অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ৬+৭+৮

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব_৬

ফারহান আর আফরা দুজনেরই চোখাচোখি হলো এবার।আফরা যে বাঙালি পরিবেশে বড় হয়নি তা গতরাতেই ফারহান আন্দাজ করতে পেরেছিলো। মেয়েটার মতো ওর নামটাও সুন্দর। ফারহান মৃদুভাবে ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে বললো,

‘হ্যালো আফরা!’

আফরা হাসে বিনয়ীভাবে। ভদ্রতার খাতিরেও সেও প্রতিউত্তরে বললো,

‘হ্যালো!’

ফারহান তৎক্ষণাৎ চোখ ঘুরিয়ে নিলো আফরার কাছ থেকে। এমন ভান করছে যে আফরাকে সে একেবারেই চিনেনা। এই মুহূর্তেই তার সাথে আফরার যেন প্রথম দেখা। ফারহান এবার মিঃ ইফাজের দিকে দৃষ্টিনিয়োগ করে বললো,

‘কোনো জরুরি প্রয়োজনে আমায় ডেকেছিলে চাচু?’

মিঃ ইফাজ হাসলেন মলিনভাবে। পত্রিকা ভাজ করতে করতে সে বললেন,

‘তোমায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ডাকতে পারি না?’

ফারহানের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে। এই পৃথিবী যে কতটা স্বার্থপর তা মিসেস নাবিলাকে দেখেই অত্যন্ত ফারহানের ভালোমতো জানা । কিন্ত এসব কথা একটা বাইরের মেয়ের সামনে এভাবে বলতে ওর মন সায় দিলো না …..তাই শান্ত গলায় প্রতিউত্তরে বললো,

‘আজ পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া আমায় তুমি কখনই ডাকোনি চাচু।’

লজ্জায় মাথানুয়ে ফেললেন মিঃ ইফাজ। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে তিনি আন্দাজ করতে পারছেন যে ছেলেটর মনে প্রচন্ড ক্ষোভ আর অভিমানের অস্তিত্ব রয়েছে যা কখনোই হয়তো সে প্রকাশ করবে না। আফরা এদের কথপোকথন শুনে অবাক হলো । কিছু একটা গন্ডগোল আছে যা হয়তো সে ধরতে পারছে না। মিঃ ইফাজ মৌনতা ভেঙে বললেন,

‘আজ ব্যস্ত আছো অনেক?’

‘উমমমম! আছি।’

‘কোথায় যাচ্ছো এখন?’

‘বর্ডারের দিকে………….একটা মিটিং আছে ওই এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে।’

‘ইলা আর আফরাকে তাহলে বর্ডারের ওদিকে যেকোনো ট্যুরিস্ট জায়গায় নিয়ে যাও।ওদেরকে রেখেই তুমি তোমার মিটিংয়ে যেও। মেয়েটা দুদিন ধরে বাংলাদেশে এসেছে অথচ ফাহিমের এত কাজের চাপ যে ও নিয়েই যেতে পারছে না।’

মিঃ ইফাজের কথায় কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না ফারহান। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে স্থির গলায় বললো,

‘ঠিক আছে।’

প্রসন্ন হলেন। মিঃ ইফাজ। আফরা আর ইলার উদ্দেশ্যে তাই বললেন,

‘তোমরা দুজন রেডি হয়ে বাইরে দাঁড়াও। ফারহান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে তোমার জন্য।’
______________

আফরা একটি হালকা বেগুনী রঙের ফতুয়া আর জিন্স পরে নিলো। কাধে বরাবরের মতো একটি ছোট ব্যাগ। আফরার কেন যেন মনে হচ্ছে আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় ওকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।তুলি দিয়ে আটকানো সিল্কি চুলগুলো খুলে ক্লিপ লাগিয়ে নিলো। ইলা আজও প্রথম দিনের মতো হলুদ রঙের একটি থ্রিপিস পড়েছে। দ্রুতস্বরে সে বললো,

‘আপু তাড়াতাড়ি চলো। ভাই রেগে গেলে পরে আমাদের রেখেই চলে যাবে।’

