অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -০৮

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ৮

(১৮)

***
—-আপু, আমাকে বার্গার কিনে দে না একটা?

ইশরাতের কন্ঠ কানে গেলেও সেদিকে মনোযোগ দিতে পারছে না মিশরাত। কারণ সে এখন তার চোখের সামনে যাকে দেখতে পাচ্ছে তাকে দেখতেই মগ্ন। কালো রঙের স্যুট পরে আছে মানুষটা। চোখে একটা কালো সানগ্লাস। মুখে মৃদু হাসি বজায় রেখে একটা লোকের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সেদিকে তাকিয়ে দেখার মতো কিছুই নেই। তবে মিশরাতের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এখন তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই হলো এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকা। ফর্সা গায়ের রঙ কালো স্যুট এর সাথে দারুণ মানিয়েছে। পুরো মুখ জুড়ে চাপা দাড়ি। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বোঝাচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে।

—-আপু, দে না একটা বার্গার? খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

—-আমারও খুব খেতে ইচ্ছে করছে৷ কিন্তু আস্ত মানুষ খায় কীভাবে?

ছোট্ট ইশরাত যেন মিশরাতের প্রত্যুত্তর শুনে ভড়কে গেল।

—-আপু, আমি বার্গার খাবো বলেছি। মানুষ খাবো বলিনি। আর আমি মানুষ খাবোই বা কেন? আমি কী রাক্ষসী নাকি?

মিশরাত দেখতে পেল কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে লোকটি থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল মানুষটা। হ্যাঁ, সেই মানুষ, যে সবসময় মিশরাতের দোয়ায় সামিল থাকে। যাকে পাওয়ার জন্য মিশরাত না জানি কতোবার প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে। প্রতিবার প্রতিটি মোনাজাতে আল্লাহর কাছে এই মানুষটিকে চায় সে। আর সে আশাবাদী, তার এই চাওয়া একদিন না একদিন পূর্ণ হবেই। তবে চাওয়া পাওয়ার এই হিসেব শুধু মিশরাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার অনুভূতি সম্পর্কে কেউ-ই অবগত নয়।

মানুষটি আরিয়ান। আরিয়ান চলে যাওয়ার পর মিশরাতের হুঁশ ফেরে৷ এতোক্ষণ যাবত কী উল্টোপাল্টা কথা বলেছে সে ইশরাতকে, এখন সেটা বুঝতে পারছে।

—-তুই বার্গারের কথা বলছিলি?

—-তোর এটা বুঝতে এতোক্ষণ লাগলো?

—-হ্যাঁ? না, বুঝেছি তো। আবার একটু নিশ্চিত হলাম আর কী।

মিশরাত ইশরাতের জন্য বার্গার কিনতে বের হওয়ার সময় গেইট পার হয়েই মুখোমুখি হলো আরিয়ানের। আরিয়ান তাদের বাসায়ই আসছিলো যেটা মিশরাত জানতে না। ধুর! একটু সেজেগুজে বের হলেই তো হতো। কেন সাজলো না মিশরাত? নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে এখন তার। অথচ দোষ নেই একটুও।

—-আংকেল বাসায় আছেন?

এই ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিমা পর্যন্ত মিশরাতের কাছে অন্যরকম লাগে। এতো সুন্দর করে কেউ কথা বলে? কাউকে কথা বললে আসলেই এতো সুন্দর লাগে? নাকি শুধু আরিয়ানকেই লাগছে? মিশরাতের চোখের সামনে তুড়ি বাজালো আরিয়ান

—-হ্যালো? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো আমি। তোমার আব্বু বাসায় আছেন?

