দেখছে সে। নিঝুমের কেমন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। শান্ত হেসে তার দিকে ফিরে পপকর্নের বাটি টা নিল।‌ নিঝুমের দৃষ্টিতে বিস্ময়, কিন্তু সেটা উপেক্ষা করতে সক্ষম হলো শান্ত। নিঝুমের এবার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ঝড়ের কোন চিহ্ন নেই আশেপাশে। সত্যিই কি কিছু ঘটেছিল তার আর শান্ত’র মাঝে। সত্যিই কি শান্ত তার কাছে ছিল, অনেকটা কাছে! সবটাই ধোঁয়াশা লাগছে, এমন কিছু হয়ে থাকলে অশান্ত কে কেন এমন লাগছে দেখতে। ভাবটা এমন কিছুই হয় নি। অশান্ত কি তবে ভান করছে! না, তা হয় কি করে? নিঝুম ঘুড়ে বসল, স্বপ্ন কি দেখছিলো সে, এমন ভয়ানক স্বপ্ন কি করে দেখতে পারল সে। লজ্জায় মুখ চোখ সব লাল হয়ে যাচ্ছে। বিচলিত হয়ে তাকাচ্ছে আশপাশ। তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। কতোটা ভয়ানক এই স্বপ্ন! অশান্ত’র দৃষ্টিতে নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছিল সে! কি বিস্ময়কর কথা! তবুও বিশ্বাস হচ্ছিল না এটা স্বপ্ন! নিঝুম খুব করে চাইছে এটা সত্যি হোক! কেন চাইছে? ছিঃ! এসব কি কথা!
আড়চোখে ফিরল শান্ত’র দিকে। অনেকটা স্বাভাবিক সে, সত্যিই এমন কিছু হলে অশান্ত কি স্বাভাবিক থাকতে পারতো। সে নিজেই তো পারছে না। শান্ত’র‌ দুই ঠোঁটজোড়া তার দৃষ্টি আঁকড়ে রেখেছে। সত্যিই কি এই ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়েছিল তার ঠোঁট! হালকা কালচে ধরণের এই ঠোঁট দুটো ছিনিয়ে নিল নিঝুমের সকল মনোযোগ! হঠাৎ শান্ত তার দিকে ফিরতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে আনলো সে। শান্ত বলে উঠল, “নিঝুম ঠিক আছো তুমি?

“হুম!

“কাঁপছো কেন অমনভাবে?

“শীত লাগছে আমার!

শান্ত আঁকড়ে ধরল নিঝুম। ঠান্ডা বাতাস বইছে বাইরে, জানাল দিয়ে সেই বাতাস ঘরেও আসছে। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ, ক্ষীণ আশা বৃষ্টি এখনই শুরু হবে। অমনি ঝর ঝরিয়ে বৃষ্টি। সে কি বৃষ্টি, এই সেদিন তো বৃষ্টি হয়েছিল। সেই বৃষ্টিতে অশান্ত কে আঁকড়ে ধরেছিল সে। তখনো তো এতো লজ্জা লাগেনি। তবে আজ কেন হঠাৎ করে লাগছে।‌ কেন এসব অনুভূতি!
শান্ত নিঝুম কে এগিয়ে দিতে বের হয়েছে। কিছুদূর এসেছো দু’জন বাসে করে। এই বৃষ্টির মধ্যে সিএনজি, রিক্সা কিছুই পাওয়া যায় নি। গেলো তো শেষে এই একটা বাস! শান্ত’র গাড়ি ওয়াশে দিয়েছে। আসতে এখনো দিন দুয়েক লাগবে। ছাতার তলে হাঁটছে দুজন। পাশাপাশি গা ঘেঁষে হাঁটছে, নিঝুমের শরীর এখনো কাঁপছে। শান্ত এক হাত দিয়ে আগলে ধরে আছে তাকে। থাকবে বাই না কেন? কথা দিয়েছিল যে আগলে রাখার! বৃষ্টির ছিটে এসে পড়ছে গায়ে। নিঝুমের শরীর কেঁপে উঠছে বার বার!
বাড়ির কাছে এসেই পড়েছে, রাস্তায় একটা ল্যাম্পপোস্ট ছাড়া আর কারো দেখা নেই। খুব অসম্ভব নয় তা, এই ঝড় বৃষ্টির মাঝে নিশ্চিত কেউ বের হইতে চাইবে না। নিঝুম হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। শান্তও থমকে গেল সাথে সাথে। নিঝুমের দিকে ফিরে তাকাল সে। নিঝুমের দৃষ্টি স্থির! একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চলেছে সে, না এবার জিজ্ঞেস করতেই হবে। সে যতোই লজ্জায় পড়তে হোক তাকে। নাহলে এই দ্বিধার মাঝে থেকে রাতে যে ঘুম হবে না তার!

