অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -১৪

#অনুভূতির_অন্বেষন
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১৪

(৪৩)

জানালার কাঁচ ভেদ করে আলো এসে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রুমে। সকাল হয়ে গিয়েছে সেটারই জানান দিচ্ছে প্রকৃতি।

চোখে আলো এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল সাদমানের। চোখ খোলার আগেই বুঝতে পারলো তার বুকের উপর কিছু একটা আছে। তৎক্ষনাৎ ব্যাপারটা বোধগম্য না হলেও চোখ খুলে সেদিকে তাকাতেই সবটা মনে পড়ে গেল তার। সেই সাথে মুখে ফুটে উঠলো এক স্নিগ্ধ হাসি। তার পিচ্চিটা এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তার বুকে মাথা রেখে। ছোট ছোট কিছু চুল মুখের সামনে এসে পড়ে রয়েছে। সেগুলো দিয়ে মুখটা অনেকটা ঢাকা। মুচকি হাসলো সাদমান। গতকাল রাতের কথা অনেকটাই তার মনে আছে। জ্বর কমে গিয়েছিলো অনেক আগেই। আর এরপর থেকে সে কী বলেছে বা করেছে তার সবটাই এখন মাথায় আছে তার। গতকাল রাতের কথা ভাবতে ভাবতেই ইশরাতের মাথায় হাত রাখলো সে। প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ইশরাতের। এরপর মুখের সামনে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো সরিয়ে কানে গুঁজে দিলো। এতোকিছু হয়ে যাচ্ছে অথচ এখনো ইশরাতের ঘুম ভাঙেনি।

ঘাড় ফিরিয়ে ঘড়িতে তাকিয়ে সাদমান দেখলো এখন সকাল সাতটা বেজে যাচ্ছে প্রায়। খুব বেশি একটা সময় তার হাতে নেই শুয়ে থাকার জন্য। আজকে একদমই ইচ্ছে করছে না তার অফিসে যেতে। তবে যেতে তো হবেই। নতুন প্রজেক্টের কাজ নিয়ে বস সবচেয়ে বেশি সাদমানের উপরই নির্ভরশীল। তাছাড়া কাজটা ঠিকঠাকমতো করতে পারলে প্রমোশনের সাথে সাথে স্যালারিও মোটা অঙ্কের ঘরে পৌঁছে যাবে। হিসেব করে সাদমান দেখলো আর মিনিট পঁচিশের মতো শুয়ে থাকতে পারবে সে। সে এতোটুকু সময় বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে নিতো অবশ্যই। তবে সেটা যদি একা থাকতো। ইশরাতকে এখান থেকে সরানো প্রয়োজন। এভাবে এই অবস্থায় দু’জনকে একসাথে দেখলো খোদ তার মা বাবাই উল্টোপাল্টা ভাববে। তবে সাদমান তো সাদমানই। নিজে জোর করে ইশরাতকে এনে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে সারা রাত, এটা তো সে অবশ্যই স্বীকার করবে না। তাই তো কিছুটা উচ্চস্বরে এবং ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো

—-এই, এভাবে আমার উপর শুয়ে মরার মতো ঘুমোচ্ছ কেন? বিছানা নেই তোমার?

কথাটা কানে যেতেই একটু নড়েচড়ে উঠলো ইশরাত। টিপ টিপ করে চোখের পাতা মেললো। ছোট ছোট চোখ করে সাদমানের দিকে তাকালো। এরপর ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো

—-কী হয়েছে?

—-কী হয়েছে? একটু নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো তো কী অবস্থায় আমার উপর শুয়ে আছো? এভাবে কেউ শোয় নাকী? আরে বাবা আমিও তো মানুষ। এভাবে ঝাপটি মেরে বুকের উপর শুয়ে থাকলে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ছাড়তেই তো কষ্ট হয়। ভাগ্য ভালো এখনো জীবিত আছি!

চোখ ডলতে ডলতে ইশরাত উঠে বসলো।

—-জানতাম। ঠিক জানতাম আমি যে সকালে উঠে আমাকে ঠিক এরকম একটা দৃশ্য দেখতে হবে। এরকম কথা শুনতে হবে। এটাই তো করে আসছেন। সবসময় আমাকে বকাঝকা করেন। আমার দোষ থাকলেও করেন, দোষ না থাকলেও করেন।

—-আমার বুকের উপর তুমি শুয়েছিলে। তাহলে দোষটা তোমার নয়তো কার?

