#ময়ূখ
#পর্ব-১৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৫২.
সকালের মিষ্টি আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে। পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে মুখরিত ধরা। মৌন ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সতেজ, নির্মল হাওয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে তার দেহ। সবুজের সমারোহে অভাবনীয় মায়া। নাম না জানা অজস্র পাখির ডাকে এক অনন্য ভালোলাগা।
‘এই মেয়ে?’
পিছনে ফিরে মৌন। সদ্য ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ায় ফুলে আছে তার চোখ। এলোমেলো চুলে হাওয়া বারি খাচ্ছে। কি যেন এক মায়া এই হলদে সাদা মুখটায়। চোখটায় যেন কি পাওয়ার আকুতি। নিভৃত চোখ সরিয়ে নেয়। মন, মস্তিষ্কের এক বিস্তৃত টানাপোড়নে আছে সে। এ এক গভীর অতল। চোরাবালির নদীটায় পা ডুবিয়ে দিচ্ছে যেন। তবে নিজেকে বাঁচাতে ইচ্ছে করছেনা। দিক্বিদিক হাতড়ে বাঁচতে ইচ্ছে করছেনা। খুব করে ডুবতে ইচ্ছে করছে চোরাবালির অতলে।
নিভৃত একধ্যানে তাকিয়ে থাকে কেবল। মাথা ব্যথা করে তার। মন, মস্তিষ্কের এ কেমন লড়াই! এ কেমন দ্বন্দ্ব! মাথা চেপে ধরে পিছু ফিরে সে শক্ত কন্ঠে বলে,
‘এই মেয়ে জলদি ফ্রেশ হয়ে নাও।’
অতঃপর ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়। একি নিভৃত না কোনো শক্ত খোলস। যার ভিতরটা নরম। শক্তিহীন মানসিক লড়াইয়ে ক্লান্ত নিভৃত। ভিষণ ক্লান্ত।
ব্রেকফাস্টে রুটি, ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই আর কন্টিনেন্টাল স্যুপ। যদিও স্যুপটা বিদঘুটে খেতে। তাই মৌন মুখেও তুলেনি। নিভৃত কপাল কুঁচকে মেয়েটার কার্যকলাপ দেখছে। কন্টিনেন্টাল স্যুপ পছন্দ না!
_______________
ব্রেকফাস্ট করে বাইরে বের হলো তারা। রিসোর্টের বামদিকে বিশাল কৃত্রিম মাটির রাস্তা। আশেপাশে গাছগাছালির অভয়ারণ্য। সবুজে ঘেরা চারিদিক। বাঁশগাছের হিড়িক পড়েছে যেন। চাপালিশ কাঠের কয়েকটা গাছ আপনমনে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বড়ই শান্তি এখানে। হালকা গোলাপি থ্রী-পিস পরনে মেয়েটার মুখের হাসির ঝিলিকে স্তব্ধ হচ্ছে কারো হৃদয়! মৌন পাশে মাইকফুল দেখে দৌড়ে গেলো। নিভৃত অবাক হয়। কখনো একেবারে মেয়েটার ম্যাচুরিটি উতলে উঠে কখনোবা আচরণ হয় শিশুর মতো। এই মেয়েটা এমন দুমুখো কেন? তার আসল রূপ ধরা যে বড্ড কঠিন।
‘এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন মেয়ে? ফুল কি পালিয়ে যাচ্ছে?’
‘আপনার সমস্যা কি?’
‘হাত পা ভেঙে কোলে চড়ার ফন্দি!’
‘আমি দরকার হলে ভাঙা হাত-পা নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আসবো। আপনার কোলে চড়ার চেয়ে তা অনেক ভালো।’
‘তোমার কি মুখে মধু দেয় নাই জন্মের সময়?’
‘আমার মাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন। কল দেই?’
‘স্টুপিড।’
অপরদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে মৌন। নিভৃতকে জ্বালাতে তার বেশ লাগে। খয়েরী রঙের টি-শার্ট আর কালো টাউজার পরিহিত লোকটাকে জ্বালাতে অন্য রকম তৃপ্তি পায় মৌন।
৫৩.
