বিয়ের পর যখন শুনলাম সালমানের আরও দুইটা স্ত্রী আছে, আরও দুইটার সাথে ওর ডিভোর্স হয়েছে আর আমি ওর পাঁচ নাম্বার স্ত্রী হয়ে ওর জীবনে এসেছি তখন আমার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এইচ এস সি পরীক্ষার্থী ছিলাম আমি। স্বপ্ন ছিলো পড়ালেখা করে জীবনে বড় কিছু একটা হবো। বাবা মায়ের ভরসা হবো। আমার বাবা শহরের একটা পাড়ায় মুদির দোকান দেন। ব্যাংক লোন, দেনা এসবের কোন কমতি নেই। মা বাসায় বসে বসে কাপড় সেলাই করতেন। বান্ধবীদের নতুন নতুন কাপড় কিনে পরতে দেখতাম। আমার আর সেই সাধ পূরণ হতো না কখনোই। গজ কাপড় কিনে মা সেলাই করে দিতেন। এই যা। তবুও মুখ ফুটে কখনো বলতান না যে এইটা আমার পছন্দ হয়নি। মেনে নিতাম সব।
টিনশেডের দুই রুমের ভাড়াই ছিলো আট হাজার টাকা। ছোট দুই ভাই আমার। একটা ক্লাস ফোরে পড়ে আর আরেকটা ক্লাস টেনে। তাদের পড়াশোনার খরচা দিতেই বাবার হিমশিম খেতে হয়। এদিকে একদিন হুট করেই বাবা বাসায় এসে মাকে বললেন
“নুপুরের বিয়ে ঠিক করে এসেছি।”
“কার সাথে?”
“বাসার মালিকের ছেলের সাথে।”
আমি আমার রুমে ছিলাম। বাবা মায়ের কথায় কান দিয়ে শুনার অভ্যাস আমার নেই। তবুও “নুপুরের বিয়ে ঠিক করে এসেছি” কথাটা শুনেই কেমন জানি মনে হলো আমার। আমি দরজার কাছে গেলাম। শুনলাম মা বলছেন,
“আলহামদুলিল্লাহ! এটা কি সত্যি বলছো নুপুরের বাবা?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি। আমাদের মেয়ের ভাগ্য খুলে গিয়েছে গো নুপুরের মা।”
“আমিতো বিশ্বাস করতে পারছি না। আল্লাহ!”
“আমিও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনাই। আজকে এইতো কিছুক্ষণ আগে আমার দোকানে এসেছেন আলী সাহেব। এসে জানালেন আমার মেয়েকে তিনি বিয়ে করতে চান।”
“ছেলে নিজেই জানিয়েছে?”
“হ্যাঁ”
“এইটা কেমন দেখায় না?”
“যেমনই দেখাক তুমি চিন্তা করতে পারছো আমাদের মেয়েটার বিয়ে কার সাথে হতে চলেছে? আমাদের বাসার সামনেই যে পাঁচ তলা বিল্ডিং সেই বিল্ডিংটার একমাত্র মালিক সে নিজে।”
“এতো সুখ আমার মেয়ের কপালে সইবে তো?”
“আল্লাহ যখন চাইছেন তখন সইবে নুপুরের মা”
নুপুর দরজার পাশেই ছিলো। নুপুরের মা নুপুরের সামনে এসে জড়িয়ে ধরলেন নুপুরকে। নুপুরের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“আমার নুপুরের ভাগ্য এতো ভালো ছিলো সেটা জানতাম না।”
নুপুর ফেলফেল চোখে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। কোন কথা বলতে পারলো না। মনে মনে চিন্তা করলো, তার বিয়েতেই কি তার বাবা মায়ের সুখ? যদি তাই হয় তাহলে বিয়েতে নুপুরের কোন আপত্তি নেই।
দিন সাতেকের মাথায় একদম গোপন আয়োজনে আমাকে তাদের বাসায় তুলে নিয়ে গেলো। আমার বাবাও কোন আপত্তি জানালেন না। আমাদের দেশের বাড়ি থেকে আমার ফুফু খালারা আসলেন। শুনেছি বিয়ের কাবিন ছিলো পাঁচ লাখ টাকা। জামাই বাড়ির লোকজন একটা লম্বা স্বর্ণের হার, আর একটা লাল বেনারসি পরিয়ে সাত দিনের মাথায়, সন্ধ্যার সময় আমাকে তুলে নিয়ে গেলো।
বর আমাকে নিতে আসেনি। আমার ফুফু বাবার কাছে জানতে চাইলেন,
“বর আসলো না কেনো?”
