#মেঘভাঙা_রৌদ্র
#পর্ব-২
#লিখা: #Nilufar_Yasmin
কথাগুলো বলার সময় উনার দু-চোখ বেয়ে পানি ঝরে পড়লো। আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে বললাম-
– ইনশাআল্লাহ আমি চেষ্টা করবো, দোয়া করবেন আমাকে-।
আমার কথায় শাশুড়িও উনাকে বললেন-
– চিন্তা করোনা আবিরের বাবা, ও আমাদের না দেখলে কে দেখবে! কারণ, আমরা তো শুধু ওকে ছেলের বউ করে ই আনিনি, মেয়ে করেও এনেছি। মেয়ে কি বাবা মা কে না দেখে পারে, না ফেলে দিতে পারে ?
কথাগুলো বলে উনি আঁচলে চোখ মুছলেন; এবং আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললেন-
বুঝলে মা, আজ তো সবে বিয়ে হয়ে এলে, আগামীকাল বউ ভাতের অনুষ্ঠান সেরে যাক, আমি এই বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিবো। অনেক তো হলো এবার আমার একটু বিশ্রাম চাই।
এই বাড়িতে আসার পর এখনো কারর সাথে সেভাবে কথা হয়নি তবে ইনাদের দুইজনের কথা শুনে বুঝলাম – উনারা সত্যিই ভাল মানুষ। হয়তো ভাগ্য ভাল হলেই এমন শ্বশুর শাশুড়ি পাওয়া যায়। সেই দিক থেকে ভাবতে গেলে আমিও ভাগ্যবতী। অথচ, এই কথা ঠিক- অয়ন হারিয়ে যাওয়ার পর ভাবতেই পারতাম না ও ছাড়া অন্য কারর সংসারে গিয়ে কখনো তাদের সংসারের একজন হয়ে উঠবো! যদিওবা আমি এখনো জানিনা, এই বাড়ির সবাইকে কতটা আপন করতে পারবো।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে শ্বশুর শাশুড়িকে বললেন, মেয়েটার উপর দিয়ে সারাদিন অনেক ধকল গেছে, তুমি বরং ওকে নিয়ে যাও, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করো। তাছাড়া দাওয়াতের মানুষ জন আছে, উনাদেরও যেন আপ্যায়নের কোন ত্রুটি না হয়। আর আবিরকে আমার কাছে একবার পাঠিয়ো, একটু কথা আছে। বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাও মা, পরে আবার এসো। আসলে আমি তো বাইরে যেতে পারিনা, তুমি একবার করে আসলে মা আর বুড়ো ছেলে মিলে চায়ের ফাঁকেফাঁকে একটু করে গল্প করতে পারবো, কি বলো?’
আমি হাসি মুখে আচ্ছা বলে মাথা নাড়লাম। মানুষ অসুস্থ হলে নাকি শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়, উনাকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে। কি সরল স্বীকারোক্তি!
উনার সাথে কথা বলা শেষে শাশুড়ি আমাকে আবারো লিভিং রুমে নিয়ে আসলেন এবং সবার মাঝে বসিয়ে বললেন- ‘এইখানে বসো, এনারা সবাই তোমাকে দেখতে এসেছেন, উনাদের সাথে কথা বলো; আমি একটু ওদিক টাই যাই- দেখি ওইদিকের কতদূর কি হলো।
বলেই উনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন। সবাই বসে গল্প করছে, আমি চুপচাপ বসে শুনছি। এমন সময় আমার পাশের সোফাই একজন মহিলা বসেই আমাকে বললেন-
– আমাকে চিনতে পারছো বৌমা?
– জ্বি- ঠিক বুঝতে পারছিনা। তবে বিয়েতে গিয়েছিলেন তাই দেখেছি।
– হ্যাঁ সেটাই স্বাভাবিক, বিয়ে বাড়ির অত লোকজনের মধ্যে খেয়াল না থাকারই কথা। সেই জন্যই তোমাকে পরিচয় দিতে আসলাম, আসলে আমি তোমার শাশুড়ির ছোট বোন। আমার দুটো ছেলেমেয়ে, মেয়েটা বড়, ওর বিয়ে দিয়েছি। আর ছেলে ছোট, ও দেশের বাইরে। নতুন এসেছো তো, ধীরে ধীরে সবাইকে চিনে যাবে।
উনার কথায় বুঝলাম, উনিই অয়নের আম্মু। আর বুঝে উনাকে সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন- ‘ ঠিক আছে পরে আবার কথা হবে কেমন?
