অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ২৩+২৪+২৫+২৬

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#পর্ব- ২৩+২৪
#কায়ানাত_আফরিন
গাড়ি নিজ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে নেলসন টি এস্টেটের উদ্দেশ্যে। বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই সাথে বহমান জোরালো বাতাস। সেই বাতাস নাকে টেনে নিলেই শরীরে এক অন্যরকম উন্মাদনায় ছেয়ে যায়। গাড়ির প্যাসেন্জার সিটে জানালা ঘেষে আফরা বসে বসেই বাতাস নাকে টেনে নিতে মগ্ন। কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখলেও সেখানে বাজতে থাকা গানগুলোতে ওর ধ্যান নেই। ফারহান গাড়ির ব্যাক মিরর দিয়ে আড়চোখে পরখ করে নিলো আফরাকে। ফাহিম ড্রইভ করছে বিধায় ফারহানের আড়নজর সে আর খেয়াল করলো না।
হাওয়ার তালে উড়ে চলছে আফরার কালচে বাদামী চুল। সে দৃশ্য নিতান্ত সাধারন মনে হলোই ফারহানের কাছে তা হৃদয় ঘায়েল করার মতো এক দৃশ্য মনে হলো। আর সারাদিনটা পুলিশ কাস্টাডিতে পার হয়ে গেলেও সন্ধ্যায় এমন মনোরম দৃশ্য দেখে ওর ভালোলাগছে। এরকম অনুভূতি ওর জীবনের যেন প্রথম অনুভূতি। াফরা প্রথম প্রথম ওর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও ফারহান ওর দিকে নজর দেয়নি কোনোভাবেও। কিন্ত এখন ওর মনে হচ্ছে কাজটি ভুল করেছে সে।এমন মায়াবী মেয়েটার প্রতি আদৌ কি দুর্বল না হয়ে পারা যায়?

আফরা তখন নীরবতা কাটিয়ে ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ফাহিম আগামীকাল আপনি ফ্রি আছেন?’

ফাহিম গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো,

-‘উমমম, সিউর হয়ে বলতে পারছি না। কেন ?’

-‘আসলে গুগলে ওয়েদার চেক করে দেখলাম কাল বৃষ্টি হবে না। তাই আমি ভাবছিলাম এখানে কোথাও ফিশিং স্পটে যাওয়ার কথা।’

ফারহান হঠাৎ হেসে দিলো আফরার কথায়। যেন মেয়েটা কোনো মজার কথা বলেছে। ফারহানের হঠাৎ হেসে ওঠাতে আফরা খানিকটা হকচকিয়ে যায়। একই সাথে বিস্মিত সে। কেননা গম্ভীর চরিত্রের এই সুপুরুষ যুবককে আফরা খুবই কম হাসতে দেখেছে। আর যদি দেখে থাকে সেটাও অত্যন্ত সুক্ষ্ণ হাসি। আফরা অপ্রস্তুত গলায় ফারহানকে জিজ্ঞেস করলো,

-‘হাসছেন কেনো? আমি কি আদৌ হাসার মতো কোনো কথা বলেছি?’

-কান্না করার মতোও তো কোনো কথা বলেননি।

ফারহান বিদ্রুপ করে বলে ওঠলো। ফাহিম গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে কোনোমতে আফরার কথায় নিজের হাসি চাপিয়ে রেখেছে। এসব দৃশ্য দেখে আফরা মুখ বাকালো ফারহানের উদ্দেশ্যে। ছেলেটার হাসি দেখে রীতিমতো ওর গা জ্বলে যাচ্ছে। ফারহান হাসি থামিয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো এখন । তারপর একটু পেছনে ঘুরে বললো,

-‘এটা বাংলাদেশ আফরা। আপনাদের অ্যামেরিকা না । এখানে খাল-বিল-নদী-হাওর সবকিছুই আস্তো একটা ফিশিং স্পট। তাই আপনি যদি মনে করে থাকেন অ্যামেরিকার মতো এখানে আলাদা আলাদা ফিশিং স্পট আছে, স্পট ছাড়া অন্য কোথায় ফিশিং করলে জরিমানা করবে সেটা নিতান্তই ভুল ধারনা। তবে প্রাইভেট প্রোপার্টিগুলোতে অবশ্যই আপনি পার্মিশন ছাড়া ফিশিং করতে পারবেন না।’

