#ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পার্ট_২১
#M_Sonali
আজ দুই দিন হল শ্রাবণের বাসায় আছে চাঁদনী। এই দুদিনের মাঝে শ্রাবনের সাথে একটাও কথা বলেনি সে প্রয়োজন ব্যতীত। শ্রাবনকে এরিয়ে চলেছে। শ্রাবণ ও ইচ্ছা করে এগিয়ে এসে ওর সাথে জোর করে কোনো কথা বলেনি। আর দুজন আলাদা রুমে থেকেছে এ দুদিন। কেউ এক রুমে কখনোই থাকেনি। শ্রাবণের বাসাটা অসম্ভব সুন্দর এবং বিশাল বড়। একদম রাজ প্রাসাদের মতো। চাঁদনী নিজের রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরের দৃশ্য দেখছে। আর ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা গুলো মেলানোর চেষ্টা করছে।
শ্রাবণের বাসাটা বিশাল বড় দোতালা একটি বাসা। আর বাসার চারপাশে অনেক উঁচু করে বাউন্ডারি করা। এতটা উঁচু করে বাংলাদেশের আর কোথাও বাউন্ডারি করে বাসা আটকানো আছে কিনা চাঁদনীর জানা নেই। কারণ বাসার ছাদের উপর উঠলেও বাসার আশেপাশের কোন এলাকা বা কোন দৃশ্য দেখা যায় না। এতটা উচু করেই বাউন্ডারি করা হয়েছে। এটা দেখে বেশ অবাক হয়েছিল চাঁদনী। কিন্তু পরে শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করলে ও এক কথায় বলে দিয়েছে, তার বাইরে প্রকৃতি দেখতে ভালো লাগে না। তাই এই ব্যবস্তা। ইদানীং ক্যান জানেনা শ্রাবণকে খুব সন্দেহ হয় চাঁদনী। বার বার মনে হয় ওর মাঝে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
চাঁদনী সত্যি বলতে জানেনা যে ওরা ঠিক কোন জায়গায় আছে। আর এই বাড়িটা কোন জায়গায় অবস্থিত। মাঝে মাঝে ওর কানে প্রবল ঢেউয়ের শব্দ আসে। মাঝে মাঝে মনে হয় এ বাসাটা যেন কোন এক নদী বা সমুদ্রের কিনারে হবে। কিন্তু দেখতে না পাওয়ায় সিওর হতে পারেনা চাঁদনী।
এই পুরো বাড়িটা ফুলের বাগান দিয়ে ঘেরা। একদম সামনে থেকে শুরু করে পিছন দিয়ে ঘুরে পুরো বাসাটাই ফুল দিয়ে ঘেরা। ছাদের ওপরে ও নানা রকম ফুলের গাছ। আর প্রতিটা গাছেই রয়েছে রং বেরংয়ের নানান রকম ফুল। এমনও কিছু গাছ আছে যে গাছ গুলোর ফুল, এর আগে কখনো দেখেনি চাঁদনী। এমনকি নামও জানে না সে। আর এই বাগানের ফুলগাছ গুলোর মাঝে একটা ফুলগাছ ভীষন ভাবে আকর্ষণ করে চাঁদনীকে। আর সেটা হলো কালো গোলাপ। যে গোলাপগুলো সাভাবিক এর তুলনায় অনেকটাই বড়। এই বাগানের ফুল গুলো দেখতেই একটা কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ে চাঁদনীর। আর সেটা হলো, ও যখন ওর বাবার কাছে সিলেট ছিল! তখন মাঝে মাঝে ওর বাবা ওর জন্য একগুচ্ছ করে ফুল নিয়ে এসে ওর হাতে দিত।
ফুলগুলোকে পেয়ে খুব খুশি হতো চাঁদনী। কেননা ও ফুলের বাগান খুব পছন্দ করত। কিন্তু কখনো ফুল গাছের চর্চা করতে পারত না, ওর বাবার বারণ থাকার কারণে। আর যখন ওর বাবা সেই ফুলগুলো ওর হাতে দিতো তখন খুব খুশি হয়ে ওর বাবার কাছে জানতে চাই তো,
— বাবা এগুলো তুমি কোথায় পেলে?
