অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব -১৩

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

তপ্ত দুপুরের তাপদাহে ঘেমেনেয়ে একাকার শরীর। স্যাঁতস্যাঁতে শরীরের সাথে শুভ্র রঙা শার্ট লেপ্টে আছে আষ্টেপৃষ্টে। ক্লান্ত মাহমুদের চোখেমুখে বিরক্তি ঝরে পড়ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখজোড়া মলিন দেখাচ্ছে। গলা বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে ঘামের বিন্দুকণা। চুলের ভাঁজে বার কয়েক আঙ্গুল চালিয়ে পেছন দিকে ঠে*লে দিলো। এদিকওদিক চোখ ঘুরিয়ে রিকশা খুঁজলো। যখন তরী পাশে থাকে, কেবল তখনই সিএনজি নেয়। আশেপাশের মানুষকে খুব পরোয়া করে মেয়েটা। প্রচন্ড সংকোচ তার।
কলেজের কাছাকাছি সেই লাইব্রেরিতে গিয়ে দাঁড়ালো মাহমুদ। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে চোখ রেখে হুমায়ুন আহমেদ ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কয়েকটি বই নিলো। তরী বই পড়তে ভালোবাসে। বইগুলো তার জন্যই নেয়া।

বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। আরও একটা জিনিস কিনলো। রিকশা ডেকে একেবারে বাসার সামনে এসে নামলো। আগামীকালই হলুদ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে বের হবে। গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই তরীর বারান্দায় তাকালো মাহমুদ। চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। মেয়েটা ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। মাহমুদ স্পষ্ট তার লজ্জা টের পাচ্ছে। প্রথমদিকে তরী লজ্জা পেলে মাহমুদের বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হতো ব্যাপারটা। ধীরে ধীরে তা সেটা চূড়ান্ত ভালোলাগায় পরিণত হলো। যেন এই লজ্জা না পেলে তরীকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। কোথাও একটা কমতি থেকে যায়। ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো মাহমুদ। অতঃপর বাসার ভেতরে চলে গেল।

বিকেলেই তরীর ডাক পড়লো তিনতলায়। আয়েশা সুলতানা ডেকেছেন।
-“জামাকাপড় গুছিয়ে নিও তাড়াতাড়ি। আমরা কাল সকালেই বের হবো।”

তরী ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,
-“সকালে উনি কিভাবে যাবেন? ক্লাস আছে না?”

আয়েশা সুলতানা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-“কার কথা বলছো।”

তরীর হুট করেই গরম লাগতে শুরু করলো। সে কখনো সরাসরি মাহমুদের নাম ধরে ডাকেনি। ডাকার প্রয়োজন পড়েনি। নামটি উচ্চারণ করতে তার ভেতর জড়তা কাজ করছে। সংকোচ করে বলল,
-“মানে রামির ভাইয়ার কথা বলছিলাম।”

আয়েশা সুলতানা বেশ শব্দ করে হাসলেন।
-“মাহমুদের কথা বলছো? সে বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়েছে। শুক্র, শনি এমনিতেই সরকারি ছুটি থাকবে।”

-“ওহ।”

তরীর গলার স্বর পেয়ে মাহমুদ ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার বিপরীতে সোফায় বসলো। তরী আড়চোখে মাহমুদকে তাকিয়ে দেখছে। তার বুক ধড়ফড় করেছে। মাহমুদ ব্যাপারটি লক্ষ করেই মিটিমিটি হাসছে। গভীর স্বরে ডাকলো,
-“তরী!”

চমকে উঠলো তরী। চমক কাটতেই লজ্জা পেল সে। কান গরম হয়ে উঠছে। মানুষটি কি দেখে ফেললো সবটা? থতমত খেয়ে জবাব দিলো,
-“জি।”

-“ছাদে যাবেন?”

-“এখন?”

-“হুম। সমস্যা হবে?”

তরী তড়িঘড়ি করে বলল,
-“না না। সমস্যা হতে যাবে কেন?”

মাহমুদ হাসলো। তরী ফের লুকিয়ে দেখলো। হাসলে চমৎকার লাগে মাহমুদকে। তরী মুগ্ধ হয়। তাকিয়ে থাকে অনেকটা সময়। মাহমুদ ঘরের দিকে যেতে যেতেই বলে,
-“ছাদে গেলেও দেখতে পারবেন, তরী। আমি বাঁধা দিচ্ছি না তো।”

তরী চোখমুখ খিঁচে উঠে পড়লো। আয়েশা সুলতানাকে ডেকে বলে গেল,
-“আন্টি আমি যাচ্ছি।”

বাসায় না গিয়ে ছাদে উঠলো তরী। অরু দাঁড়িয়ে ফুল দেখছে। ফুল তার ভীষণ পছন্দের হলেও কখনো ছিঁড়ে ফেলেনা অরু। বরং কেউ যখন গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে, অরু তখন তাকে খুব বকা দেয়।
মাহমুদ আসলো কিছুক্ষণ পর। হাতে একগাদা বই। তরী কৌতুহলী চোখে বইগুলো দেখছে। মাহমুদ তরীর দিকে বই বাড়িয়ে দিলো,
-“এগুলো আপনার জন্য।”

তরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমার জন্য? এতগুলো বই?”