ইলার কথায় দ্রুতপায়ে বাইরে চলে গেলো আফরা। চা বাগানের ছোট ছোট টিলার মাঝখানে সরু পথ দিয়ে দু’তিন মিনিট হাটলেই পিচঢালাই রাস্তার সামনে বিশাল গেট। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। গাড়িতে হেলান দিয়ে আনমনে মোবাইল স্ক্রলিং করছে।আফরা সেখানে গিয়ে বললো,

‘এইযে মিঃ ! এসে পড়েছি।’

‘ওকে। গাড়িতে উঠে পড়ুন।’

ফারহান আফরার দিকে না তাকিয়েই নির্বিঘ্নে কথাটি বলে ওঠলো। ছেলেটার কীর্তিকলাপ দেখে অবাক হলো আফরা। ইতিমধ্যে ইলাও এসে পড়েছে গাড়ির সামনে। আফরা। আবার বললো,

‘গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসবো নাকি ব্যাক সিটে?’

ফারহান মোবাইল রেখে সরু চোখে তাকালো আফরার দিকে। মেয়েটা ওর দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। একটু চাঞ্চল্যতার ভাব। কাটা চুলগুলো হাওয়ার তালে উড়ে যাচ্ছে বারবার।ফারহান মোবাইল পকেটে পুরে গম্ভীর স্বরে বললো,

‘ব্যাক সিটে বসুন ইলার সাথে।’

আফরাকে তারপর আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে। সোজাসুজি ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো।

গাড়ি ছুটে চলছে নিদারুন ভাবে। আকাশের মেঘও সামনতালে বয়ে যেতে ব্যস্ত। কি একটা মিস্টি হাওয়া! যেন এই মুহূর্তে আফরার মনেও মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়বে। আফরা কানে ইয়ারফোন গুজে আনমনে গান শোনার চেষ্টা করলো কিন্ত পারলো না। তার মনে হচ্ছে এখন গাড়িতে অতীব নজরকাড়া একজন মানুষ ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। মানুষটা কথা কম বলে, যতটুকু বলে তাতে বোঝা যাচ্ছে সে অনেকটা গম্ভীর ধাচের। কালো গহীন চোখে, ঘন পল্লবে তার সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে। উচু নাক………কথা বলার সময় গালে মৃদু একটি ভাঁজ পড়ে। রোদপোড়া গায়ের রং , বোঝাই যায় ছেলেটার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে কড়া রৌদ্দুরে। তবুও কেমন যেন চুম্বকের মতো টানে। ছেলেটার চেহারা নায়কদের মতো এতটা সদর্শন না হলেও ভীড়ের মাঝে নজর কাড়ার মতো একটা মোহনীয় চেহারা এতটুকু আফরা নিশ্চিত।

আফরা এবার ফারহানের উদ্দেশ্যে বললো,

‘আর কতক্ষণ লাগবে ফারহান?’

‘এইযে ১০ মিনিটের মতো। ‘

এরই মধ্যে মোবাইলে কল আসলো ফারহানের । স্ক্রিনে ভেসে ওঠছে শামসুর নাম্বার। ফারহান কলটা ব্লুটুথ স্পিকারে ট্রান্সফার করে রিসিভ করলো,

‘হ্যালো শামসু!’

অপরপাশ থেকে কি বলছে আফরা শুনতে পারলো না। কারন ফারহান ব্লুটুথ স্পিকারে কথা বলছে। ফারহান অপরপাশের কথা শুনে প্রতিউত্তরে বললো,

‘ওইসব ট্যাক্সের কাগজপত্র ঠিকঠাকমতো রাখো। ওই চেয়ারম্যানের বাটপারি আজ যদি ফাস না করতে পারি তবে আমার নামও ফারহান জুবায়ের না। ওই এলাকায় আমার পাওয়ার না থাকলেও যেহেতু স্থানীয়রা আমার কাছে বিচার নিয়ে এসেছে আমি অবশ্যই উপরমহলে এটা বরখাস্ত করবো। ‘

আফরা মৌনতার সাথে কথাগুলো শুনলো।হাজার চেষ্টা করেও ফারহানের কথার কোনো ঠিকঠিকানা সে খুঁজে পেলো না। ফারহান অপরপাশের কথা শুনে আবার বললো,

‘ওই চেয়ারম্যান হাজার খুঁজেও আমার দুর্বলতা বের করতে পারবে না। আমায় মরার হুমকি দিচ্ছে ওই বাস্ার্ড? আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি। রাজনীতি নিয়ে অনেক দেমাগ না……….আমি আসলেই দেখা যাবে। রাখছি!’

