# নিঃশ্বাসে_তুই(১)
রক্তাক্ত শরীর টা বহুকষ্টে টেনে টুনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল অহমি। সঙ্গে তার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড পুষ্প তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। প্রিয় বান্ধবীর এমন করুন পরিণতি মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে পুষ্পর। তার চোখে স্পষ্ট পানি টলমল করছে। সদর দরজা পেড়িয়ে প্রবেশ দ্বার অব্ধি গিয়ে দাড়িয়ে পড়ল অহমি। পুষ্পর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে দূর্বল কন্ঠে বলল,
“আর পারছি না দোস্ত। তুই কলিং বেলটা দে। রেণু দরজা খুললে বলবি ভাইয়াকে ডেকে দিতে।”
পুষ্প ‘হুম’ বলে কলিং বেল বাজাল। একটু পরেই অহমিদের বাড়ির কাজের মেয়ে রেণু এসে দরজা খুলে দিল। ছিপছিপে গড়নের,কোঁকড়া চুল বিশিষ্ট, হাসোজ্জল মুখশ্রীর মেয়েটির চেহারা নিমেষেই বিকৃত রুপ ধারণ করল অহমির অবস্থা দেখে। ভয়ার্ত কন্ঠে উত্তেজিত হয়ে সে বাড়ির বাকি সদস্যদের ডাকতে শুরু করল,
“খালাম্মা,খালাম্মা, মেঝ আপা কই গেলেন আপনেরা। একবারটি এদিকে আহেন। দেইখা যান ছোট আপার কী অবস্থা হইয়ে। খালাম্মা, ও খালাম্মা।”
অহমি পুষ্প’র কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। একটু নড়ার মতো শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। পুষ্প থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে। এই বান্ধবীটা তার কলিজার একাংশ। সেই ছোট বেলা থেকে দু’জনে একসঙ্গে। হাজারো বন্ধু বান্ধব এসেছে গেছে কিন্তু তারা কখনো আলাদা হয়নি। দু’জন দু’জনের প্রাণ।
রেণুর চিৎকারে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসলেন তাহমিনা বেগম। তাড়াহুড়ায় খুন্তি হাত থেকে পড়ে বিকট শব্দ হলো। তাহমিনা বেগম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই ছুটে এলেন। তার পেছনেই জোর কদমে এগিয়ে এলো তাহমিনা বেগমের মেঝ মেয়ে অর্পা। সে এতক্ষণ নিজের ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় মেতে ছিল। রেণুর চিৎকার তার কর্ণেও পৌঁছেছে। তাই ততক্ষণাৎ সেখান থেকে উঠে এসেছে।
দরজার কাছে গিয়ে তাহমিনা বেগম আর অর্পা দু’জনেই প্রচন্ড বিচলিত হয়ে পড়ল। তাহমিনা বেগম রেণুকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত গিয়ে তার আদরের ছোট মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,
“কী হয়েছে আমার আম্মাজানের?এ অবস্থা কেমন করে হলো? কে করল আমার এতো বড় স’র্ব’না’শ?”
তাহমিনা বেগমের চোখে বেয়ে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ল। অর্পা এগিয়ে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“আম্মা ওর ইমিডিয়েটলি ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। আগে ওকে ভেতরে নেওয়ার ব্যবস্থা করো।”
তাহমিনা বেগম ক্রন্দনরত কন্ঠে বললেন,
“বিভোরকে ডাক। মেয়েটাকে কোলে তুলে নিতে হবে তো। ও নিজের পায়ে কী করে চলবে?”
