সাপলুডুর সমাপ্তিতে পর্ব ১৫ ও শেষ

#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম
#সাপলুডুর_সমাপ্তিতে
তন্বী ইসলাম

১৪

সামনে তাকানো মাত্রই যাকে দেখতে পেলাম তাকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো, মাথায় যেনো বাজ পরলো বিশালাকারের। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

আমার মুখ থেকে আকস্মিক আর্তনাদের স্বরে বেরিয়ে এলো
“আপনি?
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, তার দৃষ্টিও আমার দিকে নিক্ষেপ করা। বাকিরা অবাক হয়ে দেখছে আমাকে। এর মধ্যে একজন বলে উঠলো
“তোমরা কি আগে থেকেই দুজন দুজনকে চেনো?
উনার কথার ফিরে তাকালাম আমি। নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক হলাম। মাথা নাড়িয়ে বললাম
“নাহ।
উনি আবারও বলে উঠলো
“তাহলে ওকে দেখে এভাবে চমকে উঠলে যে?
আমি আরেকবার সেই লোকটার দিকে তাকালাম।।এর পর চোখ ফিরিয়ে শান্ত গলায় বললাম
“হঠাৎ করে একজন পরিচিত লোকের মিল পাচ্ছিলাম তার সাথে।
“ওহ!

আরো কিছু কথা হবার পর আমাকে নিয়ে আসা হলো রুমে। ফ্যানের নিচে বসেও সারা শরীর প্রচন্ড পরিমাণে ঘামছে আমার, চোখমুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। গলা শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে আমার। পাশেই কিছুটা দুরে একটা টেবিলে পানির জগ আর গ্লাস রাখা আছে৷ আমি কোনো মতে হাতড়ে হাতড়ে সেখানে গেলাম। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে গ্লাসটা হাতে নিতে যাবো, তখনই আচমকা আমার হাত থেকে গ্লাসটা পরে গেলো নিচে। গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে দৌড়ে এলেন আমার মা আর ভাই। আমাকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। মা আমাকে এসে ধরে ফেললেন। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললেন
“কি হয়েছে তোর? এমন করছিস যে!

আমি মায়ের দিকে তাকালাম। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম
“আমি ঠিক আছি মা। হাত ফসকে পরে গেছে গ্লাসটা।
“ওহ, তাই বল। আমি তো ভয় পেয়েই গেছিলাম।
আমাকে সুস্থ দেখে ভাইয়া আবার চলে গেলো বাইরে মেহমানদের কাছে। প্রায় অনেক্ষন যাবৎ কথা হলো উনাদের সাথে আমার বাবা আর ভাইয়ের। কিছুটা সময় পর উনারা ডিসাইড করে পাত্রের সাথে আমাকে আলাদা ভাবে কথা বলাবে। আমার মা এসে বলতেই আমি না করে দেই। মা আমাকে বার বার বুঝায়। অবশেষে ভাইয়া আসে, সে আমার না শুনে সামান্য রাগারাগি করে। এক পর্যায়ে মা আমাকে বুঝায় বাবার মুখের দিকে চেয়ে যেনো পাত্রের সাথে কথা বলি। বাবা নাকি বেশ বড় গলায় উনাদের দেখা করার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।

আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, যে আমার মনে সেই প্রথম ভালোবাসা জাগিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো, তার সাথে বিয়ে, আলাদা করে কথা.. কিভাবে সম্ভব? আর সে এলোই বা কি করে এখানে? ঠিকানা পেলো কোথায়? মনের মধ্যে কথাগুলো বার বার বাজতে লাগলো। আর এর উত্তর গুলো জানতে হলে তার সাথে আলাদা করে কথা বলতেই হবে। আমি রাজি হলাম। আমার রাজি দেখে মা খুশি, ভাইয়াও খুশি। সে বাইরে চলে গেলো আমার রাজি হওয়ার ব্যাপারটা জানাতে।

খাটের কোনায় শক্ত মুখ নিয়ে বসে আছি আমি। আমার ঠিক সামনেই বসে আছে ফায়াজ। বার বার নড়াচড়া করছে সে, হয়তো কি বলবে না বলবে সেটাই মনে মনে ভাবছে। আমি নড়ছি না, কিছু বলছিও না। আগে শুনতে চাই তার কথা, জানতে চাই সে কি বলতে চায়।

