অন্তরালের কথা পর্ব ২৮

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২৮

.
.
তিহান আর কোনো কথা না বলে দরজার পাশ দিয়ে চলে যায়। অপরদিকে তানহাও তিহানের যাওয়ার পথে পাত্তা না দিয়ে চলে যায় নিজের লাগেজ গোছাতে। কিন্তু, তাদের দুজনের কেউই জানে না এসকল কথা তারা ব্যতীত অন্য একজন ব্যাক্তিও স্পষ্ট শুনেছে দরজার আড়াল থেকে। হ্যাঁ, সেই ব্যাক্তিটি আর অন্যকেউ নয়, সেই ব্যাক্তিটি হচ্ছে… অতল। তিহান ঘরে আসার পরপরই বাড়িতে চলে আসে অতল।মায়ের হাতে গরম গরম ভাজাপোড়ার প্যাকেট দিয়ে দ্রুত ডাকতে আসে তানহাকে। নাহলে যে ভাজাপোড়া ঠান্ডা হয়ে নেতিয়ে যাবে। আর এসব ভাজাপোড়া টাইপের খাবার নেতিয়ে গেলে এক্কেবারে বাজে লাগে খেতে। তাই এতো দ্রুত আসা কিন্তু এসেই বাহির থেকে শুনতে পায় তিহান ও তানহার কথা। প্রথমে অতল সেরকম পাত্তা দেয়নি সেসব কথায়। কেননা একজন দেবর ও ভাবির মাঝে অনেক কথাই হতে পারে। তাই অতল মনে কোনো দ্বিধা ছাড়াই ঘরের চৌকাঠে পা রাখতে নেয় কিন্তু সেই পা আর রাখা হয় না তিহানের বলা কথাগুলো স্পষ্ট কানে এসে পৌঁছতেই। পিছিয়ে যেতে থাকে দরজার চৌকাঠ থেকে আর স্থান পায় দরজার আড়ালে। মেঝেতে দৃষ্টি রেখে চোখের জল ফেলে শুনতে লাগে তিহান ও তানহার মাঝের সকল কথা। সেই সাথে অনুভব করতে লাগে গত তিন বছর থেকে আজ অবধি তানহার জীবনের প্রতিটি ব্যাথাকে। শুধু যে তানহার ব্যাথা তা তো নয় সাথে যে রয়েছে তিহানের না পাওয়া ভালোবাসার আর্তনাদ। অতলের চোখ ঝাপসা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অনেক পাজেলের সমাধানও সে পাচ্ছে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে মুহূর্তের মাঝেই যেন চোখের সামনে সব পরিষ্কার হয়ে গেল অতলের। বিয়ের বিদায়ের থেকে শুরু করে তিহানের সুইসাইড করা, প্রতিটি ব্যাপারে তানহার থতমত খাওয়া, তিহান ও তানহার মাঝে কথা না হওয়া, তাদের প্রথম মিলনে মাঝ রাতে ভেজা ফ্লোরে তানহার রাত কাটানো, গত তিন বছরে এমুখো না হওয়া এবং আজ সকালে তিহানের প্রশ্নের তানহার দেয়া প্রতিউত্তর সবই যেন অতলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। একটি সূত্র বের করতেই যেন আপনা আপনি বাকি সব সূত্রের ফলাফল অতলের নিকট ধরা দিল। তাতে অতলের পক্ষে সমাধান বের করতে বেশি একটা সময় লাগল না। তিহান বেরিয়ে যেতেই অতল তিহানের নিঃসঙ্গ যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল,
” তোমার সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেব তানহা। সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেব। ” তারপর অতল নিজেকে সামলে চোখের জল মুছে পা রাখল দরজার চৌকাঠে। আর ভরা কন্ঠে মিথ্যে হাসির চেষ্টা করে বলল,
” বউ! ”
দরজার কাছ থেকে অতলের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে তানহা যেন নিজের প্রাণ ফিরে পেল। চোখে মুখে হাসি ঝলক ফুটিয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে। অতলকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল,
” কোথায় গিয়েছিলে তুমি ? জানো না, তোমায় ছাড়া বেশিক্ষণ একা থাকতে ভালো লাগে না আমার ? ”
” জানি তো বউ। তাইতো ছুটে এসেছি। ”
” তাই তো তোমায় এতো ভালোবাসি। ”
” হুম, তবে..এখন আরেকটু ভালোবাসতে পারবে? ”