বাবা উত্তর দিলেন,
“কাজে আটকা পরে আছেন হয়তো। তাই আসেননি।”
আমাকে আমার হবু শাশুড়ি, ননদ আর দুইজন মহিলা এসে তুলে নিয়ে গেলো। যে দুইজন মহিলা সাথে এসেছিলো, সেই দুইজন শুরু থেকেই কেমন খুতখুতে মহিলা ছিলো। আমার চুল, চোখ, পা, হাত সব যেনো খুতিয়ে দেখতে লাগলো। আমি আমার বরকে বিয়ের আগে দেখেনি। মাকে বলেছিলাম একবার,
“বর দেখেছো?”
মা রাগ করে বলেছিলো,
“বর দেখতে হবে না পরিবার ভালো, টাকাওয়ালা এতেই হবে”
আমার মতো অভাবী ঘরের মেয়ে বাবা মায়ের কথার উপর কথা বলার সাহস কখনো করিনাই। এবারও কোন কথা বললাম না। কারণ আমি জানি, আমার বাবা মা আর যাই করুক দিনশেষে তারা আমার ভালোটাই চাইবে।
আমার বাসা আর আমার স্বামীর বাসা সামনা সামনি।আমাদের টিনশেডের দুইটা রুম, এগুলোর মালিক ও তারা। ঠিক সামনেই পাঁচ তলা বিল্ডিং। সেইটা তাদের। দুই আর তিন তলা ডুপ্লেক্স। ঠিক সন্ধ্যার সময় আমি তাদের বাসায় পা রাখলাম। আমার পরনে বঁধুয়া ভূষণ। ভেতর থেকে আমার বয়সী একটা মেয়ে এসে আমাকে রুমে নিয়ে গেলো। আমাকে ডাকলো,
“ভাবী চলো তোমার রুমে নিয়ে যাই।”
রুমটা প্রকাণ্ড। রুমের মাঝ বরাবর একটা দামি খাট। দেয়ালে এসি ফিট করা। একপাশে একটা কাঠের সুন্দর নকশা করা আলমারি আর অন্যপাশে একটা ড্রেসিংটেবিল। যে মেয়েটা আমাকে ভাবী বলে ডেকেছিলো সে বললো,
“ভাবী কাপড় চেইঞ্জ করে নাও।”
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমিতো কোন কাপড় সাথে আনিনাই। তারপর মেয়েটা আবার বললো,
“আচ্ছা ভাবী বসো, আমি শাড়ি এনে দিচ্ছি।”
এই বলে মেয়েটা ডাক দিলো রুম থেকে
” ভাবী, ও ভাবী তোমার একটা শাড়ি দিয়ে যাও এদিকে। ”
পাশের রুম থেকে আওয়াজ এলো,
“এখন শাড়ি দিয়ে সতীন পুষতে হবে। এসব আর কত!”
কথাটা শুনেই আমি কেমন হকচকিয়ে যাই। সতীন পুষা মানে? আর কে কার সতীন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম আমার মেয়েটাকে,
“সতীন কে?”
