অনপেখিত পর্ব ৭

#অনপেখিত
পর্ব ৭
লিখা: Sidratul Muntaz

ফারদিন আছাড় মেরে মেহেককে বিছানায় ফেলে দিল। মেহেক নিজের কোমড় খামচে ধরে বলল,” আহ, এটা কি হলো? আমাকে এভাবে ফেললেন কেন? ব্যথা পেলাম তো।”
ফারদিন উত্তরে কিছু বলল না। নাক-মুখ ফুলিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল। তাকে সুন্দর বলায় কি সে এতো রেগে গেছে? আশ্চর্য, সুন্দরকে সুন্দরও বলা যাবে না? তাহলে কি বলবে মেহেক? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, ” রাগ করেছেন?”
” খেতে যাও। ভাবী ডাইনিংটেবিলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
” তাহলে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন? সরাসরি ডাইনিংটেবিলেই নিয়ে যেতেন।”
” ভাবীর সামনে? লিয়ার সামনে আমি তোমাকে কোলে নিয়ে ডাইনিংটেবিলে যাবো? আমার কোনো মান-সম্মান নেই?”
” ও বাবা, আমি তো আপনার বউ। আমাকে কোলে নিলে আপনার মান-সম্মান যাবে কেন? আর লিয়ার সামনে যে সুজিকে কোলে নিয়েছিলেন। তখন মান-সম্মান যায়নি?”
” তুমি আর সুজি এক না।”
” কেন এক না?”
” জানি না। আর এতো প্রশ্ন করবে না সবসময়। আমার পারসোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি তোমাকে দেইনি।”
ধমক খেয়ে চুপসে গেল মেহেকের মুখ। কিছুটা অভিমানী স্বরে বলল,” আপনি কথায় কথায় এতো ধমকান কেন? আমার আব্বাও কখনও আমাকে এতো ধমকায়নি।”
” তাহলে বাবার কাছে চলে যাও। আমার কাছে থাকতে হলে ধমক খেয়েই থাকতে হবে।”
মেহেক মনে মনে বলল,” খুব চালাক তাই না? আমি আব্বার কাছে চলে গেলে তো আপনারই লাভ। যখন তখন ওই সুজির হালুয়াকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারবেন। আপনাকে আর কেউ কিছু বলতেও আসবে না। কিন্তু আমি এতো বোকা পাত্রী না। যদি আমি আব্বার বাড়ি যাইও আপনাকে নিয়েই যাবো। ”
” আমার আব্বা-আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। চলুন কালকে আমাদের গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।”
” ভাইয়াকে বলে দিবো। অফিসে যাওয়ার আগে তোমাকে তোমার গ্রামে ড্রপ করে দিবে।”
” আপনি যাবেন না?”
” না।”
” কেন?”
” আমার কাজ আছে।”
” কি কাজ?”
” তা দিয়ে তোমার দরকার কি?”
” বলেন না, এমন করেন কেন?”
” কাল আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি।”
” চট্টগ্রাম কেন?”
” আমাদের ছোটবেলার বাগানবাড়িটি দেখতে।”
মেহেকের হঠাৎ করেই মনে হলো ফারদিন সুজিকে নিয়ে কাল চট্টগ্রাম যাবে । এই কথা কেন মনে হলো মেহেক জানে না। সে বলল,” আমিও যেতে চাই।”
” কোথায়?”
” বাগানবাড়ি দেখতে।”
ফারদিন তাচ্ছিল্যের হাসি দিল,
” আমি তোমাকে নিলে তো!”
” নিবেন না?”
” না।”
কাঠখোট্টা স্বরে জবাবটা দিয়ে বারান্দায় চলে গেল ফারদিন। একটা সিগারেট ধরালো। অন্ধকার বারান্দায় মেহেক শুধু দূর থেকে দেখলো একটু টুকরো অগ্নিখন্ডের নড়াচড়া। আর অবাধ ধোঁয়া। সত্যি বলতে, ইদানীং সিগারেটের গন্ধটাও প্রিয় হয়ে উঠেছে মেহেকের। তার বাবাও তো সিগারেট খান। কিন্তু তখন এতো ভালো লাগতো না এই গন্ধ। এখন যতটা লাগে!