খানিক্ষন বাদে সে করুণ স্বরে আমায় ডাকলো
“তনু..
আমি চোখে তুলে তাকালাম তার দিকে। দেখলাম সে চোখে অজস্র আকুলতা। আমি নিরবে আবারও চোখ নামিয়ে নিলাম। সে আবারও বললো
“আমায় এখনো মাফ করতে পারোনি তনু? আমি যা করেছি, তা অন্যায় করেছিলাম সেটা আমিও মানি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এটা করতে চাই নি। আমি চাই নি, আমার বেকার জীবনে তোমাকে জড়াতে।
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম
“আমার বাড়ির ঠিকানা পেলেন কোথায়?
সে কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো
“আমি আসাতে তুমি খুশি হও নি?
আমি আগের ন্যায় শক্ত গলায় বললাম
“এ বাড়ির ঠিকানা পেলেন কোথায়?
সে মলিন গলায় বললো
“তোমার ফোন নাম্বার ট্র‍্যাক করেছি।

আমি সবাক হলাম। বললাম
“আমার সিম তো খোলা!!
“তাতে কি? সিম অফ থাকলেও ট্র‍্যাক করা যায়।
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। সে বললো
“তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশিই সুন্দর হয়ে গেছো তনু।
আমি হাসলাম। বললাম
“যে মেয়েটা তার দুই বছরের মেয়ের মৃত লাশ পানিতে ভেসে থাকতে দেখেছে। যে মেয়েটা তার সন্তান হারানোর সাথে সাথেই ডিভোর্সি হয়েছে। দিনের পর দিন দুঃখে কষ্টে থেকে না খেয়ে থেকে চোখের নিচে কালি পড়েছে, তাকে ঠিক কোন এঙ্গেল থেকে আপনার কাছে সুন্দর লাগছে?

দেখলাম, ফায়াজ গভীর চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার এমন তাকানোতে আমি ইতস্তত বোধ করলাম। অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিলাম। সে হেসে বললো
“যেখানে ভালোবাসা আছে, সৌন্দর্য সেখানে ধরা দিবেই। আমি তোমায় ভালোবাসি তনু, ভালোবাসার মানুষটা সবসময় সুন্দরই হয়ে থাকে।
“ফালতু ভালোবাসার দোহাই আমার সামনে দিবেন না। এ ভালোবাসা বার বার আমায় ঠকিয়েছে।
“আর একবার বিশ্বাস করো। ঠকবে না প্রমিস।
আমি তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললাম
“বিশ্বাস শব্দটাকেই তো এখন আর আমি বিশ্বাস করি না।

সে নিরাশ গলায় বললো
“আমি সত্যিই তোমায় অনেক ভালোবাসি তনু।
“আমি বাসিনা। আপনারা যে কারণে এসেছেন, সেটা কখনোই হবে না। বাড়ি চলে যান, আর এই ভালোবাসার নাম মন থেকে মুছে ফেলুন।
“মুছা সম্ভব নয়।
“চেষ্টা করলেই সম্ভব।
এবারে আমাকে অবাক করে দিয়ে সে হাসলো। বললো
“তুমি যতই আমাকে মানা করো না কেন, বিয়ে আমি তোমাকেই করবো। বেশিদিন নয়, এই কিছুদিনের মধ্যেই। সবকিছুর ফাইনাল আজই হবে।

আমি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালাম তার দিকে। সে মুচকি হেসে উঠে চলে গেলো আমার সামনে দিয়ে। আমি ডিপ্রেশনে পরে গেলাম, কি হবে না হবে ভাবতে থাকলাম। বাবার পছন্দের অন্য কোনো ছেলে হলেও আমি বিয়ে করতে রাজি হতাম, কিন্তু যে আমার সাথে এর আগেও বেইমানি করেছে, তাকে দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করি কি করে? এইসব ভাবতে ভাবতে হাত পা অবস হয়ে আসছে আমার, চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।

রাতে মায়ের সাথে একদফা হয়ে গেলো আমার। পাত্র মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে। একে তো দেখতে শুনতে অনেক ভালো, তার উপর সরকারি চাকরি, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডটাও ভালো। পছন্দ না হয়ে উপায় আছে। বাবা আর ভাইয়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে। তবে তারা এই মুহূর্তে বাড়ি নেই। বিয়ে নাকি ঠিক হয়ে গেছে, দুদিন বাদেই তারা আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে যাক জমক হীন ভাবে। ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সাড়তে চায় তারা। তবে টুকটাক বাজার তো লাগবেই। সে জন্য মেহমান বিদায় করেই তারা বাজারে চলে গেছে কেনাকাটার জন্য। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, এতটা তারাহুড়ো করবেন তারা। এতো তাড়া কিসের সেটাও বুঝছি না।