” এখন? কি যে বলো না! এই ভোর সন্ধ্যেবেলা দরজা লাগানো দেখলে সবাই কি ভাববে? ”
“আরে পাগলী আমি কি সেই ভালোবাসার কথা বলেছি নাকি! ”
” তাহলে? ”
” কিছুই বুঝে না দেখছি আমার বউটা! ”
” না বুঝিয়ে বললে বুঝবো কি করে বলো তো? ”
” হুম, তাও কথা! এসো, আমার কাছে এসো। ”
তানহাকে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অতল। আর তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” এখন বুঝেছ কোন ভালোবাসার কথা বলেছি। ”
” উহুম, আরও বুঝতে চাই। ”
” সবসময় সবকিছু যে বুঝতে নেই। তাই আজ না’হয় এতটুকুই বুঝো! আর বেঁচে থাকলে অন্য কোনো একসময় বুঝিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ। কেমন? ”
অতলের বুক থেকে মাথা তুলে ভ্রু দুটো কুচকে তানহা বলল,
” এভাবে বলছ কেন তুমি? ”
তানহার কপালে আসা উড়ন্ত চুলগুলো সরাতে সরাতে অতল মুচকি হেসে বলল,
” কি বলেছি গো? ”
” এই যে, বেঁচে থাকলে… বললে যে! ”
” তো কি হয়েছে? এটাই যে আমাদের ইসলামের নিয়ম। প্রতি কথা ইনশাআল্লাহ বলা, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর কথা সরণ করা। তাই না? ”
” হুম। কিন্তু…..”
” কোনো কিন্তু না, একটুখানি আদর চেয়েছিলাম তার বদলে কতো কথা শুরু করে দিলে। এবার চুপটি করে আমার বুকের সাথে মিশে থাকতো। আর ভালোবাসতে দাও আমায়। ”
তানহা আর একটি কথাও বলেনি। চুপটি করে অতলের বুকে নিজের মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আজ তানহার মনে কোনো শান্তি নেই। অতলে বলা কথাটি শোনার পর থেকে কেন যেন তানহার মন কু-ডাক দিচ্ছে। খুব অস্থির অস্থির লাগছে তার। তারপরও অতলকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মনের দুশ্চিন্তা মনের ভেতর লুকিয়ে অতলকে ঝাপটে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
এদিকে অতল তানহাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে নিজেকে ভাসাচ্ছে। তবে চোখের জলের এক ফোঁটাও গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে না তানহার উপর। নোনা জলের ছিটে পেলে যে তানহা বুঝে যাবে অতলের চোখের ভাষা। তাইতো চোখের জল গালে পড়তেই হাত দিয়ে মুছে ফেলে মুহূর্তের মাঝে। এভাবে ঠিক কতবার মুছেছে অতলের হয়তো জানা নেই। একপর্যায়ে নিজেকে সামলে নিজের বাঁধ না মানা চোখের জলকে সামলে তানহাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে হাসি মুখে অতল বলল,
” চলো বউ, মা যে বসে আছে আমাদের পথ চেয়ে। ”
” কেন? ”
” বারে..ভুলে গেলে! এই বৃষ্টির মাঝে তোমার এই পাগল জামাইটা যে তোমার জন্য আলুর চপ, বেগুনি আনতে গিয়েছিল। ”
” ও হ্যাঁ, সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম গো। আসলে তোমায় এতো কাছে পেয়েছি তো তাই কিছুই মনে নেই। ”
” তাই বুঝি? ”
” হুম, তবে মন ভরে নিই। ”
” এতক্ষণ মিশে থাকাতেও মন ভরেনি? ”
” উ..হু। ”
” তোমার মতিগতি তো বেশি ভালো ঠেকছে না। আজকেই বুঝি সারাজীবনের সব ভালোবাসা পুষিয়ে নেবে? ”
তানহা প্রায় রেগে গেল অতলের কথা শুনে আর গম্ভীর গলায় বলল,
” এই আজ তোমার কি হয়েছে বলোতো? এসব কি বলছ বারবার? ”
” সরি আর বলব না বউ তাও রাগ করো না প্লিজ। ”
” তুমি জানো আমি এসব ধরনের কথা পছন্দ করি না তারপরও কেন….”