ভোরে মেহেক খুব দ্রুত উঠে গেল। বলতে গেলে রাতে তার দুশ্চিন্তায় ঘুমই হয়নি। কখন যেন ফারদিন উঠে চলে যায় সেই ভয় কাজ করেছে। এমন কি শেষরাতে মেহেক একটা স্বপ্নও দেখেছিল। সুজি আর ফারদিন গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়। তার মানে আসলেই সুজি যাচ্ছে তার বরের সাথে। কিন্তু মেহেক বেঁচে থাকতে এটা কিছুতেই হতে দিবে না। সে সকাল সকাল উঠে দাদুর জন্য কফি বানালো। কিভাবে পারফেক্ট কফি বানাতে হয়, আর দাদু কিভাবে খেতে পছন্দ করে সব তিশার থেকে জেনে নিয়েছে সে। দাদুর আরেকটা অতি পছন্দের খাবার হচ্ছে মালাই চমচম। মেহেক সকালে উঠে তিশার সাহায্যে এটাও তৈরী করে ফেলল। দাদুকে ইমপ্রেস করতেই হবে। তিশা একবার জিজ্ঞেস করেছিল,” তোমার মতলবটা কি মেহেক? আজকে সকাল সকাল সব দাদুর পছন্দের জিনিস রান্না করছো?”
মেহেক শুধু হেসেছে। কোনো উত্তর দেয়নি। সে নিজে কতটা প্যারায় আছে সেটা তিশা ভাবীকে বোঝানো সম্ভব না। ট্রেতে সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে মেহেক আরশাদ সাহেবের ঘরে গেল। সকাল সকাল মেহেককে দেখে তিনি বেশ খুশিই হলেন। মেহেক বলল,” গুড মর্ণিং দাদু। আপনার জন্য কফি এনেছি।”
” বাহ, কতদিন পর সকাল সকাল একদম বিছানায় বসে কফি পেলাম। থ্যাঙ্কিউ মেহেক। এইটা কি?”
” আপনার প্রিয় মালাই চমচম। তিশা ভাবীর কাছ থেকে শিখে আমি রান্না করেছি।”
” তাই নাকি? দেখি তো খেয়ে কেমন হলো?”
আরশাদ সাহেব কফির আগে মালাই চমচমের বাটিটাই তুলে নিলেন। মেহেক একটু ভয়ে ছিল। জীবনের প্রথম রান্না কেমন না কেমন হয়েছে। দাদুর পছন্দ হবে তো? কিন্তু তিনি খুব পছন্দ করলেন। মেহেকের এবার একটু ভরসা হলো। সে যেই কাজের জন্য এসেছে সেই কাজটা হয়তো হয়েই যাবে। তাকে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরশাদ সাহেব প্রশ্ন করলেন,” আমাদের এখানে তোমার কেমন লাগছে মেহেক?”
মেহেক নিরস মুখে উত্তর দিল,” জ্বী দাদু। ভালোই।”
আরশাদ সাহেব ভ্রু কুচকে বললেন,” মনখারাপ নাকি?”
মেহেক মাথা নিচু করে ডানপাশের চুলগুলো কানে গুঁজল। তার চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। আরশাদ সাহেব এইবার ব্যাপারটা নিয়ে একটু সিরিয়াস হলেন। খাওয়া- দাওয়া রেখে মেহেককে কাছে ডেকে প্রশ্ন করলেন,” কি হয়েছে বলো তো মেহেক?বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে? গ্রামে যেতে চাও?”
মেহেক খুব দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বলল,” না দাদু। আব্বা-আম্মার সাথে তো রোজই কথা হয়। কিন্তু..”
” কিন্তু কি? নির্দ্বিধায় বলো।”
” উনি কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। ”
” কে?”
” আপনার ছোটনাতি।”
” তাই নাকি? আমি তো জানি না।”
” আমিও কালরাতেই জানতে পেরেছি। আজ সকালেই চলে যাচ্ছেন উনি।”
আরশাদ সাহেব উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন,” তিশা, এই তিশা।”
তিশা ছুটে এলো,” জ্বী দাদাজান?”