মা তো কিছুতেই এ পাত্র হাতছাড়া করবেন না। সে আমি যাই বলি, বেশ রাগারাগি হলো আমার মায়ের সাথে। আমার রাগকে উপেক্ষা করে মা নিজের কাজে ব্যস্ত। শুধুমাত্র বাবার মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হয়েছি, তার মানে এই নয় যে তারা যাকে বলবে তাকেই আমার বিয়ে করতে হবে। আমি মা’কে বুঝাতে অক্ষম। আমি চিন্তায় পরে গেলাম, কি করবো না করবো বুঝতে পারছিলাম না। অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা ঘুরে পরে গেলাম।

মা আবারও আমাকে নিয়ে টেনশনে পরে গেলো। বিছানায় শুইয়ে মাথায় পানি ঢেলে যাচ্ছে একভাবে। বাবাকে ফোন দিয়ে ডাক্তার আনার জন্যও বলা হয়ে গেছে। খানিক বাদে বাবা একজন হাতুড়ে ডাক্তারকে সাথে করে বাড়ি নিয়ে আসে। উনি উনার যন্ত্রপাতি দিয়ে আমাকে চেকাপ করতে থাকে। চেকাপ করা শেষ হলে মা উদগ্রীব হয়ে উনাকে জিজ্ঞাসা করে
“আমার মেয়েটার কি হয়েছে ভাই’সাহেব? একটু কিছু হলেই ওর মাথা ঘুরে, শরীর খারাপ করে। এর কারণ কি?

আমার বাবাও প্রশ্ন করে একই কথা জিজ্ঞাসা করে। আমি তখন সম্পুর্ণ সজ্ঞানে আছে। সকল কথাবার্তাই আমার কানে স্পষ্ট।
ডাক্টার সাহেব জড়তা ছাড়াই আমার বাবা মাকে বললেন
“দেখুন, চেকাপ করে যা বুঝলাম.. মেয়ের শরীরের কন্ডিশন খুবই খারাপ। ওর ব্রেইনের উপর দিয়ে অনেক চাপ যাচ্ছে। অতিরিক্ত চাপে যেকোনো সময় একটা খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।

উনার কথা শুনে মা আঁতকে উঠল। আতংকিত গলায় বললো
“খারাপ কিছু মানে?
“এই ধরুন স্ট্রোক করার সম্ভাবনা টাই বেশি।
মা আতংকিত চোখে আমার দিকে তাকালো। উনার চোখের কোনে পানি। বাবার কপালেও চিন্তার ভাজ। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর গলায় বাবা প্রশ্ন করলেন
“এখন উপায়?
“উপায় একটাই, মেয়েকে মানসিক ভাবে চাপ দেওয়া যাবে, চিন্তা মুক্ত রাখতে হবে। আর স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়াতে হবে।

বাবাকে দেখলাম আমার দিকে একবার তাকালো। আমিও তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। মা সামান্য আর্তনাদ করে বলে উঠলো
“আমার মেয়েটারেই কেন আল্লাহ এতো খারাপ খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে?
বাবা সামান্য ধমকের গলায় মাকে বললো
“আহ থামো তো তুমি। এমন কিছুই হবে না।
“আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি, এমন কিছু যেনো না হয়।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আমি বিছানায় উঠে বসি। মা আমাকে নিষেধ করে বসার জন্য। আমি মায়ের কথায় গুরুত্ব দেই না। ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে এসে বাবা দেখে আমি বসে আছি। আমাকে বসে থাকতে দেখে বাবা এগিয়ে আসেন আমার কাছে। আমার ঠিক পাশেই বসে বাবা। আদুরে গলায় বলেন
“মা রে, আমি কি তোরে বেশিই চাপের মধ্যে ফেলে দিছি?
সত্যিই আমি চাপের মধ্যে আছি। কিন্তু বাবার এমন আদুরে প্রশ্নের বিপক্ষে কি করে এমন শক্ত কথা বলবো আমি? এতে বাবা হয়তো নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী ম মনে করবেন। আমি মাথা নাড়িয়ে জানান দিলাম
“না।

বাবা হাসলো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো
“পুরোনো চিন্তাভাবনা সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল মা। দেখলি তো ডাক্তার কি বলে গেলো। আগের চিন্তাগুলো মনে করে করে নিজেকে আর কষ্ট দিস না মা। মনের মধ্যে জিদ চাপ, যার জন্য তুই কষ্ট পাচ্ছিস, সে তো দিব্বি সুখে সংসার করছে। তবে তুই কেন সেসব ভেবে কষ্ট পাবি?
বাবার কথায় আমি হাসলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। মনে মনে বুঝতে পারলাম ঠিকই যে বাবার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এই অবুঝ মনটাকে তো আর বুঝাতে পারি না।।