কল কাটলো ফারহান। আফরা সামনের আয়নায় খেয়াল করছে ফারহানের চোয়াল কেমন যেন শক্ত হয়ে ওঠেছে। হয়তো ফোনে এমন কোনো অপ্রীতিকর কথাবার্তা হয়েছে যা ফারহানের হয়তো পছন্দ হয়নি।

এই মানুষটাকে যতই ঘেটে দেখার চেষ্টা করছে ততই প্রহেলিকার জালে হারিয়ে যাচ্ছে আফরা। আফরা এবার চেষ্টা করলো একেবারে শূণ্য থেকে সবকিছুর স্মৃতিচারন করার।গতরাতে ফারহানের সাথে ওর দেখা হয়েছিলো এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সময়টাতে সারা শ্রীমঙ্গলে ছাত্রহরতালের জমজমাট আমেজে পরিপূর্ণ ছিলো। এমন সময়ই বৃষ্টির নিদারুন গতির মাঝে আফরার সাথে প্রথম দেখা হলো আহত ফারহানের। ফারহানের ভাষ্যমতে ওর বাহুতে পুলিশের গুলি লেগেছিলো। কিন্ত কেনো?প্রশ্ন জাগলো আফরার মনে। আচ্ছা ফারহান কি তবে ক্রিমিনাল টাইপ কেউ যার কারনে পুলিশের সাথে তার ঘোরতর সম্পর্ক? এমন কিছু আফরা কল্পনা করতে যাবে তখনই ওর মনে পড়লো একটি কথা………’অধিকারের জন্য লড়াই করি।’

কথাটি ফারহান বলেছিলো।এমন ধরনের দাম্ভিক কথাবার্তার মানুষ আর যাই হোক কখনোই অপরাধের সাথে যুক্ত হতে পারে না।

হঠাৎ গাড়ি থামার আওয়াজে নিমিষে আফরার মনের প্রশ্নের পাহাড় কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। গাড়িটি থেমেছে একটা সমান্তরাল পথের সামনে। একপাশে বড় করে সাইনবোর্ডে ঝুলানো , ‘Not for driving!’ অর্থাৎ পথটি গাড়ি চলাচলের জন্য না। আফরা আর ইলা বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। পিছু পিছু ফারহানও।

আকাশটা পরিষ্কার। তাই অনেক মানুষই ঘুরতে এসেছে এখানে। বলা বাহুল্য শ্রীমঙ্গলে আষাঢ় মাসে এমন দৃশ্য দেখা দুর্লভ। আফরা অপার নয়নে তাকিয়ে থাকলো পথের দিকে।সামনে সরু পথ দু’ধার দিয়ে বিস্তৃত ক্ষেত। শেষ প্রান্তে কিছু চায়ের স্টল আছে পানাহারের জন্য। আফরা আসার আগে গুগলে জায়গাটির নাম দেখে এসেছিলো কিন্ত কোনো এক কারনে তা ভুলে গেলো সে।
আফরা খেয়াল করলো ফারহান কাউন্টারের দিকে গিয়েছে। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির এই মানুষটার কথাবার্তার ধরনই এমন যে সহজেই কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। ফারহান ওখানে কি বলেছে আফরা তা জানেনা। ছেলেটার সব কিছুই সুন্দর। মাঝে মাঝে ফারহানের বলা কিছু সিলেটি ভাষাও কানে ভেসে আসছে যা আফরার বোধগম্য হলো না। এখানকার স্থানীয়দের সাথে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে হবে এটাই স্বাভাবিক…………..বরং প্রমিত ভাষায় কথা বলাটাই হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক। ফারহান দুটো টিকেট নিয়ে এলো আফরা আর ইলার কাছে। আফরার উদ্দেশ্যে বললো,

‘এই নিন টিকেট । আর প্লিজ………..ইলাকে রেখে বেশি দূরে যাবেন না। চাচু যদিও আপনাকে এখানে আনার দায়িত্ব আমায় দিয়েছে তবুও আপনার সিকিউরিটির ব্যাপারে আমি হেলফেল করতে চাচ্ছি না !’