“অহ কিচ্ছু না। তুমি বসো। আমি শাড়ি নিয়ে আসি”
একা একা রুমে বসা রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আমার ননদ একটা শাড়ি নিয়ে এসে বললো,
“এইটা চেইঞ্জ করে নাও।”
আমি শাড়ি বদলিয়ে নিজের রুমে বসে রইলাম একা একা।
কিছুক্ষণ পর আমার শাশুড়ি আমার রুমে আসলেন।আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“সালমানের সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে?”
কথাটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমি এই কথা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তারপর আমি বললাম,
“আমি উনাকে দেখিনি এখনও।”
“মানে?”
আমি জবাব দিলাম না আর। আমার শাশুড়ি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কি সালমান সম্পর্কে জানো?”
আমি মৃদু স্মরে বললাম,
“না।”
শাশুড়িকে দেখলাম অবাক হলেন। তার মোবাইলে কল এলো তখন। তিনি রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে কে কী বললো সেটা আমি আন্দাজ করতে পারলাম না। তবে শাশুড়ি এপাশ থেকে বললেন,
“হ্যাঁ সালমানের ছোট বউ বাসায় নিয়ে এসেছি। গরীব ঘরের মেয়ে। বড় দুইটার সম্মতি আছে বিয়েতে।”
আমি এই কথাটা কখনোই মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম। শাশুড়িকে বললাম ,
“এটা কী সত্যি?”
শাশুড়ি দেখলাম আমার থেকে বেশি অবাক হলেন। আমাকে বললেন,
“তোমার বাবা তো সব জানেন। আমাদের বাসায় এসেই তো বিয়ের আলাপ হয়েছে। উনি কি তোমাকে কিছুই জানাননি?”
আমি এই কথাটার কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ শুনে সেই দুই মহিলা একসাথে আমার রুমে এসে ঢুকলো। এর মধ্যে একজন আমার মায়ের বয়সী হবে। আরেকজনের বয়স কম করে হলেও সাতাশ আটাশ হবে। শাশুড়ি তাদের দিকে ইশারা করে বললেন,
“এই হলো সালমানের বড় বউ, এই হলো মেঝো বউ। আর এখন তুমি ছোট বউ।”
মেঝো বউ যাকে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন, সেই মেয়েটা আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো
“এমন ভাব দেখাচ্ছো যেমন কিছুই জানো না? টাকা দেখলে পাত্তর হা করে। টাকার লোভে বিয়া বইছো। সব জানি।”
বড় বউ বললো,
‘”সতীন এমনি এমনি পালবো না। সতীন সতীনের মতো থাকবে। এই ঘরে আমরা যেমন এসেছি বউ হয়ে তুমিও এসেছো বউ হয়ে। নিজের মর্যাদার বাইরে যাবা না।”
শাশুড়ি তাদেরকে বললেন,
“চুপ করো চুপ করো তোমরা। নতুন এসেছে মেয়েটা। তার সাথে এরকম ব্যবহার করো না।”
মেঝো বউ শাশুড়িকে বললো,
“বুড়ি বেটি কথা বলবা না তুমি। তোমার লুচ্চা ছেলে আমার ছোট বোনকে বিয়ে করে ডিভোর্স দিয়েছে। আরেকটা শুনেছি দিনাজপুরে আছে। সত্য কী মিথ্যা জানা নাই। তোমার কারণে আমার বাপের বাড়ির লোকজনের সাথে সম্পর্ক নাই। আর আজ সেই তুমি কিনা চুপ করতে বলতেছো?”
বড় বউ বললো,
“চিনছো না ডায়েনীকে। এই বুড়িটা ডায়েনী। জীবন অতিষ্ঠ করে রাখবে। প্রথম প্রথম ভালো ভালো দেখাবে তারপর আসল রূপ সামনে আনবে।”
এই কথাটা বলার সাথে সাথে পেছন থেকে সেই মেয়েটা, যে মেয়েটা আমাকে ভাবী ডেকেছিলো, যে মেয়েটা আমার বয়সী, সেই মেয়ে বড় বউর চুলে ধরে টান দিলো। গালাগালি করতে করতে বললো
“কুত্তি আমার মায়ের উপর কথা বলিস। তোর এতোবড় সাহস।”
বড় বউ নিজেকে টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর কান্না করতে করতে বলে,
“এই ছোট মেয়েটাকে আমার হাতে করে বড় করেছি। যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম তখন এই মেয়েটা সবেমাত্র হাঁটা জানতো। আর আজ সেই মেয়েটা আমার উপর, তার ভাবীর উপর হাত তুলে?”
