#যে_জীবন_ফানুসের
#অন্তিম_পর্বঃ৮
#রেহানা_পুতুল
তাতে আবিদ ও বিরক্ত হলো বেশ। জানালার পর্দা ফাঁক করে রিমা, হিমা,ও সায়না আমাদেরকে দেখছে। ভিতর থেকে জানালা বন্ধ করতে আবিদের মনে ছিলোনা আজ। এই কয়দিন এই কাজটা আবিদ নিজ দায়িত্বে করতো।
অতি আবেগের মুহুর্তে মানুষ এলোমেলো যায়। আবিদের ক্ষেত্রেও তাই হলো।
ওরা বলল,দরজা খোল জরুরী দরকার আছে।
আবিদ উঠে গিয়ে দরজা খুলল৷ ওরা হুড়মুড় করে ভিতরে এলো।
আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যে রিমা বলল,
তোদের বাসর অফ। আবার বিয়ে করতে হবে। তারপর সব। কারণ আগের বিয়ে ছিলো একটা চুক্তি বা শর্তের বিয়ে। তখন নিয়ত ছিলো আবিদ ভাইয়ের এমন, আমি একে তিনমাস পর ছেড়ে দিব। আর এখন নিয়ত করবে সারাজীবন একসাথে রহিবো মোরা। আমি আম্মুর সাথে কথা বলার সময় সব বলছি। তখন আম্মু বলল,এখন আবার নতুন করে বিয়ে পড়ানো হলে এটা একদম সহী হবে।
আবিদ রাগে মাথার চুল টানতে থাকে। বলে একথা মা ও আমাকে বলছে। আমি কান দেয়নি বিষয়টাতে।
আবিদের কথা শুনে আমার ও হুঁশ হলো। আমার মা ও এটা বলছে। বিয়েটা আবার পড়িয়ে নিলেই উত্তম। আর কেউ দুকথাও বলতে পারবেনা।
আবিদ বেশ চিন্তিত হয়ে গেলো। আমি উঠে যাচ্ছি শাড়ি চেঞ্জ করতে। আবিদ থামিয়ে দিলো। বলল বিয়ে হবে এই রাতেই। যত দেরিই হোক না কেন। আমি ব্যবস্থা করতেছি।
সে বের হয়ে গেলো। আধঘন্টা পরে কোথা থেকে কাজী সাহেবসহ সে ফিরে এলো। মিষ্টি ও নিয়ে এলো। তার সাথে আরো দুজন লোক ছিলো। এরা তার পক্ষের সাক্ষী হবে।
বন্ধুরা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বলল যাক আমাদের পরিশ্রম বৃথা যাবেনা। এবারের বিয়ে ফাইনাল বিয়ে।
ভিডিও কনফারেন্স এ যোগ দিলো আমার মা, বাবা,চাচী,আবিদের মা,বাবা,আরো দু চারজন নারী পুরুষ।
ছবি তোলা হলো। ভিডিও করা হলো।
ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী আবিদ আমাকে আবার বিয়ে করলো। কাজী সাহেবকে তার সম্মানী দেওয়া হলো। তারা মিষ্টিমুখ করে চলে গেলো। রিমা সবাইকে মিস্টি বিতরণ করলো। নিজেও টপাটপ করে দু চারটা সাবাড় করে ফেললো। ক্লাসে ওকে আমরা মিঠাইরানী বলে মজা লুটতাম। ওরা চলে গেলো আনন্দ নিয়ে।
আবিদ বলছে ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। জানালা দরজা ভালো করে বন্ধ হলো। নয়তো তোমার নিলজ্জ বন্ধুরা আবার উঁকি দিয়ে দেখবে আর তুমি ওমাগো বলে চিল্লানি দিবে।
মনে মনে বলছি এবার আর রক্ষা নেই। বুকের ধুকপুকানি আগের মতই শুরু
হলো।