“আম্মা ভাইয়া তো বাড়িতে নেই। দু ঘন্টা আগে বেড়িয়েছে। বলে গেছে সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। কী নাকি জরুরি কাজ আছে।”
“হায় আল্লাহ আমার মেয়েটা। কী করি এখন।”
“আম্মা তুমি, আমি,রেণু, পুষ্প তো আছিই। চলো সকলে মিলে ধরে নিয়ে যাই।”
“হ্যাঁ তাই কর।”
অর্পা, রেণু এগিয়ে যেতেই খেয়াল করে অহমি অচেতন হয়ে পড়েছে। রেণু করুণ সুরে বলে,
“খালাম্মা ছোট আপায় মনে হয় জ্ঞান হারাইছে।”
“কী বলিস। আমার মেয়েটার কী হলো। অমু, এই অমু ওঠ না। মা আমার। ওঠ না।”
অর্পা অস্বস্তিকর কন্ঠে বলল, “আম্মা থামো না। আগে ওকে ভেতরে তো নেই।”
অর্পা এগিয়ে গিয়ে অহমিকে শক্তপোক্ত হাতে সামলে নিল। আরেকটু জোর খাটাতে উদ্যত হলেই গুরু-গম্ভীর, দৃঢ়, গুমোট পুরুষালী কন্ঠ শুনে থেমে গেল। পেছন ফিরে দেখে তার বন্ধুদের মধ্যে সবথেকে বিচক্ষণ, গুরু-গম্ভীর, ব্রিলিয়ান্ট, হ্যান্ডসাম, রগচটা, একরোখা, বেপরোয়া ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে তার প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়। অর্পা কিছু বলছে না দেখে ধ্রুব পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী হলো শুনতে পারিসনি নাকি? আমি হেল্প করব?”
অর্পা আমতা আমতা করতে করতে মায়ের পানে তাকায়৷ তাহমিনা বেগম মেয়ের ইতস্ততা বুঝতে পেরে নিজেই ধ্রুব’র দিকে তাকিয়ে অনুরোধের স্বরে বলেন,
“হ্যাঁ বাবা একটু সাহায্য করো না আমাদের। দেখছ না মেয়েটার কী অবস্থা হয়েছে।”
তাহমিনা বেগমের বলতে দেড়ি তো ধ্রুব’র শুনতে দেড়ি হয় না। সে তাহমিনা বেগমের কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাঁজা কোলা করে তুলে নেয় অহমিকে। রক্তাক্ত, কোমল, মসৃণ, ছোট্ট দেহখানা এখন বলিষ্ঠ, পুরু – চওড়া বক্ষের মধ্যে আবদ্ধ। ধ্রুব দ্রুত পায়ে অহমিকে ভেতরে নিয়ে যায়। ড্রইংরুমের সোফায় নিয়ে সযত্নে শুয়িয়ে দেয়।
অহমিকে ঘিরে সকলে বসে আছে। অর্পা বিভোরকে কল করে অহমির এ অবস্থার কথা জানিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে ইমিডিয়েটলি ডক্টর নিয়ে বাড়িতে ফিরতে। অর্পা বিভোরের সঙ্গে কথা বলে কল কাটতেই ধ্রুব তার চিরাচরিত গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে বলল,
” ডক্টর আসতে তো সময় লেগে যাবে। এমনিতেই অনেকটা রক্তক্ষরণ হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। তুই বরং ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে আয় প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট টা আমি করে দিচ্ছি।”
অর্পা আচ্ছা বলে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে হাজির। ধ্রুব খুব দক্ষতার সঙ্গে অহমির ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে দিল। কপালে,ঠোঁটের কোণে,হাতে, পায়ে সব জায়গায়তেই ক্ষত। ধ্রুব সবগুলো পরিষ্কার করতে পারলেও এক জায়গায় এসে আটকে গেল। অহমির উদরের ওপর দিয়ে জামা ভেদ করে রক্তের ছাপ স্পষ্ট। বোঝাই যাচ্ছে ক্ষত সেখানেও আছে। কিন্তু একটা মেয়ের শরীরের স্পর্শকাতর অংশে টাচ করার অধিকার তার নেই। এমনিতেই মেয়েটির অনুমতি বিহীন সে তার শরীরে স্পর্শ করে ফেলেছে। হোক তা ভালোর জন্য তবুও করেছে তো। এটা অনুচিত বলে মনে করে সে। কিন্তু বি’প’দের সময় সবসময় মনের কথা শুনলে চলে না। কিছু কিছু সময় নিয়মের বাহিরেও যেতে হয়।
বাধ্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে ধ্রুব উঠে দাড়িল। ভেতরের ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে অর্পাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ওর পেটের কাছের ক্ষতটা বোধ হয় একটু গভীর। তুই ডক্টর আসার আগেই ওটা ক্লিন করে দে। আমি ভেতরের ঘরে আছি।”
অর্পা মাথা নাড়িয়ে কাজে লেগে পড়ল। তাহমিনা বেগম আর পুষ্প নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। একজন অহমির মাথার কাছে আরেকজন পায়ের কাছে। রেণু একটু দূরে দাড়িয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে দর্শকের ন্যায় দেখছে সবটা।
.