ওর কথার উত্তরে ওর বাবা শুধু একটা কথাই বলত, আর সেটা হল,
— এটা তোমার ভালবাসার উপহার। যেটা তুমি সারাজীবন পাবে।
এই ফুল গাছগুলোর দিকে তাকালে চাঁদনীর এখনো ওর বাবার সেই কথাগুলো মনে পড়ে যায়। সে এখনো জানেনা যে ফুলগুলো ওর বাবা কেন ওকে দিত। আর প্রতিবার একই উত্তর কেন দিতো যে, “এটা ওর ভালবাসা উপহার যা ও সারা জীবন পাবে!” তাহলে এখন কেন পায় না সে? কথাটা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায় চাঁদনীর। বাবার কথা প্রচন্ড মনে পড়ে যায় তার।
হঠাৎ পেছন থেকে কারও গলাখাকারির শব্দে পিছন দিকে ঘুরে তাকায় চাঁদনী। আর তাকাতেই দেখে শ্রাবণ মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর হাত দুটো পেছনে লুকিয়ে রাখা। এক নজর ওকে দেখেই আবারও পিছন দিকে ঘুরে দাড়ায় চাঁদনী। শ্রাবণ ওর একটু কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে হালকা কেশে নিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলে,
— কি দেখছ এতো মনোযোগ দিয়ে? বাইরে কি এমন আছে যে এত মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে? মাঝে মাঝে একটু ঘরের মাঝেও তো দেখতে পারো নাকি!
ওর কথার উত্তরে বিরক্তি মাখা দৃষ্টিতে একবার ওর দিকে ফিরে তাকায় চাঁদনী। তারপর আবারো জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগে। তখনই শ্রাবণ ওর কাছে আর একটু এগিয়ে এসে ওর সামনে একগুচ্ছ ফুল ধরে বলে,
— এটা আপনার জন্য মিসেস শ্রাবণ চৌধুরী।
ফুলের গুচ্ছর দিকে তাকাতেই যেন ভীষণ অবাক হয়ে যায় চাঁদনী। কারণ এই ফুলের গুচ্ছ অবিকল ওর বাবা ওকে যে ফুলগুলো দিত সেই গুলোর মত।ও ফুলের গুচ্ছটা হাতে নিয়ে তাতে হাত বুলিয়ে প্রত্যেকটা ফুল পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। শ্রাবণ পাশে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে আর তৃপ্তির হাসি হাসছে। ফুলগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে চাঁদনী,
— এই ফুলের গুচ্ছটা আপনি কোথায় পেলেন?
— আরে তুমি তো দেখি বড্ড আনরোমান্টিক! বিয়ের পর কোথায় তোমার স্বামী তোমাকে প্রথম একগুচ্ছ ফুল উপহার দিলো। বদলে তুমি তার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে একটা কিস দেওয়া বাদ দিয়ে, উল্টা তাকে প্রশ্ন করছো সে ফুলগুলো কোথায় পেয়েছে? বলি তুমি জানালা দিয়ে এতক্ষণ কি ভূত দেখছিলে? বাইরের ফুল গাছগুলো কি তোমার চোখে পড়েনি চাঁদ?
ওর প্রশ্নের উত্তরে বিরক্তি নিয়ে চাঁদনী আবার উল্টো প্রশ্ন করল,
— দেখুন স্যার আপনাকে আমি যেটা বলছি সেটার সঠিক উত্তর দিন। আমি আপনাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এমন উত্তর দিতে বলিনি। সত্যি করে বলুন এই ফুলগুলো আপনি কোথায় পেলেন?
— এতো দেখি মহাবিপদ! আরে চাঁদ তুমি কি দেখছো না জানালা দিয়ে যে, আমার বাসায় কত ফুল গাছ রয়েছে। আমি সেখান থেকেই ফুলগুলো তুলে তোমার জন্য এভাবে তোরা বানিয়ে নিয়ে এসেছি। ভালো না লাগলে বল নিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিচ্ছি।
ওর কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে ফুলের তোড়ার দিকে তাকিয়ে রইল চাঁদনী। একদম অবিকল ওর বাবা ওকে যে ফুলের তোড়া গুলো দিত সেই রকম দেখতে এটা। চাঁদনী এবার বির বির করে বলে উঠলো,
— এটা কিভাবে সম্ভব? অবিকল একই রকম ফুলের তোড়া কিভাবে হতে পারে। এটা তো একদমই অসম্ভব।
— কি অসম্ভব চাঁদ? তুমি এত কি বিড়বিড় করছো বলতো? বলি ফুলের তোড়াটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
ওর প্রশ্নের উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো চাঁদনী। তারপর আচমকাই প্রশ্ন করে উঠল,
— আচ্ছা আপনি কি আমাকে আগে থেকে চিনতেন? মানে আমি যখন সিলেটে আমার বাবার সাথে ছিলাম! তখন কি আপনি আমার বাবার কাছে ফুলের তোড়া বানিয়ে নিয়ে আমার জন্য দিয়ে আসতেন?