একটা মাইকফুল ছিঁড়ে নিজের কানে গুঁজে মৌন। এটা তার একটা অভ্যাস কিংবা বদভ্যাস। ফুলেরা তো গাছেই সুন্দর। তবে একটু নিয়ম ভাঙলে ক্ষতি কি? পাঁচমিনিট হাঁটার পর নজরে এলো একটা সবুজ রঙা বিস্তীর্ণ নদী। মৌন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিভৃতকে জিজ্ঞেস করলো,
‘এই যে?’
নিভৃতের সেদিকে খেয়াল নেই। নদীর পাশে ঘাসে ছায়া মাঠ। তাতে রাখা চার্জ চালিত এটিবি ছোট ছোট গাড়ি। নিভৃতের বেশ পছন্দ এই গাড়িতে চড়া।
‘এই!’
‘এই মেয়ে চেঁচাচ্ছো কেন তুমি?’
‘এই নদীর নাম কি?’
‘এটা লালাখাল। অনেকে সারি নদীও বলে।’
‘এটা আবার কেমন নাম?’
‘আমি কি জানি যে রাখছে তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।’
‘এসব বাদ। চলুন বোটে চড়ি।’
‘বোট পরে আগে এটিবি গাড়িতে চড়বো আমি।’
‘এটা আবার কি?’
নিভৃত আঙুল উঁচিয়ে দেখলো,
‘ঐযে চতুর্ভুজাকৃতির গাড়ি গুলো দেখছো এগুলো।’
‘আপনি এই বাচ্চাদের গাড়িতে চড়বেন?’
চিন্তিত দেখালো মৌনর মুখ। লোকটা কি তবে সত্যিই পাগল হয়ে গেলো?
‘স্টুপিড। এসবে বড়োরা উঠে।’
‘ওহ্।’
এসব বাচ্চাদের গাড়িতে নাকি বড়োরাও উঠে। কত রং দেখতে হবে দুনিয়ায়! মৌন ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিভৃত বাচ্চাদের মতো দৌড়ে গেলো গাড়ির কাছে। সাড়ে তিনশ টাকা দিয়ে ভাড়া নিয়ে এই মাথা থেকে ঐমাথা ঘুরে বেরিয়েছে। মৌনকেও ধাওয়া করেছিলো তাই মৌন লালা খালের ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা মাথার তাঁর ছিঁড়ে যে পাগল হয়ে গেছে মৌন নিশ্চিত।
গাঁ জ্বালানো হাসি দিয়ে মৌনর কাছে এলো নিভৃত। প্রথমে একদফা হেসে নিলো সে। যদিও মৌন দেখাচ্ছে তার অনেক রাগ লাগছে। তবে এটা ভুল। এমন হাসি দেখার জন্য সে সব কিছু করতে প্রস্তুত। সব।
‘হয়েছে? নাকি আরো দাঁত দেখাবেন?’
‘তুমি এতো ভিতু। আমি তো তোমাকে রণচণ্ডী ভাবতাম।’
‘আপনি একটা বদলোক।’
‘আমি জানি। নতুন কিছু বলুন।’
‘বাহ্, আমার উক্তি আমাকেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে!’
_____________________
লালা খাল কিংবা সারি নদীর ঘাটে বাঁধা সাদা, নীল, লাল মিশেলে বোটগুলো। অপূর্ব সে দৃশ্য। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কেবল। প্রকৃতি এতো মুগ্ধকর কেন। বোটে চড়ে বসলো দুজনে। আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বোটটি। একজন ব্যাক্তি বোটের তত্বাবধানে ব্যস্ত। মৌন হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখে সবুজ রঙা পানি। কি অদ্ভুত! বিশাল বড় নদীর পানির রং সবুজ। একেবারে স্বচ্ছ পানি। দূরে একাপাশে দেখা যায় জয়ন্তপুরের পাহাড়ের চূড়া। অপর পাশে দূরান্তে দেখা মিলে ভারতের পাহাড়ের।
‘এই যে শুনছেন?’