‘বুঝেছি। আপনি আবার আসবেন নাকি আমরা একাই যাবো?’

ফারহান ভ্রু কুচকে আফরার দিকে তাকালো। কেন যেনো মনে হচ্ছে যে এ মেয়েটা হয়তো বড্ড বাচাল ধরনের।আফরাকে কোনো উত্তর না দিয়ে ইলাকে বললো,

‘উনার খেয়াল রাখিস…………….এক-দেড়ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো।’

বলেই গাড়ি নিয়ে চলে গেলো ফারহান। আফরা এখনও সেপানে তাকিয়ে আছে। মানুষটির ব্যবহার আজব, সেইমতো কথাবার্তাও বড়ই আজব ! কেমন যেন মায়াজালে নিয়ে যায়। তবুও কতটা চোখ ধাধানো তার প্রতিটা কান্ড। আফরা অ্যামেরিকায় থাকাকালীন অনেক ধরনের ছেলেমেয়ের সাথেই অবাধে মেলামেলা হয়েছে কিন্ত বাংলাদেশের এক কোণে শ্রীমঙ্গলের ‘ফারহান জুবায়ের’ এর মতো এতটা প্রলুব্ধ করার মতো ব্যাক্তি সে কখনও দেখেনি….. হয়তো দেখবেও না।
আফরার মনে শত কৌতুহল থাকলেও সে তা মনের মধ্যে পুষে রাখলো। বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘আপনার রহস্য বের করেই ছাড়বো রেইনকোর্টম্যান!’

.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব -৭+৮
শ্রীমঙ্গলের হু হু বাতাসে বারবারই প্রেমের অনুভূতি হয় আফরার। কেমন যেন এক হিমশীতল আবেগে জর্জরিত ওর সমস্ত দেহ। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই বিস্তৃত চা বাগান। কেমন যেন মোহনীয় এ দৃশ্য । সহজেই সবার নজর কেড়ে নিতে পারে। তবুও আফরার অবাধ্য চোখজোড়া বারবার চলে গেলো এই ট্যুরিস্ট স্পটের একেবারে শেষপ্রান্তে। সামনেই রয়েছে বিশাল খাদ। আর সে খাদ পেরোলেই ভারতের সীমান্ত। ইলা জায়গাটি নিয়ে অনেক কথাবার্তাই বলছে যা শুনতে ভালো লাগলেও আফরা মনোযোগ দিতে পারলো না। ওর অবচেতন মন বারবার ফারহান নামক মানুষটির রহস্য উদঘাটন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

কড়া রৌদ্রের উত্তাপ থাকাতে আফরা আর ইলা দুজনেই এবার চলে গেলো চা বাগানটির শেষ প্রান্তের টি স্টলগুলোর দিকে। এখানে গাছের নিচে বেঞ্চ পেতে রখাখাতে সহজেই ছায়ার অতল স্পর্শ অনুভব করার যায়। চায়ের দোকানটির একটু পাশ ঘেষেই রয়েছে হাসনাহেনা গাছ। ইলার ভাষ্যমতে রাতে নাকি ঘ্রাণে এই জায়গাটি মৌ মৌ করে। কিন্ত কেউই এখানে তা উপভোগ করার সাহস পায়না। কারন হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণে নাকি সাপ এসে পড়ে। দোকানদার এবার দোকানে বসেই জিজ্ঞেস করলো……….

‘আফা চা দিমু?’

দোকানদারের কথায় ইলা প্রশ্নবিদ্ধ চাহিনী নিয়ে তাকালো আফরার দিকে। তারপর কোমল গলায় বললো,

‘চা খাবে আপু?’