কথাগুলো বলেই সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে রইল চাঁদনী। কিন্তু শ্রাবণ ওর প্রশ্নটার উত্তর দিতে একমূহূর্ত দেরী করলো না। হেসে দিয়ে বললো,
— ও বাবা তাই নাকি? তার মানে আমার শ্বশুর মশাইও তোমাকে এই একই রকম ফুলের তোড়া গিফট করত? তা তো জানিনা। তাহলে তো বেশ ভালোই হলো। শ্বশুরমশাই এর সাথে তার জামাই এর মিল আছে কি বল?
মজা করে কথাটা বলে চোখ টিপ দিল চাঁদনীকে শ্রাবণ। কিন্তু এখন মোটেও মজা করতে ইচ্ছা করছে না চাঁদনীর। ভীষণ বিরক্ত ফিল হচ্ছে শ্রাবণ এর উপর। ও শ্রাবণকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে সরে এসে বলল,
— আচ্ছা আপনি এমন বেহায়াপনা কেন করছেন আমার সামনে। আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনাকে আমার বিরক্ত লাগছে! চলে যান এখান থেকে। আর এই ফুলের তোড়াটা ও নিয়ে যান। আমার ভালো লাগছে না কিছু।
ওর কথার উত্তরে শ্রাবণ গম্ভীর মুখে বলল,
— ওহ হ্যালো, এ রুম থেকে এখন আমি নয় বরং তুমি চলে যাবে। কেননা এই রুমটা এখন সাজানো হবে, আজকে রাতের জন্য।
ওর কথা শুনে চাঁদনী ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
— সাজানো হবে মানে কি?
— এত মানে জেনে তোমার কাজ নেই, তুমি এখন রুম থেকে চলো। যদি ইচ্ছা করে না যাও তাহলে আমি তোমাকে কোলে করে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো।
কথাটা বলেই বাকা হাসলো শ্রাবণ। চাঁদনী এবার অসম্ভব বিরক্ত হলো। হাতে থাকা ফুলের তোড়াটা ছুড়ে সোফা সেটের ওপর ফেলে দিয়ে রুম থেকে সোজা বাইরে বেরিয়ে গেল। এই বাসাটা ভীষণ অদ্ভুত। এত বড় একটা বাসা, অথচ এখানে শুধু ও আর শ্রাবণ ছাড়া তৃতীয় কেউই নেই। এমনকি কোনো কাজের লোকও নেই এখানে। চাঁদনী বুঝতে পারে না এতবড় একটা বাড়ি এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো থাকে কিভাবে, কোন কাজের লোক ছাড়া?