আফরা ছোট করে ‘ওহ্!’ প্রতিউত্তর দিলো। বাহিরে ইতিমধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তবে টিলার মাঝপথ দিয়ে পথগুলো আতিক্রম করা হচ্ছে বিধায় তেমন একটা বৃষ্টিকণার শব্দ পাওয়া গেলো না।এমতাবস্থায় হঠাৎ গাড়ির ডেকে ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো ফারহানের ফোন। স্ক্রিনে নিজাম সাহেবের নামটি দেখে বুঝতে বাকি রইলো না কেনো উনি ফোন দিয়েছেন। ফারহান সেটা রিসিভ করার চেষ্টা করতেই বাধা দিলো ফাহিম। বললো,

-‘আগামী এক সপ্তাহ এসব পলিটিকস থেকে একটু দূরে থাকো ফারহান।নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমি কখনোই চাইবো না এসবের জন্য তোমার কোনোরূপ কোনো ক্ষতি হোক।’

ফারহান মৌনতা বজায় রাখলো এবার। এই প্রথমবার ফাহিমের কথায় ওর সায় দিতে ইচ্ছে করছে। তাই সে আর ফোনটি ধরলো না। ফাহিম আবার বললো,

-‘নিজাম সাহেবকে টেক্সট করো কিছুদিন তুমি পার্টি অফিসে যাবে না। তারপর ফোন সুইচড অফ করে ফেলবে।’

ফারহান তপ্তশ্বাস ফেলে ফাহিমের কথামতো তাই করলো।তারপর মোবাইলটা পকেটে গুজে বাহিরের নিশি দৃশ্যে মনোনিবেশ করলো। একা বড় হতে হতে সে ভুলেই গিয়েছে নিজেকে সময় দেওয়ার কথা। এখন তাই নিজেকে কিন্ত সময় দিতে হবে ফারহানের। ‘কমরেড ফারহান’ নামটিকে ভুলে একজন সাধারন মানুষের মতো পৃথিবী বিচরণ করবে।

___________________________________________

বাহিরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলেও প্রতিবারই সার্কিট হাউজ থেকে বিদ্যুত কেটে দেয় রৌশিনদের বাসায়। এখন হয়েছেটা ঠিক তাই। সন্ধ্যার দমকা বাতাসের পর যেই না ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হলো অমনেই বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো বাড়ির। ওর মা রীতিমতো বাবার উদ্দেশ্যে রান্নাঘর থেকে উচ্চস্বরে কথা বলা শুরু করেছে যাতে বাবা দ্রুত পল্লীবিদ্যুত অফিসে যোগাযোগ করতে পারে। কিন্ত ওর বাবার সবসময়েই এসকল কাজের প্রতি উদাসীনতা। সাদ্দাফও নেই যে কাজটুকু সামলে নিতে পারবে। রৌশিন বুঝে নিলো বৃষ্টি না কমলে আজ বিদ্যুত আসবে না আর।
তাই অগত্যাই বই রেখে কুপিবাতি জ্বালালো মেয়েটি।

রৌশিনের মাথা টনটন করছে ব্যাথায়। যখন মেয়েটি অতিরিক্ত চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে তখনই মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করে। আজ আজকের চিন্তার মূল বিষয় হলো আফরা নামের সেই মেয়েটি। রৌশিনের সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক মনে যেন ফাহিমের সাথে আফরাকে কোনেমতেই মেনে নিতে পারছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে সেই বিদেশিনী রমনী ফাহিম ভাইকে ওর হৃদগহীন থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্ত এটা কি আসলেই সম্ভব? যদি সেই মেয়ের জায়গায় অন্যকেউও হতো তবেও রৌশিন তাকে সহ্য করতে পারতোনা।

হঠাৎ রান্নাঘর থেকে রৌশিনের মা ডাক দিলো,

-‘অমন আঁধারে বসে বসে তুই করছিস না কি রৌশিন? ভাত খেতে আয়?’

-‘আজ খাবো না মা।খেতে ইচ্ছে করছে না।

পরে ওর মা এসে অনেক জোরাজোরি করলো খাওয়ার জন্য। কিন্ত রৌশিন নির্বিকার। কথায় আছে না, মন খারাপ হলে কিছুই ভালোলাগে না, মেয়েটার ঠিক অমন অবস্থাই হয়েছে। মা চলে যাওয়ার পর রৌশিন বিছানায় শুয়ে পড়লো জানালার কপাট খুলে। বাতাসের দাপটে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু পানি ওর শরীর শীতল করে তুলছে। চোখে ইতিমধ্যে ঘুম ভর করেছিলো ওর। কিন্ত সেই ঘুম নিমিষেই উবে গেলো বালিশের নিচে থাকা মোবাইলের কাপুনিতে।রৌশিন স্ক্রিনে দুর্বল ভাবে তাকিয়ে দেখলো ওর প্রাণপ্রিয় সহপাঠী ইলার নাম। চোখমুখ রীতিমতো চকচক করে উঠেছে ওর। আগ্রহী হয়ে রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলো,

-‘কেমন আছিস রে ইলা!’

