#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।
বাইরে মানুষের হৈ চৈ এ মেহুলের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তাকিয়ে সে তার বর্তমান অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল। চট করেই তখন তার মস্তিষ্ক বলল, ” আরে মেহুল, তুই তো রাবীরের কাঁধেই মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিস। আর কত ঘুমাবি, এবার উঠ।”
মেহুল তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে। রাবীর হালকা গলা ঝেড়ে বলে,
‘ঘুম হয়েছে?’
মেহুল বিব্রত বোধ করে। অস্বস্তি নিয়ে বলে,
‘আমি কি সারারাত এভাবেই ঘুমিয়েছি?’
‘জি।’
মেহুল আরো বেশি লজ্জা পায়। আশেপাশে কত মানুষ। সবাই নিশ্চয়ই তাদের দেখেছে। সে এবার আড়চোখে রাবীরের দিকে তাকায়। লোকটা এখনো মাস্ক পরে আছে। যাক তাহলে, কেউ অন্তত রাবীরকে আর চিনতে পারেনি। রাবীর বলল,
‘যান, ভেতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।’
________
ডাক্তার সব চেকআপ করে বললেন,
‘উনাকে এখন নিয়ে যেতে পারেন। আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ আছেন। তবে খুব যত্নের মাঝে রাখবেন। খাবার আর ঔষধটা ঠিক টাইমে দিবেন।’
‘ঠিক আছে, ডাক্তার।’
রামিনা বেগম মেহুলের দিকে চেয়ে কিছু একটা ইশারা দিলেন। মেহুল চোখের ইশারায় বুঝাল, সে সবকিছু সামলে নিবে।
রাবীর মেহুলের বাবাকে নিয়ে গাড়িতে বসাল। রামিনা বেগমও গাড়িতে বসলেন। মেহুল আসেনি তখনও। রাবীর মেহুলকে খুঁজতে ভেতরে যায়। মেহুলকে সে দেখতে পায় রিসিপশনের সামনে। রাবীরও সেখানে যায়। রাবীরকে দেখে মেহুল জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি সব টাকা দিয়ে দিয়েছেন কেন? আমরাই তো দিতাম।’
‘হ্যাঁ, দিতেন। তবে উনি তো আমারও বাবা। আর বাবার জন্য এইটুকু করা ছেলের দায়িত্ব। বুঝতে পেরেছেন?’
মেহুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘জি।’
________
মেহুল ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে রাবীর শুয়ে আছে। মেহুল ভেবেছে, রাবীর হয়তো ঘুমে। সে আস্তে আস্তে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। ড্রেসিং টেবিলটা বিছানার পাশেই। কিছুক্ষণ বাদেই রাবীর উঠে বসে। বলে,
‘আমি তো এমনিতেই গোসল করতাম। অযথা আপনার চুলের পানি দিয়ে গোসল করানোর কী দরকার, মেহুল?’
মেহুল চমকে পেছনে চেয়ে দেখে রাবীরের চোখ মুখ ভিজে আছে। সে এই মুহুর্তে হাসবে না অনুতপ্ত হবে বুঝতে পারছে না। তাও ঠোঁট চেপে হাসে সে। মৃদু সুরে বলে,
‘ভালো হয়েছে না, আপনাকে আর এখন কষ্ট করে গোসল করতে হবে না।’
রাবীর উঠে দাঁড়ায়। মেহুলের পেছনে এসে কাছাকাছি দাঁড়ায় সে। মেহুল ঢোক গিলে। আয়নার মধ্যে রাবীরের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে আছে। রাবীরের অমন দৃষ্টি দেখে মেহুলের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কিছু বলতেও পারছে না। রাবীর মেহুলের কানের কাছে মুখ নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,
‘গোসলের পর আপনাকে এত মোহনীয় কেন লাগে বলুন তো?’
মেহুল বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ। মস্তিষ্কের নিউরন সব জমে গিয়েছে। রাবীরের দিকেও চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে। হৃদকম্পন যেন বাড়ছে। রাবীর একটু সরে আসে। কিছুক্ষণ মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘কী হলো, এমন স্তব্ধ হয়ে গেলেন কেন?’
মেহুল পেছন ফিরে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘আপনার কি আজকে আর কোনো কাজ নেই? এখনো এখানে বসে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে, খেয়ে দেয়ে আপনার কাজে যান। অযথা আমাকে বিরক্ত করবেন না।’
রাবীর হাসে। বলে,
‘এই সামন্য কথাতেই কেউ এত লজ্জা পায়? এসব মিথ্যে রাগ দেখালে লজ্জা কমে না, মেহুল। লজ্জা ঢাকতে মুখ লুকাতে হয়। আর আপনার এই লজ্জামাখা মুখ লুকানোর জন্য আমার বক্ষ সর্বদা প্রশস্ত।’
মেহুল চোখ মুখ খিঁচে বলে,
‘আপনি কিন্তু আজকাল খুব বেশি কথা বলছেন। আমার কিন্তু এবার রাগ হচ্ছে বলে রাখলাম। আর আমি এখন রাগলে কিন্তু আপনার সাথে একদম কথা বলা বন্ধ করে দিব।’
রাবীর তার কথার বিপরীতে কেবল মৃদু হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়। রাবীর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেহুল বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। আর মনে মনে বলে, “লোকটা কী মারাত্মক!”