—-আমি যেচে গিয়েছিলাম? রাতের বেলা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিলেন সে খেয়াল আছে আপনার? আমি আপনাকে খাইয়ে দিলাম, মেডিসিন দিলাম, জলপট্টি দিয়ে দিলাম, সেগুলোর জন্য একটা ধন্যবাদও কী দিয়েছেন?

—-এইতো তোমার কথার ঠিক নেই। বললেই তো যে আমি জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছিলাম। তাহলে তুমি আমার জন্য কী করেছো না করেছো সেটা আমি বুঝবো কী করে? বাই দ্যা ওয়ে, খোঁটা দিচ্ছো নাকী সেবা করে?

—-আপনি একজন জঘন্য মানুষ। আপনার সাথে কথা বলাটাই ভুল। আব্বু আসছে এই সপ্তাহে। আসলেই বলবো যে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্য কোনো ফ্ল্যাটে শিফট হতে।

—-দেখা যাক কী হয়! হয়তো এর উল্টোটাও হতে পারে।

—-মানে?

শোয়া থেকে উঠে বসলো সাদমান। বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিল থেকে চশমা নিয়ে পরলো। এরপর বিছানা থেকে উঠে হাতে তোয়ালে নিয়ে ইশরাতকে বললো

—-আম্মু ঘুম থেকে উঠে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই। দ্রুত এখান থেকে যাও। আম্মুর পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবে। এখন এখানে আর ঘুমোনোর প্রয়োজন নেই। আধঘন্টার মতো ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকবে। এরপর উঠে বাসায় চলে যাবে। বাসায় গিয়ে ঘন্টা তিন-চার ঘুমিয়ে নিয়ে পড়তে বসবে।

—-তার মানে গতকাল রাতে সজ্ঞানে শেষের কথাগুলো বলেছিলেন?

—-মানে?

—-পরীক্ষা সামনে তাই পড়াশোনা করতে বলেছিলেন বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে। এখনোও একই কথা বলছেন। আর এরপরই তো টেনে নিয়ে জোর করে এখানে ঘুমোতে বললেন। আর এখন দোষ সরাসরি আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন? আপনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।

সাদমানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ইশরাত। কপালে মৃদু চাপড় মেরে সাদমান চোখেমুখে একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুললো। এতো ভাব বজায় রেখে এখন শেষ মুহুর্তে এসে এভাবে বোল্ড আউট হতে হলো? কে বলেছিলো বারেবারে বিজ্ঞের মতো পড়াশোনা নিয়ে উপদেশ দিতে? ধুর! সকাল সকাল মুডটাই গেল সাদমানের নষ্ট হয়ে।

(৪৪)

বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ নিজের বাসায় আসলো ইশরাত। ইশরাতকে দেখে মুখ বাঁকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন রেণু আক্তার। সেদিকে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে সে। দরজা বন্ধ করে রুমে গিয়ে দেখলো মিশরাত ঘুমোচ্ছে এখনো। সাধারণত এতো সময় ধরে অফিস থাকলে মিশরাত কখনোই ঘুমোয় না। সাদমান তো অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে দেখে আসলো সে। আর মিশরাত এখনো ঘুম থেকেই উঠলো না?

মিশরাতের কপালে হাত দিয়ে ইশরাত দেখলো জ্বর নেই। বুঝতে পারলো না কিছু, শরীর খারাপ নাকী? এতো সময় অবধি ঘুমিয়ে আছে অথচ রেণু আক্তার ডাকলো না তাকে?

রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো ইশরাত। রেণু আক্তার কাজ করে যাচ্ছেন।

—-আম্মু, আপু ঘুমাচ্ছে এখনো? কেন?

রেণু আক্তার নিঃশব্দে কাজ করতে লাগলেন। কিছুই বললেন না ইশরাতের প্রশ্নের জবাবে।

—-ও আম্মু, কিছু তো বলো? আমার সাথে আর কতো রাগ করে থাকবে? গতকাল সারারাত রাগ করে থাকার পরেও রাগ কী একটুও কমেনি তোমার? এবার তো একটু কথা বলো? মারবে আমায়, মারো। তবুও কিছু তো বলো?

