বৃষ্টিপ্রিয়া পর্ব ৪

#বৃষ্টিপ্রিয়া
পর্ব- ০৪।
লেখা- জাহান লিমু।

আমাকে সেইবার বেশ জব্দ বানানো হয়েছিলো। ধরা পড়ে গিয়ে ভীষণ নাজেহাল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি প্রীতি এমন কিছু করবে। যেখানে আমি ভয়ে, টেনশনে অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম,সেখানে সে এমন কিছু করবে, তা ভাবা আমার জন্য বেশ দুর্বোধ্যই বটে। হঠাৎ আমার ভীষণ রাগ উঠে গেল। একইসাথে অভিমান। মেয়েরা অভিমানী তাই যখন তখন অভিমান করে। তাই বলে কি কোথাও উল্লেখ আছে,ছেলেদের অভিমান হতে পারে না। আমার সেবার ভীষণ অভিমান হয়েছিলো। আমি এরপর প্রীতির সাথে একটা কথাও না বলে ছুটি কাটিয়ে চলে গিয়েছিলাম। যদিও কষ্টটা হয়তো আমারি বেশি হয়েছিলো। প্রীতির ব্যাপারটা অবশ্য জানিনা তখনো। সেইভাবে কথায় হয়নি আমাদের। দুজনের মনেই সংকোচ। যখন আমি বুঝতে পারলাম প্রীতি আর সোহাগ মিলে প্ল্যান করেই আমাকে ফাঁসিয়েছে। প্রীতির কোথাও বিয়ে ঠিক হয় নি। দুই ভাই বোন মিলেই আমাকে জব্দ করেছে। যখন সোহাগ আমাকে পুরোটা বললো,তখন আমি একদম নিশ্চুপ!
দাবার চালটা এভাবে ঘুরে যাবে কল্পনাও করিনি। যদিও আমার খুশিই হওয়ার কথা ছিলো। খুশি হয়েছিও বটে। তবুও কেন যেন এভাবে ধরা পড়ে যাওয়ার দরুন ভীষণ আহত হয়েছিলাম। মেয়েটা এতোটাও চালাক, বুঝতে পারিনি একদম।
আমাকে কেমন নাকানি-চুবানিটা খাওয়ালো। অথচ নিজেও মুখ ফুটে একটা কথাও বলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে গিয়েছে। আমি খুব বেশিই পর্যবেক্ষণ করতাম তাকে,সেজন্যই আংশিক আভাস পেয়েছিলাম। তবে সেটা তেমন কোন নির্ভরযোগ্য কিছু ছিলো না। অথচ কতবড় একটা কাজ করে ফেললো। সোহাগের কথা অনুযায়ী প্রীতি ওকে বলেছে যে,আমি ওকে পছন্দ করি। তখন সোহাগ প্রীতিকে ধমকে দেয় বেশ। নিজের বোনকেই কড়া কথা শোনায়,আমার ব্যাপারে এভাবে বলার জন্য। এটা শুনে আমি সোহাগের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলাম। নিজের বোনের থেকেও আমাকে বেশি বিশ্বাস করেছে সে। তাহলে আমি কি তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি?

এই প্রশ্নটার জন্যই আমি প্রীতিকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগে কিছু বলতে চায় নি। হয়তো এতে প্রীতিকে পাবার আশা শূণ্য ছিলো। তবুও আমি সেটাই বেছে নিয়েছিলাম। কখনো কখনো আশাটা শূণ্যে রাখাটাই ভালো। তাহলে হারানোর ভয়টা কম থাকে।
তবে এরপর প্রীতি যেটা বলেছিলো,সেটা শুনে আমি চূড়ান্ত বিস্মিত হই। যখন সোহাগ প্রীতিকে ধমকাচ্ছিল,তখন আচমকা প্রীতি বলে বসে যে সেও নাকি আমাকে পছন্দ করে। যখন এই কথাটা আমি শুনি সোহাগের মুখে,আমার গায়ের পশমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। যদিও কথাটা প্রীতির মুখ থেকে শুনতে পেলে হৃদয় শীতল হয়ে যেতো। যদিও সেটা আশাতীত। কারণ যেখানে আমি ছেলে হয়ে কিছু বলতে পারিনি,সেখানে সে মেয়ে হয়ে যতটুকু করেছে, সেটাই ব্যাপক কিছু।
তবে প্রীতি যখন এটা বলেছিলো,তখন নাকি সোহাগ প্রীতিকেই উল্টো সন্দেহ করে বসে। যে প্রীতিই হয়তো আমাকে পছন্দ করে,কিন্তু সেটা আগে না বলে, আমার কথা বলে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে চেয়েছে। সোহাগের কথা শুনে আমি একের পর এক হোঁচট খাচ্ছিলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। এতোটা বিশ্বাসের পর, আমার কাজটা ভুলই মনে হচ্ছিল। ভীষণ হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলাম আমি।

