পুরোনো ডাকবাক্স পর্ব -০৩

#পুরোনো_ডাকবাক্স
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৩

সারাদিন সেই একই জায়গায় কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে আসে আরসাল। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই দেখে তার বাবা বসে আছে। আরসালকে দেখেই ডাক দিলেন , আরসাল কাছে আসতেই বসতে বললেন। আরসাল বাবার কথা মতো পাশে বসে।

“তিথি নওরীনকে কল দিয়েছিল শুনলাম।

“হুম।

“ওকে যেন তোমার আশেপাশে আর না দেখি, আশা করছি বাবার কথা শুনবে।

“বাবা কেন করলেন আমার সাথে এটা? ওকে না মেনে নিলে আগেই বলতেন, আর ওই মেয়েকে তো এমনিই বাসায় রাখা যেত এভাবে বিয়ে দেওয়ার তো দরকার ছিল না।

“তোমার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড় আমি, সম্পর্কে তোমার বাবা। আমি নিশ্চয়ই তোমার খারাপ চাইবো না। তোমার চেয়ে এই দুনিয়াকে বেশি দেখেছি আমি। এখন তোমার আবেগের বয়সও নেই, যা হয় নি, যে ভাগ্যে নেই তার কথা আর ভেবো না। যে তোমার স্ত্রী তাকে স্ত্রীর অধিকার দাও। আলিজা যেন কোনভাবে বুঝতে বা জানতে না পারে তিথির ব্যাপারে। তার বাবা মা*’রা গিয়েছে, আশা করছি তাকে সময় দিবে। এখন যাও রুমে যাও, ফ্রেশ হয়ে আলিজাকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি যাও।

” আমি যেখানে কোনদিন যাই নি সেখানে আজও যেতে পারব না।

“আমার কথায় অবাধ্য হওয়া আমি পছন্দ করি না সেটা জানো তুমি আরসাল। ও বাড়ি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তৈরি হয়ে দুজন চলে যাও। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও রুমে যাও।

আরসাল আর কথা বাড়ায় না রুমে চলে যায় সে।রুমে এসে দেখে আলিজা রুমে নেই। এত বেশি পাত্তা না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। বাবার ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আরসালের। তিথি চলে যাওয়ার পর বারবার তাকে কল দিয়েছে সে কিন্তু তিথি তাকে কালো তালিকায় ফেলেছে। কোন কাজে মন বসাতে পারছে না আরসাল।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বারান্দায় গিয়ে দেখে আলিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
আরসালের উপস্থিতি বুঝতে পেরে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেয়। আলিজা পিছনে ঘুরে আরসালের দিকে তাকায়। আলিজা শাড়ি পরেছে হ্যাঁ আলিজা আজকে শাড়ি পরেছে, তার শাশুড়ী আর ননদ জোর করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। বিয়েটা আরসাল মন থেকে আর পছন্দ করে করলে হয়তো এখানে এক প্রকার প্রণয় ঘটে যেত, নতুন বর বউয়ের ভালোবাসা প্রেম প্রকাশ পেতো। আরসালের দিকে তাকায় আলিজা, চোখ লাল হয়ে আছে তার।

” কান্না করছেন আপনি?(আরসাল)

” বাবার কথা মনে পড়ছিল।

” কান্না করবেন না, মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না করা ঠিক না।

” কিন্তু বাবা….

” উহু, কান্না না একদম। যান গিয়ে রেডি হন, আপনার বাবার বাসায় যেতে হবে।

” এখন?

” হ্যাঁ, বাবা বলল যেতে হবে।

” এখন গিয়ে ফিরব কখন?

” আজকে ফিরবেন না।

” আপনিও থাকবেন ওখানে?

” হ্যাঁ বাবা বলল আগামীকাল আপনাকে একসাথে নিয়ে বাসায় ফিরতে।

” আপনার কি কিছু হয়েছে?

” না তো কি হবে?

” আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

” হ্যাঁ বলুন কি জানতে চান?

” আপনার কি কাউকে পছন্দ আছে? না মানে বিয়ের রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিলেন হয়তো বের হয়ে যাওয়ার জন্য।

আরসাল ভাবছে কি বলবে! তিথির বিষয়টা তো সে জানাতে চেয়েছিল কিন্তু তার বাবা তাকে নিষেধ করেছে। কিন্তু সে তো এখনও ছোট নেই যে কি না এখনও বাবার কথামতো চলবে কিন্তু বাবার কথা গ্রাহ্য করা ছাড়াও তো উপায় নেই। তার কথার অন্যথা হলে তিনি কি করে বসবেন নিজেও জানেন না। তাই এখন তিথির বিষয়টা লুকিয়ে যাওয়াই উত্তম হবে।

” তেমন কিছু না হুটহাট করে বিয়ে দিয়ে দিলো বাবা তাই রাগ হয়েছিল।

” অন্য কোন কারণ থাকলে বলতে পারেন, মানে পছন্দের ব্যাপার।

” না এরকম কিছু নেই চিন্তা করবেন না। এখন গিয়ে তৈরি হয়ে নেন।

” আপনি চাইলে আমার নাম ধরে ডাকতে পারেন আর তুমি করে সম্বোধন করতে পারেন।

” আচ্ছা ঠিক আছে সেটা পরে হবে ক্ষণ। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেন।

আলিজা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে চলে যায়। এই মেয়েটা এত মায়াবী যে তার সাথে কড়া কথা বলতেও পারছে না আরসাল, সবসময় কাঁদো কাঁদো মুখ করে রাখছে আর বলবেই বা কেন মেয়েটা তো কোন দোষ করে নি যা হয়েছে তা ভাগ্যে লেখা ছিল। তবে কি ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ভাগ্যকেই মেনে নিতে হবে!