_________
নিশুতি রাত। নিস্তব্ধ পৃথিবী। সমস্ত দিনের লেনালেনা চুকিয়ে সবাই ঘুমের ঘোরে বিভোর। হয়তো কেউ কেউ জেগে আছে আমাদের মতোই। কেউ জেগে আছে হর্ষে- বিষাদে। কেউ জেগে আছে বিরহ- বেদনায়। কেউ জেগে আছে একরাশ হতাশায়। কেউ জেগে আছে জীবনের অনটনে। কেউ জেগে আছে বুক ভরা সুখে। কেউ জেগে আছে রোগ যন্ত্রণায়। আমি জেগে আছি অনাগত ভবিষ্যতের আকুল ভাবনায়। আবিদ জেগে আছে হৃদয়ে ঝাঁপি ঝাঁপি রোমাঞ্চ নিয়ে।
আমার কল্পনায় ছেদ পড়লো আবিদের হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায়। একটি শক্ত হাত চেপে ধরেছে একটি কোমল হাত আমরণ সঙ্গী হয়ে পথ চলার অঢেল বিশ্বাস আর ভালোবাসায়। আমার হাত টেনে একটি আঙ্গুলে আবিদ সোনার একটি আংটি পরিয়ে দিলো। মুগ্ধতায় আমার নয়ন ভরে গেলো।
আমার চিবুক উঁচিয়ে কপালে নরম চুমু খেলো। আমি গোপনে কেঁপে উঠলাম। বুকে আসো বলে জড়িয়ে ধরলো। অসীম ভালোলাগায় বুকের ভিতর তোলপাড় হচ্ছে আমার।
জিজ্ঞেস করলো তোমার বুক কাঁপছে কেন ঝুমুর? নারভাস লাগছে? নাকি উচ্ছ্বাসে?
আমি কিছুই বলতে পারলামনা। আবিদ আরো নিবিড়ভাবে আমাকে আকঁড়ে ধরলো। ঠিক যেমন করে মা তার ছোট্ট শিশুটিকে বুকে আগলে রাখে পরম মমতায়।
____
পরেরদিন আমরা দুজন গোসল সেরে নাস্তা করে তৈরি হয়ে নিলাম সব গুছিয়ে। ওরাও রেডি হয়ে আমাদের রুমে চলে এলো। নানা গল্প গুজবে কখন যে ঢাকায় এসে গেলাম টের ও পাইনি। ওরা তিনজন ওদের বাসায় চলে গেলো। আবিদ আর আমি তালা খুলে আগের সেই বাসায় ঢুকলাম।
আবিদ আমাকে বাসায় রেখে অফিসে চলে গেলো। এ ভিতরে আমি বাসার সব কাজ সেরে একটু চাল ডাল ফুটিয়ে নিলাম। অবসর হয়ে মা, বাবার সাথে কথা বললাম। এতদিন বাবার ব্যস্ততায় জন্য কথা হয়ে উঠেনি। ভাই রাসেলের সাথে ভিডিও কলে অনেক কথা বললাম। আবিদকে বোনের বর হিসেবে পেয়ে ও পুলকিত।
______
মেঘে মেঘে বেলা গড়ালো। দিন ফুরিয়ে মাস এলো। মাস ফুরিয়ে মাস। আমাদের সংসার জীবনের চারমাস হতে চলল। ফয়সালকে যে মনে পড়েনা তা কিন্তু নয়। আকাশে হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই মাঝে মাঝে ফয়সালের সান্নিধ্যে কাটানো সুখের মুহুর্তগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দেয় মনের চিলেকোঠার। তখন এলোমেলো হয়ে যাই৷ আমার অনুভূতিগুলো গুমরে কাঁদে। জীবনের যা কিছু প্রথম তা ভোলা কি এতই সহজ। শত্রুকেওতো কখনো সখনো মনে পড়ে ঘৃণার সাথে। আর ফয়সালতো কোন এক সময় ছিলো আমার আনন্দে থাকার বড় অবলম্বন।
ফয়সালের পাওয়া পাঁচ লক্ষ টাকা রাসেল ও আব্বা ম্যানেজ করেছে। আব্বা তাদের বাড়ি গিয়ে ফয়সালের বাবার হাতে দিয়ে আসলো। যদিও আবিদ দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি একদম তা হতে দেইনি।