“কিছু বলবে?

“অশান্ত!

“হুঁ!

“সেটা স্বপ্ন ছিল নাকি সত্যি ছিল!

কথাটা বলেই লজ্জায় নিজের জিহ্বা কামড়ে ধরল নিঝুম। তবে কথার ধরণ ভালো ছিল। শান্ত যদি জিজ্ঞেস করে, “কিসের কথা বলছো?” তাহলে বুঝতে হবে ওটা স্বপ্ন ছিল। আর যদি জবাব না দেয় তাহলে…

তবে না, শান্ত হাসল, একটু বেশিই হাসল। নিঝুম কপাল কুঁচকে নিল। এর অর্থ কি?
শান্ত সোজা হয়ে দাঁড়াল নিঝুমের সামনে! নিঝুমের এবার খানিকটা ভয় লাগতে শুরু করল। কেন লাগছে ভয়! শান্ত আবারো তার গালে হাত রাখল, কেন রাখল এই হাত! এই অর্থ কি? শান্ত এবার বলে উঠল, “তুমি নিজেই বুঝে নাও!”

বলেই আবারো আঁকড়ে ধরল ঠোঁট দুখানা। নিঝুম এবার শান্ত’র হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। দৃষ্টি মেলে রাখা এখনো সম্ভব হলো না, কখনোই হবে না! আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে এই বৃষ্টি, সেই দিনের মতো আজও বৃষ্টি! সেই বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা! প্রেম নিবেদন করছে তারা, চুম্বন করছে একে অপরকে। তাদের আড়ালে ঢেকে রেখেছে শুধু একটি মাত্র ছাতা। খুব কি ভালো হতো না, ছাতা টা সরিয়ে রেখে বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে!
শান্ত ছেড়ে দিল নিঝুম কে। নিঝুম শক্ত করে এখনো শান্ত’র হাত ধরে আছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় নিঝুমের লজ্জা মাখা মুখ দেখতে মোটেও খারাপ লাগছিল না শান্ত’র । এই মুখখানি একটু আগেও দেখেছিল সে। চোখ বুঝে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলো সে। শান্ত’র বেশ ইচ্ছে করছিল ডেকে তুলতে, কিন্তু না! ডাকলো না সে, বরং একটু ভান ধরলো। এখন মনে হচ্ছে ভান ধরেই ভালো কাজ করল!

লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিল নিঝুম! হাত ছেড়ে দিল সে। শান্ত বলে উঠল, “তো কি বুঝলে!

জবাব দিল না নিঝুম, দৌড়ে বেরিয়ে পড়ল ছাতা থেকে।‌দুই হাত মাথার উপর রেখে বলল, “চলে যান আপনি!

“আরে একি করছো, ভিজে যাচ্ছো যে!

নিঝুম হাসলো, লজ্জা মাখা এই মুখের হাসি থমকে দিল শান্ত কে। বলে উঠল, “আপনি চলে যান, বাসা এইতো আমিও চলে যেতে পারবো!

বলমাত্র ছুটল নিঝুম। শান্ত এক পাও নড়ল না। বরঞ্চ দাঁড়িয়ে রইল। তার চশমিশ দৌড়ে বৃষ্টির মাঝে যাচ্ছে, আর ছাতার তলে দাঁড়িয়ে সে। কি মনে করে মাথার উপর থেকে ছাতা সরিয়ে ফেলল সে। ভিজছে, আজ আবারো ভিজছে দুজন! খুব’ই মধুর সময় এই বৃষ্টির সময়!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here