সেদিন রাতে আর কোনো সমস্যা হয় নি আমার। সকালে শুনলাম ছোট ভাই শিহাব ফিরছে বাড়িতে। আগামীকাল আমার বিয়ে, হয়তো তাই। আমি চুপচাপ বসে রইলাম নিজের ঘরে। মা মায়ের মতো করে কাজ করছে। বাবা আর ভাইয়া দুইজনই খুব ব্যস্ত। কিছু কাজের লোক রাখা হয়ছে বাড়িটাকে সুন্দর করে পরিষ্কার করার জন্য। বিয়ে বলে কথা। আশপাশটাকে সুন্দর দেখাতে হবে তো। খানিক বাদে হাতে একটা ফোন নিয়ে মা এলো রুমে। ভাবলাম হয়তো কারো নাম্বার বের করে দিতে হবে। তবে আমি ভুল ছিলাম

মা ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে বললো
“ফোনটা তোর কাছেই রাখ তনু।
“কেন? আমার কাছে আমার নিজের ফোনই তো আছে মা।
মা হেসে বললো
“তোর নাম্বার তো আর জামাইবাবাজি জানে না।
আমি ভ্রু বাকিয়ে বললাম
“জামাইবাবাজি কে?
“ফায়াজ। ফোন দিবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।

আমার রাগ হলো। সবাই এর মধ্যে পেয়েছেটা কি? শুধুমাত্র সরকারি চাকরি করে আর অবিবাহিত হয়েও আমার মতো বিবাহিত এক বাচ্চার মাকে বিয়ে করছে তাই?

মা চলে গেলে কিছুক্ষণ বাদে ফোন এলো ঠিকই, কিন্তু আমি ধরলাম না। ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেলে রাখলাম। খানিক বাদে দেখি শিহাবও চলে এসেছে।। ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে সে আগে আমার কাছে এসেছে। তার চোখমুখে চিন্তা স্পষ্ট। সে অন্য কোনো কথা না বলে আগে আমায় প্রশ্ন করলো
“এ বিয়েতে তোর মত আছে তো?
আমি হেসে বললাম
“মাত্র বাড়ি ফিরলি, এইসব কথা তো পরেও বলা যাবে।
সে খানিকক্ষণ নিরব থেকে বললো
“বাবা আর ভাইয়া তোকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে তাইনা?
” কাউকে কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করা যায় শিহাব?
“তার মানে তোর ইচ্ছে আছে? তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তবে তোকে যদি জোর করে বিয়ে করাতে চাইতো..
“তাহলে কি করতি তুই?
আমি আগ্রহভরে তাকিয়ে রইলাম শিহাবের দিকে। শিহাব এক নজরে আমাকে দেখলো। এরপর চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো
“প্রতিবাদ করতাম, বিয়েটা ভেঙ্গে দিতাম। এটা যদি না পারতাম তবে তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম।

চলবে…..
১৫
[অন্তিম পর্ব]

শিহাব এক নজরে আমাকে দেখলো। এরপর চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো
“প্রতিবাদ করতাম, বিয়েটা ভেঙ্গে দিতাম। এটা যদি না পারতাম তবে তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম।

শিহাবের কথায় আমি হাসলাম। সে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালো। বললো
“হাসার মতো কি এমন বললাম আমি?
“আমাকে নিয়ে এতটা দূর অব্দি ভেবেছিস সেটা ভেবেই হাসলাম। সে যাইহোক, এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছিস, হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে।।
শিহাব চলেই যাচ্ছিলো, এমন সময় তার চোখ গেলো সাইলেন্ট করে রাখা ফোনটার উপর। ফায়াজ এখনো কল করেই যাচ্ছে। শিহাব ভ্রু বাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। বললো
“কে ফোন করছে?
আমি একবার ফোনের দিকে তাকালাম। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম
“যার সাথে আমার বিয়ে হবে।

শিহাব এবারে বসে পরলো আমার পাশে। মৃদু গলায় বললো
“এবারে আমি ঠিক বুঝতে পারছি।
“কি! বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“তোর যে এ বিয়েতে মত নেই সেটাই বুঝলাম।
আমি কিছু বললাম না। ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। শিহাব আমার হাতে হাত রেখে নরম গলায় বললো
“তুই তো আমাকে বিশ্বাস করিস বল..
“হঠাৎ এ কথা কেন বলছিস?
“আমি বেশ বুঝতে পারছি এ বিয়েতে তোর মত নেই। কিন্তু ঠিক কি কারণে মত নেই এটা আমাকে বলবি? বিশ্বাস কর, আর যাইহোক.. এ শিহাব তোর মনের বিরুদ্ধে কিছু হতে দিবে না।