এইকয়দিন আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। প্রায় বমি হয়। আবিদ আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চেকাপ করালো। জানতে পারলাম মা হতে চলেছি। আবিদের বাঁধভাঙা খুশিতে আমার চোখের কোণ আদ্র হয়ে উঠলো। মা শুনে বাড়ি চলে যেতে বলল। আবিদ আমাকে নিয়ে গ্রামে তাদের বাড়ি গেলো। তার পরিবারের সবাই আমাকে আপন করে বুকে টেনে নিলো। সেখানে দুদিন থেকে আবিদসহ আমাদের বাড়ি গেলাম। পরে সে ঢাকায় চলে গেলো। আমি তাদের বাড়ি চলে গেলাম বারবার শাশুড়ী মায়ের ফোনকল পেয়ে।
শাশুড়ী মা আমার পছন্দের খাবার তৈরি করে খাওয়ান। আবিদের ছোট বোন অর্থাৎ আমার ননদ আরিশা আমার জন্য রোজ দুপুরে কিছু না কিছু টক ভর্তা বানিয়ে নিয়ে আসে। আমার শ্বশুর মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসার সময় পাঞ্জাবীর পকেটে করে এটা সেটা নিয়ে আসে খাওয়ার জন্য।
আমি নুইয়ে যাই লাজুকলতার মতো ওনাদের এত মায়া মমতায়।
ননদ আরিশা আমার হাত ধরে বলে ভাবী এমন চেপে চেপে থাকো কেন? তুমি কি কোন ভুল করছ নাকি? তোমার ননদ শিলার ত কাছেই যেতে পারতামনা। তার নাকি প্রাইভেসির ব্যাঘাত ঘটে। কোন প্রাইভেসির ব্যাঘাত ঘটে,তাতো দেখলামই।
ওর কথার লেজ টেনে শাশুড়ী মা বলে, বৌমা তুমি আমাদের সাথে যেভাবে মিশে থাক। শিলাতো তার ধারেকাছেও ছিলনা। আর তোমাকে আমি আগেও বৌমা বলতাম। এখনো বলছি। তফাৎ হলো আগে ছিলে দুরের বৌমা আর এখন হলে আমার নিজের বৌমা। এই বলে উনি প্রাণখোলা হাসি দিলেন।
উনার হাসি দেখে আমার ভিতরে এক দরিয়া প্রশান্তি দোল খেতে লাগলো।
এদিকে উনার কথার রেশ ধরে শ্বশুর আব্বা এসে বললেন, সুখশান্তি,বিয়ে শাদি,জন্মমৃত্যু সব উপরওয়ালার হাতে।
নইলে ঝুমুরকে পছন্দ করে বিয়ে করা ফয়সাল আচম্ভিত এমন উগ্র মেজাজের হয়ে গেলো কেন? কেনই বা ছেড়ে দিলো এত ভালোমনের একটা মেয়েকে। কেনই বা ফয়সাল বাইক এক্সিডেন্ট করলো। মরেও গেলো। কেন আবার ফিরে পেতে চেয়ে আবিদের সাথে বিয়ে দিলো। সে ছুতোয় তার বোন টাও পালিয়ে গেলো। সবি মালিকের ইশারামাত্র। এসবের উপরে আমাদের শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম,মা আপনার ছেলে বলছে আমাকে আবার ঢাকা নিয়ে যাবে। আমি আপনাদের ছেড়ে যাবনা। শহরে খালি রুমে দম বন্ধ হয়ে আসে। শিলা এসে আমার গাল টেনে ধরে,সে দায়িত্ব তুমি বাবার উপর ছেড়ে দাও সুইটহার্ট। সবাই একসাথে হেসে উঠলাম।
