নোনাজলের শহর পর্ব শেষ

নোনাজলের শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-২৭

আদিব হাসপাতাল থেকে কাউকে কিছু না বলেই বের হয়ে যায়।মিমন আদিবকে রেগে বের হতে দেখে দৌড়ে পিছু গেলেও আদিবকে ধরার আগেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়।

আদিবের কথায় রূপককে এন এস আই- এর কাস্টাডি তে রাখা হয়েছে। কাচের গ্লাসে মাথায় বেশ চোট পেয়েছে রূপক।তরুণ একজন ডক্টর ডেকে ড্রেসিং করে বেন্ডেজ করে দিয়েছে।জ্ঞান ফিরে হাতে হাতকড়া দেখে অবাক হয়ে সামনে তাকায় রূপক।সম্পূর্ণ খালি একটা রুমের মধ্যে চেয়ারে বসে আছে সে, মাথাটা বেশ ভারি লাগছে।মুমুর কথা মনে হতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রূপকের।মুমু তার হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো।যদি নাই হবে তবে কেন আল্লাহ এতো অনুভূতি দিয়েছে মুমুর জন্য, কথাগুলো ভাবতেই চোখ থেকে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।

রূপক চোখ বন্ধ করে কথাগুলো ভাবছিল, হঠাৎই কেউ এসে তার কলার ধরে দাঁড় করিয়ে প্রচন্ড জোরে নাক বরাবর ঘুষি দেয়।ঘুষি খেয়ে নিচে পড়ে যায় রূপক চোখ তুলে সামনে তাকাতেই আদিবকে দেখতে পায়।আদিব রেগে রূপকের কলার ধরে আবার দাঁড় করিয়ে চিৎকার করে বলল,
-“কেন করলি এসব, কেন?”বলেই আরো কয়েকটা এলোপাতাড়ি ঘুষি দেয় আদিব। রূপক আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ভালোবাসি আমি মুমুকে ভালোবাসি, যেকোন মূল্যে ওকে চায় আমার।”
রূপকের কথা শুনেই নিজের গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে রূপককে থাপ্পড় দেয় আদিব।তারপর আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুজতে শুরু করে।দরজার পেছন থেকে একটা স্টিক বের করে রূপককে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে।
-” ভালবাসিস? ভালোবেসে আট বছর যাবত মেন্টালি টর্চার করছিস আমার মুমুকে? বলছে আর পাগলের মতো মারছে রূপককে।
-“আট বছর আগে জানোয়ারের মতো মলেস্ট করেছিস আমার মুমুকে, আজ আবার…” বলে রূপকের হাতের উপর বেধড়ক মার শুরু করে।এতক্ষণ সহ্য করলেও এবার রূপক ফ্লোরে শুয়ে আর্তনাদ করে উঠে।হঠাৎই মার থামিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে আদিব।কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এসে রূপকের চুল ধরে দাঁড় করে দাতে দাঁত চেপে বলল,
-“মুমুর গায়ে কামড়ে ছিস নাহ?এই আদিবের কলিজাতে কামড় দিয়েছিস তুই?” বলেই আদিব রূপককে হাত-পা চেয়ারের সাথে শক্ত হয়ে বেধে দেয়।তারপর একটা প্লাস নিয়ে রূপকের গাল চেপে ধরে দাঁতে সেট করে চাপ দিতেই রূপক জ্ঞান হারায়।

আদিবকে রেগে কাস্টাডিতে যেতে দেখে তরুণও পিছে পিছে এসেছে।আদিবের মারের চোটে আর ভয়ে অনেক আগেই রূপক জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু আদিব থামছে না দেখে তরুণ দ্রুত আদিবকে জাপটে ধরে থামায়।আদিব রেগে প্লাসটা ছুড়ে ফেলে বের হয়ে আসে। অফিস রুমে এসে তরুণকে বলল,
-” জ্ঞান ফিরলে ট্রিটমেন্ট করে আমাকে ফোন দিবি।ওকে নিজ হাতে খুন করবো আমি।” বলে হনহন করে বের হয়ে যায় আদিব।