—-না।

আরিয়ান মিশরাতের উত্তর পেয়ে ফিরে যেতে নিলো তখনই পেছন থেকে ডেকে উঠলো মিশরাত।

—-আব্বু না থাকলে বাসায় আসা যায় না? সবসময় কী কাজের জন্যই আসতে হবে? আব্বু ছাড়া তো আমরা সবাই আছি।

—-এতো রিল্যাক্স লাইফ লিড করার কপাল কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। কাজ করতে হবে। তবেই নাম, অর্থ, যশ সব আসবে। ঘরে বসে শুধু হাওয়া খেলে এসব কিছুই নিজ থেকে হেঁটে হেঁটে আসে না।

আরিয়ান আর কালক্ষেপণ না করে চলে গেল। গাল ফুলিয়ে বাম দিকের ভ্রূ উঁচু করে আরিয়ানকে ব্যাঙ্গ করে মিশরাত বললো

—-ঘরে বসে হাওয়া খেলে চলে না। হুহ্! আসছে আমার কর্মঠ পুরুষ! এ কী মানুষ নাকি রোবট হ্যাঁ? একটু আশেপাশেও তো তাকায় না।

—-ও আপু? এখনো যাসনি?

মাথা উঁচু করে মিশরাত দেখলো ইশরাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। তার দিকে বললে ভুল হবে। তার হাতের দিকে তাকিয়ে। আহারে বার্গার!

(১৯)

—-বুঝলে রেণু, আমার কাজের চাপ ইদানীং বেশি পড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় আমি কয়েকটা দিন রাতে আর বাসায় ফিরতে পারবো না।

প্লেটে এক টুকরো মাছ তুলে দিতে দিতে শোয়েব রহমানকে রেণু আক্তার প্রশ্ন করে বসলেন

—-কেন? কোম্পানি তো খুব বেশি দূরে না। ঘন্টা দুয়েক এর রাস্তা। তার জন্য বাসায় না এসে থাকবে কেন?

—-বুঝতে পারছো না। অতিরিক্ত চাপ পড়েছে কাজের। অনেক হিসেবে গন্ডগোল তৈরি হচ্ছে। এর পেছনের কারণটা ঠিক বুঝতে পারছি না। টাকা পয়সার ইদানীং মিল পাওয়া যাচ্ছে না।

—-তুমি তোফায়েল ভাইকে জানাওনি এই ব্যাপারে কিছু? বা আরিয়ানকে?

—-আরিয়ানকে বলেছিলাম। সে বললো আমার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে। কিন্তু আজকে এলো না কেন বুঝলাম না।

শোয়েব রহমান, মিশরাত আর ইশরাত একসাথে রাতের খাবার খেতে বসেছে। রেণু আক্তার পরিবেশন করছেন। শোয়েব রহমানের কথা শুনে মিশরাতের মনে পড়লো আজকে তো আরিয়ান তার কাছে তার আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করেছিলো।

—-আব্বু, আরিয়ান হক এসেছিলো তো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো আমাকে।

—-তাই নাকি? কখন এসেছিলো আম্মু?

—-এইতো আজকে বিকেলের দিকে।

—-কই এসেছিলো? আমি তো বাসায় ছিলাম। দেখলাম না তো?

—-আম্মু, গেইটের সামনে থেকে চলে গিয়েছে আবার। আমি যখন বলেছি আব্বু বাসায় নেই, তখন সাথে সাথেই চলে গিয়েছে।

—-তো তুই একটু বাসায় আসতে বলবি না? ভদ্রতার খাতিরেও তো মানুষ এসব জিজ্ঞেস করে।

—-বলেছিলাম তো আম্মু। কিন্তু দাঁড়ায়নি। চলে গিয়েছে।

—-আরিয়ান ছেলেটা খুব কাজপাগল ছেলে রেণু। সে অযথা সময় একেবারেই নষ্ট করে না। প্রতিটা মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করতে জানে। তাছাড়া তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে।

লাজুক হাসলো মিশরাত। শোয়েব রহমানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো

—-একটাবার মুখ ফুটে বলো না আব্বু, যে ওই ছেলেকে তোমার মেয়ের জামাই হিসেবে ব্যাপক পছন্দ হয়েছে?

—-কী ব্যাপার মিশু? তুই একা একা হাসছিস কেন? এখানে আমরা হাসির কিছু বলেছি?

মুখের হাসি উবে গিয়ে বোকাসোকা মুখ করে তাকিয়ে রইলো মিশরাত তার আম্মুর দিকে।

—-আসলে আম্মু, আজকে কলেজে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সেটাই মনে পড়েছে। খুব হাসির ঘটনা। তাই একটু হাসলাম আর কী।

—-আম্মু, পড়াশোনা ভালো করে করিস। তোকে নিয়ে কিন্তু আমার অনেক স্বপ্ন!