কথাগুলো বলেই উনি চলে গেলেন। চুপচাপ বসে আছি। এই বাড়ির এখনো কিছুই চিনিনা, জানিনা। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে। ফ্রেশ হওয়া দরকার কিন্তু নতুন বউ কাউকে কিছু বলতেও পারছিনা। এদিকে এতসব ভারি ভারি গয়না পরে থাকা কোনকালেই আমার অভ্যেস ছিলোনা, সেখানে সেই সকাল থেকে এইগুলোকে বয়ে বেড়াচ্ছি! বিয়ে করলে না জানি আর কি কি করা লাগে! অদ্ভুত সব ব্যাপার স্যাপার! বসে থাকতেও আর ইচ্ছে করছেনা অথচ বলার উপায় নেই। কাউকে কিছু বললে না জানি আবার কি ভাবে! তারচেয়ে অপেক্ষা করি, আপাতত এ ছাড়া উপায় নেই। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, গাড়ি থেকে নামার পর আবির সেই যে বাসায় ঢুকলো তারপর একবারের জন্যও হলেও ওকে দেখিনি, অদ্ভুত ব্যাপার! বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেই হাওয়া! মনেই হয়না এই বাড়িতে কোন ছেলে আছে, আশ্চর্য!
যাইহোক আমি বসেই আছি, আর আমার পাশে কিছু মহিলা উনাদের নিজেদের মত গল্প গুজবে ব্যস্ত, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে আবার এটা সেটা জিজ্ঞাসা ও করছেন, আমি যতটা সম্ভব উত্তর দিচ্ছি কিন্তু কেন জানিনা, না চাইতেও দেয়ালে টানানো ছবিটার দিকে বারবার চোখ যাচ্ছে! এমন সময় পাশে বসা একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“আমাদের আবির ভাইয়া কিন্তু শুধু ট্যালেন্ট ই না হ্যান্ডসাম ও, তাই হয়তো ভাবি বারবার ওইভাবে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে, তাই কি ভাবি? তো বলি কি ভাবি, এত লুকিয়ে না দেখে একটু পর তো বাসরে দিবো তখন না হয় মন ভরে দেখো?”
বুঝলাম ও আবিরের কথা ভেবেছে। আমি ওর কথায় লজ্জ্যা পেয়ে নিচের দিকে মুখ করে নেই। বুঝতে পারছি মেয়েগুলো অতিবাজ ঠোঁটকাটা, বিশেষ করে এই মেয়েটা। মজা করার নামে মুখে যা আসে বলে দেয়! সম্পর্কে এরা আবিরের বোন ই হবে হয়তো। তাই হয়তো এইভাবে মজা করছে। যদিও মনে মনে অনেকটা বিরক্ত হচ্ছি কারণ এসবে আমি অভ্যস্ত নই। তবে আজকে উপাই নেই, মেনে নিতেই হবে। এমন সময় অন্য একটা মেয়ে ছুটে এসে বললো-
“তোরা সবাই এইখানে! আর ওদিকে বাসর সাজানো প্রায় শেষ। তাড়াতাড়ি দেখবি চল, যা সুন্দর হইছে না! কি বলবো তোদের? শোন একটা কথা, আজকে কিন্তু আবির ভাইয়ার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা খসাবো নইলে ভাবিকে বাসরে যেতে দিবোনা কি বলিস তোরা? ওর কথায় সবাই হৈ হৈ করে উঠলো।
এদিকে ওরা কথাগুলো বলার সময়, অয়নের আম্মু এসে কথাগুলো শুনেই বললেন-
“খবরদার তোরা এসব পাগলামি করতে যাস না, বুবু জানতে পারলে কিন্তু খুব রাগ করবে। আচ্ছা তোরা টাকা চাস তো? পেয়ে যাবি, কিন্তু আবিরের সাথে কোনরকম ঝামেলা করবি না।
কথাগুলো বলতে বলতে উনি আবারো ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
উনার যাওয়ার পর সব কয়টা আমার পাশে বসে আবারো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মাঝে মাঝে আমাকে মজা করে এটা সেটা বলাও বাদ যাচ্ছেনা! ওদের এতসব হাসি তামাশায় আমার কিছুতেই মন বসছেনা, মনে মনে শুধু তখন একটাই কথা ভেবে চলেছি, যাকে প্রতিনিয়ত ভুলতে চাই- ভুলে থাকতে চাই, সেই কেন এইভাবে আমার সামনে আসলো! সত্যি বলতে নিজের কপাল দেখে নিজেই বিষিত আমি! অবশ্য দোষ টা আমার ই, কারণ বিয়েতে আগ্রহ না থাকায় আমিই ছেলে কিংবা ছেলের ফ্যামিলির ব্যাপারে ডিটেইলস কিছু জানতে চাইনি। মাত্র পাঁচ দিনের দেখা শুনায় এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া। আর আমারো আর করার কিছু ছিলোনা, কারণ এই তিন বছর তো আর কম বিয়ের সম্বন্ধ রিজিক্ট করলাম না! যতই ভালো সম্বদ্ধ ই হোক না কেন, ফিরিয়ে দিয়েছি, আম্মু মুখে জোর না করলেও মনে মনে যে বিরক্ত হতেন বেশ বুঝতে পারতাম। আসলে উনাকেও দোষ দেয়া যায়না, আব্বু মারা যাবার পর আমাকে আগলেই বেঁচে আছেন। আর এ-ই কথা তো ঠিক ছেলেমেয়েরা বড় হলে তাদের সুখি দেখাটায় তখন বাবা মায়ের একমাত্র ইচ্ছে হয়ে দাঁড়ায়। আর আমি সেখানে বিয়ে করবো না বলে কিনা গো ধরে বসে আছি! সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেছে। অয়নের ব্যাপারটা কেউ জানেনা, কিন্তু আমার বিয়েতে রাজি না হওয়ার ব্যাপারটাও সবার কাছে আশ্চর্যের। তবুও কেন জানিনা আম্মু কখনো জানার জন্য ফোর্স করেননি, হয়তো বুঝেছিলেন মেয়ে সংগতি কারণেই এমন করছে। ছোট বেলা থেকে আব্বুকে না পাওয়ায় আম্মুই আমার একসাথে আব্বু আম্মুর অভাব পূরণ করেছে, আর এইজন্যই হয়তো আমাকে খানিকটা হলেও বেশিই বুঝে, কখনো কোন সিদ্ধান্ত জোর করে আমার উপরে চাপায় নাই, এইক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছিলো বেশ বুঝেছি। এটাও বুঝতাম, মামা মনে মনে ভাল ছেলে খুঁজছে। হয়তো আম্মুর ও তাতে ইচ্ছে আছে। সেভাবেই গত পাঁচ দিন আগে বিকেলে আমি যখন নিজের রুমে শুয়ে আছি। এমন সময় মামা আর আম্মু এসে হাজির-
– নীলা আসবো?