মাহমুদ মৃদু হাসলো।
তরীর ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি। কৃতজ্ঞতা সূচক হেসে বলল,
-“ধন্যবাদ।”

মাহমুদ রুষ্ট হলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
-“ধন্যবাদ দেওয়া আমার পছন্দ হয়নি, তরী।”

তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মাহমুদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে মেয়েটির মায়া মায়া চেহারা। এই যে তার দিকে টানাটানা চোখে তাকিয়ে আছে? লুকিয়েচুরিয়ে তাকে দেখে? মাহমুদের ভীষণ ভালোলাগে। একটু কাছে ঝুঁকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
-“নিজের মানুষকে কখনো ধন্যবাদ দিতে নেই, তরী।”

তরীর হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগলো। দাঁড়িয়ে থাকা ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে মনে বার দুয়েক আওড়ালো “নিজের মানুষ!”
তরী টের পেলো সে সত্যিই প্রেমে পড়েছে। আকাশ-পাতাল এক করা প্রেম। অবাধ্য হলো মন। বুক কেঁপে কেঁপে উঠলো। হুট করেই তার কেমন কান্না পাচ্ছে। এমনিতেও সে ভীষণ আবেগি একটি মেয়ে। এখন যেন আরও আবেগি হয়ে পড়ছে। খুশিতে নাকি দুঃখে বুঝতে পারছেনা। কেন সে প্রেমে পড়তে গেল? সে তো প্রেম নামক আজব জিনিসকে নিমন্ত্রণ জানায়নি! তবুও দিন শেষে সে তলিয়ে গেল। সমু্দ্রের জলের মতো জোয়ার-ভাটা হলো বুকের ভেতর।
মাহমুদ অপলক অশান্ত মেয়েটিকে দেখছে। হাত বাড়িয়ে কানের পাশের চুল সরিয়ে দিতেই তরী থমকে গেল। হৃৎপিণ্ড যেন তার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর।

অরু সেই কখন থেকেই ফুল দেখা বাদ দিয়ে কোমরে হাত রেখে ধারালো নজরে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। চোখ পিটপিট করে বলে উঠলো,
-“তোমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে প্রেম করছো?”

তরী ভয়ে সিটকে গেল দু-কদম। চোখেমুখে রাজ্যের ভয়। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একবার অরু আর একবার মাহমুদকে দেখছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার। অথচ মানুষটি কতটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি। চোখেমুখে আতঙ্কের চিহ্নটুকু নেই। অরু চোখের নজর আরেকটু তীক্ষ্ণ করে গম্ভীর স্বরে কথা বলার চেষ্টা করলো। শাসনের সুরে বলল,
-“কী হলো? কথা বলছো না কেন? তোমরা কি প্রেম করছিলে? এত বড় সাহস তোমাদের!”

মাহমুদ মিটিমিটি হেসে বলল,
-“তোমার কেন মনে হলো আমরা প্রেম করছি?”

অরু গাল ফুলিয়ে বলল,
-“আমিতো কার্টুনে দেখেছি। রাজকুমার রাজকুমারীর পাশে এসে দাঁড়ালেই তাদের প্রেম হয়ে যায়।”

মাহমুদ ঠোঁট টিপে হাসলো। অরুর মতোই ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
-“আমাদের দেখে কি রাজকুমার আর রাজকুমারী মনে হচ্ছে?”

অরু দুপাশে মাথা দুলিয়ে জানালো,
-“না তো। তোমাদের তো মানুষের মতো লাগছে।”

-“এক্সাক্টলি, তাহলে তুমিই বলো আমরা কি প্রেম করছিলাম?”

অরু এবারও মাথা নেড়ে না জানালো।
মাহমুদ একটা ফুল ছিঁড়ে অরুর কানে গুঁজে দিতেই অরু চিৎকার করে উঠলো। এক মুহুর্তের জন্য মাহমুদ আতঙ্কিত চোখে তাকালো। অরু কানের পাশ থেকে ফুল নিয়েই গাল ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো।
-“তুমি পঁচা। একটুও ভালো না। আমাকে বুড়োর সাথে বিয়ে দিতে চাও আবার আমার ফুল ছিঁড়ে ফেলো। একদম তোমার সাথে কথা বলবোনা। আমি বাবাকে বলে দেবো তোমাদের যেন বাসা থেকে বের করে দেয়।”

মাহমুদ হতবিহ্বল হয়ে গেল। একটা ফুল ছেঁড়াতে অরু এভাবে রিয়েক্ট করবে জানলে কখনোই ছিঁড়তোনা। মাহমুদ অরুকে কোলে তুলে নিলো। তাকে শান্ত করতেই আদুরে গলায় বলল,
-“সরি অরু! একহাতে কান ধরেছি দেখো। আমি তোমায় অনেকগুলো ফুলগাছ কিনে দেবো ঠিক আছে?”