-‘কেমন আর থাকবো, তুই তো ভুলেই গিয়েছিস আমায়। আরে সামনে পরীক্ষা ওটা তো আমিও জানি। তাই বলে কি আমার বা মারুফের সাথে একটুও যোগাযোগ রাখবিনা তুই ছেমড়ি? ‘

রৌশিন হেসে দিলো ইলার কথায়। তারপর বিদ্রুপ করে বললো,

-‘তুইও তো আমায় কল দিতে পারতি। ওহহো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, মেয়ে তো আবার সাব্বির ভাইয়ের সাথে প্রেম শুরু করেছে। আশপাশের খরব রাখার সময় কই?’

-‘ওই! আস্তে কথা বল্। আন্টি শুনলে কি ভাববে?’

-‘ধ্যুর! আম্মু আশেপাশে থাকলে কি এভাবে আমি কথা বলতাম?’

-‘তাও ঠিক।’

-‘আচ্ছা নাবিলা আন্টি, ইফাজ আঙ্কেল কেমন আছে?’

-‘এইতো ভালো?’

-‘আর ফাহিম ভাই?’

আমতা আমতা করে শেষে প্রশ্ন করেই ফেললো রৌশিন। যদিও ইলা রৌশিনের খুব কাছের একজন মানুষ তবুও এ কৈশোরকালের অনুভূতি টা কখনোই ইলাকে বলে নি সে। ইলা স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

-‘ভাইয়ার তো হসপিটালে ডিউটি থাকে বেশিরভাগ সময়ে তবে আফরা আপু আসার পর তাকে একটু সময় দিতে হয়। নাহলে ফারহান ভাই যেই, আপু তো ভয়ে পরে দৌড়ে পালাবে।’

মৌনতা কাটালো রৌশনি। কেননা আফরার কথা শোনার পর ওর মুখ নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।ইলা এবার বললো,

-‘আচ্ছা এবার রাখি রে দোস্ত! তোর সাব্বির দুলাভাই কল দিচ্ছে। মহাশয়ের কল না ধরলে রাত বিরাতেই আবার বাসার সামলে হামলে পড়বে।কাল কলেজে কথা বলবোনে।

-‘আচ্ছা ঠিকাছে। ‘

কল কেটে উপরে সিলিং ঝুলন্ত অচল ফ্যানটির দিকে তাকিয়ে রইলো রৌশিন। স্থির করলো আগামীকাল দেখা করবে সে ফাহিমের সাথে।❤️
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব – ২৫+২৬
#কায়ানাত_আফরিন
আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো ফারহান। ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখে পোনে সাতটা বাজে। হয়তো একজন স্বাভাবিক মানুষের কাছে তা অনেক সকাল। কিন্ত যেই ছেলে ফজরের ওয়াক্তের আগেই ঘুম থেকে উঠে যায় তার কাছে এই সময়টা দেরি মনে করাটাই স্বাভাবিক। আজ ফারহানের হাতে কোনো কাজ নেই। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী কিছুদিন পার্টি অফিসে যাবে না। একটু আশেপাশে ঘোরাঘুরি করবে। শ্রীমঙ্গলের আষাঢ়-শ্রাবণ মাস ঘুরাফিরার জন্য বেস্ট। আর প্রতিবছর এ মৌসুমেই প্রকৃতির আদ্রতা অনুভবের জন্য এই মাস দুটোকে ফারহান বড্ড আপন মনে করে। প্রতিবছরই নিজের সকল রাজনৈতিক জন্জাল ফেলে ফারহান অবাধে ঘুরাফিরা করে বাংলাদেশের প্রতিটি পাহাড়ি কোণায়। ফারহান সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনেক তো হলো দেশ ঘোরা, আগামীবছর এই সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয়ে পাড়ি জমাবে সে। চেরাপুন্জির বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয়ে ভুলিয়ে দিবে শৈশবকালের প্রতিটা কষ্ট, পরিবারকে হারানোর যন্ত্রণা।