“কী রে বাহিরে কী হয়েছে?”
ইমনের প্রশ্নে ধ্রুব বিছানায় বসতে বসতে এক পল তাকাল ওর দিকে। অতঃপর গুমোট কন্ঠে বলল,
“মেবি মেয়েটা অর্পার ছোট বোন। সে গুরুতর আ’হ’ত হয়ে বাড়িতে ফিরেছে। হতে পারে এ’ক্সি’ডে’ন্ট কে’স।”
“কীহ অহমি! কীভাবে ঘটল এসব? তা এখন কী অবস্থা ওর?”
ধ্রুব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
“আমি প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দিয়ে এসেছি। অর্পার ভাই আসছে ডক্টর নিয়ে। চলে আসবে ক্ষণ। এখনো অচেতন আছে।”
ইমন হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাড়াল। ব্যস্থ কন্ঠে বলল,
“আমি যাই দেখে আসি কী অবস্থা। তোরা আড্ডা দে।”
ইমনের সঙ্গে অনুষ্কা, সৌরভ, সিদ্ধার্থ, শিলা,এনি, তামান্না সকলেই যেতে চাইল। অহমিকে তারা সকলেই কম বেশি চেনে। তার চাঞ্চল্যতার জন্য সকলের কাছেই অধিক পছন্দের সে। সকলেই তাকে পিচ্চি নামে সম্বোধন করে। এদের মধ্যে সৌরভ এবং শিলার সঙ্গে অহমির অধিক সখ্যতা। প্রিয় পিচ্চির করুণ পরিণতির খবর শুনে সকলেই বিচলিত হয়ে উঠেছে তাকে দেখার আশায়।
সকলে যেতে চাইলে ধ্রুব বাঁধ সাধে। ছেলেদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “তোরা একটু পর যা। ওখানে অর্পা ওকে চেঞ্জ করাচ্ছে।”
আর মেয়েদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “তোরা যেতে পারিস।”
মেয়েরা চলে যায়। ছেলেরা পুনরায় বসে পড়ে। কিন্তু এবার আর কেউ আড্ডায় মন দিতে পারে না। সকলের মধ্যেই অস্থিরতা। ফুটফুটে মেয়েটার জন্য সকলেই দুশ্চিন্তায়। একটি বার তাকে দেখার আশায়। মনকে শান্ত রাখতে যে যার মতো ফোন ঘাটতে বসে গেছে। কেবল ধ্রুব পকেট থেকে সিগারেট আর দিয়াশলাই বের করে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসেছে। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তৃপ্তির সহিত ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। প্রত্যেকটি টান গভীর সময় ধরে টানছে। পুরু ওষ্ঠজোড়া দ্বারা তীর্যক ভাবে চেপে ধরে ধীরে ধীরে আলগা করছে। দেখে মনে হচ্ছে পারলে চিবিয়ে খেতে নিত। কোথাও একটা চিন-চিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। তেইশ বছরের জীবনে এমন অনুভব পূর্বে কোনোদিন দেখা মেলেনি। আজ কোত্থেকে আবির্ভাব ঘটল এই দহন অনূভুতির ?
—————
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি ®______