আঠারো ঘন্টা পরে মুমুর জ্ঞান ফিরলেও অতিরিক্ত হাইপার হয়ে যাওয়ায় ডাক্তার তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন।আট বছর আগের মতোই মুমু ট্রমাটাইজ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর।আরো একটা সমস্যার কথা ডক্টর জানিয়েছেন তবে সেটা শুধু আদিবকেই বলেছেন।মুমুকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আদিব সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।মুমুর ডান হাত ধরে পাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আদিব।হঠাৎই মুমু তার হাত শক্ত করে চেপে ধরায় দ্রুত সোজা হয়ে বসে।মুমু ঘুমের মাঝেই ঠোঁট নেড়ে কিছু বলছে আর বন্ধ চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে।

আদিব দ্রুত বেড সাইডে বসে মুমুর গালে হাত রেখে ডাকল,
-” মুমু,এই মুমু? মুমুসোনা?” আদিবের ডাকে মুমু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়।আদিব তার মুখের সামনে ঝুকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আদিবকে দেখে যেন তার কান্না বাঁধ ভেঙে যায়,গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে বলল,
-” আদি….. রু রুপক ভা….” এটুকু বলেই আবার কাঁদতে শুরু করে মুমু।আদিব মুমুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে।তারপর মুমু একটু শান্ত হলে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
-” সব ঠিক হয়ে যাবে মুমুপাখি, আমি আছিতো।” বলে মুমুর কপালে গভীর চুমু দেয়। হঠাৎ মুমু অস্থির হয়ে পেট হাত রেখে বলল,
-” আদি,আমার বাবু,আমার বাবু ঠিক আছে তো?” বলে কেঁদে উঠে মুমু।আদিব অসহায় দৃষ্টিতে একবার মুমুর দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে নিচে চোখ রেখে বলল,
-” বাবু ঠিক আছে মুমু, তুই শান্ত হ প্লিজ।”(কাঁপা গলায়)
-” আদি, তুমি আমার দিকে তাকাও। আদি সত্যি করে বলো আমাদের বাবু ঠিক আছে, বলো? (দু’হাতে আদিবের মুখ নিজের দিকে করে)
আদিব টলটলে চোখে মুমুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” বললাম তো বাবু ঠিক আছে।” আদিবের দিকে তাকিয়ে মুমু জোরে কেঁদে বলল,
-” তুমি মিথ্যে বলছো না? আমার বাবু ঠিক নেই, আদি আমি তোমার বাবুকে ঠিক রাখতে পারিনি তাইনা?” বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে মুমু।আদিব মুমুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” আমাদের বাবু আছে তো মুমু,আমাদের প্রয়া আছে তো সোনা। তুই এতো বোকার মতো কাঁদছিস কেন? কান্না থামা প্লিজ।” বলতে বলতেই আদিবের চোখ থেকে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।

প্রায় পনেরো দিন হসপিটালে থেকে তারপর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় মুমুকে।আর এই পনেরো দিন আদিব রূপককে নিজের ইচ্ছে মতো পিটিয়েছে।রূপকের বাবা-মা ছেলের সব কার্যকলাপ কথা জেনে কিছু বলতে পারেননি আদিবকে।তবে ছেলেকে বাচানোর জন্য মুমুর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাই।মুমু তাদেরকে খালি হাতে ফেরায় নি,কেঁদে কেটে আদিবকে জোর করে বুঝিয়ে ছিল।আদিব আগত্য রূপককে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করে দেয়।আইন রূপককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। তারপর মুমু সুস্থ হবার একমাস পরেই আদিব জোর করে তাদের নিয়ে কানাডা চলে যায়।সে চাই না আবার কখনো রূপকের ছায়া তাদের জীবনে আসুক।