” বললাম তো সরি। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। ”

” উম্মম্ম…..দিতে পারি তবে একটা শর্ত আছে। ”
” কী শর্ত? ”
তানহা অতলের সামনে নিজের ঠোঁট নিতেই অতল বুঝে যায় তানহার শর্তটি কী। তাইতো দেরি না করে নিজের ঠোঁট জোড়া ডুবিয়ে দেয় তানহার ঠোঁটের জোড়ার মাঝে।
এভাবে প্রায় মিনিট পাঁচেক থাকার পর অতল তানহাকে ছেড়ে তানহার দু’গালে আলতো করে নিজের দু’হাত দিয়ে ছুঁয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে বলল,
” এবার চলো বউ। অনেকক্ষণ হয়েছে মা অপেক্ষা করছে। ”
” হুম চলো।
অতল তানহার হাত ধরে যেতে লাগল ড্রয়িং রুমের দিকে। তবে যে শুধু হেঁটে চলছে তা নয়, হাঁটার ফাঁকে যে প্রাণ ভরে দেখছে অতলের কলিজাকে অর্থাৎ তানহাকে। দেখতে দেখতে কখন যে অতল ড্রয়িং রুমে চলে গিয়েছে বুঝতে পারেনি। পাশ থেকে তানহার গলা শুনতে পেয়েই তার হুশ হলো। আর বলল,
” কিছু বলছিলে? ”
” আজ্ঞে হ্যাঁ, ড্রয়িং রুমে যে চলে এসেছি দেখতে পাওনি? ”
” কেন? ”
” আবার বলছ কেন, আরে তুমি যে আমার হাত ধরে রেখেছ বাবা-মা দেখলে কি ভাববে ? ”
” কি আবার ভাববে? নিজের বিয়ে করা বউয়ের হাত ধরেছি এটাই ভাববে। ”
” ইশ…লজ্জা লাগছে। ”
” কিসের লজ্জা পাগলী? নিজের বরের হাত ধরে হাঁটছ অন্যকারো না। ”
” হুম। ”
” নাও এবার চলো। ”
কথা না বাড়িয়ে অতলের হাত ধরে চলে গেল তানহা ড্রয়িং রুমে। তানহার বেশ লজ্জা লাগছিল তারপরও অতলের কথা তো সে ফেলতে পারবে না তাই এভাবে চলে আসে। তবে এখন সবার মিটমিট হাসি দেখে তানহার ইচ্ছে করছে পিঁপড়ের মতো কোন চিপায় গিয়ে লুকিয়ে পড়তে। কিন্তু এটা যে সম্ভব না। তাই ড্রয়িং রুমে যেতেই অতলের হাত দ্রুত ছেড়ে চলে যায় শাশুড়ি মায়ের কাছে হাতের কাজগুলো করে দিতে ।
সবাই একসাথে বসে গল্প করছে আর অতলের আনা আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু খাচ্ছে। অনেকদিন পর আজ ফুল ফ্যামিলি এক হয়েছে। এক অন্যরকম আড্ডায় মেতে উঠেছে সবাই। অবশ্য এদের মাঝে তিহান ক্ষানিকটা কম কথা বলছে তবে বেশি একটাও কম না। এর মাঝে অতলের একটি ফোন এলো। অতল ফোনটি কানে দিয়ে হ্যালো বলতে বলতে বাহিরে চলে গেল। মিনিট দুয়েক পর ড্রয়িং রুমে এসে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
” তোমরা সবাই গল্প করো আমি আধা ঘন্টার মাঝে আসছি। ”
অতলের কথায় সবাই শায় দিলেও তানহা বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। আর বলল,
” এই বৃষ্টির মাঝে কোথায় যাবে তুমি? কোত্থাও যাবার প্রয়োজন নেই। দরকার পরলে কাল সকালে যেও কিন্তু এখন কোনোমতেই আমি তোমাকে যেতে দিব না। ”
অতল তানহার হাত ধরে কিছুটা সাইডে এনে বলল,
” লক্ষী সোনা বউ এরকম জেদ করো না। আমাকে যে যেতেই হবে বিষয়টি খুব ইমারজেন্সি। না করো না প্লিজ। ”
” না, তুমি আজ যেতে পারবে না। আমি আজ তোমায় যেতে দিব না। তুমি কাল যেও কিন্তু আজ না। ”