– হ্যাঁ মামা এসো,
– তুই কি ঘুমাচ্ছিলি?
– নাহ, এমনি একটু শুয়েছিলাম। তা দাঁড়িয়ে কেন?- বসো।
– নাহ তোর অসুবিধা হলে আমরা না হয় পরে আসি।
– কি যে বলো মামা! অসুবিধা হবে কেন, আমিতো ফ্রি ই আছি। আম্মু, তুমিই বা দরজায় দাঁড়িয়ে কেন! ভেতরে এসো। তোমরা কি কিছু বলতে এসেছো?
আমার এই কথায় আম্মু আমার পাশে বসে বললো-
– তার আগে বল রাগ করবি না?
– কি মুশকিল, না শুনলে বুঝবো কিভাবে। আগেতো বলো?
– আসলে তোর মামার অফিসের এক কলিগের ভাগনার জন্য মেয়ে খুঁজছে। তোর মামাকেও বলেছে, তাই তোর মামা এসে বললো আমাকে, বুঝতেই তো পারছিস, বিয়ে উপযুক্ত মেয়ে ঘরে থাকলে অভিভাবকদের চিন্তা হয়, কিন্তু তুই বড় হয়েছিস যেকোন সিদ্ধানের আগে তোর মতামত নেয়াটা জরুরী তাই আগেই জানতে এলাম। তুই চাইলে আমরা কথা আগাতে পারি। না তবে এমন না যে, না দেখেই তোর বিয়ে দিবো। দেখবো শুনবো, সবটা মিলিয়ে হলে আর কি…
আমি চুপচাপ আম্মুর কথা শুনে যাচ্ছি। এমন সময় মামা বললো-
– আসলে কি, ছেলেটাকে দেখেছি কয়েকবার, অসম্ভব ভাল আর ভদ্র ছেলে। আমরা তোর জন্য এমনি ছেলেই খুঁজছিলাম, তাই বলছি কি খারাপ হবেনা, তাছাড়া খান্দানী বংশ, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, ভাল চাকরী করে, দুই ভাইবোন কোন ঝুট ঝামেলা নেই। আমার সব শুনে খুব ভালো লেগেছে। এখন তুই যদি বলিস ছেলের মামা কে আসতে বলবো, আসলে ছেলের বাবার ই খুব তাড়া ছেলের বিয়ের জন্য। ওরা আর্জেন্ট মেয়ে খুঁজছে। এখন আমরা যদি না চাই ওরা অন্যদিকে খুঁজবে। দেখ মা, তোকে সবটাই খুলে বললাম, তোর বাবা নেই, বলেই আমাদের এত চিন্তা। তাছাড়া এবার তো তোর ফাইনাল ইয়ার, তেমন হলে পড়ার ও ক্ষতি হচ্ছেনা কি বলিস?
আমি জানি আমি না বললে এই দুটো মানুষ আমাকে কখনোই জোর করবেনা কিন্তু এ কথাও ঠিক, উনাদের ও বয়স হয়েছে, মেয়ে হিসাবে আমারো উনাদের স্বস্তি দেয়া উচিৎ, আর তাই সবটা ভেবেই বললাম,
– মামা, তোমাদের দু’জনকেই বলছি, আমি জানি তোমরা আমার সুখের জন্য সব করতে পারো, আমার ক্ষতি হয় এমন কিছু কখনো ই তোমরা চাইবেনা, তবুও আজকের রাতটুকু আমাকে ভাববার সময় দাও। আমি কাল সকালেই আমার মতামত জানাবো।
ঠিক আছে বলে, আম্মু আর মামা দুইজনেই চলে গেলো।
সেই রাতে সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। অনেক কথায় মনে পড়ে গেলো। বছর তিনেক আগের কথা, অন্যান্য দিনের মত সেদিনও কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি। দিনটা মেঘলা ছিলো তাই হঠাত করেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এদিকে ছাতাও নিয়ে বের হইনি….
#চলবে….