‘কি?’
‘ঐযে দূরের পাহাড়গুলো কি ভারতের?’
‘হ্যাঁ।’
চকচক করে উঠে মৌনের চোখ। কতটা চিত্তাকর্ষক অনুভূতি। চোখের সামনে অন্যদেশের সীমানা। সে তার দেশের সীমানায়। অথচ একটু নদী পেরোলেই অন্য দেশ, অন্য রাজ্য।
শো শো ঠান্ডা বাতাস বইছে। রোদ নেই তেমন। মৌনর ছেঁড়ে রাখা চুলগুলো বারি খাচ্ছে নিভৃতের চোখে। নিভৃত শত চেষ্টা করেও বিরক্ত হতে পারছেনা। মাতাল করা সুভাসে মাতোয়ারা হচ্ছে কেবল! সবুজ রঙের চূড়ার উপর সাদা রঙের মেঘের পাহাড়। সুবিশাল তার দৈর্ঘ্য। তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে কেবল। সাদা, সবুজ, নীলের অসাধারণ খেলা। সময়টা প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছুঁই ছুঁই। বকের দল উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। কখনো লালা খাল থেকে ঠোকরে মুখে তুলে নিচ্ছে নিজেদের আহার্য।
৫৪.
লালাখালের বামপাশে একটা চা-বাগানে নামানো হলো তাদের। সাদা রাজ হাঁসের দল খেলা করছে ঘাটে। বোটের তত্ত্বাবধানে থাকা লোকটি ফোকলা হেসে বললেন,
‘বাবু, আপনার বিবিরে নিয়ে ঘুরে আসেন। অনেক সুন্দর জায়গা।’
‘ধন্যবাদ চাচা।’
মৌনকে নিয়ে নেমে পড়লো নিভৃত। মানুষজন অনেক কম। অনেকটা জনশূন্য দ্বীপ। সবুজে সবুজময় গোটা স্থানটা। কানে ভাসে তক্ষকের ডাক। হাঁটতে হাঁটতে গহীনে প্রবেশ করে তারা। বিকেল হয়ে এসেছে। একটা টিলার মতো জায়গায় সবুজ চা বাগান। ছোটছোট চা-পাতা গুলো যেন একেকটা সবুজ মুক্ত। মৌনর যদিও ভয় লাগছিলো। তবে চা বাগানের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ। এ যেন লালা খালের অপর রূপ। যতদূর চোখ যায় কেবল চা বাগান। থোকায় থোকায় পাতা বিস্তৃত। ঢেউ খেলানো সমুদ্র যেন। প্রকৃতি দেখার ধ্যানে মৌন প্রবেশ করলো গহীন থেকে গহীনে। নিরবতা চারপাশে। হঠাৎ পাশ ফিরে দেখে নিভৃত নেই। মৌন ভয় পেয়ে গুটিয়ে যায় যেন। মাথায় টেনে দেয় তার হালকা গোলাপি উড়না। তক্ষকের ডাক ক্রমশ বেড়েই চলেছে। মৌনের গলা শুকিয়ে কাঠ। চিৎকারও করতে পারছেনা সে। এদিকে কেউটে সাপের ফোণা তুলা আওয়াজ আসছে। বোধহয় ক্রমশ এগিয়ে আসছে তারদিকে। গাঢ় হচ্ছে ডাক। মৌন দৌঁড়ে চিৎকার করে,
‘নিভৃত কোথায় আপনি। নিভৃত।’
ঘুরে ফিরে মনে হয় সে একজায়গাতেই আসছে। মৌন হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কেউটে সাপের হাতে পড়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু । মৌন আবার গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ ভরা চিৎকার করে।
এদিকে দিকবিদিকশুন্য হয়ে মৌনকে খুঁজে যাচ্ছে নিভৃত। কোথায় গেলো মেয়েটা! আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝপাঝপ বৃষ্টি পড়তে পারে যেকোনো সময়। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারপাশে। ঝোপঝারের আড়ালে কোথায় মেয়েটা?