” প্লিজ বউ না করো না,অনুমতি দিয়ে দাও তোমার বরটিকে প্লিজ..। ”
” কি করে অনুমতি দিব বলো মনটা যে ভীষণ কু-ডাকছে। ”
” আরে পাগলী এসব কিচ্ছু না। আল্লাহ তোমার বরকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখবে ইনশাআল্লাহ তুমি দেখো। ”
” হুম ইনশাআল্লাহ। ”
” তাহলে এবার যাই? ”
” যাই না বলো আসি। ”
” হুম গো আসছি। ”
” দ্রুত চলে এসো আম কিন্তু না খেয়ে বসে থাকব। ”
” আচ্ছা বউ আসছি। ”
অতল চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেও পারলো না যেতে। ঘুরে তানহার দিকে তাকিয়ে তানহাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তারপর মুখ ফিরিয়ে সোজা গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
.
রাত ৯ টা বাজে। তানহা মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই নিয়ে ২৭ টা কল দিয়েছে অতলকে। কিন্তু অতলের কোনো পাত্তা নেই। না ফোন ধরছে, না ফোন নিজে থেকে দিয়েছে। তানহার এক অজানা ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে । কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারছে না। তাই ঘরের একপাশ থেকে আরেকপাশ রাউন্ড দিচ্ছে বারবার। এমন সময় এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে তানহার মোবাইলে। তানহার হাত পা যেন ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসে অচেনা নাম্বার দেখে। কাঁপা হাতে ফোনটি রিসিভ করে কানে দিয়ে অস্থির গলায় বলল,
” হ্য…হ্যালো। ”
তানহার হ্যালো বলার পর ফোনের অপর পাশের মানুষটির কথা শুনে তানহা থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাত ফসকে হাতে থাকা ফোনটি মেঝেতে পড়ে ৩ ভাগ হয়ে যায়। আর মোবাইল পড়ে যাওয়ার আওয়াজটি শুনে তানহার ধ্যান ভেঙে গেল। আর নিচে তাকিয়ে ধপাস করে মেঝেতে বসে এক চিৎকার দিয়ে বলল,
“আল্লাহ……… তুমি কি করে পারলে আমাকে এভাবে নিঃস্ব করতে? ”
ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছিল মা ও বাবা। হুট করে তানহার চিৎকার শুনে দু’জনই ঘাবড়ে যায়। আর ছুটে আসে অতল ও তানহার রুমে। শুধু যে তারা দু’জন এসেছে তা নয়, তাদের সাথে এসেছে তিহান নিজেও। তানহাকে মেঝেতে বসে পাগলের মতো চিৎকার করতে দেখে সবারই হুশ হারাবার উপক্রম। তানহার কাছে বসে দু’কাঁধে হাত রেখে মরিয়ম বেগম আতংকিত কন্ঠে বললেন,
” তানহা কি হয়েছে? মেঝেতে বসে এভাবে কাঁদছ কেন? আর অতলের সাথে কোনো কথা হয়েছে? ”
তানহা এতটাই কান্না করছে মুখ দিয়ে বেরোনো একটি কথাও কেউ বুঝতে পারছে না। কান্নার বিকট শব্দে সব কথাই যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে।
এদিকে মরিয়ম বেগম তানহার এই আধো আধো কথা শুনে চোখ মুখ বড় করে তানহার কাঁধে ঝাকুনি দিয়ে বললেন,
.
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here