ফারহান খাট থেকে উঠে মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো এবার। অনেকদিন ধরেই চা বাগানের ভেতরটা দেখা হচ্ছে না। এগুলোর একটু খবর নিতে হবে, নাহলে কর্মচারীরা সবসময়ই সুযোগ খুজে কাজে ফাঁকি দেওয়ার। একটা একটা চিকন স্লিভসের সাদা গেন্জি আর ট্রাউজার পড়ে বেরিয়ে এলো ফারহান। বারান্দার সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই আফরার মুখোমুখি হয়ে সে যেন অবাক না হয়ে পারলো না। আফরা কাঠের ছোট্ট এই বাড়ির সামনের অংশে কাঠের বেঞ্চের ওপর বসে আছে। ওর পা বারবার স্পর্শ করছে ঘাসের নরম কণা।
আফরাকে এত সকালে এখানে দেখে ফারহান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। সচরাচর ওর অংশটুকুতে কেউই আসেনা। চাচি-ইলা তো দূরের কথা আর ফাহিম বা মিঃ ইফাজের কোনো প্রয়োজন হয় তবে বাংলোতে ডেকে নিয়ে যায়। তাই এখানে ফারহানের অবাধে বিচরণ। বরাবরের মতো একাকীত্ব এ জীবনে ফারহানের ভাবতে হয়নি যে এভাবে চিকন স্লিভসের গেন্জি পড়ে বেরিয়ে আসলে কেউ ভাববে কি-না। কিন্ত এখন আফরার সামনে এভাবে আসাতে ও বিব্রতবোধ করছে।

ফারহান কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই আফরা বললো,

-‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম মিঃ কমরেড ! শুভসকাল।’

আফরার মুখে ‘শুভসকাল’ শব্দটি শুনে ফারহানের ভালোলাগলো। আফরা যদিও বাংলায় কথা বলাতে একটু আটকে যাক না কেনো, ওর মুখে ছোট ছোট এসব মধুর শব্দ দারুন লাগে।

-‘শুভসকাল। আপনি এত সকালে এখানে এসেছেন যে?’

-‘একটা অনুরোধ নিয়ে হাজির হয়েছি আপনার কাছে।’

আফরার ঠোঁটকোলে স্মিত হাসি। ঠোঁট কামড়ে বললো,

-‘তবে আপনাকে এই লুকে দারুন লাগছে কিন্ত মিঃ কমরেড। এমন হট বডি লুকিয়ে সারাদিন কিভাবে কমরেডগিরি করেন আপনি?’

ফারহান বিস্ফোরিত চোখে তাকালো আফরার দিকে। নিজের সম্পর্কে এমন উক্তি শুনে কি বলবে ভেবে পেলো না। এইপ্রথম কোনো মেয়ে দুঃসাহসিকতার সাথে ওকে টিজ করলো সেদিকে ওর সৌন্দর্যে এখানকার হাজার মেয়ে ঘায়েল হলেও ফারহানের ভয়ঙ্কর রাগের জন্য কেউ কিছু বলার স্পর্ধা দেখাতো না। আফরা আবার হাসতে হাসতে বসে পড়লো বেঞ্চটিতে।কোনোমতে নিজেকে সামলে বললো,

-‘আরে মজা করছি ম্যান ! আপনি এতো সিরিয়াস হচ্ছেন কেনো?’

-‘এসব মজা আমার সাথে করবেন না আফরা। আমার এসব পছন্দ না।’

কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে বললো ফারহান। আফরা বুঝতে পেরেছে এই ছেলে বড্ড ইগোস্টিক মানুষ। এত সহজে কাউকে প্রশ্রয় দিবে না।তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো সে।

-‘তো বলুন কি জরুরি বিষয় নিয়ে হাজির হয়েছেন?’

-‘প্রায় অনেকদিন তো হয়ে গেলো আমি এখানে আছি। এখন আমার অনুরোধ হলো আপনি আমায় শ্রীমঙ্গলে ঘুরাবেন। প্রতিটা কোণে, প্রতিটা সৌন্দর্যে। যতই এ বাধাঁ ও বাধাঁ আসুক না কেনো।’

ফারহান বিস্মিত হলো আফরার কথায়। তবুও ঠোঁট নাড়িয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে বলে ওঠলো,

-‘আমি যতটুকু জানি চাচি ফাহিম আর ইলাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনাকে ঘুরানোর জন্য।তাহলে আমায় টানছেন কেনো?’