আমি আবারও হাসলাম। ফোনটার দিকে আবারও একবার দৃষ্টিপাত করে শিহাবের দিকে চোখ ফেরালাম। ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি টেনে বললাম
“সাপলুডু খেলেছিস কখনো?
“অনেক। কিন্তু এই কথা কেন বলছিস?
দেখলাম শিহাব আমার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে। আমি আবারও বলতে লাগলাম
“সাপলুডুর ছক বেয়ে তুই যতই উপরে উঠতে যাস না কেন ভাই, নানা রকম সাপ তোকে কামড়ে কামড়ে নিচের দিকে টেনে হিচড়ে নামাবেই। তুই একটা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলেও, তোকে নিচে নামানোর জন্য অনেক সাপ সামনে অপেক্ষায় থাকবে। আমার জীবনটাও এমন রে। যতই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠি না কেন, আবারও নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমাকে টেনে হিচড়ে নিচে নামিয়ে দেয়।

যখনই সুখের সিড়ির দেখা পায়, সেটা বেয়ে উপরে যাই.. দুঃখ নামের সাপগুলো আমাকে ছিড়ে ছিড়ে খায়।
আমার চোখের কোনে পানি। শিহাব ওর হাতের উল্টোপিঠে আমার চোখ মুছে দেয়। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে শিহাবকে প্রশ্ন করি
“আচ্ছা বল তো শিহাব.. আমার জীবনটা নাহয় সাপলুডুর ছক বেয়েই যাচ্ছি, কিন্তু আমার শেষটা কি হবে? সাপলুডুর শেষটা সবার জন্য খুশির হয় না। কেউ একশ পাড়ি দিয়ে জয়লাভ করে, আবার কেউ নিরানব্বই এর কোঠাতেই সাপের মুখে পতিত হয়ে শেষ হয়ে যায়। আমার কোনটা হবে শিহাব?

শিহাব আমাকে শান্তনা দিয়ে বললো
“এমনটা কেন ভাবছিস আপা? দেখে নিস তোর এমন কিছুই হবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সামনে তোর জন্য ভালো কিছুই রেখে দিয়েছেন। আর তুই যদি মনে করিস এ বিয়েতে তুই সুখী হবি না, তাহলে এখনো সময় আছ, আমাকে শুধু একবার বল।
আমি হাসলাম আবারো, বললাম
“দ্বিতীয় বার বাবার মাথাটা কাটতে চাই না রে।

সারাদিন অনেক ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছে আমার বাবা আর দুই ভাই। মা ও অনেক ব্যস্ত। যেহেতু ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হবে, সে কারণে তেমন কোনো আত্মীয় আসবে না। শুধু মাত্র খুব কাছের কয়েকজন ছাড়া। যারা আসার তারা বিকেল দিকে আসতে শুরু করেছে। কয়েক জন এসেও গেছে। আমি আমার রুমে বসে আছি চুপচাপ। আত্মীয়রা কিছুক্ষণ পর পর আমাকে এসে দেখে যাচ্ছে। কয়েকজন আবার মিনমিনে গলায় আমাকে আগের কথা মনে করিয়ে পরোক্ষভাবে কটু কথাও বলছে। আমি গায়ে মাখছি না সেসব। সন্ধ্যের পর মা এসে সামান্য রাগান্বিত গলায় আমাকে বললো
“ছেলেটা সারাটাদিন ধরে ফোন করেই যাচ্ছে। একবার কথা বললে ক্ষতিটা কি শুনি? কালকের পর থেকে তো ওরই বউ হয়ে বাঁচতে হবে তোকে।

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বললাম
“আরেকবার কল করলে দিয়ে যেও।
মা আমার খুশি হলো। সে হাসিমুখে ফোনটা আবারও আমার সামনে রেখে বললো
“কিছুক্ষণের মধ্যে বোধহয় কল করবে। সুন্দর করে কথা বলিস।
আমি মাথা নাড়ালাম।
মা চলে যাবার কিছুক্ষণ পরই আবারও সে কল করলো। আমি রিসিভ করে সালাম দিলাম। তিনি সুন্দর ভাবেই উত্তর দিলেন। মিষ্টি গলায় বললেন
“সারাটা দিন কল ধরো নি কেন?
“ইচ্ছে করেনি।
“তবে এবার ধরলে যে?
“মা বললো তাই।