***
দুজন গাড়িতে বসে আছে কেউ কারও সাথে কোন কথাই বলছে না। আলিজা বারবার আরসালের দিকে তাকাচ্ছে, সে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর গাড়ি থামলো।

” বাড়ি এসে গিয়েছি?(আরসাল)

” না, আপনি একটু বসুন আমি আসছি।

” ঠিক আছে।

প্রায় দশমিনিট কেটে যায় কিন্তু আলিজা আসছে না দেখে ড্রাইভারকে আলিজার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।

” ছোট ম্যাডাম তো স্যারের কবর দেখতে গিয়েছে।

” এখানে, ভেতরে?

” জি স্যার।

আরসাল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। এতক্ষণ লাগছে আসতে, তার মানে নিশ্চিত মেয়েটা ওখানে গিয়ে কান্নাকাটি করছে। মেয়েটা শব্দ করে কান্না করতে পারে না গতরাতে সে দেখেছে কান্না করতে গিয়ে নিঃশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিলো।
আরসাল ভেতরে গিয়ে দেখে আলিজা কবরে মাথা এলিয়ে দিয়ে কান্না করছে। কি করুণ দৃশ্যের সাক্ষী হলো আরসাল। আসলেই মেয়েটার কেউ রইলো না, একমাত্র বাবা ছিল তবুও এই অবস্থা। আলিজার মা কোথায়, সে বলেছিল সে প্রথম পক্ষের। ভাবনা থামিয়ে এগিয়ে গিয়ে আলিজাকে তুলে দাঁড় করায়।
আলিজা আরসালের বুকে মাথা রেখে কান্না করতে থাকে।

” আপনাকে বলেছিলাম আমি, এভাবে কান্না কর‍তে হয় না।

” আমার বাবা কার ক্ষতি করেছিল বলতে পারেন? আমার বাবাকে যার জন্য নিজের প্রাণ দিতে হলো!

” পুলিশ তো তদন্ত করছে খুব তাড়াতাড়ি জানা যাবে। এখন চলুন বাসায় চলুন সন্ধ্যা হয়ে গেল।

” আমার বাবা ওখানে একা আছে, সবসময় দূরে রেখেছে এখন একেবারে আমাকে রেখে চলে গেল! আমি বাবার কাছে যাব প্লিজ আপনি আল্লাহকে বলেন না আমাকে আমার বাবার কাছে নিয়ে যেতে। আমার কেউ নেই এই পৃথিবীতে, এত একাকীত্বে আমি থাকতে পারব না আমি।

আরসাল আলিজাকে ওখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ন দিয়ে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। এভাবে কান্নাকাটি করা উচিৎ না। গাড়িও আপন গতিতে চলতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় পৌঁছে যায় তারা দুজন। ভেতরে ঢুকতেই আলিজার ছোট মা এগিয়ে আসে। আলিজা দেখেও না দেখে নিজের রুমে চলে যায় আরসাল একটু আশ্চর্য হয় আলিজার ব্যবহারে। আরসাল দাঁড়িয়ে যায় সেখানেই, সে তো এ বাসার কাউকে চেনে না।

“আসসালামু আলাইকুম।

” ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি তুমি আরসাল। আমি আলিজার মা, মা বললে তো ভুল হবে আমি ওর ছোটমা।

” আমিও বুঝতে পেরেছি কিন্তু আলিজা ওভাবে….

” ওর ব্যবহারে তুমি কিছু মনে করো না বাবা, এটা আমার প্রাপ্য। বাসায় সবাই কেমন আছেন?

“জি আলহামদুলিল্লাহ।

“তুমি যাও গিয়ে ফ্রেশ হও অনেকটা পথ আসতে হয়েছে।

” ঠিক আছে।

” শোনো, একটা কথা রাখবে?

” জি বলুন সম্ভব হলে রাখব।

” আলিজার সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করো না বাবা, ছোটবেলা থেকে অনেক অবহেলায় বড় হয়েছে।

আরসাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো উনার দিকে, এরকম একটা ভালো মানুষকে ইগনোর করে চলে গেল আলিজা!
_______

রাতে খাবার খেয়ে রুমেই বসে আছে দুজন। তারা দুজনই এতক্ষণ চুপ ছিল কিন্তু আলিজা নিরবতা ভঙ্গ করে যেই না কিছু বলতে যাবে ওমনি আরসালের ফোন বেজে ওঠে। অচেনা নম্বর দেখে প্রথমে রিসিভ না করে কেটে দেয় সে। পরবর্তীতে আবার কল আসে এবার সে রিসিভ করে।
” কে বলছেন?