-‘কেননা ফাহিম ব্যস্ত আর ইলার কিছুদিন পর পরীক্ষা। ওর এখন নিয়মিত কলেজ যাওয়া আসা করতে হয়। আর ইলা আমায় বলেছিলো এ আষাঢ়-শ্রাবণ মাস আপনি নাকি সকল কাজকর্ম বিচ্ছিন্ন করে নিজ মনে ঘুরেন? তাহলে আমাকে বানাতে পারবেন না আপনার ভ্রমণ সঙ্গী?’

ফারহান ভাবলো কিছু একটা। আফরা বললো,

-‘আমি একটা চরম দুঃখ নিয়ে এখানে এসেছিলাম জানেন? কিন্ত আমি সেসব কাটিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে চাই। আমার বিশ্বাস আপনি অবশ্যই আমায় নতুনভাবে সৌন্দর্যের গহীনে নিয়ে যাবেন। আমিও আষাঢ়-শ্রাবণের এই টানটা অনুভর করতে চাই ফারহান ! না করবেন না।’

আফরার আদ্র কন্ঠে ফারহানের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন শীতল স্রোত বয়ে গেলো। এই প্রথম নিজেকে ব্যাতীত কাউকে পেয়েছে যে আষাঢ়-শ্রাণের এই সৌন্দর্যের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। ফারহান ঠোঁট চেপে সম্মতি জানালো আফরাকে।মৃদু কন্ঠে বললো,

-‘আপনি আমার ভ্রমণসঙ্গী হতে পারবেন আফরা!’

____________________________

রৌদ্রজ্জল দিন আজ। পুন্জিভূত মেঘের অবয়বে বৃষ্টির ছিটেফোটা নেই। এই মাসে শ্রীমঙ্গলে এমন দৃশ্য দেখা দুর্লভ ব্যাপার। তাই লোকজন চুটিয়ে কাজ করছে।রৌশিন সেসবে একনজর তাকিয়ে ‘শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ’ স্ট্রিটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ইলার।অপরপাশেই টং দোকানের আশপাশে ছাত্রাছাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কেউ কেউ ক্যাম্পাসের পাশে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে ব্যাস্ত। কিন্ত ইলাকে এখনও আসতে না দেখে বেশ বিরক্ত লাগছে রৌশিনের। ক্লাস শুরু হতে দশমিনিটের মতো সময় আছে।এদিকে মারুফও অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে মোবাইলে। রৌশিন আশাই ছেড়ে দিয়েছিলো ইলার। মনে করেছিলো আজ বোধহয় ইলা আবার লেট করবে। এটা ভেবে রৌশিন তপ্তশ্বাস ছেড়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছিলো তখনই পেছন থেকে শোনা গেলো এক শক্ত পুরুষালি কন্ঠ।

-‘রৌশিন দাঁড়াও।’

পা থামালো রৌশিন। পেছনে ফিরেই সে দেখতে পেলো ফাহিমকে। ফাহিমের গাড়ি থেকে সবেমাত্র বেরিয়ে এলো। পাশের সিট থেকে বেরোলো ইলা। রৌশিনের এতক্ষণের বিরক্তি যেন নিমিষেই উবে গেলো ফাহিমের প্রাণোচ্ছল মুখ দেখে। ফাহিম বরাবরই হাসিখুশি ধরনের মানুষ। তাই ডাক্তারি আবেশের সাথে এই হাসি মুখশ্রীটা নিতান্তই সুদর্শন করে তুলছে মানুষটাকে। ইলা এক কানে হাত দিয়ে রৌশিনের উদ্দেশ্যে বললো ,

-‘সরি রে জানু, আজকে বাসা থেকে বেরোতে বেরোতেই লেট হয়ে গিয়েছিলো।’

-‘তোর জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম তুই জানিস?’

-‘কি করবো বল? একে তো ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেলো তারওপর আফরা আপুকে নিয়ে বৈঠক করতে করতেই টাইম চলে গেলো?’

-‘মানে?’

রৌশিন অবাক হয়ে ইলাকে জিজ্ঞেস করতেই ফাহিম বলে ওঠলো,

-‘আসলে দু’দিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম বলে আগামী কিছুদিন ওভারনাইট ডিউটি করতে হবে আমায়। এখন আফরা যেহেতু আমাদের অতিথি তাই মা চেয়েছিলো ওকে একটু ঘুরাতে এখানে। কিন্ত আমার টাইম ম্যানেজ করতে একটু কষ্ট হয়ে যায়। এগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে বলতেই একটু দেরি হয়ে গেলো।

ছোট করে ‘ওহ্’ প্রতিউত্তর দিলো রৌশিন। ইলা এবার বলে ওঠলো,

-‘এখন জলদি ক্লাসে চল্।আর ভাইয়া তোমাকে নিতে আসতে হবেনা। আজকে রৌশিন মারুফের সাথেই বাসায় ফিরে যাবো। ফুচকা খাওয়ার জন্য বুকটা কেমন যেন আনচান করছে।ক্লাস শেষে তাই ফুচকা খাবো।’

-‘এসব হাবিজাবি খাবি না ইলা?’