মিশরাত কিছু বলতে নেবে তার আগেই শোয়েব রহমানের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে উনি তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করলেন।

—-হ্যাঁ, আরিয়ান আব্বু, বলো।

—-আসসালামু আলাইকুম আংকেল। একটু বিরক্ত করলাম।

—-না, না আব্বু। বলো। আজকে তো তোমার আমার সাথে কথা বলার ছিলো।

—-জি আংকেল। আমি আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। আপনি নেই দেখে চলে এসেছি। পরে আবার আরও কিছু কাজে আটকে গিয়েছিলাম। তাই আর কথা বলা হয়নি। আংকেল, জয়নাল আমাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন দিলো। বললো আমাদের কোম্পানির একাউন্ট থেকে নাকি আরও তিন লক্ষ টাকা আজকে উধাও হয়েছে।

—-কী বলো এগুলো! টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে এভাবে!

—-আমিও বুঝতে পারছি না আংকেল। আমাদের কোম্পানির একাউন্ট নাম্বার তো আব্বু, আমি, আপনি আর জয়নাল ছাড়া কেউ জানে না। জয়নালকে আমি একাধিকবার একাধিকভাবে জিজ্ঞেস করেছি সে কিছু জানে কিনা কিংবা টাকা সরানোর পেছনে কোনো হাত আছে কিনা তার। সে প্রত্যেকবার না করে গিয়েছে। আমি তার পেছনে ছোটখাটো তদন্তও করেছি বলতে পারেন। কিন্তু কোনো প্রমাণ পাইনি টাকা হাতানোর। বুঝতে পারছি না কিছু। আমাদের গোপন তথ্য কী তবে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে? কিন্তু এসব করবে টাই বা কে?

—-আব্বু, আমি তো কিছু করিনি।

—-ছিঃ ছিঃ! আমি আপনাকে একটুও সন্দেহ করছি না আংকেল। আপনি আমাদের কোম্পানির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আছেন। আমাদের খারাপ সময়েও নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছেন কোম্পানিকে আগলে রাখার। আমি আপনাকে কখনোই সন্দেহ করতে পারি না আংকেল। কিন্তু প্রশ্ন তো এটাই যে আমাদের গোপন তথ্য ফাঁস হচ্ছে কীভাবে? করছে টা কে এসব? আপনি কী কাউকে সন্দেহ করতে পারেন আংকেল?

—-না আব্বু, না জেনেশুনে কাউকে সন্দেহ করা বা দোষারোপ করাটাও পাপ। আমি এজন্যই তোমার আন্টিকে একটু আগে বললাম যে এখন থেকে আমি কোম্পানি ছেড়ে কোথাও যাবো না।

—-বুঝতে পারলাম না আপনার কথা?

—-আমি এখন রাতেও কোম্পানিতেই থাকবো। সেখানেই খাওয়াদাওয়ার সাথে সাথে ঘুমের ব্যবস্থাও করে নেবো। আমার ধারণা এখন যা হচ্ছে সব রাতের অন্ধকারে হচ্ছে। দিনের বেলায় আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব কেউ করার সাহস পাবে বলে আমার মনে হয় না। আমি রাতে সেখানে থাকলে এই ব্যাপারটার উপর নজর রাখতে পারবো।

—-কিন্তু আংকেল, আপনারও তো পরিবার আছে। তারা আপনার থেকে কিছু সময় চায়। এভাবে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আপনি কোম্পানি আঁকড়ে বসে থাকবেন?