তারপর আমার শাশুড়ি উঠে গিয়ে বড় বউ আর মেঝো বউকে থাপ্পড় দেন দুইটা। দুইজন কান্না করতে করতে চলে যায় রুম থেকে। তারা দুজন কোন প্রতিবাদ করলো না। তারপর আমার ননদ আমাকে বলে,
“এগুলো শিখবা নাকি এদের থেকে? বউ বউয়ের মতো থাকবা। আর আমাদের রূপ যখন প্রথম দিনই দেখে নিয়েছো তখন আর আশাকরি দ্বিতীয় দিন দেখানো লাগবে না। ”
আমার কোন অনুভূতি কাজ করছিলো না তখন।চোখ দিয়ে ছলছল করে কান্না ঝরতে লাগলো। শাশুড়ি আমার কান থেকে হুট করে স্বর্ণের দুল খুলে নিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
“এগুলো স্বর্ণের?”
আমার কানের দুলগুলো তার মায়ের ছিলো। আমাকে কিছু দেওয়ার মতো ছিলো না তাই আমার বিয়ের আগের রাতে আমার মা তার কান থেকে খুলে দুলগুলো আমার কানে পরিয়ে দেন। শাশুড়ির প্রশ্নে জবাব দিলাম,
“হ্যাঁ।”
শাশুড়ি দুলগুলো তার মেয়ের কানে পরিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন,
“গরীব ঘরের মেয়ের এসব পরতে হয় না। আর এক কাজ কর, রান্নাঘরে গিয়ে ঝাড়ি নিয়ে এসে পুরো বাসাটা ঝাড়ু দিয়ে দে একবার।”
ননদ পাশ কাটিয়ে বললো,
“দাঁড়াও আমি এনে দিচ্ছি। যাওয়া লাগবে না”
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করতে করতে বারোটা। আমার মেঝো সতীন আমাকে বুঝাতে লাগলো,
এই ঘরে সুখ নাই।কখনোই সুখ আমি পাবো না।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। এগুলো কী বলছেন উনি!
উনার কথাটা সত্য হলো যখন দেখলাম রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফেরা লোকটাকে দেখিয়ে আমার শাশুড়ি বললেন,
“এই তোর স্বামী এসেছে। যা”
আধবয়সী লোকটাকে দেখতেই আমি চিনে ফেললাম।আমার কলেজ আসা যাওয়ার পথ আটকাতো সে। তারপর একদিন সে আমাকে শারীরিক সম্পর্কের অফার দিলে, আমি না করে দেই। সেদিন সে আমাকে বলেছিলো,
“তোকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে আসবো।”
মাতাল হয়ে ঘরে ফেরা লোকটা আমাকে বললো,
“কীরে দেমাগ দেখিয়েছিলি না? তোর বাপরে এক লাখ টাকা দিয়া তোকে কিনে এনেছি। এখন আর কোন দেমাগ দেখাইতে পারবি না। তুই আমার বউ। আমার যা ইচ্ছা তাই করবো আমি।
বড় বউ বললেন,
“দোহাই লাগে তোমার মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু করো না।।অত্যাচার করো না। মেয়েটা এখনও বাচ্চা।”
“চুপ কর। তুইও বাচ্চা আছিলি একসময়। মনে নাই? তোরে ছাড় দিছি? তাইলে এইটাকেও ছাড় দিবো না।”
(চলবে)
#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১
লেখা: #মিদহাদ_আহমদ