———–
রাত ১০.৩০ মিনিট
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাইরের রুমে সোফার উপর বসে আছে চাঁদনী। ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার। কখন থেকে নিজের রুমে যেতে চাইছে, কিন্তু শ্রাবণ বারবার ওকে বাঁধা দিচ্ছে। ও বুঝতে পারছেনা কেন এমন করছে সে। অসম্ভব বিরক্তি আর রাগ নিয়ে আর ধৈর্য ধরে না থাকতে পেরে এবার সোজা নিজের রুমের দিকে হাটা দিল চাঁদনি। রুমে গিয়ে দরজা খুলতেই ভীষণ অবাক হয়ে গেল। তার কারণ এই বাড়িটাতে আসার পর থেকেই ও দেখেছে এই বাসার পুরোটাই অনেক লাইট জ্বালিয়ে সবসময় ঝলমলে থাকে। অথচ হঠাৎ এই রাতের বেলায় নিজের রুম একদম অন্ধকারে ঢাকা দেখে অবাক হলো ও। চাঁদনী অন্ধকারে হাতরিয়ে হাতরিয়ে গিয়ে লাইটের সুইচটা অন করার সাথে সাথে অবাক হয়ে গেল। কেননা পুরোটা রুম’ই রঙবেরঙ এর ফুল দিয়ে অনেক সুন্দর করে সাজানো। ঠিক যেন বাসর ঘরের মতো।
চাঁদনীর বুকের ভেতরটা হটাৎ করে ধক করে উঠল। ও বুঝতে পারল ওর সাথে আজ কি হতে চলেছে। হাত পা কাপাকাপি শুরু করে দিলো ওর। কেননা ও কোনোভাবেই শ্রাবনকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। তখনই ওর পিছন থেকে কেউ একজন ওকে ডেকে উঠল। চাঁদনী সাথেসাথে পিছন দিকে তাকাতেই দেখলো শ্রাবণ অনেক সুন্দর করে শেরওয়ানি পড়ে একদম জামাইয়ের মতো সেজে ওরদিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে রয়েছে। তার হাতে সেই ফুলের তোড়া। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ফুলগুলো এখনো একদম তাজা।
শ্রাবণ এক পা দু পা করে ওর কাছে এগিয়ে এসে ফুলের তোড়াটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— মাই সুইটহার্ট, মাই ডারলিং, মাই লাভলি ওয়াইফ এটা তোমার জন্যে। আজ এই ফুলে ফুলে সাজানো বাসর রাতে আমার পক্ষ থেকে উপহার।
শ্রাবণের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো চাঁদনী। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে কি মনে করে ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে নিল। সাথে সাথে শ্রাবণ এক মুহূর্ত দেরি না করে ক্রু হেসে ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর চাঁদনীর গলায় গালে এলোপাথাড়ি কিস করতে লাগল। চাঁদনী শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শ্রাবনকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
— এ আপনি কি করছেন? আমি আপনাকে স্বামী বলে মানি না। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।
কথাটা বলেই হাঁপাতে লাগল চাঁদনী। ওর কথা শুনে শ্রাবণের মুখে যেন রহস্যময় এক হাসি ফুটে উঠল। ও যেন আগে থেকেই জানতো যে চাঁদনী এমন কিছু একটা বলবে। কিন্তু সেই হাসিটা চাঁদনীর চোখে পরলোনা। চাঁদনী যখন ওর দিকে তাকালো তখন দেখল ও মুখটা একদম গম্ভীর বানিয়ে আছে। রাগে হাতের মুঠো শক্ত করে আছে। ওকে এভাবে রেগে যেতে দেখে ভয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো চাঁদনী। মাথা নিচু করে অপরাধীর মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
ভ্যাম্পায়ার_বর (সিজন ২)
#পার্ট_২২
#M_Sonali
— কি বললে তুমি চাঁদনী? কথাটা আরেকবার বলো আমি শুনতে চাই!
শ্রাবণের প্রশ্নের উত্তরে চাঁদনী আরো রেগে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো,
— আমি বলেছি আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। আর আপনাকে আমি নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা। শুনেছেন আপনি! এখন চলে যান এখান থেকে আমি একটু একা থাকতে চাই।
শ্রাবণ হাতের মুঠো শক্ত করে রাগে থর থর করে কাপতে লাগল। তারপর বেশ কিছুক্ষন সেখানেই দাড়িয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। ও চলে যেতেই চাঁদনী একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ এসে ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার পাশে দাড়িয়ে প্রত্যেকটা ফুল একটা একটা করে দেখতে লাগলো। ফুল গুলো অসম্ভব সুন্দর, আর সাজানোটাও অনেক বেশি দারুন হয়েছে। যেন চোখ জুড়ানো সাজানো। চাঁদনী মনে মনে ভাবলো, “আজ যদি এখানে শ্রাবণের জায়গায় ওর সেই ভালোবাসার মানুষটি থাকতো! তাহলে হয়তো অনেক কিছুই হয়ে যেত এতক্ষণে।” কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ শ্রাবণের ডাকে ধ্যান ভাঙলো চাঁদনীর।
পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো শ্রাবণ বেশ কয়েকটা শপিংব্যাগ হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসছে। চাঁদনী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
— কী চাই আবার কেন এসেছেন আপনি এখানে?