বন্য পোকার দলের ডাক বাড়ছে দ্রুত গতিতে। হাওয়া বইছে। নিভৃত চিৎকার করে। চিৎকার করে ডাকে,
‘মৌন কোথায় তুমি? মৌন!’
কোনো সাড়া নেই। দ্বীপটা খুবই ছোট। তবে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় এবং গাছগাছালি ঠাসা হওয়ায় কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। হাওয়ার তোপে কোনো আওয়াজ আসছেনা কানে। নেটওয়ার্কের কারণে কর্তৃপক্ষের সাথেও কথা বলতে পারছেনা নিভৃত। #ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৯
৫৫.
হঠাৎ পরিচিত কন্ঠে সেদিকে ছুটে গেলো মৌন। ঝড় শুরু হয়েছে। বাতাস বইছে ক্রমশ। বৃষ্টির বেগ বেশি। পিছন থেকে নিভৃতকে ঝাপটে ধরলো মৌন। শরীর তার ঠকঠক করে কাঁপছে।
হঠাৎ মেয়েটার ঝাপটে ধরায় থমকে যায় নিভৃত। অশান্ত বুকটা শান্ত হয় তার। পিছু ফিরে মৌনকে জড়িয়ে ধরে সে। মৌন ফুপিয়ে কাঁদছে। মৌনর চোখের পানি মুছে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে অনেকটা সময়।
‘বাবু, আপনার বিবিরে লয়ে চলেন। আবহাওয়ার অবস্থা ভালোনা।’
বোটের তত্ত্বাবধানে থাকা লোকটার ডাকে মৌনকে ছেড়ে দেয় নিভৃত। লজ্জাও পায় খানিকটা। অতঃপর একপ্রকার যুদ্ধ করে তারা ফিরে আসে লালা খালের ঘাটে। এই লালা খালের সবুজ পানিগুলো বিকেলেও ছিল কতটা শান্ত, নির্মল। অথচ এখন হাওয়ার তোপে তার রূপ ভয়ংকর। লালা খালের ঘাটে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের লোকজন দাঁড়িয়ে। তারা মৌন, নিভৃতকে সাহায্যের জন্যই এসেছিলো। কারণ তাদের রিসোর্টে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল বিকেল পাঁচটায়। আর এখন বাজে আটটা। উদ্ধার কর্মীরা হাওয়ার তোপে এগোতে পারছিলোনা। লালা খালের ভয়ংকরী তান্ডবে ভিত সবাই।
__________________
ভিজে জুবুথুবু হয়ে রিসোর্টে ফিরেছে মৌন, নিভৃত। মৌন যেন একেবারে চুপসে গেছে। তার হাসোজ্জল মুখটা পাণ্ডুর হয়ে আছে। আজ মৃত্যুর অনেকটা কাছ থেকে বেঁচে ফিরেছে সে। নিভৃত পুরোটা সময় আগলে রেখেছিলো মৌনকে। যেন ছেড়ে দিলে পাখি নীড় ছাড়া হয়ে উড়ে যাবে দূর। বহুদূরে।
এতোটা শক্ত ছিল তার হাতের বাঁধন। মৌন কেবল হাতের বন্ধনের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো। এটা কি নিভৃত নাকি অন্যকেউ?
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে দুজনে। খাবারও অর্ডার করে খেয়েছে রুমে এনেই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এই নিস্তব্ধতা যেন বলে দেয় প্রগাঢ়তা। কখনো কখনো স্তব্ধতার ভিতরেও লুকিয়ে থাকে হাজার হাজার কথামালা। নিভৃতের মাথা ব্যথা করছে প্রচন্ড। বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে মাথা চেপে ধরলো সে।
‘কি হয়েছে আপনার?’
কোনো কথা বললোনা নিভৃত। কেবল মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। এই মাথা ব্যথা তার জ্বর আসার পূর্বাভাস। নিভৃত বিষয়টা জানে। রুমে রাখা ফার্স্ট এইড বক্স হাতড়ে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লো সে।
৫৬.