‘না………আমি আসলে চা তেমন একটা খেতে পারিনা। স্মেলটা আমার কাছে কেমন যেন লাগে।’

আফরার কথায় মধ্যবয়স্ক দোকানদার হতবুদ্ধি হারিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো আফরার দিকে। তার ৪৫ বছরের জীবনে এমন বিস্মেয়র কথা সে কখনোই যেন শুনে নি। ইলাও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো এমন কথায়। চায়ের দেশের মানুষের সামনে যদি চা’ নিয়ে এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে সবাই উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। দোকানদার মুখ থেকে পান ফেলে তিক্ত সুরে বললো,

‘কই থেইক্যা আইসেন আপনি?আমাগো চায়ের লেগা লোকজন দ্যাশ বিদ্যাশ থেইক্যা আইয়া পড়ে। আর আপনার ভাল্লাগে না?’

ইলা বুঝলো দোকানদার ক্ষেপেছে। এধরনের নিম্ন আয়ের মানুষরা খুব কম সময়েই ভোক্তাদের সাথে আন্তরিক থাকে না তাই উনার মাথা ঠান্ডা করার জন্য ইলা বললো,

‘আমারে চা দেন মামা।কড়া লিকারের দিবেন।’

মধ্যবয়স্ক দোকানদার এতক্ষণ আফরার কথায় যতটাই না অসন্তুষ্ট ছিলো এবার ইলার কথায় যেন সে নিজের হাসি ফিরে পেয়েছে। আরেকটা পান মুখে ঢুকিয়ে বললো,

‘এহনি দিতাসি আফা।’

আফরা তাই নীরবেই বসে থাকলো ইলার সাথে। চারিদিকে রৌদ্রের ছটাকে কেমন যেন ধূ ধূ করছে। অল্পবিস্তর আবেগময় অনুভূতি। এমন দৃশ্য উপভোগ করার সময় যদি মোবাইলের রিং বেজে ওঠে কেই না বা বিরক্ত হবে? আফরাও হলো। প্রচন্ড রকমের বিরক্ত। কিন্ত সে যেহেতু নিজ দেশের বাইরে আছে তাই হঠাৎ কল আসাতে কৌতুহল জাগলো মনে। স্ক্রীনে স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে ইন্টারন্যাশনাল নাম্বার। ভ্রু কুচকে এলো আফরার। চোখের পাতা পড়ছে ঘনঘন। এসময়ে অ্যামেরিকা থেকে ওর মম-ড্যাড ছাড়া তো আর কারও কল দেওয়ার কথা না। তাহলে কে কল দিলো এটা? কপালে পড়ে গেলো চিন্তার সুক্ষ্ন ভাঁজ। আফরা তাই অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো ইলার দিকে। চোখের ইশারায় মোবাইল দেখিয়ে বললো,

‘কল এসেছে। কথা বলে আসছি।’

ইলাও সম্মতি জানালো ইশারায়। আফরা তাই এবার মোবাইল নিয়ে একেবারে ঢালে এসে দাঁড়ালো। অবশেষে কল ধরে নিদারুনভাবে বললো,

‘হ্যালো………হু আর ইউ?’

অপরপাশ থেকে শোনা গেলো কারও তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। আফরা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য। মৌনতা কাটিয়ে সে বলে ওঠলো,

‘এরিক।’

কিছুটা নীরব হয়ে গেলো আফরা। মনের ভেতরকার কথাগুলো এরিকের কন্ঠে কেমন যেন দলা পেকে যাচ্ছে। বুকের ধুকধুক শব্দটা ক্রমশই বাড়ছে। এরিক গটগটিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছো অ্যাফি?’

‘ভালো।’

আফরার সরাসরি উত্তর। এরিক অপরপাশে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।

‘অ্যানার কাছে শুনলাম তুমি নাকি বিডিতে গিয়েছো?কবে আসবে?’

‘জানা নেই।’

‘আমায় মিস করো না?’