—–তোমাদের কোম্পানিতে আমি শুধু টাকার জন্য কাজ করি না আব্বু। এই কোম্পানির প্রতি আমারও একটা টান জন্মে গিয়েছে। কোম্পানির কোনো ক্ষতি হওয়া মানে মনে হয় যে নিজের ক্ষতি হওয়া। আর তাছাড়া তুমি তো আমার বাসার পাশেই থাকো। তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতো ভাবি। তোমাকে আমি ভরসা করি। যদি খুব বেশি কোনো সমস্যা হয়,তাহলে তুমি এটা সামলে নেবে আমার বিশ্বাস।

—-আংকেল, আমিও তো কাজের জন্য সারাদিন বাসার বাইরে থাকি। রাত ছাড়া তো আমার বাসায় থাকা হয় না। আমি যদি আপনার বিশ্বাস রাখতে না পারি?

—-সমস্যা নাই আব্বু। রাত-বিরেতে সমস্যা হলে সেটা বেশি কষ্টকর সামাল দেওয়া। তুমি তখন একটু পাশে থাকলেই চলবে যদি আমার মেয়েদের বা তোমার আন্টির কোনো সমস্যা হয়।

(২০)

বিগত দু’দিন ধরে শোয়েব রহমান আর বাসায় থাকছেন না রাতে। তাই প্রতি রাতে নিয়ম করে আরিয়ান নিজের থেকেই একবার করে ফোন দেয় রেণু আক্তারকে। কোনো সমস্যা আছে কিনা বা কোনো কিছু লাগবে কিনা। আজকে রাতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে আরিয়ান যখন ফোন দিয়েছে তখন ওয়াশরুমে ছিলেন রেণু আক্তার। তাই ফোন মিশরাত রিসিভ করলো

—-হ্যালো?

—-আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

—-এই আপনি কী বয়রা?

—-হ্যাঁ। হ্যাঁ? কী? কে?

—-আরে ধুর! দু’দিন ধরে আম্মুর সাথে কথা বলে আসছেন। এখনো কী তার কন্ঠ চিনতে পারলেন না? আমার কন্ঠ কী শুনতে আম্মুর মতো নাকি? কতো বাচ্চা বাচ্চা কিউট একটা কণ্ঠ। শুনলেই তো যে কোনো কারোর মন ভালো হয়ে যায়!

—-আন্টি আসলে বলে দিও আমি ফোন দিয়েছিলাম। আর কোনো প্রয়োজন হলে যাতে নির্দ্বিধায় আমাকে জানায়।

—-কোনো সমস্যা নেই। এখন আসুন আমরা কিছুক্ষণ কথা বলি। আজকে কলেজে কী হয়েছে জানেন? একটা বড়সড় সাপ মাঠে চলে এসেছিলো। তারপর…

মিশরাতের কানে অপর পাশ থেকে টুট টুট শব্দ এলো। বুঝতে পারলো আরিয়ান ফোন কেটে দিয়েছে। ঠোঁট উল্টে ফোনের দিকে তাকিয়ে টেবিলের উপর ফোন রেখে পাশে ফিরে দেখলো ইশরাত তার দিকে তাকিয়ে আছে।

—-তোর কলেজের মাঠে সাপ এসেছে সেটা আমাকে বললি না কেন?

—-তুই ছোট মানুষ। ভয় পেয়ে যাবি শুনলে। এখন ঘুমা তো!

ইশরাতকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো মিশরাত। আগামীকাল সে প্রথম বারের মতো আরিয়ানের কাছে তার মনের কথা বলবে বলে ঠিক করে রেখেছে।

***

আজানের শব্দ কানে আসায় অতীত থেকে ফিরে আসলো মিশরাত। ভোর হয়ে গিয়েছে। পুরো নির্ঘুম রাত কাটলো। ভাগ্যিস কালকে শনিবার। তাই তার কাজে যাওয়া লাগবে না। নয়তো মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হতো।

অজু করে নামাজ পড়ে নিলো মিশরাত। এরপর বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। দু-তিন ঘণ্টা অন্ততপক্ষে ঘুমোতে হবে। নয়তো শরীর খারাপ করবে।

(২১)

চিৎকার চেঁচামেচিতে মিশরাতের ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে চোখ কচলে উঠে রুমে থাকা ঘড়ির দিকে চোখ গেল তার। দশটা বেজে চল্লিশ মিনিট। প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। আর সে এখনো ঘুমাচ্ছিলো! তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হলো মিশরাত।

দেখতে পেল রেণু আক্তার ইশরাতকে কী কী বলে চলেছেন গলা উঁচিয়ে। ইশরাতও ছাড় দিচ্ছে না। দু’জনের গলার স্বর এখন এতটা উঁচু যে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ব্যক্তিও বোধহয় উঠে যাবে। মিশরাত কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কথা কাটাকাটি শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু প্রায় মিনিট চারের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন বুঝলো যে এই ঝগড়া এতো সহজে থামবে না, তখন সে জোরে এক চিৎকার দিয়ে বললো

—-ঝগড়া বন্ধ করো প্লিইইইজ!

