#দ্বিতীয়_বসন্ত-৮
Zannatul Eva
রুহি এক পা দু পা করে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। সায়েদা বেগম ভারী গলায় বললেন, এই মাইয়া! তুই বাড়ির বাইরে গেছিলি?
রুহি কিছু বলার আগেই মাহির বলল, সকালে তো উনার সাথে আমাদের দেখা হয় নি বাবা। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।
তামজিদ আহমেদ অবাক হয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি ভীষণ বুদ্ধিমান। তাই তিনি আন্দাজ করলেন, মাহির তো কখনও মিথ্যে বলে না। যখন বলে তখন সেই মিথ্যায় কারোও না কারোও ভালোই হয়। তাই তিনি আর কথা বাড়ালেন না। একটা হাসি দিয়ে বললেন, তাহলে বোধহয় আমারই ভুল হয়েছে।
রুহি ভীষণ চমকে গেলো। মাহির তাকে হঠাৎ এভাবে বাঁচিয়ে দিল কেনো!! অদ্ভুত! দাদিজানের সামনে যদি বলে দিতো সত্যিটা তাহলে আজকে তুলকালাম হয়ে যেতো। ছেলেটাকে যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম ততোটা খারাপ নয়। সে যাই হোক, এর জন্য যদি ভেবে থাকে আমি ওকে পছন্দ করবো তাহলে ও ভুল ভাবছে। আমি কী বলেছি নাকি আমাকে বাঁচাতে!! ইমপ্রেস করার ধান্দা।
সবাই যার যার মতো কথা বলছিলো এমন সময় মাহির রুহিকে বলল, তোমাদের বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে না? প্রথম বার এলাম।
রুহি কিছু বলার আগেই মমতা খানম বললেন, এই রুহি যা না মাহিরকে আমাদের বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখা। বেচারা এখানে বুড়োবুড়িদের ভেতরে বসে থেকে কী করবে! যা না!
রুহি মায়ের দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে। তারপর মাহিরের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলল, এই ছেলে তো ভীষণ বিরক্তিকর! মা কে শুনিয়ে শুনিয়ে এসব বলার কী দরকার ছিল!! এখন আরও কিছুক্ষন এর সাথে থাকতে হবে। ডিজগাস্টিং।
রুহি মুখে একটা ফেইক হাসি ঝুলিয়ে মাহিরকে বলল, আসুন ভাইয়া আপনাকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাই।
মাহির একটু লজ্জা পেলো। রুহি তাকে ভাইয়া বলে ডাকুন এটা সে কখনোই চায় না। ভার্সিটিতে বলে ঠিক আছে। এখানে বলার কী খুব দরকার ছিল!
দেখুন ভাইয়া এটা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব বাগান৷ এখানে দাদিজান অনেক রকমের ফুল আর ফলের গাছ লাগিয়েছেন। ঐ যে দেখছেন একজন গাছে পানি দিচ্ছেন। উনি হলেন দাদিজানের বাগানের মালি। উনাকে রাখা হয়েছে সবটা দেখার জন্য৷ আর ভাইয়া ঐটা হচ্ছে আমাদের পুকুর। পুকুরের ভেতরে কী সুন্দর পদ্মফুল ফুটে আছে! গ্রামের সৌন্দর্য্য আসলেই একদম অন্যরকম। আমার তো গ্রাম ভীষণ ভালো লাগে।
বাট আই হেইট গ্রাম।
রুহি কপাল কুঁচকে বলল, তাহলে এলেন কেনো?
তোমার জন্য।
হ্যাঁ!