অরু কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। মাহমুদের কথা না শুনেই বলল,
-“তোমাকে পাগল নজরুলের কাছে দিয়ে আসবো। সে তোমাকে খামছি দিয়ে ব্যথা দেবে। তুমি আমার ফুল ছিঁড়েছ কেন? আমি কষ্ট পেয়েছিনা!”

-“আমার অরুপাখি খুব কষ্ট পেয়েছে, তাইনা?
সরি তো! আর ফুল ছিঁড়বো না। কথা দিলাম।”

তরী ওদের দুজনকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। মাহমুদ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
-“খুব হাসি পাচ্ছে, তাইনা? ছোটো বোনকে সামলাতে এত কষ্ট, বড়োটাকে কিভাবে সামলাবো আমি?”

লজ্জায় আরক্তিম হলো গাল দুটো। তরী আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালোনা। বই নিয়ে দ্রুত কে*টে পড়লো। লোকটি তাকে লজ্জা দিতে ওস্তাদ। সে কি জ্বালায় নাকি মাহমুদকে?
অরুকে থামাতে না পেরে তাকে নিয়ে দোকানের দিকে রওনা হলো মাহমুদ। আপাতত চিপস-চকলেট দিয়েই শান্ত করতে হবে।

★★★

সকলেই তৈরি। আয়েশা সুলতানা তরীকে ডাকতে উপরে এলেন। মিঠু আগেই নেমে পড়েছে। বাবা তরীর সাথে সাথে নিচে নেমে এলো। মাহমুদ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলো এবার একটা গাড়ি কিনতে হবে।
তরীকে বসিয়ে দিয়ে বাবা বারবার করে আয়েশা সুলতানাকে বলে দিলেন,
-“আপনাদের কথা ফেলতে না পেরে ছেলেমেয়ে দুটোকে দিয়েছি। আপনার কাছে আমানত রাখলাম দুজনকে। আমার মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখবেন। বিয়ে বাড়িতে অনেক ছেলেপেলে থাকে।”

আয়েশা সুলতানা আশ্বস্ত করলেন।
-“আপনি চিন্তা করবেন না। তরীকে আমি নিজের মেয়ের মতো জানি। মায়ের সাথে মেয়ে নিরাপদ থাকবে।”

তরীর মা’ও তরীকে বলে দিলেন,
-“সবার সাথে সাথে থাকবি। পৌঁছে গিয়েই কল দিয়ে জানিয়ে দিবি।”

তরী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
-“আসছি বাবা।”

অরু কান্না করছিল যাওয়ার জন্য। ছোটো বলেই তাকে বাবা-মা যেতে দিলেন না। আয়েশা সুলতানা অনেকবার বলেছেন,
-“অরুকেও আমাদের সাথে দিন।”

তরীর বাবা-মা দিলেন না। মা বললেন,
-“ছোটো মানুষ। রাতে কান্নাকাটি করে বিরক্ত করবে সবাইকে।”

হাইওয়ে ধরে গাড়ি চললো শাঁইশাঁই করে। জানালার পাশে বসা তরীর চুল উড়ছে অবিন্যস্তভাবে। চোখেমুখে মুগ্ধতা। বাইরের পরিবেশ বেশ এনজয় করছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। মাহমুদ লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে কেবল তরীকেই দেখে গেল। আজ রামির চোখে একটা বিষয়ে সন্দেহ তৈরি হলো। ভাইয়া সেই প্রথম থেকেই তরী আপুকে দেখে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। কেমন অশান্ত, উন্মাদনা সেই দৃষ্টি।

#চলবে…….

(গত পর্বের রেসপন্স দেখে আমি হতাশ। লিখা কি আপনাদের ভালোলাগছে না? মনে হচ্ছে লিখা খা*রা*প হচ্ছে বলেই আমি পাঠক ধরে রাখতে পারছিনা। একটা গল্পে রেসপন্স কম হোক বা বেশি, শুরুতে যতজন পাঠক থাকে তাদের শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে না পারা লেখকের ব্যর্থতা। আমার মনে হয় আমার লিখার মান প্রচন্ড খা*রা*প হয়ে যাচ্ছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here