মনে হলো কথাটা বলে কাজে দিয়েছে। আসলেই তারা দু’জন চুপ হয়েছে।

—-আম্মু, এসব কী শুরু করে দিয়েছো বলো তো? পাশের বাসায় অন্য আরও মানুষ থাকে না? তারা কী বলবে, কী ভাববে আমাদের নিয়ে সেটা ভেবে দেখেছো?

—-এসব কথা আমাকে না বলে তোর বোনকে বল।

—-আম্মু, এখন আমার দোষ দেবে না বলেছি। তুমি ঘুম থেকে উঠার পরেই তো বললে আমার ট্যুরে যাওয়া ক্যান্সেল। কী হলো? বলোনি বলো?

—-হ্যাঁ বলেছি। তো?

—-তো মানে? তুমি গতকাল রাত পর্যন্ত রাজি ছিলে। আর আজকে ঘুম থেকে উঠে বলছো “না”?

—-তোর আব্বুকে বলবো ছুটি ম্যানেজ করে আনতে। আমি, তোর আব্বু, তুই আর মিশু আমরা চারজন মিলে ঘুরতে যাবো। ঠিক আছে? হলো তো তোর ট্যুর?

—-ফ্যামিলি ট্যুর আর ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুর এর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। তুমি বুঝবে না এসব।

—-না, সে কেন বুঝবো। সব তো তুই-ই বুঝিস। শোন, আমি তোর মা। তোর থেকে বেশি বুঝি বলেই বলছি তোর যাওয়া হবে না। যখন আরেকটু বড় হবি তখন না হয় যাবি। এইতো ভার্সিটি হোক বা অন্য কোথাও, তখনও তো ট্যুরে নিয়ে যায়। তখন যাবি। আরও তিন-চার বছর পর। এখন না।

—-কেন? এখন আমি কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে যাবো? তোমার সাদমান বলেছে তাই?

—-সাদমান বলুক, আর যেই বলুক। তোর যাওয়া বন্ধ। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোর আব্বুকে ফোন দেবো বললাম!

রেণু আক্তার হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। ঠোঁট বাঁকিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে ইশরাত। মনে হচ্ছে এখনই কান্না করে দেবে। তাড়াতাড়ি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মিশরাত।

—-এই ইশু, কাঁদছিস নাকি তুই?

—–ও আপু, প্লিজ রাজি করা না আম্মুকে? আমি সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছি। কোন ড্রেসের সাথে কী পড়বো সেটাও। না যেতে পারলে আমার খুব কষ্ট হবে রে আপু। তুই না আমার কষ্ট বুঝিস? বোঝা না একটু আম্মুকে?

—-আম্মু তো রাজি ছিলো। শুধু বলেছিলো সাদমানের সাথে তোকে যেতে হবে। বুঝতে পারলাম না, এখন কী সাদমানকেও আম্মু বিশ্বাস করতে পারছে না?

মুহুর্তের মধ্যেই যেন দপ করে জ্বলে উঠলো ইশরাত।

—-বুঝেছি আপু। আম্মুর হুট করেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার কারণ বুঝতে পেরেছি আমি।

—-কী কারণ?

—-সাদমান হাসান। গতকাল রাতে ও আমাকে বললো সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। তার মানে এই জিনিসটার অপেক্ষা করতে বলছিলো। নিশ্চয়ই আমার আম্মুটাকে উল্টোপাল্টা কিছু বুঝিয়েছে। নয়তো আম্মু এতোটা পাষাণ হতে পারতো না। আমার কোনো কথাই শুনতে চাইছে না। এখন কী করবো আপু?