শপিং ব্যাগ গুলো ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে শ্রাবণ বলল,
— এর মাঝে শাড়ি জুয়েলারি আর কিছু সাজগোজের জিনিস রাখা আছে। সবকিছু পড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বউয়ের মত সেজে রেডি হয়ে নাও। আমি আসছি।
শ্রাবণের কথা শুনে যেন মাথায় বাজ পরলো চাঁদনীর। ও ভ্রু কুঁচকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— বউ সাজবো মানে! কি বলছেন কি আপনি এসব?
— আমি যেটা বলছি ঠিক বলছি। তুমি কাকে ভালোবাসো, না ভালোবাসো, সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। তুমি এখন আমার বউ, আমি তোমার স্বামী। এটাই আমার দেখার বিষয়। আর আমি আমার নিজের অধিকার একটুও ছাড়বো না। বেশি কথা না বাড়িয়ে এগুলো পড়ে দ্রুত রেডি হয়ে নাও। নইলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।
কথাটা বলেই ব্যাগগুলো চাঁদনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল শ্রাবণ। চাঁদনী মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বিছানার উপর বসে পরল। কি করবে কিছুই যেন মাথায় আসছে না ওর।
বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যাওয়ার পর আবারো রুমে ফিরে এলো শ্রাবণ। ফিরে এসে দেখে চাঁদনী আগের মতোই চুপচাপ গাল ফুলিয়ে বসে আছে। একটা জিনিসও পড়ে নি। শ্রাবণ হাতের মুঠ শক্ত করে রাগি গলায় বলে উঠলো,
— এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? তুমি এগুলো পরে রেডি হবে! নাকি আমি তোমাকে জোর করে নিজে হাতে সব পড়িয়ে সাজিয়ে দেব?
ওর কথা শুনে বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকাল চাঁদনী। তারপর শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে বললো,
— আচ্ছা ঠিক আছে আমি পরে নিচ্ছি, আপনি যান।
— এই তো গুড গার্ল। ১৫ মিনিট সময় দিলাম এর মাঝে রেডি হয়ে নাও। আমি ১৫ মিনিট পরেই আসছি।
শ্রাবণ চলে যেতেই কান্না করে ফেললো চাঁদনী। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে তার। এখন যদি এখানে ওর আপন কেউ থাকতো। বা শ্রাবণী থাকতো তাহলে হয়তো শ্রাবণ ওর সাথে এমন ব্যবহার করতে পারত না। কিন্তু এখন এখানে ওকে দেখার মত কেউ নেই বলেই শ্রাবণ ওর সাথে এমন আচরণ করছে। আর চাঁদনী তার প্রতিবাদও করতে পারছে না।
কিছুক্ষণ কান্না করার পর, চোখের জল মুছে নিয়ে, ধীরে ধীরে সবকিছু পড়ে নিজেকে বউয়ের মত সাজাতে লাগলো চাঁদনী। ছোটবেলা থেকে ওর বাবার কাছে সব কিছুই মোটামুটি শিখেছিল চাঁদনী। ওর বাবা ওকে প্রায় সবকিছুই শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই রেডি হতে খুব একটা অসুবিধা হলো না তার। বাবা ছিল তার বন্ধুর মতো, ভীষণ ভালোবাসতো বাবাকে। সাজগোজ করার সময় বাবার কথা বড় বেশি মনে পড়ছিল চাঁদনীর। কিন্তু তবু চোখের জল লুকিয়ে রেখে শক্ত হয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। ১৫ মিনিটের মাঝেই নিজেকে মোটামুটি হালকা পাতলা ভাবে সাজিয়ে ফেলল চাঁদনী। তারপর চুপচাপ গিয়ে খাটের একপাশে বসে পড়ল। ভয়ে যেন বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে তার। বারবার মনে হচ্ছে শ্রাবণ ওর সাথে আজ উল্টাপাল্টা কিছু করে না বসে। ও তো শ্রাবণকে এখনো মন থেকে নিজের স্বামী হিসেবে মানতে পারেনি। কিন্তু এখন যদি ও সেটা না মানে, যদি ওর উপর জোর করে। তাহলে কি করবে ও? এসব ভেবেই যেন মাথা ধরে যাচ্ছে চাঁদনীর।
হঠাৎ রুমে শ্রাবণের উপস্থিতি টের পেয়ে ভয় যেন কুকড়ে গেল চাঁদনী। ও জড়োসড়ো হয়ে বসে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে রাখল। ওকে এমন করতে দেখে মুচকি হেসে ওর কাছে এগিয়ে এল শ্রাবণ। তারপর ওর সামনে বসে মৃদু কণ্ঠে বলল,
— এবার বলো তুমি কাকে ভালোবাসো? অবশ্যই তোমার স্বামী হিসেবে এটা জানার অধিকার আমি রাখি। আমি জানতে চাই সেই লোকটি কে! যাকে আমার বউ ভালোবাসে। আর যার জন্যে আমাকে স্বামী হিসেবে মানতে চাইছে না!