” ভাইয়া তিথি সুই*’সাইড করার চেষ্টা করেছিল, আপনি প্লিজ হাসপাতালে একটু আসবেন?

” কি, কিভাবে!

” স্লিপিং পিল খেয়ে নিয়েছে কয়েকটা।

” আমি এক্ষুনি আসছি, ঠিকানা টেক্সট করে দাও।

কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে আরসাল বলে তার কোন এক বন্ধু হাসপাতালে তাই তার এখনই যেতে হবে। আলিজাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে সে..

” আপনার নম্বরটা দিন, রাতে যদি আসতে না পারি তাহলে কল দিয়ে জানাবো।

আলিজা নিজের নম্বর দিলে সাথে সাথে আবার বেরিয়ে যায় সে। আলিজাও শুয়ে পড়ে যেহেতু রাত হয়ে গিয়েছে অনেকটা।
__________

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় আলিজার, সাথে সাথে উঠে ফোন চেক করে দেখে আরসাল কল দিয়েছিল কিন্তু ফোন সাইলেন্ট থাকায় রিসিভ করতে পারে নি। হয়তো ব্যস্ত আছে ভেবে আর কল দেয় না সে, ছোট একটা মেসেজ দিয়ে রাখে। ততক্ষণে পাঁচটা বেজে গিয়েছে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে বাবার বসার রুমে চলে যায় সে। এই রুমে তার বাবা কাউকে ঢুকতে দিতেন না। মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজটা আদায় করে নেয়।

নামাজ শেষ করে বাবার রুমের আনাচে কানাচে সবকিছু স্পর্শ করে দেখতে থাকে সবখানে তার বাবার ছোয়া লেগে আছে শুধু তার বাবাটাই নেই।
বুক ভারী হয়ে কান্না চলে আসে তার, দুদিন আগেও তার বাবা তার সাথে ছিল আর আজ!
______

সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে নি আরসাল। তিথির অবস্থা খুব খারাপ ছিল, এখন একটু ভালো ভোরবেলা তাকিয়েছিল কিন্তু কারও সাথে কোন কথা বলে নি। আর বেশিক্ষণ হাসপাতালে থাকা যাবে না জন্য আরসাল বেড এর পাশে চেয়ার নিয়ে বসে তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে থাকে। এক পর্যায়ে তিথি চোখ মেলে থাকায়, চোখের কোণা থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।

” তিথী কেমন লাগছে এখন?

” এখানে সবাই আছে তারা তোমার খেয়াল রাখবে।

” আর তুমি? কেন করলে তুমি আমার সাথে এমন, একটুও বুক কাঁপলো না তোমার? আমি তোমার সাথে অন্যকাউকে ভাবতে পারছি না, আমি ওই মেয়েকে খু*’ন করে ফেলব আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না।

” তোমার কিছুই করতে হবে না যা করার আমি করব আর তাছাড়া তার ও কোন দোষ নেই সব দোষ আমার ভাগ্যের।

” মেয়েটার সাফাই গাইছো মনে হচ্ছে।

” আমি কিছু করছি না তিথি, আমি বলেছি তোমাকে যে আমি তাকে ডিভোর্সের কথা জানাবো। মেয়েটা বাবা হারানোর ধাক্কা সামলে উঠতে পারে নি এখনই কিভাবস এসব বলি?

“মেয়েটা ব*’শ করে নিলো নাকি তোমায় তার জন্য এত ভাবছো যে!

” তিথী তুমি এখন অসুস্থ, সুস্থ হও আমরা এসব নিয়ে কথা বলব।

” আবার এটা যেন বলো না যে তিথি তোমাকে ভালো লাগছে না আমি ওই মেয়ের সাথেই থাকব।

” তিথি একদম বাজে কথা বলবে না। তোমার জন্য সারারাত আমি ঘুমোতে পারি নি আর তুমি এসব বলছো! রেস্ট নাও আমি আসছি এখন, রিসেপশনে সব টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি।

তিথিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে যায়। এখানে বসে থাকলে সম্পর্ক নষ্ট হবে তিথির মাথা ঠিক নেই।
______

আরসাল আলিজাদের বাসা প্রায় পেয়ে গিয়েছে। তিথি যা শুরু করেছে এভাবে বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে সাথে সে নিজেও। কিন্তু আলিজাকে এসব কিভাবে বলবে সে, কিন্তু না বলেও তো উপায় নেই। এখন মনে হচ্ছে সে নিজে না থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। এসব কথা নিজের মধ্যে চেপে রাখার উপায় নেই আবার কাউকে বলার ও উপায় নেই। ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে যায় সে, কোথাও দেরি না করে সোজা রুমে চলে যায়। রুমে কেউ নেই দেখে একটা সিগা*’রেট জ্বা*’লিয়ে বারান্দায় চলে যায় সে, এটা যদি কষ্ট একটু কমাতে পারে!

সবাই রেস্পন্স করবেন, একের অধিক কমেন্ট করবেন😊
চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here