—-কী আর বলবো আমি? চলেই তো গিয়েছিলি ধেই ধেই করে নেচে গতকাল রাতে।

—-আবার সেই গতকাল নিয়েই তুমি পড়লে। বললাম তো স্যরি। আর কখনো হবে না। কোনোদিনও না।
কিন্তু অন্ততপক্ষে আপুর কথাটা তো বলো? এখনো ঘুমোচ্ছে যে? অফিসে যাবে না আজ?

—-সবে বাজে সাতটা। এখন ডেকে কী করবো?

—-আম্মু, সাতটা নয় প্রায় সাড়ে আটটা বাজে।

—-দেখ তাকিয়ে ঘড়িতে।

ইশরাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সেখানে আসলেই সাতটা বেজে আছে। বুঝতে পারলো ঘড়ির ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

—-আম্মু, যদি নাস্তা বানানো হয়ে থাকে তাহলে টেবিলে বেড়ে রাখো। ঘড়িতে সমস্যা হয়েছে। এখন সাড়ে আটটা বাজে। আপুকে ডেকে দিচ্ছি। সাদমান হাসানকে দেখলাম অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। এইমাত্র আপুকে ফোন দিলো বলে!

ইশরাত চলে গেলে রেণু আক্তার দৌড়াদৌড়ি করে এই রুম ওই রুমের ঘড়ি চেক করছেন। চেক করে বুঝলেন, বাকী দু’টো রুমের দু’টো ঘড়িতে আসলেই সাড়ে আটটা বাজে। আর উনি যেই ঘড়ি ধরে কাজ করছেন সেটাতেই শুধু সমস্যাটা হতে হলো। হায়রে কপাল!

(৪৫)

খুব তাড়াহুড়ো করে আজকে অফিসের জন্য খেয়ে রেডি হয়ে বেরিয়েছে মিশরাত। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে একটা ব্রেড জেলি দিয়ে মেখে কোনোমতে মুখে ঢুকিয়ে দৌড়। এখন গাড়িতে বসে কিছুটা হাঁপাচ্ছে সে। সাদমান গাড়ি ছেড়েছে কিছুক্ষণ আগেই। এসি অফ করে জানালা খুলে দিয়েছে। ঠান্ডা স্নিগ্ধ বাতাস এসে মিশরাতকে অনেকটা ঠান্ডা করে দিয়েছে।

—-কী হলো মিশরাত? আজ এতো লেইট হলো যে?

—-গতকাল রাতে ঘুমোতে দেরী হয়েছিলো। আজকে এলার্ম বাজছিলো। কিন্তু আমি ঘুমের ঘোরে বন্ধ করে দিয়েছি কখন নিজেও বলতে পারবো না। একটা ঘড়ি গিয়েছিলো নষ্ট হয়ে। আর আম্মু সেটা দেখেই ধীরেসুস্থে কাজ করছিলো। আমাকেও ডাকেনি। ভাগ্যিস ইশু গিয়েছিলো বাসায়। আমাকে ডেকে দিয়েছে সে-ই।

—-গতকাল রাতে ঘুমাতে দেরী হয়েছিলো কেন? কোনো সমস্যা? আমাকে বলতে পারো।

—-না, তেমন কিছু না। আসলে এটা সেটা চিন্তা করছিলাম তো, তাই রাত অনেকটা পেরিয়ে গিয়েছিলো। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি।

—-বাব্বাহ্! কী এতো ভাবছিলে যে রাতটাই পার করে দিলে?

—-আরাভ ইসলাম ফোন দিয়েছিলো।

—-আরাভ কে আবার?

—-আরিয়ানের বন্ধু।

গাড়িতে ব্রেক কষলো সাদমান। চোখ কুঁচকে তাকালো মিশরাতের দিকে।

—-আরিয়ানের বন্ধু তোমাকে ফোন কেন দিলো? এখন নিজে না পেরে বন্ধুকে ধরলো তোমাকে বিরক্ত করার জন্য?

—-সেটা আমিও বলেছি ওই ছেলেকে। কিন্তু সে বললো…

—-সে কী বললো না বললো সেটা পুরোপুরি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। এসব ভেবেও লাভ নেই। আরিয়ানের বন্ধু আরিয়ানের হয়েই কথা বলবে সেটা তো তোমার অবুঝ বোন ইশরাতও বোঝে। আর তুমি বোঝো না?