কিন্তু সোহাগের কথা শুনে সেদিনের মত আরেকদফা বিস্ময়ের শেষ ধাপে পৌঁছে ছিলাম। দুই ভাইবোন মিলে আমাকে একের পর এক শক দিয়ে যাচ্ছিল। সোহাগকে সেদিন আমি বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। নিজের ভাইকেও কেউ এতোটা বিশ্বাস করে না। তবে এটা ঠিক আছে মাত্র দুইবছরেই সোহাগ আমার নাড়ী নক্ষত্র সব জেনে গিয়েছিলো। আর এটাও জেনে গিয়েছিলো, আমি চাপা স্বভাবের। সহজে মনের কথা প্রকাশ করিনা। তাই আমার মনে কি চলছিলো,সেটা সে একটুও অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু আমার বৃষ্টিপ্রিয়া,যে বৃষ্টির জলের মতই স্বচ্ছ, সে কিভাবে কিভাবে যেন আমার মনের ভেতরটা পড়ে ফেলেছিলো। হয়তো মেয়ে বলে। তবে আমিতো কখনো প্রীতির চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতাম না। যে কয়েকবার সামনা-সামনি কথা হয়েছে,অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলেছি। যখন প্রীতি অন্য কারো সাথে কথা বলতো,তখন আমি আড়চোখে দেখতাম। সেটাও অল্প সময়ের জন্যই। যেন ধরা না পড়ে যায়। কিন্তু সেই তো ধরা খেলাম। তাও এমন শক্তপোক্তভাবে।