এরিকের জড়ানো কন্ঠ। আফরা কি বলবে ভেবে পেলো না। কেননা মেয়েটার এরিকের কথা মনে পড়েনাই এমন না কিন্ত ছেলেটার জন্য কখনোই ওর মনে কোনো অনুভূতি কাজ করতো না। আফরা নির্দয়ভাবে বললো,

‘উহু……….আমি এখানে অনেক ভালো আছি।’

এরিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আফরার কথায়। নিজের ব্যর্থতাকে আগুনে সপে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। স্মিত হেসে তাই সে বললো,

‘ভালো থেকো তাহলে। গড এর কাছে প্রে করবো আমার মতো অবস্থা তোমার যেন না হয়। ওয়ান্স এগেইন………………আই লাভ ইউ অ্যাফি!’

বলেই টুট করে কল কেটে দিলো এরিক। আফরা প্রশ্নবিদ্ধ চাহিনী নিয়ে এরিকের নাম্বারের দিকে তাকিয়ে আছে। বুক চিরে বারবার বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। কেনো সে এরিককে ভালোবাসতে পারলো না? আর ভালোবাসলে কি আদৌ ওদের সম্পর্কের কোনো রূপ পেতো? এরিক যে খ্রিস্টান। সে আর যাই হোক…………মম-ড্যাড এর কথা অমাণ্য করে কখনোই এরিককে বিয়ে করতে পারবে না। আফরা ইতিমধ্যে খেয়াল করলো অ্যামেরিকায় থাকা এরিকের দুঃখে শ্রীমঙ্গলের আকাশেও হঠাৎ অন্ধকার ছেয়ে এসেছে। এতক্ষণের নীল আকাশে ঘনীভূত হতে শুরু করেছে অল্পবিস্তর কালো মেঘ।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আফরা। অল্প সময় পর ক্লান্তি বেশে জায়গাটি প্রস্থান করে চলে গেলো ইলার কাছে।
ইলা আফরাকে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে ওঠলো,

‘আপু ! একটা সমস্যা হয়েছে?’

‘কি সমস্যা ইলা?’

আফরা অবাক হয়ে বললো।

‘আসলে আমায় ইমার্জেন্সি একটু *****বাজারে যেতে হবে। আগামীকাল আমার নোটসগুলো জমা নেয়ার কথা তাই একটু প্রয়োজনে স্টেশনারি যেতে হবে।

‘তো চলে তাহলে আমিও যাই।’

‘তোমায় নিতে পারবো না আপু।’

‘কেনো?’

‘আমার আসতে সময় লাগবে। তাছাড়া ওখানকার রাস্তাঘাট কাদা দিয়ে ভরা । তুমি হাঁটাচলা করতে পারবে না। এক কাজ করো আপু। তুমি এখানেই বসো। তোমায় আমি ফারহান ভাইয়ের নাম্বার দিচ্ছি। সে একটু পরেই তোমায় নিয়ে ‘নেলসন টি এস্টেটে’ চলে যাবে।’

ফারহানের নাম শুনেই মনের সুপ্ত কৌতুহল জেগে ওঠলো আফরার। কালবিলম্ব না করে তাই সে ইলাকে বললো,

‘ঠিক আছে। তুমি যাও। আমি এখানেই আছি।’

‘আচ্ছা আপু আমি গেলাম। আর ভাইকে ম্যানেজ করে নিও প্লিজ…….’

বলেই চলে গেলো ইলা।এতক্ষণের সুমধুর ঠান্ডা বাতাস এবার তীব্রতার সাথে দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বনফুলের ঘ্রাণ ওর নাসিকারন্ধ্র স্পর্শ করছে। আফরার এবার অপেক্ষা করতে লাগলো ফারহানের জন্য।
__________