শ্রাবণ যে এমন একটা প্রশ্ন করবে সেটা ভাবনার বাইরে ছিল চাঁদনীর। ও কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওকে ভয় পেতে দেখে আবারও শ্রাবণ ওকে আশ্বাস দিয়ে কিছুটা দূরে সরে বসে বলল,
— ভয় পেয়ো না চাঁদ আসলে তোমাকে বউয়ের সাজে কেমন দেখা যায় সেটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। তাই এভাবে সাজতে বললাম। তুমি কিছু মনে করো না। আসলে আমাদের বিয়ের দিন তো তোমাকে বউয়ের সাজে দেখিনি। তুমি তো শুধু একটা কালো লেহেঙ্গা পড়েছিলে। যেটা বিয়ের সাজ নয়। তাই বউ সাজে দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমি তোমার ওপর স্বামী হিসেবে কোন জোর জবরদস্তি করব না। তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো। তবে এটা বলো তুমি কাকে ভালোবাসো, সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটা কে?
ওর প্রশ্নে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো চাঁদনী। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আদৌ বলা ঠিক হবে কিনা সেটাও তার জানা নেই। কিন্তু শ্রাবণ যখন ওকে আশ্বাস দিয়ে কথাগুলো জিজ্ঞেস করলো। তাহলে নিশ্চয়ই ওর তাকে সত্যিটা বলা উচিত। তাই নিজেকে শক্ত করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমি চিনি না। সে কে তাও জানি না। শুধু জানি সে আমাকে অনেকবার বাঁচিয়েছে নানা রকম বিপদ থেকে। আর সে কোনো মানুষ নয়।
— মানুষ নয় মানে?
— মানে আমার মনে হয়, সে একজন ভ্যাম্পায়ার। যে বারবার আমাকে শয়তান ভ্যাম্পায়ার এর হাত থেকে রক্ষা করেছে। অনেক বিপদ থেকে বাচিয়েঁছে। আমার সাথে অনেক কথা বলেছে। যার সাথে আমার কোনো না কোনোভাবে সংযোগ আছে। কিন্তু সে আমাকে দেখা দেয় না। তার চেহারা এখন অব্দি দেখিনি আমি। শুধু তার গাঢ় নীল বর্নের চোখটা দেখেছি। যে চোখটা দেখে যেমন ভয় পেয়েছি। ঠিক তেমনি মায়ায় পড়েছি আমি। তাকে ভালোবাসি এটা কাল অব্দি বুঝতাম না। কিন্তু আজকে বারবার উপলব্ধি করছি যে আমি তাকে ভালোবাসি। তার শূন্যতা অনুভব করছি আমি। আর তার কারণে আমি আপনাকে নিজের স্বামী হিসেবে মানতে পারছিনা। আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেলো থামল চাঁদনী। ওর কথা শুনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম শ্রাবণ। কোন উত্তর দিল না। তারপর কিছু না বলেই আচমকা চাঁদনীর একটা হাত ধরে হ্যাচকা টেনে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিল ওকে। শ্রাবণের এমন কান্ডে যেমন ভয় তেমনি অবাক হলো চাঁদনী। ভয়ে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করল ওর। আচমকা এমন একটা কাজ করে বসবে শ্রাবণ সেটা যেন ধারনার বাইরে ছিল তার। চাঁদনী কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই শ্রাবণ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