🌲🌲
মুমুর ভীষণ মনখারাপ।
সন্ধ্যা থেকে কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।তবু্ও আদিব তার কোন কথা শুনছে না।আজ দুই বছর হলো কানাডা এসেছে তারা, মুমু এই দুই বছরে সাতশো পয়ত্রিশ বার বাবু নেওয়ার কথা বলেছে।কিন্তু আদিব কোনো ভাবেই রাজি হয় না। আজ খুব জেদ করায় আদিব তাকে থাপ্পড় দিয়েছে।তাই সে না খেয়ে কেঁদে কেঁদে বিছানার একপাশে শুয়ে বালিশ ভিজচ্ছে। বিছানার অন্যপাশে প্রয়া আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমচ্ছে আর আদিব মুমুর দিকে তাকিয়ে আছে।কান্নার জন্যে থেকে থেকে শরীর কেপে উঠছে মুমুর।

প্রয়ার কপালে চুমু দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আদিব।তারপর উঠে বিছানার অন্য পাশে এসে মুমুকে কোলে তুলে নেয়।কোলে নিতেই মুমু নামার জন্য ছটফট শুরু করে দেয়,আদিব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই শান্ত হয়ে যায় মুমু।ডাইনিং এর চেয়ারে বসিয়ে প্লেটে খাবার নিয়ে মেখে মুমুর মুখে পুড়ে দেয় আদিব।মুমুর খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকতে দেখে আবার চোখ রাঙিয়ে তাকায়, মুমু কাঁদতে কাঁদতে খাবার খেতে শুরু করে।মুমুর কান্না দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিব।তারপর খাবার প্লেট রেখে মুমুর সামনে হাটু গেড়ে বসে মুমুর হাত ধরে বলল,
-” প্রয়া আমাদের বাবু না?” মুমু কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
-“তাহল আর বাবুর তো দরকার নেই।আর আমরা যদি আরেকটা বাবু নিয়ে প্রয়াকে অযত্ন করে ফেলি, তাহলে তো ওর প্রতি আমাদের অন্যায় হয়ে যাবে তাইনা।”
মুমু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
-” অযত্ন কেন করবো, ওতো আমাদের প্রথম বাবু।”
-” এখন তোর মনে হচ্ছে অযত্ন করবি না কিন্তু নিজের বাবু হলে মন পরিবর্তন হয়ে যায় মুমু।আর তোর কথা বাদ দে আমার তো এমনই হবে আমি নিশ্চিত। তাই আমি কখনো বাবু চায় না।কারণ আমি প্রয়াকে একটুও কষ্ট দিতে চায় না।”
মুমু ভ্রু কুঁচকে কিছু ভেবে বোকা বোকা চাহনিতে বলল,
-“সত্যি এমন হবে? ” আদিব প্রবল জোরে মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।ঠিক তখনই প্রয়া চোখ ডলতে ডলতে এসে আদিবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” মাম মাম তোমরা এখানে কি করেছো? আমার একা ভয় লাগে তো?
আদিব প্রয়ার গালে শব্দ করে চুমু দিয়ে বলল,
-” পরী তোমার মাম মাম রাগ করেছে, চলতো আমরা মাম মামের রাগ ভাঙায়।”
বলে আদিব আর প্রয়া একসাথে মুমুর দুই গালে চুমু দিতে শুরু করে।বাবা-মেয়ের পাগলামি দেখে মুমু ফিক করে হেসে দেয়। তার আর কিচ্ছু চাই না, এই দুইটা ভালবাসাই তো তার স্বর্গ।

(সমাপ্ত)

নিন হ্যাপি এন্ডিং দিলাম,খুশিতো সবাই? তবে ভাবছি🤔’নোনাজলের শহর ২’ লিখে মুমুকে মেরে দিব😉
…………….আরে জাস্ট কিডিং😆……………………..
৷৷৷ ভালো থাকুক নোনাজলের শহরের বাসিন্দাগণ।।।

আল্লাহ হাফেজ

ওহো ভুলে গেছিলাম, কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here