—-সব কথায় ঘুরেফিরে ইশু চলেই আসে, তাই না সাদমান?

অপর পাশে ফিরে মুখ চেপে হাসছে মিশরাত।

—-মজা নিচ্ছো?

—-হ্যাঁ? না, না। মজা কখন নিলাম? যা সত্যি তাই বললাম আর কী। বান্দা তুমি মুখে শুধু না না-ই করে গেলে। দিলে তোমার কী চলে সেটা তো আমি এখন বুঝি। আমার ভাবতেই দারুণ লাগছে জানো? আমার বোনের সাথে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের জুটি। ওয়াও! অসাধারণ!

আমতা আমতা করে সাদমান বললো

—-একটু বেশিই বোঝো তুমি। এসব কিছুই না। শোনো, মেইন পয়েন্ট থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। আসল কথা হলো তুমি ওই আরাভ না কী যেন, তার কথা ধরতে যেও না। এসব ইগনোর করে যাও।

—-সেটা আমিও করছিলাম। কিন্তু আরাভ বললো অতীতের কিছু সত্য নাকী উন্মোচন করতে চায় আমার কাছে। এমনকী এটাও বলেছে, সেদিন নাকী মোনাকে আরিয়ান জানে মেরে ফেলতে নিচ্ছিলো। ওই যে আমরা চলে এসেছিলাম রেস্টুরেন্ট থেকে, তার পর।

—-ওই ছেলেও বললো আর তুমিও বিশ্বাস করে নিলে? আরে এগুলো আরিয়ান হকের নিত্যনতুন ধান্দা তোমাকে ফাঁদে ফেলার। যেই মোনার জন্য তোমাকে রিজেক্ট করেছিলো, যেই মোনার সাথেই এখনো সম্পর্ক রেখে চলেছে, যেই মোনার সাথেই সেদিন তাকে ওয়াশরুমে এতোটা কাছাকাছি অবস্থায় দেখলে সেই মোনাকে সে জানে মেরে ফেলতে যাবে? পাগলেও তো এসব গাঁজাখুরী কথা বিশ্বাস করবে না। তুমি জানো গতকাল রাতে কী হয়েছিলো?

—-হ্যাঁ, তাই তো! সেদিনের কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আরিয়ান তোমার ফোন দিয়ে কথা বলেছিলো। তোমার ফোন তার কাছে কীভাবে গেল?

—-তাহলে শোনো। প্রথম থেকে বলছি তোমাকে সবকিছু।

(৪৬)

—-হ্যালো, মিশরাত? আপনি আমার ফোন রিসিভ করেন না কেন?

—-ওহ, তাহলে অন্য আরেক নাম্বার থেকে ফোন করে এখন আপনিও বিরক্ত করা শুরু করেছেন আমাকে?

—-আশ্চর্য! বিরক্ত কখন করলাম? আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেননি। তাই আপনাকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছি। আর আমার ফোন নাম্বার থেকে ফোন করলে তো রিসিভ করছেন না। তো অন্য নাম্বার থেকে ফোন না দেওয়া ছাড়া আমি আর কী করতাম?

—-আর কখনো কোনো নাম্বার থেকেই আমাকে ফোন করবেন না, বুঝেছেন?

—-এই, এই দাঁড়ান। ফোন রাখবেন না। আপনি বলেছিলেন না এই সপ্তাহে আমার সাথে দেখা করবেন? আমি বলেছিলাম না আপনাকে আরিয়ানের ব্যাপারে অনেক কিছু বলার আছে আমার? আপনি তো রাজিও হয়েছিলেন। তাহলে এখন এমন করছেন কেন?

—-আপনার বন্ধুর মানসিকতা আগেও নিচ ছিলো, এখনো নিচ ই রয়ে গিয়েছে। লজ্জা থাকা উচিত আপনার বন্ধুর। সাদমানের সাথে আমি চলি দেখে এখন তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে চলে এসেছে আপনার বন্ধু। সমস্যা কী উনার?

—-আপনি বিষয়টাকে এতো বড় করে দেখছেন কেন? তিলকে তাল করছেন। যে ছেলেটা এখন দিনরাত এক করে আপনার পেছনে পড়ে আছে আপনাকে পাওয়ার আশায়, সে যদি দেখে অন্য একটা ছেলের সাথে সারাক্ষণ পারলে আপনি সঙ্গ দিচ্ছেন, তাহলে তার রাগ হওয়া কী স্বাভাবিক নয়? তার মনে প্রশ্ন আসা কী অস্বাভাবিক?