মৌন নিভৃতের কাজ দেখছে। বারবার প্রশ্ন করছে। নিভৃত তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে উপেক্ষা। অবহেলার অপমানে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে মৌন। চোখের কোণা বেয়ে জলগুলো গড়িয়ে পড়ে তার। এমন করছে কেন নিভৃত?
মাঝামাঝি রাতে মৌনকে জড়িয়ে ধরে নিভৃত। মৌন যদিও রাগ করে ছিলো তবে নিভৃতের কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারে প্রচুর জ্বর। ঘাবড়ে যায় মৌন। নিভৃত আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। বিড়বিড় করে,
‘আমার তোমাকে চাই। যেকোনো মূল্যে চাই।’
‘কাকে চাই?’
‘তোমাকে। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা।’
মৌন ভাবে হয়তো রুহানির কথা বলছে। তবে একটু কি গভীর চিন্তা করতে পারতোনা মৌন? নিভৃত যে কারো নাম উল্লেখ করেনি!
জ্বরের ঘোরে নিভৃত দ্বিতীয়বার চায় মৌনকে। মৌনও নিজেকে সঁপে দেয়। এই লোকটার ডাকে সে সাড়া দিতে বাধ্য। আজকের ভালোবাসায় অন্যরকম ছোঁয়া ছিল। মৌনর মনে হলো এটা শুধু তার ভাগের ভালোবাসা। এখানে রুহানির ভাগের ভালোবাসা নেই।
________________
সকালের আবহাওয়াটা অসম্ভব সুন্দর। গতরাতে ঝড় বৃষ্টির ফলে ধরণী হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ। ভেজা মাটির স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ হাওয়া। পরিষ্কার আকাশে মেঘেদের দল ছুটাছুটি করছে। মৌন ভিজা চুলগুলো ছেড়ে আকাশে মেঘেদের খেলা দেখছে। কখনো তারা ছুটছে আবার কখনো স্থির হয়ে থাকছে। কি স্বাধীন, মুক্ত তাদের জীবন! সকালে নিভৃতের কপালে হাত দিয়ে দেখেছিলো মৌন জ্বর অনেকটাই কমে গেছে।
‘এই মেয়ে?’
নিভৃতের ডাকে মৌন সামনে তাকিয়েই বললো,
‘হুম।’
‘আই এম সরি। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিও। আসলে কি থেকে কি হয়ে গেলো। কালরাতের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’
তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় মৌন। সে হয়তো জানতো এমন কিছুই হবে। নিভৃত আর নিভৃতের ভালোবাসা উভয়েই গভীর কুহক। তাদের মায়াজাল বুঝা বড্ড দায়। কখনো মনে হয় মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসছে। কখনোবা মনে হয় ভাবনা ভুল। মৌন মনে মনে বলে,
‘আমি আপনাকে কবে বুঝতে পারবো নিভৃত? এমন কিছু করবেন না যেন আমি আপনার ভালোবাসা বুঝা সত্ত্বেও আপনাকে দূরে ছেড়ে চলে যাই। আপনিও জ্বলবেন আর আমিও জ্বলবো নিভৃত।’
মুখে বলে,
‘আপনি মানেন আর না মানেন আমি আপনার স্ত্রী। তিন কবুল পড়েই আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার উপর আপনার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এভাবে বলে দয়াকরে আমাকে ছোট করবেন না।’
নিভৃত আমতা আমতা করে কথা খুঁজে পায়না। তার নিজের জালে সে নিজেই জড়িয়ে। কি করছে, কি ভাবছে, কি বলছে সে জানেনা। দ্বিধাদ্বন্ধের সাগরে পড়ে আছে সে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। রুহানির সাথে কি সে অন্যায় করে ফেললো?
_________________
ব্রেকফাস্টে রুটি, চিকেন চাইনিজ সিজলিং আর ক্যাশনাট স্যালাড খেয়েছে দুজনে। আগামীকাল ফিরে যাওয়ার কথা। আজই এখানে শেষদিন।
‘চলো ঘুরে আসি। যাবে? নাকি এখনো ভয় লাগছে?’