“আমার প্রতি এতো অভিমান?
আমি সামান্যই হেসে বললাম
“অভিমান তো কাছের মানুষের প্রতি হয়। আপনার প্রতি আমার কোনো অভিমান নেই।
বুঝলাম আমার কথায় তিনি কষ্ট পেলেন। তিনি শ্রান্ত গলায় বললেন
“আমি কি তোমার কাছের কেউ নয়?
“হয়তো না।

কয়েক সেকেন্ড আবারও দুইজন নিরব রইলাম। উনি প্রশ্ন করলেন
“তুমি কি অসুস্থ তনু?
“মোটেও না।
“তাহলে তোমার কন্ঠস্বর এমন শোনাচ্ছে যে?
“কেমন?
“ভারী ভারী লাগছে।
“তাহলে রেখে দিন, বুঝতেই তো পারছেন কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
“এতো রাগ! ঠিক আছে, কালকের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি হাসলাম। প্রত্যুত্তরে কিছু বললাম না।
উনি ফোন রেখে দিলেন, আমিও ফোনটা খাটের পাশে থাকা টেবিলটাই রাখলাম। উনি মিথ্যে কিছু বলেন নি, সত্যিই আমি অসুস্থ বোধ করছি।

রাতে মায়ের জোরাজুরিতে সামান্যই মুখে তুললাম। ইচ্ছে করছিলো না কিছু খেতে। কিন্তু মা না খাইয়ে ছাড়বেন না। মায়ের মন রাখতে তাই সামান্য খাওয়া। পানির জগ আর একটা মগ আমার রুমে রেখে মা চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন যেনো তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পরি আর কিছু লাগলে যেনো মাকে ডাকি। আমি মাথা নাড়িয়ে মাকে সায় জানালাম।
বরাবর ফেইসবুক না চালালেও আমার ফোনে ফেইসবুক একাউন্ট খোলা ছিলো। শখের বসে খুলেছিলাম কিছুদিন আগেই। কখনোই তেমন এক্টিভ থাকা হয় নি। আজ হঠাৎ ইচ্ছে করলো কিছুটা সময় ফেইসবুকিং করার জন্য।

আমি আইডিটা লগ ইন করে আইডিতে ঢুকলাম। কিছুটা সময় ফেইসবুকিং করার সময় মনে হলো মৃদুলের কথা। ভাবলাম একবার ওর আইডিটা সার্চ করে দেখে আসি। কালকের পর থেকে তো অন্য কারো বউ হয়ে যাবো, চাইলেই আর দেখতে পারবো না। হয়তো মন থেকে মুছতে পারবো না, তবে ভুলে থাকার নাটকটা তো করতে হবে। তার আইডিটা সার্চ দেওয়ার সাথে সাথেই সামনে চলে এলো। আমি অতি আগ্রহে চটপট তার প্রোফাইলে গিয়ে ঢুকলাম।

প্রোফাইল পিকচারে অনেক সুন্দর একটা ছবি দেওয়া৷ দামী ব্র‍্যান্ডের একটা বাইকে বসে ছবিটা তুলা হয়েছে। তবে বাইকটা তো আগে ছিলো না! মনকে বুঝ দিলাম, হয়তো নতুন শশুড়বাড়ি থেকে পেয়েছে। আমি খুটে খুটে পিকটা বার বার দেখলাম।
এরপর স্ক্রল করে একটু নিচে আসতেই বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। নতুন বউ এর সাথে বেশ সুন্দর করে একটা পিক ছাড়া হয়েছে দুদিন আগেই।

ক্যাপশনে লিখা, ‘আমি অতীত নয়, বর্তমানে বিশ্বাসী। বুদ্ধিমান লোক কখনোই অতীতকে মনে রেখে কষ্ট পায় না, বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে সামনে এগিয়ে যায়। আর এভাবে এগিয়ে যাওয়াটাই বেটার। আমি নিজেকে বুদ্ধিমান দাবী করি না, তবে আমি বর্তমানেই খুশি’

হাত থেকে ফোনটা পরে গেলো আমার, দুচোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পরলো। এক অজান ডিপ্রেশনে তলিয়ে গেলাম আমি। মাথায় নানা ধরনের উদ্ভব চিন্তা কাজ করছে, নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছেনা। কেন জানি হঠাৎ করেই গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো আমার। মাথাটা ঘুরছে প্রচন্ডভাবে। চোখেও ঝাপসা দেখছি আমি। আমি টেবিলটার কাছে উঠে গিয়ে জগটা হাতে নিতে চাইলাম, তবে প্রচন্ড পরিমাণে হাত আর সারা শরীর কাঁপুনিতে হাত থেকে জগটা ফসকে গিয়ে নিচে পরে গেলো।