—-উনি জোর করে আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করছেন। আর আপনি সেটাকে সমর্থন করছেন? আসলেই সাদমান একেবারে ঠিক বলেছে। আরিয়ানের বন্ধু তো আরিয়ানের টান টানবে এটাই স্বাভাবিক। আমিও পাগলের মতো আপনার কথায় বিশ্বাস করে দেখা করার জন্য রাজি হয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যাই নি ভালোই করেছি।

—-আরিয়ান কখনো বিনাকারণে আপনার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলো অতীতে? এমনকি কারণ থাকা সত্ত্বেও করেছিলো?

—-মানে?

—-হ্যাঁ নাকী না শুধু সেই জবাবটুকু দেবেন। আপনার রাগ করা স্বাভাবিক সেটা আমিও মানছি। কিন্তু আপনি খুব বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন ব্যাপারটা নিয়ে। অথচ ঘটনার আগে-পরে আপনি কিছুই জানেন না কী হয়েছিলো। এমনকি আমি জানানোর কথা বলার পরেও জানতে চাইছেন না। তাই আপনার সাথে এখন আমার অনেক বোঝাপড়া করতে হবে। সততার সাথে আমার করা প্রশ্নের উত্তর দেবেন। তো বলুন, আরিয়ান আপনাকে যেদিন অপমান করেছিলো সেদিন তো করেছিলোই। আমিও মানছি। কিন্তু এর আগে কখনো এমন কোনো ব্যবহার করেছিলো যার দরুন আপনার বা আপনার পরিবারের সম্মানহানি হয়? এখন তো বলতে গেলে বলতেই হয়, মোনা মেয়ে হিসেবে ভালো না খারাপ সেটা তখন আরিয়ান কেন, কেউই বোঝেনি। তার পোষাক হোক বা অন্যকিছু নিয়ে, আপনি অনুমান করেছিলেন যে মেয়েটা ভালো না। কিন্তু একটাবার ভেবে দেখুন তো, একটাবার আরিয়ানের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভাবুন। আপনি যাকে পছন্দ করেন, তার নামে আপনাকে কেউ আজেবাজে কথা বললে আপনার কেমন লাগবে? আপনার পেছনে জোর করে ঘুরঘুর করলে আপনার কেমন লাগবে? রাগ হবে না আপনার? আরিয়ান কী শুরুতেই আপনাকে কড়া ভাষায় কিছু বলেছিলো এটা নিয়ে? বলেনি। যথেষ্ট সংযত ভাষায় শান্তস্বরে বুঝিয়েছে। সেটা আপনার বাবার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক। কিন্তু আপনি করলেন কী? ক্রমাগত তাকে বিরক্ত করতে লাগলেন, তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকতে লাগলেন। সবকিছু আবেগ দিয়ে বিচার না করে বিবেক দিয়ে করুন। ঠিক একই কাজ যদি অন্য একটা ছেলে আপনার সাথে করতো, তাহলে লাগতো না আপনার খারাপ? হতো না মেজাজ গরম? একজনের পছন্দের উপর আপনি জোর করে নিজের পছন্দ চাপিয়ে দিতে চাইছিলেন। নিজের দোষ দেখেন না কেন আপনি?

আপনি শুধু কয়েকদিন আরিয়ানের পেছনে ঘুরে তাকে না পেয়েই একসময় ক্লান্ত হয়ে তার সাথে কথা বলে বন্ধ করে দিয়েছিলেন শুনছি। তাহলে এই ছেলেটা নিজের সবকিছু ছেড়ে আপনার জন্য এসে এখানে পড়ে আছে। অথচ আপনার সাড়া না পেয়ে কথা বন্ধ করা তো দূর, জ্বরের ঘোরে পর্যন্ত আপনাকে চায়। আপনার জন্য জায়গায় জায়গায় অপমানিত হয়ে আসে। সেদিন আপনার ছোট বোন তার বান্ধবীর পরিবারের সামনে আরিয়ানকে অপমান করেছে। জানেন আপনি? জানবেন কেন, আপনি তো শুধু নিজের দিকটাই বিচার করেন।