” ফারদিন নাকি আজকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে? তুমি জানো এই ব্যাপারে কিছু?”
” হ্যাঁ। ও আমাকে বলেছিল কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যাবে। কিন্তু আজকেই যাবে কি-না সেটা বলেনি।”
” মেহেককে নাকি বলেছে আজকেই যাচ্ছে।”
” তাই? তাহলে হতে পারে দাদাজান। ওর তো কোনোকিছুর ঠিক নেই। যখন যা মনে চায় তাই করে। আপনি তো চেনেন ওকে।”
” তাই বলে এখনও যা মন চায় তাই করবে নাকি? ওর বিয়ে হয়েছে না? নতুন বউকে রেখে একা একা ঘুরতে চলে যাবে এইটা কোনো কথা হলো? মেহেকের তো মনখারাপ হয়ে আছে এজন্য।”
তিশা তাকালো মেহেকের দিকে। এতোক্ষণে বুঝতে পারল সকালে এতো আয়োজনের কারণ। আরশাদ সাহেব হুংকার ছাড়লেন,” ডাকো ফারদিনকে।”
” জ্বী ডাকছি দাদাজান।”
তিশা দ্রুত চলে গেল। একটু পরেই ফারদিন এসে উপস্থিত হলো।
” দাদু ডেকেছো?”
” তুই নাকি আজ চট্টগ্রাম যাচ্ছিস?”
” হ্যাঁ। ওই বাগানবাড়িটা দেখতে যাচ্ছি। আগেই তো যাওয়ার কথা ছিল দাদু।”
” মেহেককেও সাথে নিয়ে যা।”
” মানে? ও আমার সাথে গিয়ে কি করবে?”
” তুই যা করবি মেহেকও সেটাই করবে। বাগানবাড়ি ঘুরে দেখবে!
” কিন্তু দাদু, আমি তো যাচ্ছি আমার কাজে। ”
” বললাম তো মেহেকও যাবে। হয় মেহেককে নিয়ে যাবি নয়তো তুইও যেতে পারবি না। কথা শেষ।”
ফারদিন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মেহেকের দিকে তাকালো। মেহেক ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল। তার এতো ভালো কেন লাগছে? ইশশ, দাদুটা কত্ত ভালো!

নীরবে গাড়ি ড্রাইভ করছে ফারদিন। পাশে বসে আছে মেহেক। কারো মুখে কথা নেই। মেহেক নিজেও কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। কারণ ফারদিনের ভাব-গতিক দেখে মনে হচ্ছে সে ভয়ানক রাগান্বিত। তাই এখন ওর সাথে কথা বলতে গেলে আগুনে ঘি ঢালার মতো ব্যাপার হবে। সেজন্য চুপ থাকাই শ্রেয়। মেহেক মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল। যদিও এভাবে বসে থাকতে তার দমবন্ধ লাগছে। বাচাল প্রকৃতির মেয়েদের এই এক জ্বালা। পৃথিবীর সব কঠিন কাজ তারা করতে পারবে। কিন্তু চুপ করে থাকা? ইম্পসিবল! একটু পরে একটা বিশাল এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামানো হলো। ফারদিন জানালার কাঁচ নামিয়ে হাত বের করে কাউকে ‘হাই’ বলল। মেহেক দেখল সুজি নামের মেয়েটা হাতে লাগেজ ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠছে। অর্থাৎ সুজিও তাদের সঙ্গে যাচ্ছে! মেহেক যা ভেবেছিল তাই হলো। সুজি মেহেকের দিকে ইশারা করে ফারদিনকে বলল,” ও এইখানে কি করছে?”
একই সময় মেহেকও প্রশ্ন করল,” উনি এইখানে কেন?”
ফারদিন উত্তর দেওয়ার আগেই সুজি বলল,” এইটা আমার সিট। তুমি পেছনে যাও।”
” মানে?” মেহেক আশ্চর্য হয়ে গেল এই মেয়ের স্পর্ধা দেখে। তার বরের পাশ থেকে তাকেই উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে? খুব অদ্ভুত মেয়ে তো! মেহেক অসহায়ের দৃষ্টিতে ফারদিনের দিকে তাকালো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here