দ্রুতগতিতে ড্রাইভ করে ট্যুরিস্ট স্পটের দিকে যাচ্ছে ফারহান। ঘন ঘননিঃশ্বাস ফেলছে বারবার। চোখের তীব্র দৃষ্টি একবার শ্রীমঙ্গলের অপরূপ পিচঢালাই রাস্তার দিকে তো একবার হাতঘড়ির দিকে। চিকন ব্ল্যাকবেল্টের স্মার্ট ওয়াচ বারবার স্মরণ করে দিচ্ছে ‘দেরি হয়ে গিয়েছে।’বাইরে চলছে তুমুলধারায় বৃষ্টি। ফলে গাড়ির কাচটি বারবার অস্পষ্ট হয়ে আসছে।জায়গামতো আসতেই গাড়ির ব্রেক কষলো ফারহান। বৃষ্টিতে বেরোনোর আগে কালো রেইনকোর্ট আর মাস্ক পরে নিলো সে। এমনিতেও ওই এলাকার চেয়্যারম্যানের সাথে ঝামেলা হয়ে এসেছে। ফারহান নিশ্চিত এবার ওর দুর্বলতা খোজারঁ জন্য সেই দুর্নীতিবাজ মানুষটা লোক লাগাবে ওর পেছনে। এসব হুমকিতে অভ্যস্ত ফারহান। ওর দূরদর্শীতার জন্য আজ পর্যন্ত একটা ক্ষমতাবান নেতাও এক চুল ক্ষতি করতে পারেনি ওর। তবুও সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। নিজের জন্য না হলেও ,মানুষের জন্য বাঁচতে হবে।

রেইনকোর্ট পড়ে গাড়ির বাইরে বেরোতেই রেইনকোর্টের ওপর টপ টপ করে পড়তে থাকলো বৃষ্টির পানি। দু আড়াই ঘন্টা আগের জনবহুল ট্যুরিস্ট স্পট এবার জনমানবহীন। দূর দূর বৃষ্টির কণায় ত্র্রাস সৃষ্টি করছে। ফারহান দ্রুত পা চালিয়ে আরও ভেতরে ঢুকলো। আশেপাশে নিজের প্রখর চোখজোড়া দ্বারা হন্য হয়ে খোঁজতে থাকলো ইলা আর ওই মেয়েটাকে। ‘ওই মেয়েটা’ মনে বিচরণ করতেই থমকে গেলো ফারহান। ‘আফরা’ নামের মেয়েটার কথা ইলা থেকেও ওকে যেন বেশি ভাবাচ্ছে।কিন্ত কারনটা সে জানে না। ইলা ফারহানের আপন চাচাতো বোন…………কিন্ত আফরা?

এসব ভাবতে ভাবতেই ফারহানের হঠাৎ চোখ গেলো শেষপ্রান্তে থাকা খাদের দিকে। এক রমনী দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টিবিলাসে যেন ঘোরতর মগ্ন। চোখ ক্রমশ সরু হয়ে এলো ফারহানের। মেয়েটার শারীরিক গঠন দেখে ফারহানের মনে হলো আফরার কথা। দূর থেকে তবুও তেমন একটা বোঝা যাচ্ছে না।

পা চালিয়ে তাই খাদের পাদদেশে গেলো ফারহান। মেয়েটি আফরাই। একধ্যানে খাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির স্পর্শে কেপেঁ ওঠছে বারবার।মাস্কের ভেতরেই বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বললো ফারহান। সপ্রতিভ চাহিনী সে নিক্ষেপ করে রেখেছে অসম্ভব রূপবতী এই আফরার দিকে। অতঃপর আড়ষ্ট কন্ঠে ফারহান বললো,

‘এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো আফরা?’

এক শক্ত পুরুষালি কন্ঠ শুনে মুহুর্তেই মাথা সরিয়ে সেই ব্যাক্তিটির দিকে তাকালো। শার্টের ওপর পরনে কালো রেইনকোর্ট , মাথাটা ঢেকে রাখলেও মসৃন চুল বেয়ে কপালে পানি পড়ছে টপ টপ করে। মুখের মাস্ক ইতিমধ্যে নামিয়ে ফেলছে ফারহান। ফলে প্রখর চাহিনীর সাথে টসটসে ঠোঁটজোড়া কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গে। আফরা বলে ওঠলো,

‘এই খাদে লাফ দিলে কি আমি মরে যাবো নেতাসাহেব?’