না মানে তোমার জন্য গ্রামটাকে এখন অন্যভাবে জানার সুযোগ হলো৷ পুকুর, পুকুরের ভেতর পদ্মফুল এবং তার অপরূপ সৌন্দর্য্য।
রুহি সবটা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে রইলো।
মাহির বলল, বাই দ্যা ওয়ে আমাকে এখন ভাইয়া না বললেও তো হয়। মানে এখানে তো আর আমি তোমার ভার্সিটির সিনিয়র না। এখন তুমি চাইলে আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারো।
রুহি হেসে বলল, অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে আই উইল ট্রাই।
আচ্ছা রুহি শুনো, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
হ্যাঁ বলুন।
এমন সময়ই মাহিরের ফোন বেজে উঠলো। মাহির ফোন রিসিভ করলো।
বলল, কী! ঐ শালাকে মেরে ওর হাত পা গুড়ো করে রাখ। আমি ঢাকায় এসে বাকিটা দেখে নেবো।
মাহিরের একদমই খেয়াল ছিল না যে রুহি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুহি মাহিরের কথা গুলো শোনা মাত্রই বলল, এই জন্যই আমার আপনাকে সহ্য হয় না। একটা মানুষকে কেউ এভাবে মারতে বলতে পারে ছিঃ! ভার্সিটির সবাই ঠিকই বলে, আপনি আসলেই একটা গুন্ডা। ডিজগাস্টিং।
মাহির হতভম্ব হয়ে বলল, তুমি ভুল বুঝছো রুহি। আসলে ব্যাপারটা এরকম নয়………
রুহি হুরহুর করে ভেতরে চলে গেল। মাহির দেয়ালে একটা ঘুষি মেরে বলল, শীট! বারবার রুহির সামনেই যতো উল্টোপাল্টা ঘটনা গুলো ঘটে। সবে মাত্র কথা গুলো গুছিয়ে আনছিলাম আর তখনি অমিত শালার ফোনটা আসতে হলো। শীট ম্যান!!
এরপর আর মাহির রুহির সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ পেলো না। সারাদিনে একবারের জন্যও রুহিকে দেখতে পায় নি। মাহির মনে মনে বলল, কাল বিয়ে বাড়িতে নিশ্চয়ই রুহিও যাবে। এই সুযোগটা একদমই হাত ছাড়া করা যাবে না।
এরপর মাহিররা তাদের বাড়িতে ফিরে এলো।
__________________________________________________
ময়নার বিয়ের দিন সেখানে তুলকালাম কান্ড ঘটে গেল। পাত্রপক্ষ পনের টাকা ঠিক সময়ে হাতে পায় নি বলে প্রচন্ড ঝামেলা করছে। ওদিকে ময়নার মা ঘরের এক কোনে বসে মুখে কাপড় গুঁজে কান্না করছে। ঝগড়া তুলুম পর্যায় চলে যাওয়ার পর পাত্রপক্ষ পাত্রকে নিয়ে উঠে চলে যাচ্ছিলো। এমন সময় মাহির এসে পাত্রকে কয়েকটা চর থাপ্পর দিয়ে বসলো।
বিয়ে বাড়ির সবাই একদম হতভম্ব হয়ে গেলো। একনিমিষেই হৈচৈ করতে থাকা বাড়িটা একদম থমকে গেলো।
মাহিরের মা বলল, মাহির এখানে এসেও একটা না একটা ঝামেলা পাকাবে৷ তোমার ছেলেকে ধরে নিয়ে আসো।
তামজিদ আহমেদ বললেন, আমার ছেলে ভুল কী করেছে! পন নেওয়া কি ঠিক? এদেরকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
মাহির পাত্রকে বলল, এখান থেকে বিয়ে করে তবে যেতে হবে। নয়তো হাত-পা গুড়ো করে রেখে দিবো।
মায়নার মামা মতিন মিয়া বললেন, বাবা তুমি এর মধ্যে আইসো না। আমরা ওনাগো হাতে পায়ে ধইরা মানায়া লইমু।
মাহির রাগি স্বরে বলল, হোয়াট! আপনারা কেনো ওনাদের হাতে পায়ে ধরবেন? আপনারা তো আপনাদের মেয়েকেই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। তাহলে সাথে করে আবার দানসামগ্রী, পনের টাকা এসব কেনো দিতে হবে?
পাত্রের বাবা রমিজ উদ্দিন বললেন, কারন ওনারা আমগোরে কথা দিছিলো যে বাকি ট্যাকা বিয়ার দিন শোধ করবো। কিন্তু হেরা কথা রাহে নাই। আমি এইহানে আমার পোলার বিয়া দিমু না৷ এই চলো সবাই।
ময়নার বর হঠাৎ বলে উঠলো, আপনি যান আব্বা। আমি ময়নারে বিয়া কইরা তারপরই যাইম। আমার কোনো টাকা-পয়সার দরকার নাই।
রমিজ উদ্দিন প্রচন্ড রাগি স্বরে ছেলেকে বললেন, তোর না দরকার থাকতে পারে কিন্তু আমার দরকার আছে। এই টাকা দিয়া আমার মেলা ধার শোধ করোন লাগবো।
মাহির ফোন হাতে নিয়ে বলল, আপনার টাকার দরকার তো? ঠিক আছে। জায়গা মতো ফোন গেলেই আপনার সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
রুহি রুম্পাকে বলল, এই রুম্পা! মাহির কি এখন ঐ লোকটাকে পনের টাকা দিতে চাইছে নাকি?