ফাহিম কথাটি বলামাত্রই রৌশিন চোখ বাকিয়ে বললো,

-‘কি হবে খেলে?’

-‘অনেক কিছু হবে। ওকে আমি না বললাম সাথে তুমিও খাবে না। আফটার অল ইলার মতো তুমিও তো আমার বোন।’

রৌশিন চরম রেগে গেলো উনার কথায়। তাই প্রখর গলায় বললো,

-‘কে আপনার বোন? লিসেন আমার একমাত্র ভাই হচ্ছে সাদ্দাফ ভাইয়া। আর কেউ না। আপনিতো একেবারেই না। তাই এসব হাবিজাবি কথা বলবেন না।এই ইলা ! চল তো?’

বলেই রৌশিন হনহন করে চলে গেলো ইলার হাত ধরে। ফাহিম এবার বিস্মিত।রৌশিনের আচমকা রূপে ফাহিমের কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিত তা ফাহিমের অজানা। নিনির্মেষেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,

-‘স্ট্রেন্জ গার্ল !’

____________________________________________

ড্রইংরুমে ফারহানকে স্থিরভাবে বসা দেখে মিসেস নাবিলা অবাক। উনার জানামতে ফাহিম বা মিঃ ইফাজ কেউই তো তাকেনি ওকে যে ফারহান এখানে আসবে। ফারহান বরাবরই ইগোস্টিক মানুষ। পারিবারিক এ সমস্যাগুলোর জন্য ফারহান অকারনে খুব কমই এসেছে এখানে। তাছাড়া ছেলেটা ফর্মাল অবস্থায় নেই। একটা রেগুলার টিশার্ট আর থ্রি কোয়ারহটার প্যান্ট পড়ে আছে। মিসেস নাবিলা ফিচালো হাসি দিয়ে বললেন,

-‘আরে ফারহান ! তুমি হঠাৎ এখানে?’

ফালহান আলতো হাসলো। স্মিত কন্ঠে বললো,

-‘চিন্তা করবেননা চাচি , আপনাকে জ্বালাতে আসিনি।’

-‘ধ্যুর বোকা ছেলে, আমি কি সেরকম কিছু বলেছি?’

ফারহানের কোনো উত্তর না পেয়ে কিছু বললেন না উনি। ইতিমধ্যে আফরা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। আজ ফিশিং করতে যাবে বলে একটা কর্মোর্ট জিন্স আর বুকে কুচি দেওয়া কোয়ার্টার হাতার টপস পড়েছে সে। কপালে কালো রঙের একটি ক্যাপ। ফারহান শীতল কন্ঠে বললো,

-‘রেডি আপনি?’

-‘হুম। জিনিসপত্র কোথায়?’

-‘গাড়িতে রাখা আছে।’

মিসেস নাবিলা এবার তাই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘কোথায় যাচ্ছো তোমরা?’

-‘বিলে নিয়ে যাচ্ছি।’

শীতল কন্ঠে বললো ফারহান। মিসেস নাবিলা অসন্তুষ্ট হলেও কিছু প্রকাশ করলেন না। তিনি আফরাকে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘তোমার আঙ্কেলকে বলেছো?’

-‘আঙ্কেলই তো বললো উনার সাথে যেতে।ফাহিমের নাকি সময় নেই?’

-‘ওহ্ ! তাহলে যাও!’

মলিন স্বরে বলেন মিসেস নাবিলা। ফারহান আর আফরা এবার বেরিয়ে গেলো বাংলো থেকে। নীল আকাশ আর টিলার সৌন্দর্য মনোহর করে তুলছে পরিবেশটি। ফারহান ঠোঁটে স্মিত হাসি তুলে বলে ওঠলো,

-‘তাহলে প্রস্তুত তো আমার ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার জন্য?’

আফরা সম্মতি জানানো। মনের মধ্যে নুপুরের ন্যায় বেজে ওঠলো,
‘আপনি চাইলে আমি আপনার চলার পথের সঙ্গী হতেও রাজি কমরেড সাহেব!❤
.
.
.
.
~চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here