________
রাবীর চলে গিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। মেহুল রুমে এসে বিছানায় বসতেই তার টেবিলের দিকে চোখ যায়। হলুদ রঙের কাগজটা চোখে পড়ে তার। মনে পড়ে কাগজটার কথা। ইশ, এটাতো রাবীরকে দেখানোই হলো না। তার একটা বিশাল সুযোগ হাতছাড়া হলো। এই কাগজটা দেখিয়ে সে রাবীরের অনেক মজা নিতে পারতো। ধুর, তখন একবারও কেন যে মনে পড়ল না।
সন্ধ্যা সাতটা,
রাবীরের অফিসে বেশ কয়জন সাংবাদিক এসেছেন। তারা ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছেন। রাবীর তখনও অফিসে আসেনি। তার অফিসে আসতে আসতে আরো পনেরো মিনিট সময় লাগে। অফিসে এসেই সাংবাদিকদের দেখে ভ্রু কুঁচকে রাবীর পি এ’র দিকে চায়। পি এ নিচু স্বরে বলে,
‘স্যার, উনারা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান।’
‘এখন আবার কী ব্যাপারে কথা বলতে চান।’
‘জানি না, স্যার।’
‘ঠিক আছে। উনাদের ভেতরে পাঠিয়ে দিন।’
রাবীর তার কেবিনে বসার পর পরই একে একে সব সাংবাদিক তার কেবিনে প্রবেশ করেন। তারপর একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন,
‘জনাব রাবীর খান, অনেক তো হলো রাজনৈতিক প্রশ্ন; আজ আমরা আপনাকে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।’
রাবীর বলল,
‘যদি তাই হয়, তবে আমি বলব, আমি এই ব্যাপারে একদমই আগ্রহী না। আমি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে মিডিয়ার সামনে কোনো কথা বলতে চাই না।’
সাংবাদিক হেসে বললেন,
‘কিন্তু, রাবীর সাহেব, আপনাকে যে আজকে কথা বলতেই হবে। এটা আমাদের দাবি না, এটা আমাদের দর্শকদের দাবি। বিশেষ করে আমাদের মেয়ে দর্শকদের। আপনার বিয়ের খবর শোনার পর থেকে তো চারদিকে একটা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। মেয়েরা তো সব অস্থির হয়ে উঠেছে। এই ব্যাপারে আপনি কী বলতে চান?’
রাবীর নিশ্বাস নিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
‘দেখুন, আমার বিয়ে নিয়ে আমি যথেষ্ঠ খুশী। আর দর্শকরা বা আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও নিশ্চয়ই এতে খুব খুশী হয়েছেন। বিয়ে পবিত্র জিনিস, এখানে কারোর কষ্ট পাওয়ার মতো তো কিছু হয়নি।’
‘কিন্তু, ঐ যে আপনার কিছু মেয়ে ক্রাশরা আছেন যারা আবার এই ব্যাপারে খুব দুঃখ প্রকাশ করছেন। সঙ্গে আবার তারা আপনার ওয়াইফকে দেখার জন্যও খুব উতলা হয়ে উঠেছেন। তা, আমরা কবে সেই কাঙ্খিত ব্যক্তির দেখা পাবো, মি. খান।’
‘সময় এলে সব কিছুই হবে। তাই আগে থেকেই কিছু বলা যাচ্ছে না।’
সাংবাদিক তখন বললেন,
‘তাহলে কি আমরা ধরে নিব, এত সহজেই মিসেস খানের দেখা কেউ পাবে না?’
‘বললাম তো, সময় এলেই সবকিছু হবে। এখন সেই নির্দিষ্ট সময়টা ঠিক কখন, সেটা আমিও জানি না।’
সাংবাদিকরা আর প্রশ্ন না করে নিজেদের মতো করে একটা রিপোর্ট বানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।
তারা চলে যেতেই রাবীর যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। আসলেই, একটু পরিচিত মুখ হলেই যত জ্বালা। তার চেয়ে সাধারণ মানুষই ভালো, কাউকে আর এত জবাবদিহি করতে হয় না।
________
‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার। স্যার, আমাদের রাবীর খানের সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু, উনি উনার ওয়াইফ সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেননি। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে, এখনই হয়তো উনি উনার ওয়াইফকে নিয়ে মিডিয়ার সামনে আসবেন না।’
সাদরাজ হাসে। বলে,
‘বউ সুন্দরী হলে ছেলেদের এই দশা’ই হয়। সুন্দরী বউ তো, তাই ভয় পায় আরকি। যদি মিডিয়ার সামনে আনার পর, কেউ আবার তার বউয়ের উপর নজর দিয়ে ফেলে! কিন্তু, বেচারা রাবীর খান তো আর জানে না; শকুনের নজর যে তার পাখির উপর অলরেডি পড়ে গিয়েছে। এখন এই শকুনের কাছ থেকে সে তার পাখিকে কী করে বাঁচাবে, হু?’
কথাটা বলেই বেশ শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করে সাদরাজ। মনে মনে এই সবকিছুর পরিকল্পনা করে যেন এক পৈশাচিক আনন্দ পায় সে।
চলবে…