রুম্পা বলল, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কী করে জানবো! আচ্ছা দাঁড়াও আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসি৷
এই দাঁড়া এখানে! তোকে কি যেতে বলেছি আমি? চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখ কী হয়।
পাত্রের বাবা রমিজ উদ্দিন বলল, তুমি কি আমগোরে পুলিশের ভয় দেহাইতাছো?
মাহির বলল, ভয় দেখাচ্ছি না। সত্যি সত্যিই পুলিশকে ফোন করছি।
রমিজ উদ্দিন হতভম্ব হয়ে বলল, এই না না পুলিশে ফোন দেয়ার কী দরকার! আমরা নিজেগো মধ্যে মিটায়া নিলেই হইলো। চলেন কাজী বিয়া পরান। আমনেরা সবাই বসেন বিয়া হইবো।
মাহির বলল, শুধু বিয়েই হবে না। আপনি এই সমস্ত লোক ভর্তি বিয়ে বাড়িতে দাঁড়িয়ে সাদা কাগজে লিখে দেবেন যে বিয়ের পর কোনোদিন এই মেয়ে কিংবা মেয়ের পরিবারের কাছে কোনো প্রকার পণের টাকা বা কোনো কিছুর জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন না। এমনকি এই মেয়ের উপর কোনো অন্যায় অত্যাচার করবেন না। আগে এই কথা লিখে কাগজে সই করবেন তারপর বিয়ে হবে।
রমিজ উদ্দিন আমতা আমতা করে বললেন, আমি তো লেখতে পারি না বাবা।
মাহির বলল, সমস্যা নেই। আমি লিখে দিচ্ছি আপনি সই করতে তো পারবেন?
রমিজ উদ্দিন আবারও আমতা আমতা করে বলল, জে আইচ্ছা।
তামজিদ আহমেদ বুক ফুলিয়ে বলে উঠলেন, এই না হলে আমার ছেলে! সাব্বাস মাই সন!
রেহনুমা আহমেদ বললেন, ছেলে তোমার একার নাকি! মাহির আমারও ছেলে। সোনার টুকরো ছেলে আমার লাখে একটা মেলে।
তামজিদ আহমেদ বললেন, এই তো কিছুক্ষন আগেই বলছিলে আমার ছেলে যেখানে যায় শুধু ঝামেলা পাকায়।
মায়ের মন তুমি কী বুঝবে! ছেলের জন্য সব সময় চিন্তা করি আমি। ও ভালোর জন্য এসব করে বুঝি আমি। কিন্তু এসবের জন্য অনেকেরই ওর উপর ক্ষোভ রয়েছে। কে কখন ক্ষতি করে দেয়!
থাক এখন আর এসব না ভাবি। চলো খেতে বসি। মাহিরকে ডাকো।
মাহির ওদিকটা সামলে বাবা-মায়ের কাছে এসে বলল, আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
রেহনুমা আহমেদ বললেন, হঠাৎ কী হলো! চল আমিও যাবো তোর সাথে।
আরে মা তোমার যেতে হবে না৷ তোমরা থাকো এখানে। আমি ঠিক চলে যাবো।
তামজিদ আহমেদ বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে যাস। আমরা তারাতারি চলে আসবো।
রুহি রুম্পাকে ফিসফিসিয়ে বলল, যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম ততোটা খারাপ নয় ছেলেটা। একটা থ্যাংকস কিন্তু দিতেই হয়।
রুম্পা বলল, আমার তো প্রথম থেকেই ভালো লেগেছে। কী সুন্দর দেখতে!!
রুহি চোখ মুখ বেকিয়ে বলল, শোন, মানুষের সৌন্দর্য্য থাকে তার ব্যাক্তিত্বে। তার চেহারায় নয়।
মাহির চলে যাচ্ছিলো এমন সময় পাশ থেকে তার কানে কয়েকটা ছেলের কথার আওয়াজ ভেসে এলো_______
মামা ঐ যে লাল ড্রেস পরা মাইয়া ঐটাই রেপ হইছিলো। দেখ কী দেখতে! যে ঐ কাম করছে তার কী দোষ! এমন সুন্দরী মাইয়া দেখলে কী মাথা ঠিক থাকে!!
এ কথা বলে সব গুলো ছেলে রুহির দিকে তাকিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি দিলো। মাহির সেখান থেকে যেতে যেতেও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো।
চলবে……….