— কী ভেবেছিলে তুমি আমার কাছে মিথ্যা একটা গল্প বানিয়ে বলবে আর আমি তাতেই তোমাকে ছেড়ে দেবো? আরে ভ্যাম্পায়ার বলে পৃথিবীতে কিছু আছে নাকি? ওগুলো শুধু গল্পে শোভা পায়! এরকম কোন কিছুই হয় না। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার থেকে পালানোর জন্য এসব গল্প বানিয়ে বলছ। আর তাছাড়া এইভাবে কখনো ভালোবাসা হয় নাকি! কাউকে না দেখে না জেনে শুধু চোখ দেখে কখনো কারো প্রেমে পড়া যায় না বুঝলে। তুমি আমার বউ তোমাকে শুধু আমাকেই ভালবাসতে হবে। তবে আজকের মত তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম। আজকে কিছুই করবো না তোমার সাথে। আমার এখন ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমাবো। তবে তোমার আমাকে মেনে নিতে হবে। আর আমাকেই ভালবাসতে হবে। এটা মনে রেখো মিসেস শ্রাবণ চৌধুরী।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে চাঁদনীকে জোর করে ঠোঁটে ও কপালে রুডলি কিস করে ছেড়ে দিল শ্রাবণ। তারপর মুচকি হেসে পাশের বালিশে শুয়ে ঘুমানোর ভান করল। চাঁদনী অবাক হয়ে সেখানে বসে রইলো। ওর সাথে কিছুক্ষণ সময় এর মাঝে কী ঘটে গেল কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না ওর।
বেশ কিছুক্ষণ সেখানেই বসে থেকে চিন্তা করল চাঁদনী যে, ওর এখন কি করা উচিত। কিন্তু কোন কুল কিনারা পেল না সে। তাই সেখান থেকে উঠে গিয়ে কাপড়-চোপড় নিয়ে আরেক রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিল। তারপর সেখানে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ও ঘুমাতেই শ্রাবণ বিছানা ছেড়ে ওঠে ওর পাশে চলে গেল। তারপর ওর সামনে হাটুগেড়ে বসে মনে মনে বলল,
— পাগলি মেয়ে, তুমি কেন বোঝনা! তোমার এই ভয়ার্ত মুখটা আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগে। তোমার দিকে আমাকে আরো হাজার গুণ বেশি আকর্ষিত করে তোমার ওই ভয় পাওয়া মুখটা। আর সে কারণেই তো তোমাকে ভয় দেখাতে এত বেশি আনন্দ বোধ করি আমি। তোমাকে যে কতটা ভালবাসি সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না চাঁদপাখি। সেই ছোটবেলা থেকে তোমার প্রতি এতটা পাগলপারা আমি। তাইতো সব সময় আগলে রাখতাম তোমায়। কিন্তু আজ আফসোস দেখো, তুমি আমাকে ভালোবাসো সেটা আমি জেনেও তোমার থেকে দূরে সরিয়ে আছি পরিচয় গোপন করে। সেটাও তোমারই ভালোর জন্য। এখন যে আমি তোমার কাছে আসতে পারব না। নিজের আসল পরিচয় তোমাকে জানাতে পারবো না। তবে সময় এলে সব কিছু জানতে পারবে তুমি। তোমার কাছে এটা আমার প্রমিস। আর এতদিন আমার অত্যাচার সহ্য করার জন্য প্রস্তুত হও মাই জান।
মনে মনে কথা গুলো ভেবে মুচকি হাসলো শ্রাবণ। তারপর চাঁদনীকে আস্তে করে কোলে তুলে নিল। তারপর সোজা গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। নিজেও পাশে শুয়ে ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মনে মনে বললো,
— আমার চোখে তো ঘুম নেই। কিন্তু তুমি আমার বুকে ঘুমিয়ে থাকো এটা যে কত বড় সুখের, সেটা তোমাকে বোঝাতে পারবো না চাঁদপাখি। আজ থেকে তুমি এভাবে ঘুমাবে সেটা তুমি চাও বা না চাও।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সন্ধ্যায় আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এবার রহস্য খুলবে একটু একটু করে। গল্পটা কেমন হচ্ছে জানাবেন সবাই। ধন্যবাদ