আরিয়ানের ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার ধারণা আছে? আরিয়ানের যোগ্যতা সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই অবগত? নিজেও দেখেছেন কতো কতো ছেলে সেসময় এসে আরিয়ানের ইন্টারভিউ নিতো। কীভাবে আরিয়ানের মতো হতে পারবে সেই জন্য। আর ওই একই আরিয়ান এখন শুধু আপনাকে পাওয়ার জন্য এদিক সেদিক অপমানিত হয়ে আসছে। কিছু বললেই বলে যে মিশুকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দে, আমি আবারও আগের মতো হয়ে যাবো প্রমিস।

ওই যে একটু আগে বললাম? আরিয়ানের ক্ষমতার কথা? জানেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে যদি আরিয়ান আপনাকে জোর করে আপনার বাসা থেকে তুলেও নিয়ে যায়, তাহলে শুধু আপনি কেন, আপনার বন্ধু সাদমান সমেত পুরো পাড়া এক করলেও তার সামনে টিকতে পারবে না? সে কী এমন কিছু করছে? কিছুই করছে না। বরং ভিখারির মতো আপনাকে আপনার কাছে ভিক্ষে চাইছে। অথচ এতোটুকু দয়াও আপনার মনে হচ্ছে না।

ওই ছেলে আমি শতবার বললেও আপনার পিছু এতো সহজে ছাড়বে না আমি জানি। এই ক্ষেত্রে যে নিজের বাবা মায়ের কথাই শুনছে না, সে আমার কথা কী শুনবে! তবে এতোটুকু বলে রাখি, আমার সামনে সে যতোবারই আপনাকে পাওয়ার, আপনার কাছে যাওয়ার কথা তুলবে, ততোবারই তার দুই গালে চারটা থাপ্পড় দিবো আমি। কারণ ওই মূর্খটার এটাই শাস্তি হওয়া উচিত।

অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেললেন মিশরাত, অতিরিক্ত। আমি আরিয়ান না যে অপমানিত হওয়ার পরেও আপনার সাথে যেচে কথা বলতে যাবো। এতো বেহায়া হইনি এখনো আমি। আমি শুধু আরিয়ানের কথা ভেবেই একটা কথা বলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম আপনার সাথে। কারণ জানেন? কিছুই তো জানেন না আপনি। আমিই বলছি। আপনার জন্য ছেলেটার হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেতে চলেছে। বলেছিলাম না সে মোনাকে মেরে ফেলতে নিয়েছিলো? অবশ্য আপনি হয়তো সেই কথাও বিশ্বাস করেননি। তবে কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে আবারও। মোনার মতোই ঠিক একইভাবে সে সাদমানেরও অনেক বড় ক্ষতি করতে চাইছিলো। কখনো দেখেছেন বা শুনেছেন আরিয়ানকে এতোটা আগ্রাসী হতে? সে হয়েছে, শুধু আপনার জন্য। কারণ তার মতে, আপনার আর তার মাঝে যে আসবে সে তার পথের কাঁটা। আর সেই পথের কাঁটাকে সে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে দু’বার ভাববে না।

যাই হোক, আপনি কথা বলবেন না তো? ঠিক আছে, দরকার নেই বলার। আপনি আপনার ইগো নিয়ে বসে থাকুন। তবে একটা কথা জানিয়ে ফোন রাখছি, আরিয়ান কখনো মারা গেলেও আপনাকে জানাবো না আমি। মনে রাখবেন!

ওপাশ থেকে ফোন কেটে গেল। আরাভ ফোন কেটে দিয়েছে। এখনো ফোন কানে লাগিয়ে রেখেছে মিশরাত। মুখে তার চিন্তা এবং ঈষৎ ভীতির ছাপ স্পষ্ট। সে কী আসলেই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললো? একাধারে যেভাবে আরাভ কথা বলেই যাচ্ছিলো, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো সে ভীষণ রেগে গিয়েছে মিশরাতের ব্যবহারে। পুরো কথা শুনে মিশরাত শুধু ভেবেছে। কিন্তু শেষের কথাটা শুনেই শরীরটা কী একটু কেঁপে উঠলো তার? আরিয়ানের মৃত্যু? কথাটা শুনেই এতো ভয় কেন পেলো সে? এতোটা নাড়া দিলো কেন ভেতরটা হুট করে? যতোটা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যুর আশঙ্কা মনে আসলে হয়?

চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here