বিয়ের বাড়ির আমেজে সারা বাড়ি মেতে উঠেছে। সবাই যে যার মত কাজ করছে। বাচ্চারা হাতে মেহেদি দিচ্ছে, আনন্দ করছে। শিহাব বাড়ির এদিক ওদিকটা বেশ ভালো মতোই পর্যবেক্ষণ করছে। যেহেতু আয়োজন খুবই অল্প, তাই ছোটখাটো একটা প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে বাড়ির দক্ষিণ দিকটায়। ওদিকে বেশ আলো বাতাস আছে। বাবা সেদিকটার দেখাশোনা করছে। ভাইয়া আছে বাবুর্চিদের কাছে। শিহাব এদিক ওদিক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো, এরপর হঠাৎ কি মনে হল তার, সে চলে এলো রান্নাঘরে মায়ের কাছে। মাকে প্রশ্ন করলো
“মা, আপা কোথায়?
“ও তো উঠেনি এখনো। রান্নাঘরের কাজ সামলাতে সামলাতে উত্তর দিলো মা।
শিহাব অবাক হয়ে বললো
“অন্য দিন তো বেশ তাড়াতাড়িই উঠে পরে, আজ ওর বিয়ে তাহলে আজই কেন এতো দেরি করছে?.

“হয়তো মন খারাপ তাই শুয়ে আছে।
শিহাব চিন্তিত গলাতেই বললো
“হয়তো।
এরমাঝে মা আবারও বলে উঠলো
“তনুকে একটু ডেকে দে তো বাপ। এখন তো শুয়ে থাকলে হবে না। কত নিয়ম কানুন পরে আছে, সেগুলি এবার সেড়ে ফেলতে হবে।
শিহাব মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে রুমের কাছে চলে এলো। রুমটা ভেতর থেকে লাগানো। শিহাব দরজায় কড়া নাড়লো, কয়েক বার কড়া নাড়ার পরেও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। সে এবারে ডাকতে লাগলো
“আপা, আপা… আপা..
বার বার ডাকার পরেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। শিহাব এবারে অনেক জোরে জোরে কড়া নাড়ছে আর সমানে ডেকে যাচ্ছে৷ ফল শূন্য। ওর ডাকাডাকির শব্দে এবারে বাবা আর ভাইয়া এসেও হাজির হলো এখানে। ভাইয়া অবাক হয়ে বললো
“কি হয়েছ?

আতংকিত গলায় শিহাব বললো
“অনেক্ষন ধরে ডেকে যাচ্ছি আপাকে, দরজা খুলছে না।
ভাইয়া সামান্য রেগে গিয়ে বললো
“আজ বিয়ের দিনে এটা আবার কোন ধরনের নাটক শুরু করেছে ও?
শিহাব ভাইয়ার বিপরীতে চটে গিয়ে বললো
“নাটক করার হলে ও আগেই নাটক করতে পারতো ভাইয়া।
বাবা তাড়া দিয়ে বলে উঠলেন
“এই তোরা কথা কাটাকাটি পরে কর, আগে দরজা ভাঙ।

ততক্ষণে মাও চলে এসেছে এখানে, গুটিকয়েক আত্মীয় এসে জড়ো হয়েছে। মায়ের চোখেমুখে আতংক, কপালে চিন্তার ছাপ।।
অনেক চেষ্টার পর দরজা ভাংগা হলো। হুমড়ি খেয়ে ভিতরে ঢুকলো সকলেই। কিন্তু যা দেখলো তা দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। মা চিৎকার করে বলে উঠলেন
“তনু রে… মা রে আমার। এ তোর কি হলো?
সকলের চোখেমুখে আতংক। তনুর নিথর দেহটা মাটিতে পরে আছে। পাশেই ভাংগা জগ, পানিতে ভিজে আছে সারা শরীর। শিহাব তনুর গায়ে স্পর্শ করে দেখলো গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে। চিৎকার করে সে বলে উঠলো
“তারাতাড়ি আপারে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো।