সোহাগ আমাদের দুজনকেই স্বাভাবিক থাকতে বললো। যদিও আলাদাভাবেই বলেছে। কারণ আমি অভিমান করে চলে এসেছিলাম। অবশ্য আমার ফোন নাম্বারটা চুরী করে প্রীতির বইয়ের ভাজে রেখে এসেছিলাম। যদিও জানি সোহাগের কাছ থেকে নাম্বার নিতে পারতো। কিন্তু কেন যেন আমার নাম্বারটা এভাবে দিয়ে আসতে মন চাইছিলো। প্রীতি তখন কোচিং-এ ছিলো। আমি আরেকটা ভয়ানক কাজ করেছিলাম। সেটা সোহাগের চোখকেও ফাঁকি দিয়ে। প্রীতির একটা ওড়না চুরি করেছিলাম। যদিও সেটা বেশ রিস্কি ছিলো। কিন্তু ওড়নাটা ব্যাগে ভরে নিয়েছিলাম তাড়াহুড়ো করে। ভাগ্যিস সাথে ছোট ব্যাগ ছিলো একটা। এই ব্যাগটা সবসময় এমনি সাথে রাখতাম। যাক ভালো কাজেই লাগলো। অবশ্য প্রীতি যেন ওড়না না খুঁজে,সেজন্য নাম্বারটার নিচে একটা ছোট নোট লিখে রেখে এসেছিলাম। কোন বইটার ভেতর রাখবো,বুঝতে পারছিলাম না। তারপর ইংরেজী গ্রামারের ভেতরই রাখলাম। কারণ এটা বেশি পড়ার চান্স আগে আগে। অন্যগুলো ততটা নিয়মিত পড়া না হলেও,এটা মোটামুটি পড়তে হয়। আমার সেন্সটা অবশ্য ঠিকই ছিলো। আমি ডিউটিতে চলে আসার পরেদিনই একটা টেক্সট আসে। যেখানে একটা লাইন লিখা ছিলো কেবল,
নাম্বারটা কি মনচোর, না ওড়না চোর, কোনটা লিখে সেইভ করবো অফিসার?
মেসেজটা পড়ে আমি ঘরকাঁপিয়ে হেসেছিলাম। যদিও সচরাচর আমি এতো জোরে হাসি না। কিন্তু ঐ মেসেজটা পড়ার সময় আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার মুখটা চোখের সামনে ভাসছিলো। মেয়েটা এতোটা দুষ্ট, দেখে বুঝা যায় না। আমিও ছোট্ট করে রিপ্লে দিয়েছিলাম,
” যেটাতে বৃষ্টিপ্রিয়ার মন তুষ্টি হয়।”
এর পরের সময়গুলো যেন কাটতে চাইতোনা। ঐদিনের ঐ মেসেজের পর প্রীতি আর কোন মেসেজ বা কল করেনি। আমার অভিমান যদিও ওর মেসেজ দেখেই উধাও হয়ে গিয়েছিলো। তবুও কেন যেন ফোন দিতে পারছিলাম না।
কেন যেন ওর কল বা মেসেজের অপেক্ষায় থাকতাম। কিন্তু সেও কল দিতো না। শেষমেষ যখন ভাবলাম আমিই ফোন দিবো,ঠিক সে সময়ই আমার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে নামটা দেখেই ঠোঁট জোড়া আপনা আপনি প্রসারিত হয়ে গিয়েছিলো।
আমার বৃষ্টিপ্রিয়ার ফোন যে ছিলো।
ফোন রিসিভ করে কেউ কোন কথা বলতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর যখন ভাবলাম কথা বলবো,তখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঝড়ো বৃষ্টি শুরু হলো। কথা বুঝবার উপায় নেই। তখন শুনতে পেলাম সে বলছে,
” কেমন আছেন?”
আপনি ডাক শুনে আমি বেশ আহত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো তুমি করেই বলবে। তাই আমিও আপনিই সম্বোধন করলাম সেদিন। সে অবশ্য কোন রিয়েক্ট করেনি অন্য মেয়েদের মতন। যেন আপনি ডাকাই যায়।
পরবর্তীতে আমি তুমি করে ডাকলেও,সে আমাকে বরাবরই আপনিই বলে এসেছে। সে একই সাথে শান্ত নদীর মতো,আবার প্রাণোচ্ছল। যে নদীতে আমি ডুবে গিয়েছিলাম। হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। সেদিন প্রথমবারের মত বেশ সময় কথা হয়েছিল আমাদের। অনেক অজানা বিষয় জানা হলো একে অন্যের ব্যাপারে। তবে ফোন রাখার আগে আমাকে বলেছিলো,
” আচ্ছা, যদি সত্যিই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যেতো,কি করতেন?”
” আমি শান্ত স্বরে বলেছিলাম,কিছুই না।”
এটা শুনে ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিলো তা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে আমি যেটা বলেছি,সেটাই সত্য। কারণ আমি সবসময় এরকম কিছুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতাম। আর ভাবতাম,যদি সে আমার জন্য হয়ে থাকে, তবে সে আমারই হবে। নয়তো, আমি শত চেষ্টা করলেও পাবোনা।
এইযে আমরা এতবছর প্রেম করেও,শেষ পর্যন্ত কোন না কোনভাবে বিয়ে হয়না। তখন দুজনকেই কষ্ট পেতে হয়। তারচেয়ে এটাই ভালো। ক্ষণিকের সুখের চেয়ে,সারাজীবন একসাথে থাকতে পারাটা অনেক বেশি কিছু।
যদিও সোহাগের কথায় তখন স্বাভাবিক ছিলাম, তবে মনে ভয় ঠিকই রয়ে গেছিলো। কারণ, আমার বা সোহাগের পরিবারের কেউ তখনো কিছুই জানেনা। কারণ তখন জানালে আরো বেশি ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। তাই সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। তবে আমার জন্য যে সামনে এরচেয়েও বড় কোন শক অপেক্ষা করছিলো,সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

#চলবে…
#জাহান_লিমু।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here