আফরার ‘নেতাসাহেব’ ডাকটিতে শরীরের সর্বত্র এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো ফারহানের। বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দটা ক্রমশ যেন বেড়েই চলছে। এই মেয়ে কে? তার সম্পর্কে এতকিছু একদিনের ব্যাবধানে জানলোই বা কিভাবে? ফারহানের হাতের মুঠো শক্ত করে রেখেছে নিজেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তারপর বলে ওঠলো,

‘কিসব আবোল-তাবোল বলছেন আপনি? আর ইলা কোথায়?’

‘আপনার দরবারে রেখে গিয়েছে।’

আফরার বিক্ষিপ্ত কন্ঠ। ফারহান যা বোঝার বুঝে নিলো। ইলা আফরাকে রেখেই চলে গিয়েছে কোথাও।

‘কি হলো নেতাসাহেব? বলুন ! এখান থেকে লাফ দিলে আমি কি মরে যাবো?’

ফারহান শক্ত হাতে আফরার বাহু চেপে নিয়ে এলো নিজের কাছে। আফরার সিক্ত দেহ ওর উষ্ণ দেহর ওপর রেইনকোর্টের আবরণে মিশে যাচ্ছে।আফরা নির্লিপ্ত চাহিনী নিয়ে তাকালো ফারহানের দিকে। কি মায়া তার মুখে? সৃষ্টিকর্তা এই পাষাণ মানুষটার মুখেই যেন অজস্র মায়া ছাড়িয়ে দিয়েছে।

‘পাগলের মতো বিলাপ করছেন কেনো? এখান থেকে লাফ দিলে মৃত্যুটা কি অনির্বার্য নয়?’

আফরা মলিন হাসে। ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অবচেতন মন বারবার বলছে এরিকের সাথে প্রতারণা করেছে সে। এরিকের চাপা অভিমান থেকে কিছুতেই সে হয়তো রেহাই পাবে না। ধুকে ধুকে কষ্টের শিকার হচ্ছে । কিন্ত ফারহান এসে আবারও ওর সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। এরিকের কথায় যতটা না মর্মাহত হয়েছিলো……….ফারহানে শীতল রূপে তা যেন ধুলোর ন্যায় উড়ে গেলো হঠাৎ। আফরা কাট কাট গলায় বললো,

‘জানেন ! এতক্ষণ মরতে ইচ্ছে করছিলো আমার। যে অতীত ফেলে এখানে এসেছি তা যেন কোনোক্রমেই ছাড়তে চাইছিলো না। তবে এখন তা আর করবো না। আপনাকে দেখেছি যে……………আপনার সম্পর্কে জানার জন্য কৌতুহলের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছিলাম আমি। অবশেষে সক্ষম হলাম আমার চিন্তাশক্তির জন্য। ‘অধিকারের জন্য লড়াই করি’ এটা শুনেই আমার বুঝে ফেলা উচিত ছিলো আপনি একজন নেতা। অন্য চার-পাঁচজনের মতো রাজনৈতিক নেতা না,,,,,,,,,,,,ছাত্রদের নেতা….মানুষের নেতা।অ্যা ট্রু কমরেড।’

বিস্মের চরম শিখায় চলে গেলো ফারহান। বৃষ্টিতে সিক্ত এই মেয়েটার কথাগুলো ঝংকারের ন্যায় কর্ণকুহরে বাজছে। আফরার ঠোঁটে স্মিত হাসি। যেন ফারহানকে অবাক করতে পারাটাই ওর জন্য বড় আনন্দের। আফরার এই হাসিতে ফারহানের মাথায় ঝিম ধরে গেলো। পাগল হয়ে যাবে ফারহান ! এই মেয়ে সত্যিই ওকে পাগল বানিয়ে ছাড়বে।
.
.
.
.
#চলবে………..ইনশাআল্লাহ

২০০০ শব্দের পর্ব দিয়েছি আজ। মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে। আমি চাই আপনারা প্রত্যেকেই মন্তব্য করুন যাতে একটু হলেও ব্যাথাটা ভুলিয়ে মন ভালো করতে পারি।
.
.
#চলবে………ইনশাআল্লাহ!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here