____
জগতে মানুষে মানুষে কত ব্যবধান। তা আবার ও উপলব্ধি করতে পেরে আমি স্তম্ভিত হলাম। একদল নতুন মানুষের সাথে অফুরন্ত ভালোলাগায় সময়গুলো অতিবাহিত হচ্ছে। দিনে দিনে শরীরটাও ভারী হয়ে যাচ্ছে। দুই মায়েরি একান্ত ইচ্ছেয় সাত মাসের ‘ সাধ ‘ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। দু পক্ষের বিপুল লোকজন এলো। বহু উপহার সামগ্রী পেলাম। গতরাতে আবিদ ও এলো ঢাকা থেকে।
আয়োজন শেষে বিছানায় যেতে যেতে নিশিরাত হয়ে গেলো। আবিদ আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। আমি ভাবনার অতলে হারিয়ে যাচ্ছি। আমার ফানুসের জীবন এসে যেখানে ঠেকলো। সেখানে ভালো আছি। বেশ আছি। আগে ফয়সালদের সংসারের সব কাজ একা নিজ হাতে সামলাতাম। তবুও তার মা বোনের কাছে আমার অবস্থান ছিলো অচল পয়সার মতো। আর আবিদের সংসারে আমি তেমন কোন কাজ করিওনা। তবু্ও তাদের সবার কাছে আমি লক্ষীবধু আর মিষ্টিমেয়ে।
অনেকের মুখেই শুনতাম মেয়েদের প্রথম বিয়ে যেকোন কারণে ভেঙ্গে গেলে বা প্রথম স্বামী মারা গেলে দ্বিতীয় বিয়ে তার জীবনে সুখকর হয়না।
আমার এখন একথা বিস্বাসই হচ্ছেনা। আসলে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বলে কোন কথা নেই। কে কখন কিভাবে কার সাথে ভালো থাকবে, সুখে থাকবে এটা সবচেয়ে বেশী নির্ভর করে মেন্টালিটির উপরে। ব্যাস আর কিছুই লাগেনা। তখন নুন পান্তা খেয়েও একজীবন নিশ্চিন্তে পার করা যায়। মেন্টালিটি সত্তর পার্সেন্ট মিলে গেলেই এনাফ। কারণ শতভাগ তাবৎ দুনিয়ার কোন দাম্পত্য সঙ্গীরই মিলেনা।
প্রতিটি মানুষ আলাদা। তার চিন্তাভাবনা,চাওয়া-পাওয়া,হিসেব-নিকেশ আলাদা। তাই না মেলাটাই স্বাভাবিক।
______
গা জ্বলা গরম পড়েছে। ঘরভর্তি অতিথি। তাই জানালা খোলা রয়েছে আমাদের রুমের। আবিদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রাতের মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় জানালার পর্দা সরে সরে যাচ্ছে। জানালা গলিয়ে চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে আমাদের বিছানার উপরে। এ যেন জোছনার হাট বসেছে। আবিদ আমার পেটের উপর মোলায়েম করে হাত রাখলো। বলল ও হলো তোমার আমার সুখের সোনালী ফসল।
আমি চাপা হাসি হাসলাম। আবিদ বলল দেখো আমাদের সুখে অবাধ জোছনারাও বাঁধ ভেঙ্গেছে আমাদের কোলে। আমি মনে মনে বললাম ফানুসের জীবন ও বুঝিবা এত ঝলমলে হয়।
ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। দুজনের হাত ভিজে চুপসে গেলো।
ও বলল,চলো উঠানে গিয়ে রাজসিক বারিধারায় ভিজি আজ।
#সমাপ্ত