শীঘ্রই বাড়ির পাশের একটা সিএনজি ওয়ালাকে ডেকে আনা হলো, মায়ের আর্তনাদ আর আত্মীয়স্বজনের হাহাকারে পুরো বাড়িতে দুঃখের ছায়া নেমে এসেছে। শিহাব, ভাইয়া আর বাবা মিলে তনুকে নিয়ে যাওয়া হলো হসপিটালে। হসপিটালে নেওয়া মাত্রই ইমার্জেন্সিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। পেছনের গাড়িতে মা’সহ কিছু আত্মীয়স্বজনেরাও আসছে। কিছুক্ষণ যাবৎ চেকাপ করার পরেই একজন ডক্টর বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে মা’সহ বাকিরাও চলে এসেছে।
ডাক্তার আসামাত্রই উনাকে ঘিরে ধরা হয়েছে। বাবা আতংকিত গলায় বললেন
“আমার মেয়ের কি অবস্থা ডাক্তার সাহেব?
উত্তর দেওয়ার আগেই শিহাব বলে উঠলো
“কি হলো, কিছু বলছেন না যে। আমার বোনটা এখন কেমন আছে? কি হয়েছে ওর?

“উনি আর বেঁচে নেই।

ডাক্তারের একটা ছোট্র উত্তরেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশটা। সবাই হতভম্বের মতো তাকালো ডাক্তারের দিকে। হঠাৎ মায়ের আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠলো হসপিটালটা। কেঁপে উঠলো বাকি সকলেই। বাবা থপ করে বসে পরলো হাসপাতালের ফ্লোরে। ভাইয়ার অবস্থাও খারাপ। শিহাব অবিশ্বাসের সাথে চিৎকার করে বলে উঠলো
“মানে কি এইসবের? কি বলছেন আপনার কোনো ধারণা আছে? এতগুলো মানুষের সামনে কি করে এমন মিথ্যা কথা বলতে পারেন আপনি?
ডাক্তার সাহেব শিহাবকে সামলে বললো
“দেখুন, আমরা ডাক্তাররা রোগীকে বাচাতে চেষ্টা করি, মারা যেতে নয়। আর মৃত্যু নিয়ে আমরা মজা করি না। উনি মারা গেছেন গতকাল রাতেই। আর আজ আপনারা আসছেন উনার ডেথবডি নিয়ে? সারাটা রাত কি করছিলেন আপনারা?

সবাই আবারও চমকালো। মা আবারও আর্তনাদ করে বললো
“আমার মেয়েটা গতরাতেও ঠিক ছিলো, আমি নিজে দেখে আসছিলাম।।
“হয়তো আপনি আসার পরেই সে স্ট্রোক করেছে।
বাবা বিস্ময়ে বলে উঠলো
“স্ট্রোক!!
“হুম, আপনার মেয়ে ব্রেইন স্ট্রোক করেছে গতরাতে। হয়তো প্রচন্ড ডিপ্রেশনে ছিলো, টেনশন করতো বোধহয় প্রচুর।

কিছুটা সময় সবাই নিস্তব্ধ, শুধু চিৎকার করে যাচ্ছে মা। ডাক্তার বললেন
“আমাদের কিছু ফর্মালিটি আছে, সেগুলো কমপ্লিট করে আপনারা লাশ নিয়ে চলে যেতে পারবেন।

তনুকে দাফন করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। জানাজায় ছিলো ফায়াজ সহ তার সাথে আসা পুরো বর‍যাত্রী। ফায়াজের চোখেও পানি, প্রচন্ড যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে তার বুকটাও। কিন্তু দেখাতে পারছেনা কাউকে। শিহাবকে দেখা গেলো কবরের পাশে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে। বাবাকে আগলে ধরে রেখেছে কিছু আত্মীয়। মায়ের আহাজারিতে ভেসে যাচ্ছে পুরো গ্রাম। ভাইয়া গিয়ে হাত রাখলো শিহাবের পিঠে। শিহাব কেঁপে উঠলো। আর্তনাদ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরলো ভাইয়াকে। ভাইয়া নিজেও ভেঙ্গে পরেছে। তবে সবাইকে সামলানোর দায়িত্বে সে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। শিহাব দৌড়ে এলো মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরে বললো
“সাপলুডুর সমাপ্তিটা খুব খারাপ হলো মা, শেষে এসেও আমার আপাটা রেহাই পেলো না। খেয়ে নিলো মৃত্যু নামের সাপটা।

মা গম্ভীর, নিস্তব্ধ, শিহাবের মাথায় হাত রেখে শক্ত গলায় বললো
“কাঁদিস না বাপ, তনু ওর মেয়ের কাছে গেছে। মেয়ের ডাকে, সাড়া নিয়ে পারলোনা আমার মেয়েটা।

____[সমাপ্ত]____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here