নিভৃতের নরম গলায় মৌন থমকে যায়। এতটা রূপ দেখালে মৌন কিভাবে আসল রূপ বুঝবে।
‘আমি ভয় পাইনা।’
‘তাই! তা কে যেন কালকে আমাকে ঝাপটে ধরে ছিচঁকাদুনেদের মতো নাকের পানি আর চোখের পানি এক করেছে? এই মেয়ে সত্যি করে বলোতো আমার প্রিয় খয়েরী টি-শার্টে তুমি নাক মুছোনি তো!’
‘দেখুন! একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমি মোটেও নাক মুছিনি।’
৫৭.
নিভৃত পাশে তাকিয়ে হাসে। রাগলে মেয়েটার নাকটা লাল হয়ে যায় কেন!
‘তুমি একটা টমেটো!’
‘কি! এটা আবার কেমন কথা!’
‘টমেটো বললাম ভালোলাগে নাই? আচ্ছা যাও তুমি একটা বোম্বাই মরিচ। খুশি?’
মৌন দাঁত কিড়িমিড়িয়ে তাকিয়ে আছে। এই লোকটা তো আচ্ছা বদ!
কতক্ষণ রিসোর্টটা ঘুরে দেখলো তারা। রিসোর্টের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে। চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। রিসোর্টটা খুবই সুন্দর, পরিপাটি।
অতঃপর নিভৃতের সাথে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মৌন। মুখটা কিঞ্চিৎ ফুলানো। এই তো দশমিনিট আগে,
‘এই মেয়ে!’
‘কি?’
‘তোমাকে লাল,কালো ড্রেসে পুরো মুরগীর মতো লাগছে। ঐ যে থাকেনা দেশি মুরগীগুলো। সারাদিন গলা ছেড়ে ডেকে বেড়ায় যে ঠিক ঐরকম।’
‘আর আপনাকে? আপনাকে পুরো এনাকন্ডার মতো লাগছে।’
‘স্টুপিড!’
মৌনর মনটা খারাপ। এতো সুন্দর লাল, কালো মিশেলে থ্রি-পিস পরেছে, সেজেছে আর তাকে নাকি মুরগীর মতো লাগছে! তাঁর ছিঁড়া কোথাকার!
গ্যারেজ থেকে টয়োটা গাড়িটা বের করলো নিভৃত। দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে বসেছে সে। মৌন বাইরে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এই মেয়ে গাড়িতে উঠবে নাকি রেখেই চলে যাবো?’
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘জাফলং যাবো। দেখি ডাউকি নদীতে চুবিয়ে তোমাকে মুরগি থেকে মানুষ করা যায় কিনা।’
বলেই গা জ্বালানো হাসি দিলো নিভৃত। মৌন রেগে গলা উঁচিয়ে বললো,
‘দেখুন। আপনি কিন্তু বেশি বেশি করছেন। যাবোনা আমি আপনার সাথে।’
‘না গেলে কি করা আমি একলাই ঘুরে আসি।’
গাড়ি নিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে নিভৃত। মৌন হা করে তাকিয়ে আছে। এ কার পাল্লায় পড়লো সে। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি থামালো নিভৃত। দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,
‘কেউ চাইলে আসতে পারে।’
মৌন দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে। হাঁপিয়ে গেছে বেচারি। এদিকে নিভৃত মিটিমিটি হাসছে।
‘আপনি একটা অসহ্যকর লোক।’
‘আমি জানি। নতুন কিছু বলুন।’
মৌন হা করে তাকিয়ে থাকে। এমন অদ্ভুত লোক সে জীবনে দুটো দেখেনি। গাড়ি চলছে সাই সাই করে। পাশে সারি নদী। নির্মল বাতাসে ছন্দে ছন্দে মাতোয়ারা হচ্ছে দুটো মন।
(চলবে)…….
চলবে…….