—-তুই কী করতে চাস?

—-খুবই সহজ আমার চাওয়া। শুধু ট্যুরে যেতে চাই।

—-একা?

—-অবশ্যই।

—-তাহলে ট্যুরে যাওয়ার কথা ভুলে যা। তুই একা যেতে চাইলে শুধু আম্মু কেন, আমিও রাজি না। যদি পারিস সাদমানের সাথে যাবি, নয়তো না।

—-আপু! তুইও সাদমান হাসানের পক্ষ নিচ্ছিস!

—-আমি কারোর পক্ষ নিচ্ছি না। কামরুলের ব্যাপারটা না থাকলে আমি তোকে একা যাওয়ার কথাই বলতাম। কিন্তু এখন আমার সাহস হচ্ছে না তোকে একা ছাড়তে।

—-আপু, আমি একেবারে লক্ষী একটা মেয়ের মতো থাকবো সেখানে।

—-তুই কীভাবে থাকবি না থাকবি সেটা আমার জানার বিষয় না। যেহেতু তোর মনে হচ্ছে যে সাদমান আম্মুকে কিছু একটা বলেছে, তাহলে তুই সরাসরি সাদমানের সাথে কথা বলে সবকিছু মিটমাট করে নে। এদিকে আমি কিছু বলবো না।

ইশরাতের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে মিশরাত চলে গেল। সাদমানের নাম্বারে ডায়াল করে দিয়েছে মিশরাত। রিং হচ্ছে। উপায়ান্তর না দেখে এখন সাদমানের সাথে কথা বলতেই বাধ্য হলো ইশরাত।

—-গুড মর্নিং! বলো মিশরাত।

—-আমার সকাল টা পুরো নষ্ট করে দিয়ে এখন আপনি মর্নিং বলতে আসছেন?

—-এই তুমি ফোন ধরার সাথে সাথেই ঝগড়া শুরু করে দাও কেন? যার কপালে গিয়ে পড়বে তার তো বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। মানে মানুষ শুরুতে তো একটু স্বাভাবিক স্বরে কথা বলে। এরপর না হয় ত্যাড়া কথা বলে। আর তুমি তো শুরুই করো ত্যাড়া কথা দিয়ে। কোত্থেকে যে আসে এসব ঝগড়ুটে মেয়ে সকল!

—-ওই! আপনি ঝগড়া নিয়ে পড়েছেন? আর এদিকে যে নিজের বাসায় বসে বসে আমার ভোলা ভালা আম্মুর কানে কীসব কুবুদ্ধি ঢুকিয়ে আমার সর্বনাশ করছেন, সেটা?

—-আমি কুবুদ্ধি দেই না। আন্টি আমার থেকে যেচে পরামর্শ চায়। কারণ আন্টি বুঝতে পেরেছেন আমি সবসময় সঠিক পরামর্শ দেই। উনি আমার বুদ্ধির উপর কোনো সন্দেহ রাখেন না।

—-নিজের প্রশংসা নিজে পরে করবেন। আমি ভালোয় ভালোয় বলছি, আম্মুকে কী বলেছেন জানি না। তবে কথা ফিরিয়ে নিন।

—-কাউকে কোনো ব্যাপারে রাজি করাতে হলে, মানুষ তার মন গলানোর জন্য, তাকে খুশি করার জন্য চেষ্টা করে। আর এই এক উদ্ভট প্রাণী দেখছি, যে কিনা হুমকি ধমকি দিয়ে কাউকে রাজি করাচ্ছে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য।

—-তো? আপনি কী আশা করছেন আপনার পিছনে পিছনে আবার ঘুরবো আমি? আপনার পায়ে পড়ে থাকতে হবে? এরকম আমি কখনো করবো না।

—-ঠিক আছে, করো না। আমার কী? ট্যুরে তুমি যেতে পারবে না। আমার তো আর কিছু না।

ফোন কেটে দিলো সাদমান। মুখ ফুলিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে ইশরাত। আপনমনে ভাবতে লাগলো ছেলেটা এখন চাচ্ছে টা কী?

চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here